Bengali Science fiction Story- Amriter Mrittyu by Aritra Das- Suspense thriller action-adventure story
অমৃতের মৃত্যু
কাহিনি: অরিত্র দাস
©অরিত্র দাস
[👉তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবী। একই সাথে বিশ্বযুদ্ধ ও একটি মারণ ভাইরাসের দাপট- পৃথিবীর জনসংখ্যা নেমে এসেছে দশ শতাংশেরও নীচে! একটিই মাত্র ক্ষীণ সুতোয় ঝুলছে বিশ্বের ভাগ্য, এবং তার প্রান্তদুটি ধরা একজনেরই হাতে। তিনি কি পারবেন- ক্ষুধার্ত ‘অ-মৃত’র দল ও সরকার-বিরোধী ‘নেকড়ে’ গোষ্ঠীর কড়া নজর পেরিয়ে অভীষ্ট গন্তব্যে পৌঁছতে, মানবজাতির ভবিষ্যতকে বর্ধিত করতে? জানতে হলে অবশ্যই পুরোটা পড়ুন।👈]
বুড়ো শিয়ালটি অবশেষে বাধ্য হল একদিন বেরিয়ে আসতে রাস্তায়, তার লুকোন আশ্রয় ছেড়ে।
তীব্র ক্ষুধা আর হাড়-কাঁপানো শীতের কাছে সম্পূর্ণ পরাস্ত সে! গত দুদিন ধরে পেটে দানাপানি কিছু পড়ে নি বিশেষ; সীমাহীন ভীতি নিয়ে নিজের লুকোনো আশ্রয়ে পড়ে থেকে শুধু ভয়ে পড়ে কেঁপেছে সে। দুদিন আগে খাবারের সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে আচমকা একদল দোপেয়ের একদম মুখোমুখি পড়ে যায় বুড়ো শিয়ালটি; বিকটদর্শন এই দোপেয়েগুলির আচরণ অদ্ভুত, অন্যান্য দোপেয়েগুলির মত নয় মোটেও। তাছাড়া, এদের গা থেকে কিরকম যেন একটা বাসি মড়া-মড়া গন্ধ ছাড়ে সর্বক্ষণ, যেন এদের গায়ের মাংস পচছে অনেকদিন ধরে! তাকে দেখতে পেয়েই সবকটা দোপেয়ে মিলে যা একটা অদ্ভুত গর্জ্জন করে হাত বাড়িয়ে তেড়ে এল তার দিকে- সেটা মনে পড়লে এখনও হাড়ে-হাড় লেগে ঠকঠকিয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে বুড়ো শিয়ালের দেহ। ঐখানে অবশ্য আর দাঁড়িয়ে থাকে নি সে- প্রাণপণে দৌড়ে নিজের লুকোনোর জায়গায় ফিরে এসে আত্মগোপন করে; এই দুটো দিন টানা নিজের গর্তেই লুকিয়ে ছিল শেয়ালটি! আর আজ সকাল থেকেই সে হাড়ে-হাড়ে টের পাচ্ছে- পৃথিবীতে এই বিকটদর্শন দোপেয়েগুলির থেকেও ভয়ংকর একটি বস্তু আছে- খিদে! এক্ষুণি কিছু দরকার তার মুখে তোলবার জন্য, নাহলে এমনিতেই খিদের চোটে প্রাণ বেরিয়ে যাবে তার! বুড়ো শিয়ালের সন্ধানী, সতর্ক দৃষ্টি ঘুরতে লাগল চতুর্দিকে, বহু-কাঙ্খিত খাবারের সন্ধানে।
ঐ তো, ওখানে কি পড়ে রয়েছে ওটা মাটির ওপর? আরে- একটা দোপেয়ে না? চলতে চলতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল বুড়ো শিয়ালটি; পিছনের দুটি পায়ের ওপর ভর করে বসে তীক্ষ্ন চোখে মৃতদেহটিকে ভালো করে দেখতে লাগল সে। তার স্নায়ু সতর্ক, পেশিগুলি টানটান- বিন্দুমাত্র বিপদের আভাষ পেলেই ছুটে যাওয়ার জন্য তৈরি তার দেহ। কিন্তু কই, নড়াচড়া তো কিছুই দেখা যাচ্ছে না পড়ে থাকা দেহটিতে! সাহস পেয়ে বেশ কিছুটা এগিয়ে এল সে। দোপেয়েটা পড়েই রয়েছে মাটিতে, একদম স্থির হয়ে; কোন প্রাণের স্পন্দন নেই সেখানে। এদিক দিয়ে বাঁচোয়া। তার কপালটা বেশ ভালোই বলতে হবে- ঘর থেকে বেরিয়ে কাছাকাছির মধ্যেই খাবারের সন্ধান পাওয়া গেল। কিন্তু অন্য কোন দোপেয়ে নেই তো ধারেকাছে? উদ্বিগ্ন, সতর্ক চোখে আশেপাশের পেল্লাই, আকাশছোঁওয়া ‘গুহা’গুলোর দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল বুড়ো শিয়াল, এবারে সামনের দুটো থাবার ওপর ভর দিয়ে উবু হয়ে বসে- সত্যিই আর কেউ আশেপাশে আছে কি না সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নিল সে। তারপর একইভাবে বসে ধীরে ধীরে, এক পা দুই পা করে সতর্কভাবে এগিয়ে গেল সে সামনে পড়ে থাকা মৃতদেহটির দিকে। ঢিলছোঁড়া দূরত্বে পৌঁছে সামনের দিকে নাক বাড়িয়ে পড়ে থাকা দেহটির গন্ধ একবার শুঁকে দেখল সে- ব্যাস, আর কোন চিন্তা নেই! বেজায় বাসি মাংসের খোশবু ছড়াচ্ছে দোপেয়েটার গা থেকে, ব্যাটা মরে গিয়েছে অনেকক্ষণ আগে! বাঁধভাঙা আনন্দের প্লাবন ডাকল বুড়ো শিয়ালের মনে, সমস্ত সতর্কতা শিথিল হয়ে গেল পলকে। আর সময় নষ্ট না করে কাজে লেগে পড়ল শিয়ালটি; দেহের বামদিক ঘেঁষে বুকের কাছটা খুবলিয়ে একটুকরো মাংস মুখে তুলে চিবোতে শুরু করে দিল সে, আনন্দে চোখ বুঁজে এল তার। আর ঠিক এই সময়তেই হঠাৎ-
আচমকা মৃতদেহটির একটি হাত এসে চেপে ধরল বুড়ো শিয়ালের ঘাড়; কিছু বুঝে ওঠবার আগেই মৃতদেহটি একঝটকায় উঠে বসে মোক্ষমভাবে কামড়ে ধরল তার গলা! একটা সজোরে মরণ-আর্তনাদ বেরিয়ে এল শিয়ালের গলা থেকে; কামড়ের চোটে কন্ঠনালীটি বেরিয়ে আসবার আগের মুহুর্ত পর্যন্ত চেঁচাতে পারল সে, তারপর নিস্তেজ হয়ে এলিয়ে পড়ে গেল মাটিতে। ঝাপসা চোখে সে প্রথম ঠাহর করল- ‘মৃত’ ভেবে যে দোপেয়েটার মাংস খেতে এসেছিল সে, সেটির চোয়ালে এখন আটকে রয়েছে তার নিজেরই শরীরের মাংস! দৃষ্টি ঘুরতেই এবারে আবছাভাবে তার নজরে এল, আশপাশ থেকে দৌড়ে আসছে আরও কয়েকজন দোপেয়ে। এরপর…চেতনা লুপ্ত হয়ে গেল বুড়ো শিয়ালের; তার চোয়ালে তখনও আটকে তার আততায়ীর শরীরের মাংসের টুকরো!
সদ্যলব্ধ শিয়ালের দেহ খুবলে খুবলে খেতে যখন ব্যস্ত ছিল ‘অ-মৃত’র ছোটখাটো দলটি, তখন একটু পিছন দিক করে, একটা প্রায় ভেঙে আসা বড় বাড়ির তস্য ভাঙাচোরা দেওয়ালের পিছন দিক থেকে তাদের গতিবিধির দিকে সতর্ক নজর রাখছিলেন একজন যুবক। কৃষ্ণকায়, মুখে চাপদাড়ি, বলিষ্ঠ চেহারার যুবকটির চেহারা আর পোশাক পরিস্থিতির সঙ্গে দারুণভাবে মানানসই। যুবকের পরণে একটি ঘন বাদামি-রঙা জ্যাকেট, পিঠে একটি রুক-স্যাক, ডান কাঁধের ওপর দিয়ে উঁকি মাছে একটি তূণীর। তাতে আট-দশটি তীর রাখা, আর হাতে ধরা একটি ধনুক। এতেই শেষ নয়, যুবকের ডানপায়ের উরুর কাছে একটি হোলস্টারে উঁকি দিচ্ছে একটি পিস্তলের বাঁট, বাঁদিকের কোমরের কাছে খাপে ঢোকানো একটি পেল্লাই ভোজালি! তার কাছে এই সকল অস্ত্রের উপস্থিতি দেখে বোঝা যায়- এই যুবকটি শান্তিপ্রিয় হতে পারে, নিরীহ সে কখনও নয়। কিন্তু বিপজ্জনক অস্ত্রগুলিকে নিয়ে এখানে, এরকম একটা বৈসাদৃশ্যমূলক পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে তিনি কি করছেন?
অদূরে মৃত শিয়ালটির দেহ ভক্ষণকারী ‘অ-মৃত’দের দলটিকে ভালো করে দেখে নিল যুবকটির সন্ধানী দুটি চোখ। আশেপাশের ভাঙাচোরা বাড়িগুলির কঙ্কালের দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে তিনি নিশ্চিত হতে চাইলেন- আর কোন ‘অ-মৃত’ কোথাও আত্মগোপন করে আছে কি না। পরিস্থিতি ভালো করে বুঝে নিয়ে যখন তিনি বুঝলেন সব স্বাভাবিক, এইবার আত্মগোপন করে থাকা বাড়ির দেওয়ালের বাইরে বেরিয়ে এলেন তিনি, বাঁহাতে ধনুকটি ধরে। ডানহাতে ততক্ষণে তিনি তূণীর থেকে বের করে নিয়েছেন তিনটি তীর; সেগুলিকে হাতের আঙুলের মধ্যে পরপর ঠিকভাবে সাজিয়ে নিয়ে সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে আশেপাশে শেষবারের মত চোখ বুলিয়ে নিলেন যুবা, তারপর প্রথম তীরটি ধনুকে জুড়ে নিয়ে সতর্ক পদক্ষেপ ফেলে এগিয়ে চললেন ‘অ-মৃত’দের দলটির দিকে।
প্রথম ‘অ-মৃত’টি একটু তফাতে ছিল ভীড় থেকে; শিয়ালটির গলার অংশ নিয়ে ব্যস্ত ছিল সে। কিছু বুঝে ওঠবার আগেই পিছন থেকে একটি তীর এসে বিদ্ধ করল তার মাথা। দ্বিতীয়টিরও একইরকম পরিণতি হল চোখের নিমেষে। তৃতীয় ও চতুর্থ ‘অ-মৃত’ দুটি বোধহয় কিছু একটা টের পেয়েছিল- হয় যুবকটির এগিয়ে আসবার শব্দ, নয়তো তার গা থেকে বেরিয়ে আসা গরম, তাজা রক্তের ভাপ পড়তে পেরেছিল তারা- মোদ্দা কথা, হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়েই তারা পাল্টা ধেয়ে এসেছিল যুবকের দিকে! প্রস্তুত ছিলেন যুবকও; অসামান্য ক্ষিপ্রতায় হাতের শেষ তীরটি তিনি ছুঁড়ে দেন সামনের ‘অ-মৃত’র মাথা লক্ষ্য করে, পলকে মৃত্যু হয় সেটির। কিন্তু শেষেরটির জন্য নতুন করে তীর তূণীর থেকে টেনে বার করবার সময় পান নি তিনি; এত দ্রুততার সঙ্গে কাছিয়ে আসে এই ‘জীবন্ত শবদেহ’টি যে যুবক বাধ্য হন হাতের ধনুক দিয়ে তাকে প্রতিহত করতে। সামনের দিকে টলে পড়ে ‘অ-মৃত’; সামলে নিয়ে দ্বিতীয়বার ঘুরে আঘাত করতে যেতেই একটি ছোট ছুরি তার কন্ঠনালী বিদীর্ণ করে অনেক গভীরে ঢুকে পড়ে। একটি ক্ষীণ, জান্তব আওয়াজ বের হয় তার মুখ দিয়ে, তারপর আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়ে তার শরীর। মৃত্যু হয় ‘অ-মৃত’র!
