সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

The Legacy of Ram: Prologue- Part4 (দ্যা লেগ্যাসি অফ্ রাম: আদি পর্ব- অধ্যায়৪)- A mystery, post-apocalyptic fiction Bengali Novel series by Aritra Das

দ্যা লেগ্যাসি অফ্ রাম- আদি পর্ব (The Legacy of Ram- Prologue):  অধ্যায়৪  ( PART4 ) - A Bengali science fiction, mystery, suspense thriller and post-apocalyptic fiction novel series by Aritra Das, the Bengali writer   The Legacy of Ram: Prologue (আদি পর্ব) Part4 [দ্যা লেগ্যাসি অফ্ রাম- আদি পর্ব (প্রলগ) গল্পটির প্রথম তিনটি পর্ব প্রকাশিত হয়ে গিয়েছে, পেজে গল্পের শেষে অন্যান্য লিঙ্কগুলি পাওয়া যাবে। অবশ্যই পড়বেন] দ্যা লেগ্যাসি অফ্ রাম: আদি পর্ব- অধ্যায়৪ অধ্যায়৩ থেকে শেষের কিছুটা অংশ- -“অভিযুক্ত… দ্যূহ… অভিযুক্ত… দ্যূহ… দ্যূহ…” একটি কথাই পর্যায়ক্রমে উচ্চারণ করে চলেছে ‘মদন’! অস্পষ্টভাবে ‘ব্যূহ’ কথাটি মহর্ষির কানে শোনাল ‘দ্যূহ’। কিন্তু সেদিকে তখন মন নেই তাঁর, তিনি শুধু বিস্মিত এই ভেবে যে এই আদিম মানব দম্পতি তা হলে কথা বলতেও সক্ষম! তিনি আবিষ্ট হয়ে তাকিয়েই থাকলেন তাদের দিকে। -“বিচারকরা সকলেই আপনার জন্য অপেক্ষমান, মহর্ষি! চলুন, আর বেশি দেরি করা উচিৎ হবে না। আমি উপযাচক হয়ে এগিয়ে এসেছিলাম আপনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আসুন।” -“আমাকে পথ দেখান, ভগবান!”   মাথা নীচু করে ভগবান শ্রীবি

Dahana- A Bengali science fiction, suspense thriller, action story of a little princess by Aritra Das

 

Source: Pixabay

দহনা

-অরিত্র দাস


জমাটবাঁধা অন্ধকার শীতল একটি রাত, তার সাথে অবিরাম পাল্লা দিয়ে ঝরতে থাকা সূঁচের মত ধারালো বৃষ্টির ফোঁটা। বছর দশেকের মেয়েটি অবাক চোখে তাকিয়ে ছিল সামনের দিকে। তার আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা বাকি সকলের মত সেও যেন নির্বাক, কাঠের পুতুলের মত স্থির; যেন সেও প্রতীক্ষায় আসন্ন ও অবশ্যম্ভাবী কোন একটি ঘটনার অপেক্ষায়। কিন্তু কি হবে, ফাঁকা, রুক্ষ, জনমানবহীন এই মাঠটিতে?

পাশে দাঁড়িয়ে তার দাদা; বয়সে সামান্যই ফারাক দুই ভাই-বোনের। চুপ করে সেও তাকিয়ে ছিল সামনে। বেশ খানিকক্ষণ এইভাবে চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে বিরক্তি ধরে গেল বাচ্চা মেয়েটির; এত দীর্ঘক্ষণ চুপ করে থাকতে সে অভ্যস্ত নয়। কিন্তু কথা বলতে গেলেই সবাই তাকে এরকমভাবে বকে থামিয়ে দিচ্ছে কেন? বাধ্য হয়ে শেষে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দাদাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে উঠল সে-

-“দাদা, আমরা এখানে দাঁড়িয়ে কেন রে? চল না ঘরে ফিরে যাই!”

বয়সে বড় দাদা গম্ভীরভাবে একবার ফিরে তাকাল নিজের বোনের দিকে; অন্ধকারের মধ্যে ঠিক বোঝা গেল না তার মুখের অভিব্যক্তি। তারপর সে বললে-

-“ঘরে আর ফেরা হবে না রে দহি! আমাদের এখন সামনেই এগোতে হবে-”

-“কোথায়?”

-“ঐ দূরে পরপর ঐ আলোগুলি দেখতে পাচ্ছিস?”

 

অন্ধকারের সীমানার মধ্যেই দূরে, অনেকটা দূরে পরপর কয়েকটি আলোর রেখা দেখা যাচ্ছিল এখান থেকে, সেদিকে ইশারা করে দেখাল দাদা। ভালো করে সেদিকে তাকিয়ে এবার ঘাড় নাড়ল মেয়েটি।

 

-“ঐ আলোটা ঠিক যেখান থেকে শুরু, সেই জায়গাটিকে ‘গ্রীন জোন’ বলে। ওটা স্বর্গ রে! ওখানে ভালো খাবার আছে, শ্বাস নেওয়ার জন্য পরিষ্কার বাতাস, ওখানকার বাড়িগুলো বড় ঝড় আর বর্ষার জলকে বাইরেই ঠেলে রাখে, ঘর ভিজতে দেয় না, সব থেকে বড় কথা ওখানে হতচ্ছাড়া ভাইরাসটা একদমই নেই, আর…আর ওখানে ভালো ভালো চকলেট পাওয়া যায়; তুই খাবি তো চকলেট?”

চকলেট জিনিষটা কোনদিনই খায় নি বাচ্চা মেয়েটি, কিন্তু দাদা যখন বলছে তখন নিশ্চই ভালোই হবে ব্যাপারটা। বড় মুখ করে ভালো করে ঘাড় নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলল মেয়েটি; তারপর বলল-

 

-“আচ্ছা দাদা, ওখানে কারা থাকে রে? ওদের হাতে ভালো খাবার, ভালো বাড়ি, পরিষ্কার বাতাস আর আমাদের জন্য লবডঙ্কা কেন?”

-“ওদের হাতে প্রচুর পয়সা রে দহি। ঐজন্যই ওরা ওখানে থাকে, সব ভালো জিনিষ পায়, আমরা পাই না!”

-“তাহলে ওদের কাছ থেকে কিছু পয়সা নিয়ে আমাদের দিয়ে, আমাদের ঐদিকে যেতে দেয় না কেন?”

কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ছেলেটি; কিন্তু তার আগেই তাদের পাশে দাঁড়ানো বুড়োটার খ্যাঁকখ্যাঁকানিতে ছেদ পড়ল ভাই-বোনের নিজেদের মধ্যে আলাপচারীতায়-

-“তোরা থামবি? তখন থেকে বকবক; কানের ঘিলু অবধি পচিয়ে দিলে! ওরা তোদের কথা শুনতে পেলে এক্ষুণি গুলি চালিয়ে দেবে- চকলেট খাওয়া তখন বেরিয়ে যাবে! বগাড়ু কোথাকার!!”

 

অন্ধকারের মধ্যেই নিজের ঠোঁটে আঙুল রেখে বোনের দিকে তাকাল দাদা; তারপর আবার মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে রইল সামনের দিকে। দাদাকে অন্যদিকে তাকাতে দেখে চুপ করে গেল মেয়েটিও। এই দাদুগুলো এত বেশি বকে-

বৃষ্টির বেগ আরও বাড়ল, তার সাথে শোঁ শোঁ শব্দে ঝোড়ো হাওয়া। একটি মাথা-ঢাকা জ্যাকেট পড়েছিল মেয়েটি তীব্র শীতের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাবার জন্য; ওদের দুজনের মা জ্যাকেটটি পড়িয়ে দিয়েছিল ওকে আদর করে। এখানে আসবার সময় শেষ যে বাড়িটায় ওরা আশ্রয় নিয়েছিল একটা রাতের জন্য, সেই ফাঁকা বাড়িটার কোন একটি ঘরের কোণায় একটা ভাঙ্গা চেয়ারের ওপর অবহেলায় পড়ে ছিল জ্যাকেটটি। মা অবশ্য ঐ বাড়িটা থেকে আর বেরিয়ে আসেন নি…আসবার সময় ঠাণ্ডায় আর ক্লান্তিতে মেঝেতেই শুয়ে ছিলেন…বাবা অবশ্য বলেছিলেন মা পরে আসবেন-

-“শেষ টহলটা পাস করছে এদিক দিয়ে, প্রত্যেকে মাথা নীচু করে বসে পড়ুন-”

 

সামনের অন্ধকার থেকে যেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এল একজন লোক; কথাকয়টা বলেই তড়িৎগতিতে ছুটে আবার সামনের অন্ধকারেই মিলিয়ে গেল সে। সামনের সারির সবাই ততক্ষণে বসে পড়েছে মাথা নীচু করে, এবার বড়দের দেখাদেখি দুই ভাই-বোনও হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল সামনে। ঐ বসা অবস্থাতেই মেয়েটির কানে এল সামনের অন্ধকার থেকে ভেসে আসা একটি যান্ত্রিক ঘড়ঘড় শব্দ; কোনমতে মাথা তুলে ব্যাপারটা দেখবার চেষ্টা করল মেয়েটি। অন্ধকারে অনভ্যস্ত চোখে মেয়েটির মনে হল যেন অনেকগুলি উঁচু, ভারি গাড়ির ছায়া চলে গেল তাদের পাশ দিয়ে, সামনের ঐ প্রকাণ্ড মাঠটি অতিক্রম করে। অন্ধকারে এর থেকে বেশি আর কিছু চোখে পড়ল না।

-“ওরা চলে গেছে!”- পিছন থেকে ফিসফিস করে ভেসে এল বাবার গলা- “ওদের টহল দিয়ে এখানে ফিরে আসতে আরও পঞ্চাশ মিনিট সময় লাগবে। ততক্ষণে আমরা এই এলাকাটি নিশ্চই পেরিয়ে যাব।”

বেশ কিছুক্ষণ পর ভেসে এল একটি চাপা শিসের শব্দ- এটাই সংকেত। এতক্ষণ নিঃশ্বাস চেপে নিশ্চল হয়ে বসে ছিল অনুপ্রবেশকারীদের এই দলটি; এখন সংকেত পেতেই দৌড় শুরু হল তাদের। সামনের ফাঁকা মাঠটি অতিক্রম করে প্রথমে একটি কাঁটাতারের বেড়া পড়বে, কিন্তু তা নিয়ে বিশেষ ভাবিত নয় অনুপ্রবেশকারীদের কেউই। কথা অনুযায়ী ঐ বেড়াটি কাটা থাকবার কথা; ওখান থেকে অনেকটা দূরে একটি সেনা-ব্যারাক আছে বটে, কিন্তু সব কিছুর বন্দোবস্ত হয়ে আছে, কেউ চলে আসবে না ওখানে হুট করে। এখন শুধু ‘ওপারে সর্বসুখ আমার বিশ্বাস’ মন্ত্রের ডানায় ভর করে সামনের দিকে একনাগাড়ে দৌড়ে চলা; ‘গ্রীন জোন’-এ একবার ঢুকে পড়তে পারলেই-

মাঠটি এবড়ো-খেবড়ো, উঁচু-নীচু, অসমতল। জায়গায় জায়গায় খানা-খন্দ, তার মধ্যে আবার বৃষ্টির জল জমে একটি ডোবার আকার ধারণ করেছে সেগুলি। অন্ধকারে ছুটতে গিয়ে কেউ পড়ে গেল, কেউ আছাড় খেল; কিন্তু অনর্থক চোট-আঘাতের দিকে মনোযোগ না দিয়ে কোনমতে উঠে দাঁড়িয়ে আবার ল্যাংচাতে ল্যাংচাতেও একবগ্গা হয়ে তারা এগিয়ে গেল সামনে, শেষপ্রান্তের বেড়া লক্ষ্য করে। অন্ধকারে এইভাবে হাতড়াতে হাতড়াতে অবশেষে গোটা দলটি বেড়ার সামনে আসতেই-

হঠাৎ কোথা থেকে একসার আলো জ্বলে উঠল পর পর; কিছু বুঝতে না পেরে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সকলেই। একটানা অন্ধকারের মধ্যে চোখ সয়ে গিয়েছে তাদের; এখন হঠাৎ সামনের থেকে চোখ-ধাঁধাঁনো এই আলো যেন কার্যত কানা করে ফেলল তাদের! হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন সকলে, পুরো দলটা, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে। প্রত্যেকের কানে ভেসে এল উঁচু গলায় একটি সুস্পষ্ট নির্দেশ, আর তারপরই-

কর্কশ আওয়াজের পাশাপাশি শিসের আওয়াজ তুলে সবেগে ধেয়ে এল পরপর প্রাণঘাতী বুলেট; কিছু বুঝে ওঠবার আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়তে লাগল দেহগুলি। অনুপ্রবেশকারী দলটির কারোর হাতে কোনপ্রকার অস্ত্র ছিল না, অপরদিকে প্রতিরোধকারী দলটির প্রতিটি সেনার হাতেই বন্দুক; তাদের মুখ মুখোশে ঢাকা আর হাতের আঙুল প্রাণপণে টেনে ধরে রয়েছে ট্রিগার! ফাঁকা মাঠে সামনের অনুপ্রবেশকারী দলটিকে লক্ষ্য করে মেশিনগানাররা শুধু হাত ঘোরালো কয়েকবার; বারুদের গন্ধ আর বুকফাটা আর্তনাদের রেশ মিলিয়ে যেতে না যেতেই গোটা জায়গাটি খানিকক্ষণের মধ্যেই ভরে উঠল মৃতদেহের স্তুপে! তারপর একসময়- বন্দুকের কর্কশ শব্দ থেমে গেল। বৃষ্টিটা অবশ্য তখনও ঝরেই চলেছে একটানা! আর তার সাথে…প্রবল ঠাণ্ডা!!