বাকি মৃতদেহগুলি থেকে নিজের তীরগুলি উদ্ধার করে তাতে লেগে থাকা রক্ত ভালো করে পুঁছে নিয়ে তীরগুলি তূণীরে চালান করে দেন যুবক; আরও একবার চতুর্দিকে সন্ধানী দৃষ্টি ঘোরে তার। তারপর সবকিছু ঠিক আছে বুঝে নিয়ে এবারে যুবকটি পা ফেলে এগিয়ে যান সেই ভাঙাচোরা বাড়িটিরই দিকে, যার দেওয়ালের পিছনে আত্মগোপন করে ছিলেন তিনি। এবারে সেই বাড়িটির ভাঙা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একটি মৃদু শিস্ দেন তিনি; পরক্ষণেই সেখান থেকে বেরিয়ে আসে দুইটি প্রাণী- এক যুবতী ও একটি বছর সাত-আষ্টেকের বাচ্চা ছেলে।
বাইরে বেরিয়ে এসে প্রথমদিকে একটু আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল বাচ্চাটি; বোধহয় তার আড়ষ্টতার কারণ অদূরে পড়ে থাকা চারটি প্রাপ্তবয়ষ্ক মৃতদেহ। তারপর সামনে দাঁড়ানো যুবকের দিকে চোখ পড়তেই কেটে গেল তার আড়ষ্টতা- দৌড়ে এগিয়ে এসে তার হাত চেপে ধরল সে। পরম মমতায় বাচ্চাটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন যুবকটি।
-“তুমি এত ভালো তীর ছোঁড়, আমাকে তীর চালানো শেখাবে না কাকা?”- ফিসফিস করে বলে উঠল বাচ্চাটি; পরিস্থিতির বিচারে তার ছোট্ট মাথায় বোধহয় ব্যাপারটা ঢুকেছে- বাঁচতে গেলে কথা বলতে হবে আস্তে!
বাচ্চাটির কথায় স্মিত হেসে উঠলেন যুবক; তারপর প্রশ্নমাখা চোখে তাকালেন পিছনে রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাটির দিকে। এগিয়ে এলেন তিনি; রাইফেলটি যুবকের হাতে তুলে দিতে দিতে ফিসফিসিয়ে বললেন-
-“ভিতরে থাকতে ভয়ই লাগছিল; খালি মনে হচ্ছিল এই বুঝি পিছনের অন্ধকার থেকে ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে পড়ল কোন ‘অ-মৃত’-”
কথা বলবার সময় শংকিত মুখে পিছনের অন্ধকার ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখলেন মহিলাটি কয়েকবার। বোঝা গেল, বেশ শংকিত, ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন তিনি। তার আচরণে হেসে ফেললেন যুবক, তারপর বললেন-
-“ভয় পাবেন না, মিসেস মজুমদার; এই কঠিন পরিস্থিতিতে জিততে গেলে ‘ভয়’ আপনাকে জয় করতেই হবে! এই ‘জীবন্ত মড়া’গুলি চোখে ভালো দেখতে পায় না; ভাইরাসের প্রভাবে এদের ‘মৃত্যু’ ঘটেছে অনেক আগে। কিছু মোটর অ্যাকশন আর বেঁচে থাকবার জন্য রক্ত-মাংস – ব্যাস! অপর কোন চেতনা, ইন্দ্রিয় এদের ক্ষেত্রে কাজ করে না। কাজেই আপনি যদি কোন শব্দ না করে চুপচাপ বসে থাকেন, তাহলে একেবারে কাছাকাছি এরা চলে না আসা অবধি আপনি নিরাপদ।”
-“কিন্তু যে পদ্ধতিতে এরা শিয়ালটাকে শিকার করল, তাতে আপনি কি মনে করেন যে ‘বুদ্ধিবৃত্তি’ ব্যাপারটা এদের একেবারেই নেই? আমার কিন্তু তা মনে হচ্ছে না-”- অদূরে পড়ে থাকা শিয়ালটির ভূক্তাবশেষ দেহের দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাসের সুরে বলে উঠলেন মহিলাটি; তার চোখে তখনও লেগে প্রত্যক্ষ অবিশ্বাসের দৃষ্টি।
-“পুরো ঘটনাটা খালি চোখে দেখে ‘বুদ্ধি করে শিকার’ করবার কথা মনে করালেও তা কিন্তু বাস্তবে না ঘটাই সম্ভব। টানা তিনদিন কোন রক্ত-মাংস না পেলে এই শরীরগুলির ভিতরে বাসা বাঁধা ভাইরাসগুলি মারা পড়তে থাকে; ফলে পোষক দেহকোষগুলিও আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে শেষে মারা যায়। এর বেলাতেও সেটাই হচ্ছিল। প্রায় বা অর্ধমৃত দেহটি পড়ে ছিল রাস্তায়। হয়তো আজ রাত্রেই ‘মৃত্যু’ হত দেহটির, খুব বেশি হলে কাল সকাল। শিয়ালটি কাছাকাছি চলে আসায় ওর সমস্যার সমাধান হয়ে গিয়েছিল। এই পোষক দেহগুলি গরম রক্তের ভাপ অনুভব করতে পারে; শিয়ালটির দেহের গরম রক্তের ভাপ একে সজীব করে তুলেছিল মুহুর্তে। আর শিয়ালটির মরণ-আর্তনাদে ছুটে এসেছিল বাকিরা, যারা ধারে-কাছে ছিল-”
-“কি পৈশাচিক গোটা ঘটনাটি- তাই না দত্তাত্রেয়?”- অদূরে মাটিতে পড়ে থাকা ‘অ-মৃত’গুলির পচাগলা, বিকৃত, স্থির দেহগুলির দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন মিসেস মজুমদার নামক মহিলাটি- “প্রথমে সারা বিশ্বে একটি ‘লো-প্রোফাইল’ ভাইরাস ছড়িয়ে গেল যার মারণ-ক্ষমতা এক শতাংশেরও কম… তারপর তাকে প্রতিরোধ করবার জন্য এল একটি ভ্যাকসিন, অত্যন্ত স্বল্প সময়ের ব্যবধানে, যা ভাইরাসটিকে প্রতিহত করবার পরিবর্তে তাকে আরও শক্তিশালী করে তুলল…ভ্যাকসিন নেওয়া মানুষগুলি প্রথমে সংক্রামিত করল নিজের বাড়ির লোকদের…তারপর গলি…পাড়া…এলাকা…রাজ্য…দেশ…এভাবেই ছড়িয়ে গেল গোটা বিষয়টি…প্রায় সবাই জীবন্ত লাশ হয়ে গেল মুহুর্তে! আপনি তো ভ্যাকসিন নেন নি, তাই না?”
শেষ প্রশ্নটি করা হয়েছিল দত্তাত্রেয় নামক যুবকটিকে উদ্দেশ্য করে; কিন্তু কোন সাড়া এল না তার দিক থেকে। কথাগুলি শুনতে শুনতে যুবকের চোখের সামনে যেন ভেসে উঠল কিছু খণ্ডচিত্র- একটা বাড়ির সোফা, তাতে শায়িত একটি বাচ্চার মৃতদেহ! অবিশ্বাস্য বিকৃত তার চোখমুখ- যেন একটা সুন্দর রঙ করা ক্যানভাসের ওপর দিয়ে ভিজে স্পঞ্জ বুলিয়ে দিয়েছে কেউ…মুখে গ্যাঁজলা তুলে তার দিকে দুহাত বাড়িয়ে ছুটে আসা এক মহিলা…তার গলার কাছে দুটি সদ্য দাঁত বসানোর গভীর ক্ষতচিহ্ন…রক্ত ঝরছে সেখান থেকে…করালদ্রংষ্টা হয়ে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে তেড়ে আসছেন তিনি মুখে অদ্ভুত আওয়াজ করতে করতে-
যুবকের হাতে একবার টান পড়ল; মন ফেরৎ এল স্বপ্নলোক থেকে বাস্তবে, চোখ চলে গেল নীচের দিকে। বাচ্চাটি বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে তার দিকে, চোখে-মুখে উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট। তার দিকে তাকিয়ে আবারও একবার হাসলেন যুবক, তারপর নীচু হয়ে তাকে বললেন-
-“আমরা এখন এখান থেকে চলে যাব। দুধারে বাড়িগুলি থাকবার জন্য এই রাস্তাটা দেখেছ তো কেমন ছায়া-ছায়া? তুমি মাকে ধরে ধরে নিয়ে যাবে, আমি থাকব পিছনে। সোজা এগিয়ে ডানহাতে বেঁকে কিছুটা পথ চলে আমরা রোদ্দুরের মধ্যে গিয়ে পড়ব; তাহলে আর ভূতগুলো তখন আমাদের ধরতে পারবে না। ওরা একেবারে বেকুব বনে যাবে! দারুণ মজা না?”
এইবার একচিলতে হাসি খেলে গেল বাচ্চাটির মুখে। মাথা নেড়ে একবার হ্যাঁ বলল সে, তারপর গম্ভীরমুখে এগিয়ে গিয়ে চেপে ধরল মায়ের হাত; এরপর মা কে নিয়ে এগিয়ে গেল সে, একচিলতে গলিপথটি ধরে, পিছন পিছন রওনা হল যুবক, সমবেতভাবে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
======================================================
-“কাকা,
রোদ্দুরের মধ্য দিয়ে হাঁটলে ভুতগুলো আমাদের ধরতে পারবে না কেন?”- নিষ্পাপমুখে পিছনদিকে
মুখ ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল বাচ্চাটি পথ চলতে চলতে।
-“ওদের শরীরের ভিতরে যে ভাইরাসগুলি আছে তা রোদ্দুরের তাপ সহ্য করতে পারেনা। তাই রৌদ্রে বেরিয়ে এলে কিছুক্ষণের মধ্যেই ভূতগুলো মারা যায়।”
-“অ! কিন্তু ‘ভাইরাস’ মানে কি?”