 

-“সামনের সারির সৈন্যরা- এগোও!”

 

তীব্রস্বরে ভেসে এল দলপতির গলা। আদেশ পেতেই সামনের সারির জনাবিশেক বন্দুকধারী সৈন্যের দল সারি বেঁধে এগিয়ে চলল সেইদিকে, যেখানে লাশগুলি পড়ে আছে অঝোর বৃষ্টির মাঝখানে স্থবির হয়ে। প্রত্যেক সৈন্যের মুখ মুখোশে ঢাকা; অন্যায়কারীর মুখ মুখোসে ঢাকবার প্রয়োজন আছে বৈকি!

অকুস্থলে অবশ্য আর পরীক্ষা করে দেখবার কিছু ছিল না; অনুপ্রবেশকারীদের গোটা দলটি তখন মরে কাঠ হয়ে পড়ে রয়েছে পুরো মাঠটি জুড়ে! প্রত্যেকেই মৃত, কোন আহত ছিল না সেই দলটিতে। এক হিসেবে অবশ্য ঝামেলা কম- ‘বোবা আর মৃতদেহ কথা বলে না’। কাজ সেরে কতক্ষণে ব্যারাকে ফিরে বরাদ্দ সাড়ে চারশ এম.এল.-এর বোতলগুলি খোলা যাবে এই চিন্তাতেই মশগুল ছিল সকলে। প্রায় তিনশ জন অনুপ্রবেশকারীদের একটা দল, সবাই মৃত- আজকের কৃতিত্বে উদ্বেল ছিল সৈন্যরা সকলেই। এখন তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে একটু ফূর্তি করে নেওয়া- এটাই মনোগত সদিচ্ছা ছিল সকলের।

দুজন সেনা মূল দলের থেকে একটু বিচ্ছিন্ন হয়ে সরে ছিল মাঠটির প্রান্তসীমার দিকে। এখানেও পড়ে ছিল বেশ কয়েকটি বিক্ষিপ্ত মৃতদেহ। হতভাগ্য লোকগুলি বাঁচবার জন্য ঢুকে পড়তে চেয়েছিল অন্ধকারের আশ্রয়ে, কিন্তু সে সুযোগ কেউই পায় নি দেখা যাচ্ছে। এদের মধ্যে কেউ বেঁচে আছে কি না সেটাই খুঁজে দেখছিল দুজনে। এমন সময় বাচ্চাদের গলায় চাপা কন্ঠে ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ পেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে যান দুজনই। অদূরে দু-তিনটি লাশ পড়ে ছিল, মনে হল কান্নার আওয়াজ আসছে ঐদিক দিয়েই।

 

-“সাবধানে, আরিত্রীক!”

 

দ্বিতীয় মুখোসধারী সেনাটি চাপা গলায় সতর্ক করল প্রথমজনকে, তারপর দুজনেই আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল সেদিকে।

 

অদূরেই একটি ছোট খানা মতন ছিল, তার ধারে দুটি মৃতদেহ পড়ে ছিল। প্রথমটি একটি বাচ্চা ছেলের মৃতদেহ- গুলি লেগে মাথার একটি দিক প্রায় উড়ে গিয়েছে বাচ্চাটির; তার সামনে পড়ে থাকা একটি বয়ষ্ক লোকের মৃতদেহের জামা খামচে ধরে রেখেছিল বাচ্চাটির ছোট মুঠিটা। এই বয়ষ্ক লোকটি মনে হয় বাচ্চাটির বাবাই হবেন, তিনিও অবশ্য আর বেঁচে নেই তখন; তার পিঠের মেরুদণ্ড সটাং ভেঙে দিয়েছে দশ ইঞ্চির একটি ট্রেসার গুলি। উপুড় হয়ে মরে গেছেন লোকটি, তার হাতদুটি বাড়ানো সামনের খানার দিকে। এক পা-এক পা করে এগিয়ে এসে খানাটির মধ্যে উঁকি মেরে অবাক হয়ে গেলেন আরিত্রীক নামের সেনাটি!

টর্চের আলোয় দেখা গেল- খন্দের মধ্যে পড়ে একটি বাচ্চা মেয়ে, জল-কাদায় পুরো মাখামাখি হয়ে! মেয়েটি কিন্তু জীবন্ত; ফুঁপিয়ে কাঁদছিল সে, এরই কান্নার আওয়াজে আকৃষ্ট হয়ে এগিয়ে এসেছিলেন তারা দুইজন। এখন দ্বিতীয় সেনাটিও এসে দাঁড়াল ‘আরিত্রীক’ নামক প্রথম সেনাটির পাশে বন্দুক উঁচিয়ে, কিন্তু বাচ্চা মেয়েটি ঠিক সেইসময় টর্চের আলো চোখে পড়াতে মুখ তুলে তাকায় ওপরের দিকে; তার নিষ্পাপ, কান্নাভেজা মুখের দিকে তাকিয়ে হাতের উদ্যত বন্দুক নেমে আসে দুজনেরই!


-“তুমি উঠে আসতে পারবে?”

 

যতটা সম্ভব শান্ত, সংযত গলায় প্রশ্ন করলেন আরিত্রীক; উত্তরে তার হাতের বন্দুকের দিকে ভীত, সন্ত্রস্ত চোখে তাকাল মেয়েটি।

 

-“না না, ভয়ের কিছু নেই…এই দেখ আমার দু হাত খালি! তুমি উঠে এস…এই দেখ, চকলেট! তুমি চকলেট খাবে?”

 

মুখোস পরা বন্দুকবাজ দুজন ইউনিফর্ম পরা সেনাকে দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল; এখন এদের একজনের হাতের চকলেট দেখে একটু শান্ত হল সে, ফুঁপিয়ে কান্না বন্ধ করে ডাগর চোখ মেলে কিছুক্ষণ একদৃষ্টে সে তাকিয়ে রইল রাংতায় মোড়া চকলেটটির দিকে, তারপর খানা থেকে উঠে এসে হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিল তার দিকে বাড়িয়ে ধরা চকলেটখানা। একটা কোণ ভেঙে একটুখানি মুখে দিয়েই অবশ্য ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠল মেয়েটি।

 

-“কি হল তোমার? চকলেট ভালো নয়?”

-“আমার দাদা আমাকে চকলেট খাওয়াবে বলেছিল-”

-“তোমার দাদা! কোথায় তোমার দাদা?”

-“ঐ যে! আর ঐ তো বাবা!”

 

তাদের ঠিক পিছনেই অদূরে গুলি লেগে পড়ে ছিল যে বাচ্চা ছেলেটি আর বয়ষ্ক লোকটির মৃতদেহ, তাদের দিকে আঙুল তুলে দেখাল মেয়েটি। আবারও কেঁদে উঠতে যাচ্ছিল সে, ব্যাপারটা বুঝে চট করে মৃতদেহগুলির দিকে বাচ্চা মেয়েটিকে ঘুরিয়ে নিলেন আরিত্রীক, যাতে নিজের পরিজনের দিকে মেয়েটির আর দৃষ্টি না পড়ে। এবারে পরম মমতাভরে মেয়েটির গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন তিনি।

 

-“তোমার গায়ে গুলি লাগে নি তো?”

 

মাথা নেড়ে ‘না’ বলল বাচ্চা মেয়েটি; সে তখন একমনে চকলেট খেতে ব্যস্ত। ঘটনাক্রমও তাই বলছে; নিজেদের দিকে আসন্ন মৃত্যুর ধেয়ে আসা বুঝতে পেরে প্রথমে নিজের মেয়েকে খানার মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দেন বাবা, হয়তো ছেলেকেও বাঁচাতে চেয়েছিলেন তিনি, কিন্তু সময় পান নি! তাও আশ্বস্ত হতে পারলেন না আরিত্রীক, মেশিনগানের গুলির ভেদন-ক্ষমতা তিনি ভালো করেই জানেন; ঘুরিয়ে-ঘারিয়ে সার্চলাইটের আলোয় ভালো করে পরীক্ষা করে দেখে নিলেন মেয়েটির সর্বাঙ্গ, তারপর বললেন-

 

-“তোমার নাম কি?”

-“‘দহনা’।”- কচি গলায় উত্তর দিল মেয়েটি।

-“বাঃ, খুব সুন্দর নাম! কে নাম রেখে ছিলেন তোমার?”

-“বাবা।”

 

পলকের জন্য আরিত্রীকের দৃষ্টি ঘুরে গেল অদূরে শায়িত মধ্যবয়ষ্ক পুরুষটির মৃতদেহের দিকে; ঠাণ্ডায় আর প্রবল বৃষ্টির দাপটে ইতিমধ্যেই ‘ঠাণ্ডা গোস্ত’ হয়ে উঠেছে সেই মৃতদেহ! তারপর ঘুরে আবার প্রশ্ন করলেন তিনি মেয়েটিকে-

 

-“আর তোমার ঘাড়ের পিছনদিকটা করে এই পক্ষীরাজ ঘোড়ার ট্যাট্টুটা? এটা কে এঁকেছেন, তোমার বাবা?”

-“মা! ভারি সুন্দর ছবি আঁকত মা, অনেকের গায়ে এরকম ছবি এঁকে দিয়েছে মা আমাদের মহল্লায়-”

 

এক মনে চকলেট খেতে খেতে বলে উঠল মেয়েটি; জীবনে প্রথমবার চকলেট খাচ্ছে সে; প্রথমবার খাওয়া এই সুন্দর জিনিষটার আনন্দ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে চাইছে তার অবুঝ, বাচ্চা মন! একমনে খেতে খেতে এবারে পাল্টা প্রশ্ন করে বসল সে-

 

-“তোমার চোখের মণি এত সুন্দর, নীল হল কি করে?”

 

একথায় সজোরে হেসে উঠলেন আরিত্রীক; হাসতে হাসতেই তিনি বললেন-

 

-“আমার চোখের মণি ছোটবেলা থেকেই এরকম নীল; তুমি বরং আমায় ‘নীলকাকু’ বলেই ডেক, কেমন? এখন শোন, বাইরে খুব বৃষ্টি পড়ছে, আর তেমনই ঠাণ্ডা। চল, আমরা কোথাও গিয়ে বসি; তুমি আর আমি, কেমন? তুমি ভয় পাবে না তো?”

-“না…বাবা আর দাদা আসবে তো?”

 

একথায় পাশে দাঁড়ানো সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে নিলেন একবার আরিত্রীক; তারপর বাচ্চাটির দিকে ফিরে বললেন-

 

-“হ্যাঁ, ওরাও আসবেন খুব তাড়াতাড়ি; এই পাণ্ডেজিই ওদের নিয়ে আসবেন। এখন চল, আমরা ভিতরে যাই-”

 

বাচ্চা মেয়েটিকে একপ্রকার বুকে জড়িয়ে ধরে সঙ্গী পাণ্ডেকে নিয়ে এরপর অভিশপ্ত মাঠ ছেড়ে ধীরে ধীরে সেনা-ব্যারাকের দিকে পা বাড়ালেন আরিত্রীক।

 

=================================================================

 

বিপ বিপ…বিপ বিপ…

 

ডিজিটাল টাইমপিসের অ্যালার্মের শব্দে ঘুম ভাঙ্গল আরিত্রীকের; একটা হাই তুলে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলেন তিনি ঘাড়ে হাত বুলোতে বুলোতে। একরাশ বিরক্তি নিয়ে ফিরে তাকালেন অ্যালার্ম ঘড়িটির দিকে, তারপর একটা মৃদু চাপ্পড়ে বন্ধ করলেন ওটিকে। তারপর বিছানা থেকে উঠে টেবিলে রাখা কফি-মেকার থেকে একটু কফি বানিয়ে নিয়ে খেতে খেতে নিজের কেবিনের জানলার ধারে এসে দাঁড়ালেন তিনি।

 

বাইরের আকাশে সদ্য ওঠা নিটোল, গোল সূর্যের দিকে তাকিয়ে একটু অন্যমনষ্ক হয়ে গেলেন আরিত্রীক। বহু বছর পর আবার স্বপ্নে স্লীম্যানাবাদের সেই ভয়াবহ রাত ফেরৎ এল; মধ্যিখানে এতগুলি বছর ভুলেই গিয়েছিলেন তিনি, তার সেই দুঃস্বপ্নময়, কলঙ্কে ঢাকা অতীত ইতিহাস। বহু বছর পর স্বপ্ন হয়ে ফেরৎ এল সেই রাত। আর সেই মুখগুলো, যা বহু রাত ঘুমোতে দেয় নি তাকে প্রথমদিকে।

 

২১১৯সাল অবধি ভালোই ছিল পৃথিবী, মানে, ভালোভাবে থাকা বলতে যা বোঝায়। তখনকার মেরুকরণ হয়ে যাওয়া বিশ্বে বড়লোকরা গরীবদের নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাত না, প্রত্যেকে যার যার নিজের জীবন নিয়ে খুশি ছিল। কিন্তু হিসেব উল্টে যেতে শুরু করল তার পরের বছর থেকে। একটি অজানা ভাইরাস তোলপাড় করে দিল গোটা বিশ্বকে। রাজনীতিবিদরা যদি প্রথম থেকেই সতর্ক থাকতেন তাহলে সংক্রমণের হার নিম্নমুখী থাকত। কিন্তু দূর্ভাগ্যক্রমে তা হল না!