মা আর ছেলেকে সামনে রেখে পিছন পিছন চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে এগোচ্ছিলেন দত্তাত্রেয়; নিজের পিছনদিকটিতেও সতর্ক দৃষ্টি রেখে চলতে হচ্ছিল তাকে। এই ‘অ-মৃত’গুলিকে কোন বিশ্বাস নেই, যে কোন সময় যেকোন স্থান থেকে আক্রমণ চালাতে পারে এরা। সতর্ক থাকাটাই শ্রেয়।
প্রকৃতপক্ষে যেখান থেকে হাঁটা শুরু করেছিলেন তারা সেই জায়গাটি ছিল একটা সরু গলি। দুধারে সার বেঁধে দাঁড়ানো বিরাট বড় বড় বাড়িগুলির ভাঙাচোরা স্তূপ; তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের বম্বিং-এর সর্বোৎকৃষ্ট নমুনা! গোটা গলিপথটি এই বাড়ি-ঘর-দোরের কঙ্কাল বুকে ধরে রেখে বুকচাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একলা পড়ে রয়েছে যেন কোন বিগত যুগের সাক্ষী হয়ে। পুরো গলিপথটি অন্ধকার- ‘অ-মৃত’দের আদর্শ চারণভূমি! গলি ধরে অনেকটা পথ উজিয়ে এসে তারপর বড় রাস্তা; সেটি ধরে একটু এগোলেই চওড়া রাজপথ।
দত্তাত্রেয় আগেই বলে দিয়েছিলেন- দিনের বেলায় কোন অন্ধকার গলি দিয়ে যাতায়াতের সময় মুখে কোন শব্দ করা চলবে না; টুঁ-শব্দটি যেন না বেরোয় মুখ দিয়ে। যেকোন জায়গা দিয়ে মৃত্যু হয়ে বেরিয়ে আসতে পারে ‘অ-মৃত’র দল; খাদ্যের অভাবে এরা এখন এমনিতেই মরীয়া, এই অবস্থায় তাদের তাজা রক্তের সন্ধান একবার পেলে-
এই সংকীর্ণ গলিপথের ভিতরে অন্তত তিনবার থামতে হয়েছে পথে; ভাগ্য ভালো থাকায় দূর থেকেই দেখা গিয়েছে এই চলমান শবদেহগুলিকে।! প্রতিবারই মা-ছেলেকে আড়ালে দাঁড় করিয়ে রেখে এগিয়ে গিয়েছেন দত্তাত্রেয়; বিন্দুমাত্র নড়াচড়া করছে এরকম কোন ‘অ-মৃত’কে পিছনে ফেলে রেখে এগিয়ে যেতে নারাজ তিনি। সংকীর্ণ গলিপথে তাদের ওপর যেকোন প্রকারের সমবেত গেরিলা বা সাঁড়াশি আক্রমণ বিপদে ফেলতে পারে তাদের; তার থেকে ভাল এদের সংখ্যা যতটা সম্ভব কমানো।
অবশেষে সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে তারা সক্ষম হন, নির্বিঘ্নে রৌদ্রকরোজ্জ্বল বড় রাস্তায় উঠে আসতে। আর তার পরই খুলে যায় বাচ্চাটির অসীম কৌতুহলের দরজা; কিচিরমিচির করে একের পর এক প্রশ্নে দুজনকেই অস্থির করে তোলে সে। হাসিমুখে তার সকল প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন তার মা ও দত্তাত্রেয়- দুজনেই। ভাইরাস কি, এটা জানবার পর তার পরবর্ত্তী প্রশ্ন-
-“কিন্তু কাকা, তুমি বলেছিলে এটা নাকি এককালে একটা বিরাট বড় শহর ছিল, কিন্তু এখানকার বাড়িগুলো সব এরকম ভাঙাচোরা কেন? এখানে ভূত থাকে কেন? মা বলল এখানে নাকি বেজি, সাপ, শিয়াল, শকুন-সব থাকে? ওরা এখানে এল কি করে? শহরে তো এরা থাকে না! এখানে কোন গাড়ি চলছে না কেন?”
বাচ্চাটির এই প্রশ্নেরও উত্তর দিতে যাচ্ছিলেন বীরভদ্র; এমন সময় পথের ধারে একটি দৃশ্য চোখে পড়াতে থমকে গেলেন উনি। দূর থেকে ভালো করে আগে দেখে নিলেন পরিস্থিতি, তারপর বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে চললেন সেদিকে।
রাস্তার ধারে একটি বিরাট বড়, ভাঙাচোরা ভবনের ছায়ায় ফুটপাথে একটি আবর্জনার ভ্যাটের ধারে পাশাপাশি পড়ে ছিল দুটি দেহ। প্রথমটি ফুটপাথের ধারে প্রায় নিস্তেজ হয়ে শায়িত, তখনও ধীরে ধীরে শ্বাস পড়ছে তার। দ্বিতীয়জন ভ্যাটের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে কোনমতে বসা। তারও শ্বাস পড়ছে ধীরগতিতে। একটি ফাঁকা রিভলবার পড়ে ছিল দুজনের মাঝখানে; দত্তাত্রেয় এগিয়ে গিয়ে রিভলবারটি তুলে নিয়ে ভাল করে পরীক্ষা করে দেখলেন। তারপর শায়িত দেহটিকে একপলক দেখে নিয়ে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে কোমর থেকে নিজের সাপ্রেসড্ পিস্তলটি বের করে একবারই মাত্র ফায়ার করলেন সেটির মাথা লক্ষ্য করে! একবার কেঁপে উঠেই স্থির হয়ে গেল সেই দেহ। সব কাজ সেরে এবার ভ্যাটে ঠেস দিয়ে বসা মৃতপ্রায় মহিলাটির মুখোমুখি দাঁড়ালেন তিনি। কঠিন চোখমুখ নিয়ে তাকিয়ে রইলেন তার দিকে।
-“…সাহায্য…কর!”
একটা ক্ষীণ কাতরোক্তি বেরিয়ে এল মহিলাটির মুখ দিয়ে। জবাব না দিয়ে তার দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে রইলেন দত্তাত্রেয়। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে আসা মহিলাটির বিকৃত চোখমুখ সত্ত্বেও তাকে বিলক্ষণ চিনতে পেরেছেন তিনি। কিন্তু, মহিলাটি একা এখানে কি করছেন? উত্তর পাওয়ার অবশ্য কোন উপায়ই নেই। যুগপৎ ঘৃণা ও বিদ্বেষভরা চোখ নিয়ে দত্তাত্রেয় তাকিয়ে রইলেন তার মুখের দিকে, একদৃষ্টে।
-“সাহায্য…দোহাই!”
একটা কাতর স্বর বেরিয়ে এল মহিলাটির মুখ দিয়ে। কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে তাঁর; মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা ওঠা শুরু হয়ে গিয়েছে। পাশে দাঁড়ানো মিসেস মজুমদার নামক মহিলাটি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তাকে বাধা দিলেন দত্তাত্রেয়। এবার মিসেস মজুমদার ভালো করে লক্ষ্য করলেন ঠেস দিয়ে বসা মৃতপ্রায় মহিলাটিকে- তাঁর সর্বাঙ্গে কামড়ের দাগগুলি এতক্ষণে চোখে পড়ল তার।
জ্যাকেটের পাশ-পকেট থেকে একটিই গুলি বের করে খালি রিভলবারের ম্যাগাজিনে ভর্ত্তি করলেন দত্তাত্রেয়; তারপর অস্ত্রটিকে নামিয়ে রাখলেন ফুটপাথের ওপর। সেটির বাঁট ঘোরানো থাকল মৃতপ্রায় মহিলার দিকে। সব সেরে মহিলাটির চোখের দিকে একবার তাকালেন তিনি। পরিস্কার দেখতে পেলেন- ধূসর-রঙা ছায়ার একটি আস্তরণ গ্রাস করছে ধীরে ধীরে দুচোখের মণিদুটিকেই! ঘাড় উঁচিয়ে একবার পিছনের ভবনটিকে দেখে নিলেন দত্তাত্রেয়; তারপর পাশে দাঁড়ানো মা-ছেলেকে নিয়ে দ্রুত সরে এলেন অকুস্থল থেকে।
-“কিন্তু, ওঁনাকে সাহায্য না করে চলে আসাটা কি ঠিক হল দত্তাত্রেয়? মানে…হাজার হোক, উনি একসময়কার-”
-“মহাভারতে লেখা আছে- সারাজীবন সত্যি কথা বলা সত্ত্বেও যুধিষ্ঠিরকে একবার নরক-দর্শন করতে হয়েছিল; একটা আংশিক মিথ্যে বলার জন্য। সেই অনুপাতে আমি ওঁনাকে অনুমতি দিলাম, নরকে ‘নারকীয়’দের একজন হয়ে স্বাধীন বিচরণে। তবে পুরনো দিনের কথা ভেবে ছাড়পত্র পাশে রেখে দিয়ে এসেছি; উনি তা চাইলে ব্যবহার করতেও পারেন, অথবা নাও পারেন- যদিও ওঁনার হাতে সময় আর বেশি নেই!”
মিসেস মজুমদার একবার ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালেন, তারপর এগিয়ে চললেন ছেলেকে নিয়ে, দত্তাত্রেয়র সঙ্গে।
===========================================================
-“এরা
কারা, দত্তাত্রেয়? আর এরা কি করছে, নরকের একেবারে কেন্দ্রস্থলে?”