 

সংক্রমণ না কমে বাড়তেই লাগল, পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগল মৃত্যুর হার। আর যত দিন যেতে লাগল, পরিস্থিতি হয়ে উঠল আরও ভয়াবহ। পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে একটি অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নিল বিশ্বের বিভিন্ন ভাইরাস-আক্রান্ত দেশের মাথারা। সৃষ্টি হল অঞ্চলভিত্তিক কিছু ‘পকেট-ইউনিট’, যেগুলির পোশাকি নাম- ‘গ্রীন জোন’। এই অঞ্চলগুলি তৈরি করা হয়েছিল অসংক্রামিত মানুষদের আশ্রয়স্থল হিসেবে। রীতিমতন কড়া শারীরিক পরীক্ষার পর এখানে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হত।

 

উদ্দেশ্য সাধু এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু বখেড়া দাঁড়িয়ে গেল অন্যত্র। গরীব-বড়লোক নির্বিশেষে যেখানে থাকবার কথা ছিল সকল স্তরের সুস্থ মানুষদের, সেখানে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে সৃষ্টি হল দুই শ্রেণীর বিভাজন- অর্থের মানদণ্ডে! বড়লোকরা জায়গা করে নিল গ্রীন জোনের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের কাঁটাতারের বেড়ার পিছনে। ভালো খাবার, স্বাস্থ্য পরিষেবা, জীবনের উপযোগী সবরকম রসদ নিয়ে একদম আলাদা একটি বিশ্ব। আর তার বাইরে রয়ে গেল গরীব ও মধ্যবিত্ত জনতা! ভাইরাসের দাপটে লোক মরে ধূলিধাবাড় হতে লাগল; যারা বেঁচে রইল তাদের একটি বড় অংশ চলে গেল অনাহারে, অপুষ্টিতে।

 

তবে এদের মধ্যে সবাই যে পরিস্থিতিকে মাথা নীচু করে মেনে নিয়েছিল তা কিন্তু নয়।

 

এদের মধ্যে কিছু লোক সবসময়ই চেষ্টা করত লুকিয়ে গ্রীন জোনের এপারে চলে আসতে, বড়লোকদের জন্য তৈরি হওয়া এই প্রমোদ কাননে নিজের ক্ষীণ অস্তিত্বের থাবা বসাতে। মূলতঃ এই ধরণের অনুপ্রবেশকারীদের ঠেকানোর উদ্দেশ্যেই সেনাবাহিনীর থেকে বাছাই করা সৈন্যদের নিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল বিশেষ একটি ইউনিট- ‘কুম্ভ’। কোন উদ্দেশ্যে এরকম অদ্ভুত নামকরণ হয়েছিল তা জানা নেই, কিন্তু নামকরণ যে সার্থক এ বিষয়ে কোন সন্দেহই নেই- নকল বুঁদিগড় রক্ষার দায় তো এই নামধারী ব্যক্তিই নিয়েছিলেন, নাকি?

 

এই বিশেষ ইউনিটের একটি শাখায় কাজ করবার সুবাদেই স্লীম্যানাবাদের গ্রীন জোন অঞ্চলের বাইরে অবৈধ অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সেদিন মোতায়েন ছিলেন আরিত্রীক ও পাণ্ডে- দুই বন্ধু। ভাগ্যিস ছিলেন! নাহলে এরা কেউ রাষ্ট্রের এই ভয়াবহ দিকটি সম্পর্কে জানতে পারতেন না! কি দোষ ছিল ঐ তিনশ জন অনুপ্রবেশকারীর? ওরা তো কেউ সন্ত্রাসবাদী ছিলেন না। সীমানা পেরিয়ে অস্ত্র হাতে ওরা তো একটা অঞ্চলের দখল নিতে আসেন নি! ওরা তো শুধু প্রত্যাখ্যান করেছিলেন নিজেদের ঘাড়ের ওপর সদাজাগ্রত মৃত্যুর শীতল স্পর্শকে, ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছিলেন নিরুদ্বিঘ্ন জীবন, তাহলে এই নিরস্ত্র মানুষগুলিকে হত্যা করে রাষ্ট্রের কি লাভ হল? ‘পেস্ট কন্ট্রোল’?

 

-“ক্যাপ্টেন আরিত্রীক, আপনার জন্য একটি স্পেশাল আপডেট…ক্যাপ্টেন আরিত্রীক…”

 

অন্যমনষ্ক ভাবে নিজের হাতের তালুর দিকে তাকিয়ে পুরোন ক্ষতগুলিকে মনে করবার চেষ্টা করছিলেন আরিত্রীক; ভিতর থেকে ‘ভিস-কম’ যন্তের যান্ত্রিক মহিলা-ঘোষকের গলার আওয়াজে চটকা ভাঙল তার। কাছিয়ে এসে যন্ত্রটিকে সক্রিয় করতেই যন্ত্রের মধ্য থেকে হলোগ্রাফ ভিশনে এক মহিলার আবক্ষ প্রতিরূপ ভেসে উঠল তার সামনে।

 

-“পাসওয়ার্ড বলুন।”

 

-“জিনি ইন আ বটল্।”

 

-“ধন্যবাদ। ক্যাপ্টেন আরিত্রীক, অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি আপডেট এইমাত্র এসেছে। সেনাবাহিনীতে আপনার কুড়ি বছর পূর্তি উপলক্ষে গ্রীন জোনে থাকবার অধিকার আপনি অর্জ্জন করেছেন। আপনি যদি এই সুবিধা লাভ করতে চান তবে এক নম্বর বোতামে চাপ দিন।”

 

কথামত এক নম্বর বোতামে চাপ দিলেন আরিত্রীক। এবার মহিলা-ঘোষক আবার বলে উঠলেন-

 

-“অজস্র ধন্যবাদ। গ্রীন জোনে আপনি পাবেন ফ্রি কোয়ার্টার, চিকিৎসা ও…”

 

-“সংক্ষিপ্ত করুন!”- রীতিমতন অধৈর্য্য হয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন আরিত্রীক; তিনি জানেন গ্রীন জোনে থাকবার সুবাদে কি কি বিশেষ সুবিধা তিনি লাভ করতে চলেছেন সেই তালিকা। অহেতুক তা শুনে সময় নষ্ট করতে চান না তিনি; বেশিক্ষণ যন্ত্রের সাহচর্য্য তার পছন্দ নয়।

 

-“দুঃখিত ক্যাপ্টেন। আপনার অন্তর্ভুক্তির প্রক্রিয়া শুরু করবার জন্য প্রথমে আপনার রেটিনার স্ক্যান হওয়া অত্যন্ত দরকার। সম্মত থাকলে এক নম্বর বোতামে চাপ দিন।”

 

চাপ দিতেই এবার যন্ত্রের পাশ থেকে একটি রেটিনাল স্ক্যানার চলে এল আরিত্রীকের সামনে। নিঃশব্দে সেই স্ক্যানারের পাত্রে নিজের চোখ লাগালেন আরিত্রীক। বেশ কিছুক্ষণ চলল স্ক্যানিং প্রক্রিয়া; তারপর একটি তীক্ষ্ণ ‘বিপ্’ ধ্বণিতে বোঝা গেল- স্ক্যানিং প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ।

 

-“আপনার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়েছে। তিন সপ্তাহ বাদে আপনার অন্তর্ভুক্তি হবে গ্রীন জোনে। শারীরিক পরীক্ষা ও অপরাপর সংশোধনের জন্য আপনার সংশ্লিষ্ট কমাণ্ডিং অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে দশদিন পরে। বিশদ তথ্য আপনাকে ইমেইল করা হবে। রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্যের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ, ক্যাপ্টেন আরিত্রীক। আপনার দিনটি শুভ হোক।”

 

মানসিকভাবে খুব ক্লান্ত বোধ করছেন আরিত্রীক; একটি অপরাধবোধ ফুটে উঠছে তার মনে। স্লীম্যানাবাদ…জায়গাটির নামকরণ কর্ণেল হেনরি স্লীম্যানের অনুকরণে। ব্রিটিশযুগের প্রথমদিকে এই অঞ্চলটিতে ‘ঠগি’ বলে একরকমের ডাকাতদের রাজত্ব ছিল; সেই ডাকাতদের পুরো গোষ্ঠীটিকে নাকি একা হাতে দমন করেছিলেন অকুতোভয় এই ব্রিটিশ অফিসার। শোনা যায়, ডাকাত দমনের মহান ব্রতে ব্রতী এই বিদেশি সামরিক পুরুষটি নাকি অন্ধকার রাত্রে একটি কালো পোশাকে সর্বাঙ্গ ঢেকে ডাকাতদের অঞ্চলগুলির ওপর দিয়ে হেঁটে যেতেন নির্দ্বিধায়; ডাকাত চোখে পড়লেই মুখোমুখি সংঘর্ষে হার মানাতেন তাদের! ভুলে যায় নি তাকে এখানকার তৎকালীন নিরন্ন, গরীবগুর্বো, সম্পূর্ণ ভিন্ জনগোষ্ঠীর মানুষজন; তাঁর নামে আস্ত অঞ্চলটির নাম হয়ে গেল ‘স্লীম্যানাবাদ’! অমর হওয়ার জন্য ব্রিট অফিসারটিকে বেঁচে থাকতে হয় নি বছরের পর বছর; আপন সুকৃতিতেই ইতিহাসের পাতা থেকে সরাসরি উঠে এসেছেন তিনি জীবন্ত মানুষদের মাঝে!

 

আর সেই পবিত্র ভূমিতে দাঁড়িয়ে এ কি কাণ্ড ঘটালেন তারা! অনুপ্রবেশের খবর তাদের কাছে আগে থাকতেই ছিল; ফাঁকা মাঠে নিরস্ত্র ঐ মানুষগুলিকে ঘিরে তাদের গ্রেপ্তার করা যেত, তারপর তাদের মেডিক্যাল টেস্ট করে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা করা যেত! কিন্তু…মেজর ধীঁলোন!! ধারই ধারলেন না এই খাটুনির, সরাসরি গুলি চালাবার আদেশ দিলেন তিনি। সিদ্দিকি- যে লোকটি অনুপ্রবেশের দায়িত্ব নিয়ে টাকা নিয়েছিল ঐ অসহায় জনতার কাছ থেকে তিনিই বা কম যান কিসে? ঐ নাচার, নিরুপায় জনতার কাছ থেকেও টাকা খেলেন, আবার সেনাবাহিনীর কাছ থেকেও টাকা নিলেন অনুপ্রবেশের স্থান ও তারিখ সঠিকভাবে জানিয়ে! ক্যাম্পে ঢোকবার সময় সিদ্দিকির সেই দাঁত বের করা হাসি টাকার বাণ্ডিলটি হাতে নিয়ে…সেদিন আরিত্রীকের হাত নিশপিশ করে উঠেছিল গুলি ছুঁড়ে রাস্কেলটাকে ওখানেই-

 

শব্দ করে বেজে উঠল ফোন। একরাশ বিরক্তি নিয়ে সেটির দিকে তাকালেন আরিত্রীক- ঘুম থেকে উঠে এ কি বিড়ম্বনা? পাণ্ডের ফোন দেখে অবশ্য বিরক্তি কেটে গেল তার; দুজনই অকৃত্রিম বন্ধু, দুজনেই এক সাথে ঢুকতে চলেছেন গ্রীন জোন-এ। ওকেও নিশ্চই কনফার্ম করা হয়েছে, এই জন্যই ফোন করছে ব্যাটা! হাসিমুখে ফোন রিসিভ করলেন আরিত্রীক।

 

-“আপডেট হল আরু?”- জিজ্ঞেস করলেন পাণ্ডে।

 

-“হ্যাঁ…তোরটা?”