দত্তাত্রেয়র বাড়িয়ে দেওয়া দূরবীন দিয়ে অদূরে পরিত্যক্ত কারখানায় দাঁড়িয়ে থাকা পাঁচ সশস্ত্র ব্যক্তিকে দেখে নিচ্ছিলেন মিসেস মজুমদার। একটি ছোট আয়তনের গ্রীল কারখানা ছিল এটি; যদিও এর এখনকার চেহারা দেখে তা বুঝে ওঠা কঠিন। এখানেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে পাঁচজন; তাদের সঙ্গে একটি গাড়ি ও একটি খোলা-মাথা, ছোট আকারের ট্রাক। এই ট্রাকের পিঠে অনেকগুলি পেট্রোলের জারিকেন; মনে হয় সবকটি ভর্ত্তি।
-“সরকার-বিরোধী ‘নেকড়ে’ গোষ্ঠীর লোক এরা!”- উত্তর দিলেন দত্তাত্রেয়- “এদের একমাত্র নীতি- আগে গুলি, তারপর প্রশ্ন। প্রথমে মনে হয়েছিল এরা পেট্রোল সংগ্রহ করতে এসেছে এই চত্ত্বরে; কিন্তু এখন এদের হাবভাব অন্যরকম ঠেকছে। এরা নজর রাখছে সামনের বড় রাস্তার ওপর, যেন অপেক্ষা করছে কিছুর জন্য; কিন্তু কিসের? এখানে তো জীবন্ত মড়াগুলি ছাড়া অন্য কিছুই নেই!”- মিসেস মজুমদারের হাত থেকে দূরবীনটি নিয়ে সামনের দৃশ্যপট দেখতে দেখতে স্বাভাবিক স্বরে উত্তর দিলেন তিনি। অনেকটাই তফাতে ছিলেন তারা, এখান থেকে কিছু বললে অতদূর কথা পৌঁছবে না। কিন্তু…এই লোকগুলির কি করা যায়? শত্রুপক্ষের এরকম ছোট ‘পকেট’ আগেও তাদের যাত্রাপথে ছিল; সেগুলিকে এড়িয়ে ঘুরপথে এসেছেন তারা। কিন্তু এবার জায়গাটি এত সুন্দর বেছেছে শত্রুপক্ষ যে ঘুরপথে যাওয়ার কোন সুযোগই নেই; ওদের সামনে দিয়েই যেতে হবে! তাহলে উপায়?
দত্তাত্রেয় দূরবীন দিয়ে শত্রুদের হাবভাব দেখতে ব্যস্ত থাকায় খেয়াল করেন নি- তার উত্তরের সাথে সাথে মিসেস মজুমদার একপলকের জন্য তাকিয়ে দেখলেন নিজের বাচ্চা ছেলেটির দিকে। ছাদের মেঝেতে বসে সে তখন খেলা করছে দত্তাত্রেয়র ধনুকের সাথে। পলকের জন্য একটা চিন্তা খেলা করে উঠল তার চোখে-মুখে; পরক্ষণেই অবশ্য স্বাভাবিক হয়ে উঠল তার অভিব্যক্তি।
-“উঁহু”- দেখা শেষ করে বলে উঠলেন দত্তাত্রেয় - “ঘুরে যাওয়ার কোন উপায় নেই! ওদের সামনে দিয়েই যেতে হবে। ঐ রাস্তাটি ধরে একটু এগোলেই রাজপথ। সেটা ধরে যদি সোজা, একটানা এগিয়ে যাওয়া যায়, তবে একঘন্টা পর আমরা গিয়ে পৌঁছব গঙ্গার পাড়ে; ভাঙ্গা সেতুর নীচে যে সরকারি রিলিফ ক্যাম্পের কথা আপনি বলছিলেন, একদম সেখানে। কিন্তু তা সত্যিই আছে কি না জানেন তো ঠিক?”
মহিলাটি প্রত্যুত্তরে ঘাড় নাড়লেন। ভাবতে বসলেন দত্তাত্রেয়- এখন কি করণীয়?
-“কিন্তু কাকু, তুমি কিন্তু বললে না! এত তাড়াতাড়ি তুমি তীর কিভাবে ছোঁড়?”- এতক্ষণে সুযোগ পেয়ে মৃদু অনুযোগ করে উঠল বাচ্চাটি। হাসিমুখে কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকলেন দত্তাত্রেয়; তারপর বাচ্চাটির হাত থেকে ধনুকটি তুলে নিলেন হাতে। দুটি তীর একসঙ্গে তূণীর থেকে বের করে ডানহাতে সেগুলি সাজিয়ে ধরে বললেন-
-“বেশিরভাগ লোক তীর ছোঁড়ে ধনুকের বাঁদিকে তীর জুড়ে। কিন্তু আমি তীর ছুঁড়ি ধনুকের ডানদিক দিয়ে। এতে তীর তাড়াতাড়ি ছোঁড়া যায়। আবার, পিঠের তূণীর থেকে তীর বের করে পরপর তীর ছুঁড়তে গেলে সময় বেশি লাগবে। এইজন্য আমি একসাথে চারটি তীর সাজিয়ে রাখি আমার ফাঁকা ডানহাতে। এতে ধনুকে পরপর তীর জুড়ে ছুঁড়তে সময় কম লাগে। মনে রাখবে- যারা বাঁহাতি তারা তীর ধরবে বাঁহাতে, আর ছুঁড়বে ধনুকের বাঁদিক দিয়ে। ডানহাতিরা উল্টোটা করবে; তারা ডানহাতে তীর ধরবে আর ধনুকের ডানদিক দিয়ে তীর ছুঁড়বে- মনে থাকবে?”
ঘাড় নাড়ল বাচ্চাটি। পরক্ষণেই আবার প্রশ্ন-
-“কিন্তু কাকু; তুমি বন্দুক ব্যবহার কর না কেন সবার মত?”
-“বন্দুকের গুলি একবার ব্যবহার করলে আর ব্যবহার করা যায় না; কিন্তু তীর বারবার ব্যবহার করা যায়। বন্দুকে যতই সাপ্রেসর ব্যবহার কর, হালকা একটা শব্দ বেরোবেই; কিন্তু তীর এত নিঃশব্দ যে অনেকসময়-”
কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেলেন দত্তাত্রেয়; চোখের দৃষ্টি সংকুচিত হয়ে এল তার। দ্রুত কি একটা ভেবে নিলেন তিনি, তারপর মিসেস মজুমদারের দিকে ফিরে বললেন-
-“আপনি ছেলেকে নিয়ে এখানেই ঘাঁটি আগলে বসে থাকুন, কোথাও নড়বেন না। আমি একটু চেষ্টা করে দেখি, ওদের গাড়িটা পাওয়া যায় কি না। কোথাও যাবেন না, এই রৌদ্রের মধ্যে আপনি নিরাপদ। আর একটি কথা- দূরবীন দিয়ে বেশিক্ষণ ওদের দেখবেন না; রৌদ্রে কাঁচে প্রতিফলন ওদের চোখে পড়ে গেলে আপনার লোকেশন ওরা জেনে যেতে পারে। কোন অবস্থাতেই নিরস্ত্র অবস্থায় ছায়ায় যাবেন না। মনে থাকবে তো?”
-“কিন্তু…আপনি ওদের গাড়ি…কি করে?”
-“খুব সহজ! আমি ওদের মিষ্টি করে ‘প্লীজ’ বলব, আর ওরা গলে গিয়ে আমায় গাড়ি দিয়ে দেবে!”- একটি রহস্যময় একপেশে হাসি হেসে বাচ্চাটির মাথায় আদর করে ছাত থেকে নেমে এলেন দত্তাত্রেয়। এগিয়ে চললেন পরিত্যক্ত গ্রীল কারখানার দিকে, প্রস্তুত হয়ে।
===========================================================
গ্রীল
কারখানার গেটে তখন কেউ ছিল না। এই পাণ্ডব-বর্জিত জায়গায় কোন প্রহরার প্রয়োজনটাই বোধ
হয় এদের ধারণায় আসে নি। এতে অবশ্য সুবিধাই হল; ভাঙাচোরা গেটের ফাঁক গলে প্রথমে ভিতরে
আধখানা ঢুকে পড়লেন দত্তাত্রেয়। সতর্ক চোখে একবার দেখে নিলেন চারদিক, তারপর পুরোটা ঢুকে
একটু এগিয়ে বাঁদিকে একটি টিনের ভাঙাচোরা শেডের মধ্যে ঢুকে পড়লেন তিনি। যতটা কভারে থাকা
যায় ততই মঙ্গল। এবার সবকটাকে খুঁজে পেলেই হল।
শেডটা টানা লম্বা, জায়গায় জায়গায় অন্ধকার। পুরো জায়গাটা বাইরে থেকে যতটা ছোট দেখায়, ভিতরে ততটাই বড়। অনেকটা ছড়ানো জায়গা জুড়ে কারখানা চত্ত্বর। যে শেডের নীচে কভার নিয়েছিলেন দত্তাত্রেয়, তার অন্ধকারের মধ্য দিয়ে ধীর পদক্ষেপে চলতে শুরু করে দিলেন তিনি। জায়গায় জায়গায় আবর্জনার স্তুপ, গাদাগাদি করে জড়ো হওয়া পুরনো যন্ত্রাংশ, ভাঙা স্ক্র্যাপ, ভেঙে পড়া, ছাত থেকে নেমে আসা টিন। সব বাঁচিয়ে একটুও আওয়াজ না করে আধো-অন্কারাচ্ছন্ন, সংকীর্ণ পথটি ধরে এগিয়ে চললেন তিনি।
আর এভাবেই খুঁজে পাওয়া গেল প্রথম রক্ষীটিকে; একটি কোণে কিছু স্ক্র্যাপ জড়ো করে রাখা ছিল, তাতে প্রস্রাব করছিল রক্ষীটি। কাজ সেরে ফূর্তিতে শিস্ দিতে দিতে এগিয়ে আসছিল সে; পথে একটু অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি খিলান অতিক্রম করে একপা এগিয়ে যেতেই পিছন থেকে একটি হাত বেরিয়ে এসে সটাং চেপে ধরল তার মুখ; পরক্ষণেই একটি ছুরি ঢুকে গেল তার গলার পাশ দিয়ে, পুরোটা গলার ভিতরে, এফোঁড়-ওফোঁড় করে! খাবি খেতে খেতে মৃত্যু হল সেই রক্ষীর। অন্ধকারে আবর্জনার মধ্যে তাকে শুইয়ে দিলেন দত্তাত্রেয়; তারপরই একটি গাড়ির এঞ্জিন স্টার্টের আওয়াজ পেয়ে সতর্ক হয়ে উঠলেন তিনি। এরা কি চলে যাচ্ছে না কি? শেডের বাইরে কৌতুহলবশতঃ উঁকি দিলেন তিনি।
একটি গাড়ি স্টার্ট নিয়ে বেরিয়ে গেল কারখানার গেট দিয়ে। একজনই লোক ছিল তাতে। খোলা-মাথা ছোট ট্রাকটি অবশ্য দাঁড়িয়েই, তার মধ্যে সজ্জিত পেট্রোলের সম্ভার নিয়ে, নিষ্প্রাণ হয়ে। কেউ নেই তার ধারেকাছে। তার মানে বাকিরা এখানেই রয়েছে। নাহলে অন্তত পেট্রোলগুলিকে পিছনে ফেলে রেখে যেত না এরা। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এগুলি এখন মহামূল্যবান সম্পত্তি; এগুলিকে পিছনে ফেলে রেখে অন্তত পালাবে না কেউ, যতই বিপদ আসুক না কেন! সামনে এগোতে লাগলেন দত্তাত্রেয়।
সৌভাগ্যবশতঃ শেডটির শেষপ্রান্তে এসে একসাথে দুজনের দেখা পাওয়া গেল; বেশ খোসমেজাজে দাঁড়িয়ে গল্প করছে দুজনে। বেড়ালের মত লঘুপায়ে একটু সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন দত্তাত্রেয়; একটি পুরোন, বাতিল স্ক্র্যাপের আড়ালে দাঁড়িয়ে প্রস্তুত হতে লাগলেন তিনি। এইসময় দুজনের কথাবার্তার কিছু অংশ কানে এসে ঠেকল তার-
-“…আরে চাপ নিস না; ঐ মা-ছেলে আর কোন দিক দিয়ে যাবে…যেতে হলে তো এদিক দিয়েই যেতে হবে না কি? পেট্রোল ঝেঁপে নিয়েছি, এবার ওদেরকে পেলেই আমরা এখান থেকে ফুটুস! অন্ধকার হওয়ার আগেই ক্যাম্পের ভিতর-”
-“গুল্টে কোথায় গেল আবার? বস বলেছে গেটের আশেপাশে টহল দিতে…”
-“খালি হতে গেছে হতভাগা! হাতে বন্দুক নিয়ে তুই এত ভয় পাচ্ছিস কেন? এই নে খা!”- হাতের জ্বলন্ত সিগারেটটি প্রথম রক্ষীর দিকে বাড়িয়ে দেয় দ্বিতীয় রক্ষীটি। সিগারেটটা নিয়ে একটা সুখটান মেরে প্রথম রক্ষীটি বলে ওঠে-
-“আরে এই আধমড়া লাশগুলোকে দেখলে আমার যা ভয় লাগে না গুরু, মনে হয় যেন ছোটবেলার সেই রক্তচোষার গল্প…ভালো কথা- মা আর ছেলের ছবিটা একবার দেখা তো, ভালো করে দেখে নিই।”
এ কথায় প্যান্টের পকেট থেকে একটি ইশতেহার বের করল দ্বিতীয় রক্ষীটি। সেটি প্রথম রক্ষীর দিকে বাড়িয়ে ধরতেই-
অন্ধকারে দুটি পরপর তীর ছুটে এল দুইজনেরই মাথা লক্ষ্য করে। কোনরকম আওয়াজ না করে দুজনেই এলিয়ে পড়ে গেল মাটিতে, মাথায় আমূল তীরবেঁধা অবস্থায়। দ্বিতীয় রক্ষীর স্খলিত হাত ইশতেহারটি পড়ে গেল মেঝেতে। এবার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এলেন দত্তাত্রেয়; ইশতেহারটি একবার পড়ে দেখলেন তিনি পুরোটা। তারপর মৃতদেহগুলি থেকে তীর সংগ্রহ করে, ইশতেহারটি মুড়ে পকেটে রেখে দিলেন তিনি। মিসেস মজুমদারকে কিছু প্রশ্ন করা দরকার পরে এ বিষয়ে। এখন আগে এদিককার কাজ মেটানো যাক!
শেডের শেষে ঝোপঝাড় মত হয়ে রয়েছে পুরো জায়গাটি; লম্বালম্বি এই বুনো গাছপালার ঝোপ-জঙ্গলের সারি গিয়ে ধাক্কা খেয়েছে একটি লম্বাটে ভবনের গোড়ায়। ঝোপঝাড়ের আড়াল দিয়ে সেই ভবনের সামনেটায় এসে যখন পৌঁছলেন দত্তাত্রেয়, তখন দেখা গেল- সেই গাড়িটি আবার ঢুকছে কারখানার গেট দিয়ে। দেরি করলেন তিনি একমুহুর্তও; এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে যে কোন মুহুর্ত্তে নজরে পড়ে যেতে পারেন উনি। শত্রুপক্ষ এখনও দুজন, উনি একা! সাত-পাঁচ ভেবে কপাল ঠুকে দত্তাত্রেয় ঢুকে পড়লেন সামনের ভবনটিতে; দরজার আড়ালে পোজিশন নিয়ে দেখতে লাগলেন বাইরের কর্মকাণ্ড।
গাড়ির থেকে প্রথমে নামল একজন লোক। একটি শিস দিতেই একজন দৌড়ে চলে এল তার দিকে; দুজনে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত ভাবে কিছুক্ষণ কি একটা বিষয়ে তর্ক হল; তারপর গাড়ির থেকে নেমে আসা লোকটি অপর লোকটির হাতে তুলে দিল একটি দূরবীন।
চমকে মাথা ভিতরে টেনে নিলেন দত্তাত্রেয়; দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে একটি গভীর নিঃশ্বাস নিলেন তিনি। ওটি তারই দূরবীন, যেটা তিনি রেখে এসেছিলেন মিসেস মজুমদারের কাছে! দূর থেকে হলেও নিজের সম্পত্তি ঠিকই চিনতে পেরেছেন তিনি। এখন প্রশ্নটা হল- ওরা কি দূরবীনের সঙ্গে মিসেস মজুমদারকেও ধরতে পেরেছে? খোলা দরজা দিয়ে আবার বাইরে উঁকি দিলেন দত্তাত্রেয়।
গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে আরও কিছুক্ষণ তর্কাতর্কি হল; যেন কোন একটি বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারছেন না দুইজনে। এরই মধ্যে একজন লোক দুহাত মুখের কাছে জড়ো করে বেশ কয়েকটি নাম ধরে ডাকাডাকি করলেন; তারপর কোন সাড়া না পেয়ে পিছিয়ে গেলেন দুই পা। তার পরই-
গাড়ির পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল যে লোকটি এবার সে একটানে খুলে ফেলল পিছনের ডিকি; তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন- মিসেস মজুমদার ও তার ছেলে! বাচ্চাটি মনে হয় অজ্ঞান- কোন নড়াচড়া করছিল না সে!
আবার দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে পুরো বিষয়টি ভেবে নিলেন দত্তাত্রেয়। পাশা ঘুরে গিয়েছে! যে কোনভাবেই হোক, মিসেস মজুমদার ধরা পড়ে গিয়েছেন তার সন্তান সমেত। আর শত্রুপক্ষ জানে তার উপস্থিতি। এখনও অবশ্য তারা তার পোজিশনটা বুঝে উঠতে পারে নি, পারলে হয়তো-
এখন কি করা যায়?
ভবনটির ভিতরে ঘোরানো সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে একটা বুদ্ধি এসে গেল দত্তাত্রেয়র মাথায়। দ্বিতীয় কোন কিছু চিন্তা না করে সিঁড়ি বাইতে শুরু করলেন তিনি। আগে পোজিশন নেওয়া যাক, তারপর দ্বিতীয় কথা। ওরাও আর এগোচ্ছে না, দাঁড়িয়ে আছে এক জায়গায়। চিলেকোঠার কাছে একটা ঢাকা জায়গা দেখা গিয়েছিল নীচ থেকে; এই সিঁড়িতে কি পৌঁছনো যাবে ঐ অবধি?
তা অবশ্য হল, ওপর অবধি পৌঁছনো গেল; এখন ঐ ঘরটি আগে খুঁজে বের করতে হবে। ওপরে উঠে ইতস্ততঃ খুজতে খুঁজতে অবশেষে ঘরটি খুঁজেও পেলেন তিনি; প্রায়ান্ধকার একটি ঘর যার দেওয়ালে একটি মাঝারি গর্ত। ওটি দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। তীরগুলি ফেরৎ চলে গেল তূণীরে, ধনুকটি কাঁধে ঝুলিয়ে নিলেন তিনি। এবারে বন্দুকটি কাঁধ থেকে খুলে হাতে নিয়ে এক পা এগিয়ে ঘরে ঢুকতেই-
অন্ধকারে কিসের সঙ্গে ঠোক্কর খেলেন তিনি বুঝতে পারলেন না; ধপাস করে মেঝেতে পড়ে গেলেন দত্তাত্রেয়। পরমুহুর্তেই উরুর কাছে একটি প্রবল দংশন অনুভব করলেন তিনি, যেন একসঙ্গে অনেকগুলি সূঁচ ঢুকেছে সেখানে! চীৎকার করে উঠতে উঠতেও সামলে নিলেন তিনি; কোনমতে মাথা পিছন দিকে ঘুরিয়ে প্রবল বিষ্ময় ও আতংকের সাথে আবছা অন্ধকারে আবিষ্কার করলেন- একটি ‘অ-মৃত’র কালো মাথা! তার দাঁতগুলিকে তিনি অনুভব করলেন শিরায় শিরায়, তার উরুর পিছন দিকটি করে। যদিও যোদ্ধার প্রতিবর্ত ক্রিয়া কাজ করল মুহুর্তমধ্যে; তার হাতে উঠে এল সাপ্রেসড্ পিস্তল, এক লহমায়! একটি গুলিতেই ‘কোঁক’ শব্দ করে মারা গেল ‘অ-মৃত’; সাঙ্গ হল তার রক্তের তৃষ্ণা!
প্রচণ্ড ব্যথা উপেক্ষা করে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন দত্তাত্রেয়। পকেট থেকে লাইটার বের করে জ্বাললেন। দেখা গেল- ঘরের চৌকাঠের কাছে পড়ে ‘অ-মৃত’র বিকারগ্রস্ত মৃতদেহ। কোমরের অল্প একটু নীচ থেকে সেটার পায়ের প্রায় পুরোটাই কাটা! এ হতভাগা লুকিয়ে ছিল ঘরের ভিতরে, কিভাবে বেঁচে ছিল তা অবশ্য আর জানা যাবে না; তবে মরবার আগে মোক্ষম কাজটি করেছে সে- দত্তাত্রেয়কে ‘অ-মৃত’ করে দিয়ে!! এ একাই ছিল এখানে, আশেপাশে নজর বুলিয়ে দেখা গেল ঘরে আর কেউ নেই।
মাথা তুলে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালেন দত্তাত্রেয়- তার অসীম সৌভাগ্য যে কোন শব্দ বেরোয় নি পিশাচটার গলা দিয়ে- বাইরের মানুষ-পিশাচগুলি নাহলে সতর্ক হয়ে যেত। এখন তার পালা, নিজে শেষ হওয়ার আগে এই খেলাটা শেষ করার।
দেওয়ালের গর্ত দিয়ে বন্দুকের নল বাইরে বের করলেন দত্তাত্রেয়।
নীচে তখন অবস্থা বেশ খারাপ। মিসেস মজুমদারকে মাটিতে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে হাঁটু গেড়ে; অজ্ঞান বাচ্চাটিকে কোলে ধরে শিশুর মত কাঁদছেন তিনি! তার ঠিক পিছনেই একহাতে একটি শটগানের নল তার দিকে তাক করে দাঁড়িয়ে অবশিষ্ট দুইজনের একজন; অপরজন ঠিক তার পাশেই দাঁড়িয়ে ইতস্তত তাকাচ্ছেন এদিক-ওদিক। স্কোপের মধ্য দিয়ে পরিষ্কার দেখলেন দত্তাত্রেয়- শটগানের ট্রিগারটি টেনে ধরে রাখা। এর মানে- যদি তিনি ফায়ার করেন ব্যক্তিটির ওপর, তবে ট্রিগার দেবে যাবে; লোকটি মারা পড়বে নিঃসন্দেহে, কিন্তু মিসেস মজুমদারও বাঁচবেন না! তাছাড়া, বামপাশে দাঁড়ানো লোকটিও নিজের পিস্তল উঁচিয়ে রয়েছে মিসেস মজুমদারের মাথা লক্ষ্য করে। বন্দুক নামিয়ে রেখে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে ভাবতে শুরু করলেন দত্তাত্রেয়- কি করা যায় এখন? কিভাবে সম্ভব এক গুলিতে দুইজনকে ফেলা?