 

-“এইমাত্র। আগে বলে রাখতে পারত…চোখের পিচুঁটি ধুয়ে আসতাম-” – হাস্যমুখে কথাগুলি ভেসে এল ফোনের ওপ্রান্ত থেকে। একথা-সেকথার পর মূল বক্তব্যে এলেন পাণ্ডে-

 

-“আরু, হেডকোয়ার্টার থেকে অর্ডার এসেছে; মানুষ-পারাপারকারীদের গ্যাং একটি বড় অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে বেরোবে খুব তাড়াতাড়ি; অনেকগুলি লোককে ওরা গ্রীন জোনে ঢোকাবার মতলব ভাঁজছে। ওদের হাতে ‘হলো ভিশন’ প্রযুক্তি পর্যন্ত চলে এসেছে…ফলে কোন জায়গা দিয়ে ওরা এই কাজটা করবে তা ধরা খুবই কঠিন। কিন্তু সেটা জানবার একটিই উপায় আছে।

 

খবর অনুযায়ী আজ দুপুর দুটোর সময় ওদের দলের মাথাগুলির একটা জায়গায় জড়ো হওয়ার কথা; অ্যাসাইনমেন্টের আগে ওরা নিজেদের মধ্যে কিছু আলোচনা সেরে নিতে চায়। আমাদেরকে দেখা করতে হবে ইস্ট এণ্ড গেটের সামনে; ওখানে পৌঁছনোর পর এই সাক্ষাৎকারের লোকেশন আমাদের জানানো হবে-”

 

চুপ করে বন্ধু পাণ্ডের কথা মনযোগ দিয়ে শুনছিলেন আরিত্রীক; বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে এসেছিল তার। আর তিনসপ্তাহ বাদে তার অবসর, তিনি চেয়েছিলেন তার আগে কোন বিপজ্জনক কনসাইনমেন্টের মধ্যে না যেতে…যাই হোক, খাতায়-কলমে অবশ্য তিনি এখনও কর্তব্যরত একজন সৈনিক, তাছাড়া পাণ্ডেও যখন যাচ্ছে-

 

কিন্তু একটি কথায় খটকা লাগল তার; মানুষ-পাচারকারীদের সাধারন একটা গ্যাং- হতে পারে তারা বর্তমানে এক ছাতার নীচে একজনই দলপতির হুকুম পালন করে এবং যথেষ্ট সুশৃঙ্খল, সংঘবদ্ধ এবং অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত শক্তিশালী একটি বিরাট দল- কিন্তু এরকম একটি দুর্বৃত্ত দলের কাছে ‘হলো ভিশন’ প্রযুক্তি এল কোথা থেকে? এ তো অত্যন্ত উচ্চ পর্যায়ের আর্মি-ডিভাইস, এটি অত্যন্ত জটিল ও এর পরিচালনা বেশ শক্ত। এই যন্ত্রের সাহায্যে কোন একটি অঞ্চল দিয়ে যদি এক কোম্পানি সৈন্য যাতায়াত করে, আর এই ডিভাইসটি যদি সক্রিয় থাকে, তবে বিপক্ষ সেনা জায়গাটিকে ফাঁকাই দেখবে, কোন লোককে এর ভিতর দিয়ে দেখতে পাবে না। তাহলে এরকম একটি ডিভাইস গুণ্ডাদের দলে এল কি করে?

 

-“কুকুরদের মুখে রুটি না ছুঁড়ে আমরা যদি তখনই ওদের মেরুদণ্ড ভেঙে না দিতাম তবে আজকে এই দিনটি দেখতে হত না পাণ্ডে! একইসাথে জনতা ও আমাদের টাকায় পুষ্ট হয়ে ধীরে ধীরে এরা আমাদের একটা বিরুদ্ধ শক্তিতে পরিণত হয়েছে; আর এদের হাতে আমাদের অস্ত্র যাওয়ার মানে বুঝতে পারছিস ভাই? আমাদের ভিতরে এদের লোক রয়েছে-”

 

-“আরু…আরু…রাগ করিস না ভাই…আমরা না গেলে নতুন ছোঁড়াগুলো কিছুতেই সুবিধা করতে পারবে না এদের সঙ্গে, এখন তো মেজর ধীঁলোন-ও স্বেচ্ছাবসর নিয়ে নিয়েছেন-”

 

-“রাগ করে আমার আর লাভ নেই পাণ্ডে- আমরা এখন এই সার্কাসের আর তিন সপ্তাহের অতিথি…কটায় আসবি তুই?”

 

-“সাড়ে বারোটা। তৈরি থাকবি। এটাই আমাদের শেষ কনসাইনমেন্ট। এরপর দেখা হবে নতুন পৃথিবীতে-”

 

ফোনটা কেটে একটা সিগারেট ধরিয়ে নিলেন আরিত্রীক। তিন সপ্তাহ বাদে পৃথিবীটা তাদের কাছে হয়তো নতুন হবে, কিন্তু স্মৃতিগুলিও কি মুছে আবার নতুন হয়ে যাবে? বিশেষ করে নতুন রূপ ধরে সেটি যদি আবার ফেরৎ চলে আসে বাস্তবে? উদাসীন হয়ে মাথা উঁচু করে কেবিনের ছাদের দিকে তাকিয়ে একমনে ভাবতেই লাগলেন আরিত্রীক…

 

=================================================================

 

বড় আয়নার সামনে বসে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বিমূঢ় হয়ে বসে ছিলেন সিল্ক। এই নামেই তিনি পরিচিত তার বিশ্বে।

 

খানিকক্ষণ আগে নির্দেশ এসেছে তার কোঅর্ডিনেটরের কাছ থেকে; আজ আবার তাকে ফেরৎ যেতে হবে সেই খদ্দেরের কাছে। সেটা বড় বিষয় নয়- এক ঘন্টার মামলা, আর তার পরেই নগদ অর্থ। এটাই তো তার কাজ! অর্থের বিনিময়ে তার খদ্দেরদের সন্তুষ্ট রাখাটাই তো তার পেশা। কিন্তু সমস্যাটা অন্যত্র- এই লোকটির কাছে ফিরে যেতে তার ভিতরে ভিতরে একটা অস্বস্তি হচ্ছে; যদিও তার মতন একজন লাস্যময়ী পতিতার কাছে এই ধরণের কোন অস্বস্তি ব্যাপারটাই অস্বাভাবিক।

 

সিল্ক একজন উঠতি পতিতা। সুন্দরী, লাস্যময়ী, চটকদার মুখ, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ চামড়া ও টানটান চেহারার জন্য এই জগতে খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে যথেষ্ট সুনাম অর্জ্জন করেছেন তিনি। মালিকপক্ষও এরকম একটি টাটকা ফুলের পূর্ণ মালিকানার দুর্লভ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে নিয়েছে পূর্ণমাত্রায়; অন্যদের মত সিল্ককে যেতে হয় না যত্র-তত্র-সর্বত্র, শুধুমাত্র উঁচু মহলের জন্যই নির্দিষ্ট করা তার গতিবিধি। এই সূত্র ধরেই তাকে একদিন পাঠানো হয়েছিল এক আর্মি অফিসারের কেবিনে, সেনা ব্যারাকের ভিতর। নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দরজায় নক্ করতেই খুলে গিয়েছিল দরজা, বেরিয়ে এসেছিলেন অফিসারটি।

 

-“নমষ্কার, আমি সিল্ক; রেবেকার পরিবর্ত হিসেবে পাঠানো হয়েছে আমাকে। এখন থেকে ও আর আসতে পারবে না, তাই-”

 

-“চলে এস!”