অন্ধকার কড়ি-বরগার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ একটি বিকল্প সম্ভাবনা খেলে গেল তার মাথায়। লাফিয়ে উঠলেন তিনি; সাগ্রহে তাকালেন অকুস্থলের দিকে। লোকদুটি আর মিসেস মজুমদার তখনও একভাবে রয়েছেন, নিজ নিজ অবস্থানে স্থির, নিশ্চল হয়ে, দুটো গাড়িকে পিছনে রেখে। বাঁদিকের লোকটি অবশ্য একটানা কি একটা বলে চলেছে চেঁচিয়ে, বিন্দু-বিসর্গও কান দিলেন না তাতে দত্তাত্রেয়। তার লক্ষ্য তখন একহাতে শটগান ধরা বাঁহাতি লোকটির বাঁহাতের কব্জির ওপরের অংশটি। অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ্য স্থির করলেন দত্তাত্রেয়; তারপর দ্বিতীয় ব্যক্তির চিৎকার করে বলা কথাগুলি থেমে যেতেই গুলি চালালেন তিনি। গুলিটি বন্দুকের নল থেকে বেরিয়ে সিধে ছুটে চলল লক্ষ্যের দিকে; একসময় টার্গেটে গিয়ে লাগলও তা, অব্যর্থভাবে! কিন্তু-
বুদ্ধিটি ভালোই বের করেছিলেন দত্তাত্রেয়। কবজির সন্ধিক্ষণে আঙুলগুলি ঠিক যে জায়গায় এসে মিলিত হয়, সেখানে যদি আচমকা জোরে আঘাত পড়ে, তবে হাত সঙ্গে সঙ্গে ঝটকা মেরে ঘুরে যায় অনুবর্ত্তী দিকে। এখানে টার্গেট বাঁহাতি, সে শটগান ধরে আছে বাঁহাতে, আর তার সঙ্গীও দাঁড়িয়ে সেদিক ঘেঁষেই। কাজেই এইভাবে টার্গেটের বাঁহাতে গুলি মারলে ঝটকা খেয়ে অনুবর্ত্তী দিকে, অর্থাৎ বাঁদিকে শটগানের নল তো ঘুরবেই, উপরন্তু শটগানের ট্রিগার টানা থাকায় গুলি বেরিয়ে তা বিদ্ধ করবে মিসেস মজুমদারকে নয়, বরং তার দিকে বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটির সঙ্গীকে! এক ঢিলে দুই পাখি শিকার! উদ্দেশ্য অসাধু নয়, কিন্তু হিসেবে একটু গণ্ডগোল হল।
লোকটির হাতের সঠিক জায়গায় অব্যর্থ নিশানায় গুলি লাগল, লোকটির শটগানে আচমকা চাপ পড়ে সেটি থেকে গুলিও বেরোল; কিন্তু তা দ্বিতীয় লোকটিকে বিদ্ধ না করে সোজা গিয়ে লাগল ঠিক তার পিছনেই দাঁড় করানো ট্রাকটির পিঠে বসানো অনেকগুলির মধ্যে একটি পেট্রোলের জারিকেনে! নিমেষে বিস্ফোরণ হল তাতে, ভয়াবহ বিস্ফোরণ! ট্রাকটির সামনে দাঁড়ানো দুইজন ব্যক্তিই আহত হয়ে পড়ে গেল মাটিতে; উবু হয়ে বসা মিসেস মজুমদার সামনের মাটিতে এলিয়ে পড়ে গেলেন নিশ্চল হয়ে। বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল দত্তাত্রেয়র- ওনার বা ওনার সন্তানের কোন ক্ষতি হল না তো? পরপর দুটি গুলি ছুঁড়লেন তিনি, শায়িত দুই শত্রুর মাথা লক্ষ্য করে; বিশ্বযুদ্ধ তাকে হাড়ে হাড়ে শিখিয়েছে সেই প্রাচীন প্রবাদ- “শত্রুর শেষ রাখতে নেই”। তারপর আর অপেক্ষা না করে কাঁধে বন্দুক ঝুলিয়ে দ্রুতপদে ভবনের বাইরে বেরিয়ে এলেন তিনি।
==========================================================
-“মিসেস
মজুমদার, মিসেস মজুমদার!!”
রীতিমতন হাত দিয়ে ঝাঁকাতে হল মিসেস মজুমদারের দেহ; তারপর জলের বোতল থেকে চোখেমুখে জল দেওয়াতে অবশেষে তার জ্ঞান ফেরৎ এল। বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল মিসেস মজুমদারের, পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে মানিয়ে নিতে, তারপর উঠে বসেই নিজের সন্তানকে তুলে পরীক্ষা করতে লাগলেন তিনি।
-“ওর নাড়ির গতি স্বাভাবিক, শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়মিত। এখনও অবশ্য অজ্ঞান; কিন্তু…কি করে, মিসেস মজুমদার?”- জিজ্ঞেস করলেন দত্তাত্রেয়।
-“আমরা ছাদেই ছিলাম, হঠাৎ পিছন থেকে একজন এসে প্রথমেই বাবুকে অজ্ঞান করে দিল একটি ইঞ্জেকশন পুশ করে…আমি বাধা দিতে গেলে বন্দুকের কুঁদো দিয়ে…আমার অবশ্য ডিকির ভিতরেই জ্ঞান ফেরৎ আসে, কিন্তু বাবু…ওকে কি ওরা মেরে ফেলল, দত্তাত্রেয়?”
হাঁউমাউ করে কেঁদে ফেললেন মিসেস মজুমদার; শেষের কথাগুলি বলতে গিয়ে। তাকে আশ্বস্ত করলেন দত্তাত্রেয়-
-“ওকে শুধু ঘুমের ওষুধই পুশ করেছে ওরা, আপনি নিশ্চিত থাকুন। ওদের ওপর নির্দেশ ছিল, বাচ্চাটির যেন কোন ক্ষতি না হয়। এই যে, পড়ুন।”
পকেট থেকে ইশতেহারটি বের করে মিসেস মজুমদারকে পড়তে দিলেন দত্তাত্রেয়। পুরোটা পড়লেন তিনি; তারপর একটা লম্বা শ্বাস টেনে দত্তাত্রেয়র দিকে তাকিয়ে বললেন-
-“এই কারণেই আমাদের পথচলা, সরকারি রিলিফ ক্যাম্পের দিকে…”
আর কিছু বলতে পারলেন না মহিলা; জলভরা চোখে তিনি তাকিয়ে রইলেন দত্তাত্রেয়র দিকে।
-“আমাদের এখন খুব দ্রুত পৌঁছানো দরকার ওখানে।”- বলে উঠলেন দত্তাত্রেয়।
-“কিন্তু যাবেন কিসে? দুটো গাড়িই তো শেষ!”
মিসেস মজুমদারের কথায় পিছন দিকে তাকিয়ে দেখলেন দত্তাত্রেয়- সত্যিই তাই! দুটি গাড়িতেই আগুন ধরে গিয়েছে সম্পূর্ণভাবে, পুড়ে ঝামা হয়ে যাচ্ছে গাড়িগুলি, তাদের একমাত্র অবলম্বনগুলি, তাদের অসহায় চোখের সামনে! এদিকে সূর্যও আস্তে আস্তে হেলতে শুরু করেছে পশ্চিমদিকে; শীতকালে সূর্য অত্যন্ত তাড়াতাড়ি ডোবে। এখন কি হবে?
এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে আচমকা চোখে পড়ল- অদূরে শেডের ভিতরে সার বেঁধে দাঁড়ানো পুরনো আমলের কয়েকটি হাতে-টানা বাহক টানাগাড়ি; লোহার চাকা সমেত। কাছে এগিয়ে এলেন দত্তাত্রেয়, খুঁটিয়ে পরীক্ষা করতে লাগলেন তিনি সেগুলিকে। টানবার জন্য অনেকটা লম্বা দুটি সমান্তরাল হাতল; বেশ কিছুটা এগিয়ে এসে একটি আড়াআড়ি হাতল দিয়ে একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত। মাল বহন করবার জায়গাটিও যথেষ্ট প্রশস্ত। সর্বোপরি, লোহার চাকা হওয়ায় কোন সমস্যা নেই চাকা গড়াতে। আর শেডের নীচে থাকায় এতবছরেও বৃষ্টির জলে বিশেষ মর্চে ধরে নি এতে। বেশ কয়েকগাছা মজবুত দড়িও রাখা ছিল সেখানে, ঝাড়াই-বাছাই করে তার মধ্য থেকে কয়েকটি শক্তপোক্ত নারকুলে-দড়ি নিয়ে মিসেস মজুমদারের কাছে ফেরৎ এলেন তিনি।
-“বাচ্চা সমেত একবার উঠে বসুন তো দেখি এতে!”
দুজনকে নিয়ে টেনে দেখলেন একবার দত্তাত্রেয়- দিব্যি গড়াচ্ছে টানাগাড়ি গড়গড়িয়ে। এবার বাচ্চাকে রেখে মিসেস মজুমদারকে নেমে আসতে বললেন তিনি।
-“এবারে মন দিয়ে শুনুন মিসেস মজুমদার। এই প্রত্যেকটি অস্ত্র আপনার কাছে রাখুন। প্রত্যেকটির সেফটি লক খুলে রেখে দিলাম, যাতে বিপদে পড়লে গুলি চালাতে কোন অসুবিধা না হয়। সাবধান! বাবু যেন হাত না দেয় এতে! এই যে ছুরি- এটা কাপড়ের মধ্যে রাখবেন। ‘অ-মৃত’দের থামাতে একমাত্র ভরসা মাথায় আঘাত করা, মনে আছে তো? বেশ!”
প্রত্যেকটি আগ্নেয়াস্ত্রে সম্পূর্ণ গুলি ভরে সেফটি লকগুলি সরিয়ে নিলেন দত্তাত্রেয়; সাজিয়ে রাখলেন অস্ত্রগুলিকে পরপর, বাচ্চা ছেলেটি যেদিকে শুয়ে ছিল তার বিপরীত দিকে। তারপর কাঁধ থেকে ধনুকটি নামিয়ে পিঠের তূণীর সমেত সেটিকে সাজিয়ে রাখলেন বাচ্চাটির শিয়রে।
-“ওকে এই উপহারটা দিলাম। এবারে…দাঁড়ান এক মিনিট!”
দৌড়ে গিয়ে সামনে পড়ে থাকা দুটি মৃতদেহর মধ্যে একটিকে তুলে নিয়ে এলেন দত্তাত্রেয়। ভালো করে, কষে বাঁধলেন দেহটিকে তিনি, লম্বা, টানা হাতলগুলির একেবারে শেষ প্রান্তে। এবারে টানবার জায়গার মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্রথমে দেখে নিলেন তিনি- না, সামনে বাঁধা মৃতদেহ অবধি মুখ পৌঁচ্ছে না তার। নিশ্চিত হয়ে এবারে তিনি পাশে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকা মিসেস মজুমদারের উদ্দেশ্যে বললেন-
-“আমার দুটি হাত খুব ভালো করে কষে শক্ত করে বাঁধুন হাতলের সঙ্গে; এত জোর বাঁধুন যাতে আমি গায়ের সমস্ত জোর লাগিয়েও খুলতে না পারি একে! তাড়াতাড়ি, সময় বেশি নেই…”
-“কি হচ্ছে বলুন তো এসব? এর মানেটা কি?”
অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন মিসেস মজুমদার; তিনি হাঁ করে দেখছিলেন এই ব্যাপার-স্যাপারগুলি, বিষয়ের কার্য-কারণ কিছু বুঝতে না পেরে। অবশেষে আর থাকতে না পেরে প্রশ্নটা করেই বসলেন তিনি। উত্তরে এতক্ষণে ক্ষতস্থানটি তার দিকে মেলে ধরলেন দত্তাত্রেয়। বিস্মিত হয়ে ফ্যালফ্যাল করে সেদিকে তাকিয়ে থাকলেন মিসেস মজুমদার।
-“আমি সংক্রামিত! সময় বেশি নেই। যা বলছি করুন, মিসেস মজুমদার!”
আর থাকতে না পেরে এবারে কেঁদেই ফেললেন তিনি। এই লোকটি, দত্তাত্রেয়, এর সঙ্গে দেখা রাস্তায়, সম্পূর্ণ অভাবনীয় পরিস্থিতিতে, বিপদসংকুল পরিবেশে। কত নিশ্চিত বিপদ থেকে তাদেরকে রক্ষা করেছেন দত্তাত্রেয় এই পুরো সপ্তাহটা ধরে, তার কোন ইয়ত্তা নেই; আর আজ সে যখন নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে একধাপ পা ফেলে বাড়িয়ে রেখে… কান্না ছাড়া আর কোন কিছুই দেওয়ার নেই তার!
যোদ্ধার শক্ত মন নরম হয়ে এল কিছুক্ষণের জন্য এক অসহায় মহিলাকে পাশে কাঁদতে দেখে; দত্তাত্রেয় কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন মিসেস মজুমদারের দিকে, আর্দ্র চোখে। তারপর জ্যাকেটের ভিতর-পকেট থেকে একটি ছবি বের করে বাড়িয়ে ধরলেন। সেটিকে দেখলেন মিসেস মজুমদার- এক মহিলা ও একটি বাচ্চা ছেলের হাস্যমুখর ছবি। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে দত্তাত্রেয়র দিকে তাকালেন তিনি।
-“কেউ যদি জিজ্ঞেস করে ছবিটি সম্পর্কে, বলবেন- এই ছবি যার, সে নিজের হাতে খুন করেছে তার সংক্রামিত স্ত্রী ও পুত্রকে। এখন তাড়াতাড়ি করুন, মনে হয় সংক্রমণের প্রভাব শুরু হয়ে গিয়েছে!”
দত্তাত্রেয়র নির্দেশ মত তাকে টানাগাড়ির হাতলের সঙ্গে খুব শক্ত করে বাঁধলেন মিসেস মজুমদার। তারপর টানাগাড়িতে পাশাপাশি শুয়ে পড়লেন নিজের ছেলের পাশে। এরপরই মানুষে টানা গাড়িটি বেরিয়ে গেল কারখানার লোহার গেট দিয়ে; মা-ছেলেকে নিয়ে। দত্তাত্রেয় টানছেন সেই গাড়ি!
==========================================================
[উপসংহার- মিসেস মজুমদারের অভিজ্ঞতা]
টানাগাড়িতে শুয়ে থাকতে থাকতে একসময় কষ্টটা বেশ জাঁকিয়েই বসল মাথায়।
কষ্টটা হচ্ছিল দত্তাত্রেয়র জন্যই। অত্যন্ত দায়িত্ববান যুবক; এই কটা দিন রীতিমতন আগলে রেখে ছিল আমাদের দুইজনকে, সমস্ত বিপদ-আপদ থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে রেখে। কতবার যে রাস্তায় আক্রমণ করেছিল অর্ধমৃত ‘অ-মৃত’র দল, বা ক্ষুধার্ত ‘নেকড়ে’ গোষ্ঠীর দূর্বিনীত সৈন্যরা তার কোন ইয়ত্তা নেই! অস্ত্রধারী এই দ্বিতীয় গোষ্ঠীর অসংক্রামিত মানুষগুলির আক্রমণকে প্রথমে আমি বিক্ষিপ্ত একটি ঘটনা হিসেবে দেখতাম; কিন্তু শেষদিনকে দত্তাত্রেয়র কথাতেই জানতে পারি এরা সরকার-বিরোধী ‘নেকড়ে’ গোষ্ঠীর পথভ্রষ্ট নীতিবিহীন সৈনিক; এদের লক্ষ্য এই অরাজক সময়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নেওয়া।
হাসি পেয়ে যায় এদের উচ্চাশার কথা ভাবলে! গোটা পৃথিবীর জনসংখ্যা আজ যেখানে দশ শতাংশেরও নীচে নেমে এসেছে, মানবগোষ্ঠী যেখানে বিলুপ্তপ্রায়; হাজারে হাজারে লোক প্রতিদিন যেখানে নতুন করে সংক্রামিত হচ্ছে- সেখানে এই সন্ত্রাসবাদী ছেলেমানুষী কার্যকলাপ কি নিতান্তই প্রয়োজন? এত বড় একটা যুদ্ধ ঘটে গেল গোটা বিশ্বজুড়ে, তারপরেও এদের এতটা রক্ততৃষ্ণা? ‘অ-মৃত’রা শিকার করে নিতান্তই জৈবিক প্রয়োজনে; ওদের শরীরের দ্রুত বর্ধমান ভাইরাসগুলির বৃদ্ধি ও বেঁচে থাকবার জন্য দরকার রক্ত ও মাংস, তাই তাদের দ্বারা চালিত হয়ে মৃতদেহগুলি মানুষ শিকার করে। এই মৌলিক ব্যাপারটা মেনে নিতে আমার কোন অসুবিধা হয় না। তাছাড়া- পোষক দেহগুলি কিন্তু চেতনাবিহীন মৃতদেহ! এটিই সবচেয়ে অবাক করা তথ্য, আর বিষয়টি ভেবে দেখবার মত।
কিন্তু তার থেকেও বেশি নৃশংস এই মানুষরূপী পিশাচগুলি, অকারণে রক্তের স্বাদ যাদের সবচাইতে প্রিয়! ‘প্রয়োজনের জন্য শিকার’ বনাম ‘মনোরঞ্জনের জন্য শিকার’- দুইয়ের মধ্যে আমার ভোট সর্বদা প্রথমটিতেই।
তবে ভরসা লাগে দত্তাত্রেয়, আর তার মতন মানুষগুলিকে দেখলে। বোঝা যায়- ‘মানুষ’ নামক আবর্জনার স্তুপের মধ্যেও এখনও কাজ করছে মনুষ্যত্ব। বেঁচে থাকুক ও, বেঁচে থাকুন আমার স্বামী- ‘অমৃতের সন্তান’ হয়ে, আজীবন!
কারখানা থেকে বেরিয়ে আমাদের টানাগাড়িটি বড়রাস্তায় পড়েই সবেগে ধেয়ে চলল সামনের দিকে। দত্তাত্রেয় বলেছিল যে এই রাস্তাটা ধরে রাজপথে উঠে এরপর উত্তরমুখো হয়ে খানিকটা এগিয়ে গেলেই একটা বড় চৌরাস্তা পড়বে; তার মধ্যে সিধা নাক-বরাবর রাস্তাটি ধরে সোজা সামনের দিকে এগিয়ে প্রায় আধাঘন্টা উজোলেই ভাঙ্গা সেতুর নীচে প্রস্তাবিত রিলিফ ক্যাম্প। ও অবশ্য নিশ্চিত নয় ওটা আদৌ আছে কি না; মধ্যিখানে বেশ কয়েকবছর ছিটকে গিয়েছিল ও এখান থেকে। নতুন স্থাপনাগুলি সম্পর্কে ওর কিছু জানা ছিল না।
আমাকে বলা হয়েছিল যাই ঘটুক না কেন- গাড়ির ভিতরে মাথা গুঁজে পড়ে থাকতে। সূর্য ডুবতে প্রায় ঘন্টাদেড়েক বাকি; অন্ধকার হলেই রাস্তায় উঠে আসবে ক্ষুধার্ত নরপিশাচ ‘অ-মৃত’র দল; তার আগেই পৌঁছতে হবে সেতুর কাছাকাছি। তার মধ্যে দত্তাত্রেয়ও আবার সংক্রামিত; ও সুস্থ থাকতে থাকতেই চাইছিল চৌমাথা অবধি পৌঁছতে। সোজা রাস্তায় গিয়ে উঠলে দিকভুল হওয়ার কোন জো নেই; আমরা অন্তত কিছুটা অক্সিজেন পাব দৌড়ে প্রাণ বাঁচানোর জন্য।
অনেকটা পথ উজিয়ে একটা প্রশস্ত জায়গায় পৌঁছে শোওয়া অবস্থাতেই ঠেলাগাড়ির পিছনে তাকিয়ে যতটুকুনি চোখে পড়ল, মনে হল যে আমরা চৌরাস্তাটা অতিক্রম করেছি। দত্তাত্রেয়র সিধা দৌড়নো দেখেও বুঝতে পারলাম যে অনুমানটা অভ্রান্ত। গাড়ির গতিবেগ অবশ্য অনেকটা কমে এল; মনে হল খুব জোর শ্বাস টানতে টানতে এগোচ্ছে ও, যদিও গাড়ি থামে নি এক সেকেণ্ডের জন্যও। এইভাবে আরও মিনিট দশেক একটানা ঢিমেতালে চলে অবশেষে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে পড়ল এক জায়গায় দত্তাত্রেয়! ওর শরীর ঝুলে গিয়েছে, মাথাটা কাত হয়ে এলিয়ে রয়েছে একদিকে, শরীরের পুরো ভরটা এসে পড়েছে টানাগাড়ির হাতলের ওপর।
বুঝলাম, ব্যাপারটা কি। মন ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। নেমে যেতে ইচ্ছে করছিল গাড়ি থেকে; কিন্তু দত্তাত্রেয় পইপই করে বলেই দিয়েছিল কোন অবস্থাতেই আমরা যেন গাড়ি থেকে না নামি। পাশেই বাবু অকাতরে ঘুমোচ্ছে। বেশ কয়েকবার ওর গায়ে হাত দিয়ে দেখেছি- সব স্বাভাবিকই আছে। এখন বেশ কিছুটা লম্বা সময় গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকাতে বাবুর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে দোনোমোনো করতে লাগলাম। নেমে পড়ে হাঁটা লাগাব জীবনের দিকে সন্তানসমেত, নাকি গাড়ির ভিতরে অপেক্ষা করব সপুত্র- মৃত্যুর আশায়?
শেষে সব দ্বিধা কাটিয়ে উঠে যখন নামতে গেলাম- আচমকা গাড়ির চাকা নড়ে উঠে গড়াতে শুরু করল সামনের দিকে। আর কোন কথা না বাড়িয়ে আড়ষ্ট হয়ে শুয়ে পড়লাম টানাগাড়ির ভিতর, বাচ্চাকে একহাতে জড়িয়ে। গাড়ি যাতে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছায়, তার ব্যবস্থাও বুদ্ধি করে আগেই করে রেখেছিল দত্তাত্রেয়। এই গাড়ি এখন স্রেফ সামনের দিকেই যাবে…তার ভুতুড়ে চালকের সৌজন্যে। আমাদের শুধু পড়ে থাকতে হবে ভিতরে, মুখে কোন শব্দ না করে…
কতক্ষণ এইভাবে কাটল জানি না; সূর্যও প্রায় ডুবু-ডুবু; আশপাশ থেকে অন্ধকারের পিশাচগুলির রক্তহিম করা আওয়াজ শোনা যাচ্চে মাঝে মধ্যে। এই জায়গায় ওদের সংখ্যাধিক্য বেশি এ কথা আগেও বলেছিল দত্তাত্রেয়; ও চেয়েছিল এই এলাকাটিকে গোটা দিনে অতিক্রম করতে। এই নেকড়েগুলি মধ্যিখানে চলে না এলে আমরা এতক্ষণে ক্যাম্পে-
হঠাৎ একবার একটা ফায়ারিং-এর আওয়াজ কানে এল, তারপরই থেমে গেল আমাদের টানাগাড়ি! কিন্তু, ফায়ারটা করল কে? ধারেকাছে কি কোন ‘অ-মৃত’ চলে এসেছিল? দত্তাত্রেয়ই কি ফায়ার করেছে? কিন্তু ওর সব অস্ত্রই তো আমার কাছে; তাছাড়া ওর হাত-পা বাঁধা, সম্পূর্ণ সংক্রামিত হয়ে গিয়েছে ও- এই অবস্থায় ও ফায়ার করবেই বা কি করে?
আশা ও অবিশ্বাসের দোলাচলে ইতস্তত করে মুখটা তুলে চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম- প্রায় চলে এসেছি ভাঙ্গা সেতুর কাছে; কিছুটা দূরেই দাঁড়িয়ে রয়েছে সেটি, আর-
আর তার ঠিক পাশেই একটি বিশাল বড় দেওয়াল! কংক্রীট নির্মিত এই দেওয়ালের মাথার ওপরে দূর থেকেও পরিষ্কার বুঝতে পারছি বেশ কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে, হাতে বন্দুক নিয়ে। সাথে সাথে হাত তুলে একটি বিশেষ কায়দায় অভিবাদন জানালাম যাতে ওরা আমাকে ‘অ-মৃত’ ভেবে গুলি না করে বসে! তারপর টানাগাড়ি থেকে নেমে এলাম দত্তাত্রেয়কে দেখতে। গাড়িতে চাপবার পর ওর মুখ আর দেখতে পাই নি এতক্ষণ ধরে। এখন সামনে গেলাম, দেখলাম, আর চমকে উঠলাম!
মৃত্যুর কাঠিন্যে কঠিন হয়ে আসা একটি বিকৃত মুখ; খুলির কাছটা গুলি লেগে ফেটে চৌচির! সদ্য সংক্রামিত হওয়ায় দৈহিক কোন বিকৃতি আসে নি বটে, কিন্তু চোখদুটি ধোঁয়াটে সবুজ হয়ে গিয়েছিল এর মধ্যেই। ওর মৃতদেহ কিন্তু মাটি ছোঁয়নি, বাঁধা হাত আর টানাগাড়ির হাতলের সৌজন্যে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই মারা গিয়েছে ও! বর্তমান সময়ের নিরিখে ছবিটি বেশ প্রতীকি বলে মনে হল। দত্তাত্রেয়র মৃত্যু কিন্তু রিলিফ ক্যাম্পের গার্ডের গুলি লেগে হয় নি, ওর মৃত্যু হয়েছিল চৌরাস্তা অতিক্রম করে, বেশ খানিকটা পথ উজিয়ে এসে। সেই তখন, যখন ওর পাদুটি কিছুক্ষণের জন্য থেমে গিয়েছিল চলতে চলতে! রিলিফ ক্যাম্পের গার্ডের ছোঁড়া বুলেট ওকে অব্যাহতি দিয়েছে মাত্র, একটি অভিশপ্ত ভবিষ্যতের হাত থেকে!
হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে দ্বিতীয়বারের জন্য কান্নায় ভেঙে পড়লাম। এই অচেনা, বলা ভাল স্বল্প-চেনা লোকটির জন্য। ও কিন্তু কথা রেখেছে; অক্ষত অবস্থায় আমাদের রিলিফ ক্যাম্পে পৌঁছে দিয়ে। ওর কাঁধে একটা হাত রেখে ফিসফিসিয়ে বললাম-
প্রতিজ্ঞা করছি বন্ধু, তোমার মত শোচনীয়, অসহায়ভাবে আর কোন ‘অমৃতের মৃত্যু’ যাতে না হয়, সেই ব্যবস্থা করব আমি। তুমিও আমার কাছে আর ‘অ-মৃত’ নও, ‘অমৃত’। মানুষকে দুঃসময়ে পথ দেখাবার স্পর্ধা।
একটা হালকা, ঝিরঝিরে বাতাস আলতোভাবে আমার কানের লতি ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল; যেন না-বলা, অনুচ্চারিত কিছু শব্দ ছুঁয়ে গেল আমার কানদুটিকে। বেশ কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম দত্তাত্রেয়র মৃত মুখের পানে; তারপর এগিয়ে গেলাম টানাগাড়ির দিকে। বাবুর অল্প অল্প জ্ঞান ফেরৎ এসেছে, একটু একটু নড়ছে ও। প্রথমে তূণীরটিকে ঝুলিয়ে নিলাম পিঠে, ধনুকটিকে আর রাইফেলটিকে ঝোলালাম দুই কাঁধে। পিস্তলটা গুঁজে নিলাম প্যান্টে। পরিস্থিতি কোনদিকে গড়াবে জানি না, তৈরি থাকাই শ্রেয়। ‘নেকড়ে’ গোষ্ঠীর কাছে খবর কোথা থেকে এল তা এখনও পরিস্কার নয় আমার কাছে। তারপর বাবুকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিলাম গাড়ির থেকে। মৃত দত্তাত্রেয়র দিকে তাকালাম একবার, তারপর একটি গাড়িকে এগিয়ে আসতে দেখে এগিয়ে গেলাম সেদিকে। গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল দুই যুবক, বন্দুক হাতে।
-“এই ব্যাপারটা কি বলুন তো, ঠিক বুঝলাম না-”
হাতলে দড়ি-বাঁধা মৃতদেহটির দিকে ঈঙ্গিত করে আমায় জিজ্ঞাসা করলেন এক গার্ড। সেদিকে আলগোছে একবার তাকিয়ে উত্তর দিলাম-
-“‘পাঁচ ঘন্টার রাস্তা যাবে দেড় ঘন্টায় চলে’!”
দুইজনে একবার এর-ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে নিল, কিছু বলল না। ব্যাপারটা বোধহয় ওদের মাথায় ঢোকে নি; এই নবীনতর প্রজন্মের কতজন ‘সুকুমার রায়’ পড়েছে সেটা আমার কাছে ঠিক পরিস্কার নয়। গম্ভীর মুখে উঠে বসলাম গাড়িতে। সামনে এক মহিলা বসে ছিলেন, উনি নিজের পরিচিতি দিলেন রিলিফ ক্যাম্পের একজন অফিসার হিসেবে। আমায় জিজ্ঞেস করা হল আমি কোনভাবে সংক্রামিত কি না। প্রত্যুত্তরে মাথা নেড়ে বললাম-
-“আমার নাম অরুন্ধতী মজুমদার। আমার বিশ্বাস, আমার স্বামী ডাঃ অনির্বান মজুমদার আপনাদের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন আমাদের ছেলের ব্যাপারে-”
-“কি বিষয়ে বলুন তো?”- কৌতুহলী হয়ে উঠলেন মহিলা। বাবু তখনও ঝিমোচ্ছে কোলে বসিয়ে। ওকে দেখিয়ে বললাম-
-“আমাদের ছেলে প্রাকৃতিকভাবে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে সক্ষম। ও ইমিউন। বছরখানেক আগে ওর ওপরে একটা আক্রমণ হয়, কিন্তু ‘অ-মৃত’র দংশনের পরেও ও প্রাণে বেঁচে যায়। এই যে, দেখুন-”
বাবুর কাঁধের কাপড় সরিয়ে পুরোন কামড়ের দাগটি দেখালাম মহিলাকে। বিস্মিত চোখে ওষ্ঠ চেপে তা দেখলেন উনি, এবং বাকি সকলেই। একটু গলা খাঁকড়ে বলতে শুরু করলাম-
-“আমার স্বামী ওর রক্তের নমুনা থেকে একটি প্রতিষেধক তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন; যদিও এটি একেবারে প্রাথমিক স্তরের প্রতিষেধক, প্রোটোটাইপ। এর ওপর বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন। এই যে-”
প্যান্টের পকেট থেকে ভায়ালটি বের করে দেখালাম ওনাকে।
-“ডাঃ মজুমদার আসেন নি?”- জিজ্ঞেস করলেন মহিলা।
জানলা দিয়ে বাইরে তখনও দেখতে পাচ্ছিলাম দত্তাত্রেয়র মুখটা; শেষ বিকালের পড়ন্ত সূর্যের আলো সরাসরি পড়েছে ওর মুখে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটি বুকচাপা দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে এল মুখ দিয়ে। প্রতিষেধক পকেটেই ছিল, এতে হয়তো প্রাণ বাঁচত ওর। কিন্তু…এই পদক্ষেপ লক্ষ লক্ষ লোকের প্রাণসংশয় করে ফেলত ঐ দণ্ডেই। অনির্বানও মৃত্যুর আগে মুখে তুলতে চায় নি এই ওষুধ; সেখানে আমি কি করে-
আর তাকাতে পারলাম না ওর মৃত মুখটির দিকে। ফিরে তাকালাম মহিলার দিকে, তারপর বললাম-
-“মাসদুয়েক আগে একদল ‘অ-মৃত’র হাতে মৃত্যু ঘটে ওঁনার। আপনারা তাড়াতাড়ি গাড়িটা ছাড়ুন। সূর্য ডুবল বলে। সামনে অন্ধকার রাত, আর আমাদের কাজ এখন শুরু হল মাত্র।”
রক্তিম সূর্যকে সামনে রেখে এগিয়ে চলল গাড়ি, একটি নতুন, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে।
তাং-১৪/০৩/২০২১
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আমাদের ব্লগগুলি আপনাদের কেমন লাগছে? অবশ্যই জানান আমাদের-