 

একটি প্রবল হ্যাঁচকা টানে ঘরের ভিতর অফিসারটির প্রশস্ত বুকের ওপর যেন সবেগে আছড়ে পড়লেন সিল্ক; প্রথমে একটু অবাক হলেও পরক্ষণে খিলখিলিয়ে হেসে উঠেছিলেন তিনি! দুটি বিষয় স্বস্তি দিয়েছিল তাকে; প্রথমত- লোকটি আদত একজন ‘টিন ক্যান’; যার অর্থ- পুরোন শরীরের প্রতি কোন অনুভূতিই কাজ করে না তার, কর্মক্ষেত্রে নতুন উদ্যমে এগিয়ে চলবার রসদ ইনি সংগ্রহ করে নেন যেকোন শরীর থেকে। এই বিষয়টি একটি বড় স্বস্তি, কারণ আসবার সময় গোটা পথটাই সিল্ক এটাই ভাবতে ভাবতে আসছিলেন যে কেমন করে পুরনো শরীরের সঙ্গে যে অ্যাটাচমেন্ট, তা ভাঙা যায়। তিনি ধরেই রেখেছিলেন যে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে তাকে, কিন্তু বাস্তবে সেরকম কিছুই ঘটল না! দ্বিতীয় ব্যাপারটি অবশ্য আরোই স্বস্তির- এনার যা বয়স, তাতে বেশিক্ষণ সময় লাগবে না। এর অর্থ- উপরি আয়ের দুর্লভ সুযোগ! সকলেই তো ‘উপরি আয়’ পছন্দ করে, না কি?

 

বেশ খানিকক্ষণ একটা ছোটোখাটো ঝড় চলবার পর মনে হল ফোর-প্লে খেলে একটু বেশিই তেতে উঠেছেন ভদ্রলোক- সোফার সামনে একটি ছোট চেয়ারের ওপর বসে এবার তিনি কাছে টেনে নিলেন সিল্ককে। পিঠে একটা লম্বা চুমু খেয়ে এবার হাত দিয়ে চুলের গোছা সরিয়ে ঘাড়ের কাছে একটি চুমু খেতে যেতেই-

 

যেন জোঁকের মুখে একদলা নুন মেরে দিল কেউ; একদমই নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলেন তিনি! পিছন থেকে কোন সাড়া-শব্দ না পেয়ে মাথা ঘুরিয়ে পিছনে তাকাতে যাবেন- এমন সময় প্রবল এক ধাক্কায় সিল্ক ছিটকে পড়লেন সামনের সোফাটির ওপর! ধাক্কাটা ভালোই জোর মারা হয়েছিল, মুখটা টনটনিয়ে উঠল ব্যথায়। মনে বিরক্তি ও মুখে হাসি নিয়ে সোফার ওপর বসে পড়লেন সিল্ক; পরণের জামাকাপড় ঠিক করতে করতে বললেন-

 

-“কি ব্যাপার? ডোজটা একটু বেশি পড়ে গিয়েছে নাকি?”

 

অদূরে থাকা ডিভানের নীচ থেকে বেরিয়ে আসা একটি মদের বোতলের ছিপিখোলা মুখের দিকে তাকিয়ে হালকা উষ্মার সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন সিল্ক, এর থেকে বেশি রাগ তিনি দেখালেন না। বেশি রাগ তার মৃত্যু ডেকে আনতে পারে; মাতালদের আত্মাভিমান খুব সাংঘাতিক হয়।

 

লোকটিকে দেখে অবশ্য মনে হল গোটা ব্যাপারটায় যথেষ্ট অনুতপ্ত তিনি; হাত দেখিয়ে ইশারায় ‘দুঃখিত’ বললেন, তারপর দুহাতে মাথার দুপাশের রগ টিপে ধরে চেয়ারটিতে হেলান দিয়ে বসে রইলেন তিনি কিছুক্ষণ। খুব জোরে জোরে শ্বাস পড়ছিল তার।

 

তাড়াহুড়ো দেখালেন না সিল্ক। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ব্যাপারটা। এই বয়সে পৌঁছে সচরাচর ক্ষণিকের উত্তেজনায় এসব ব্যক্তিরা অদম্য উৎসাহ দেখাতে যান, কিন্তু শরীর যখন প্রাকৃতিক নিয়মে আর সঙ্গ দেয় না তখন প্রবল মানসিক চাপের সামনে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হন এরা; অথচ মুখ ফুটে সেকথা তারা স্বীকারও করেন না। একটা অদ্ভুত হীনমন্যতায় ভুগে চাপা কষ্টটিকে নিজের মধ্যেই রাখতেই চান, ফলে-

 

একটু অনুকম্পা বোধ করেন সিল্ক সামনের চেয়ারে বসা লোকটির প্রতি। এত সুন্দর সুঠাম দেহ এনার, এত সুন্দর নীল দুটি চোখ, কিন্তু বয়স এনার ইচ্ছার পথে একটি প্রবল অন্তরায়। কিই বা সাহায্য করতে পারেন সিল্ক, প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে? চুপ করে বসে রইলেন তিনি সামনে। দীর্ঘক্ষণের একটি নীরবতার পর অবশেষে অফিসারটি মুখ খুললেন-

 

-“কে তুমি?”

 

-“কেন? বললাম যে আমি সিল্ক-”

 

-“মিথ্যে কথা!”

সিল্কের কথার মাঝখানে দাবড়িয়ে উঠলেন ভদ্রলোক; তারপর চেয়ার থেকে উঠে সামনের টেবিলে রাখা সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটি সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে আবার এসে বসলেন চেয়ারটিতে।

 

-“রেবেকা কোথায় এখন?”

 

-“ও এখন এখানে নেই। ওর অবসর হয়ে গিয়েছে-”

 

-“ও কোথায়?”

 

খানিকক্ষণ পূর্ণ দৃষ্টিতে অফিসারটির দিকে তাকালেন সিল্ক; তারপর বললেন-

 

-“ওকে অবসর দিয়ে গ্রীন জোন-এ পাঠানো হয়েছে-”

 

-“গ্রীন জোন? তুমি নিশ্চিত জান?”

 

এইবার একটু রেগে গেলেন সিল্ক; ইউনিফর্ম পরে বলে কি এরা ধরাকে সরা জ্ঞান করে নাকি? একটু উষ্মামিশ্রিত কন্ঠে অফিসারটির চোখে চোখ রেখে তিনি বললেন-

 

-“একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা অবধি আমরা বাইরের বিশ্বে থাকি, তারপর আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়-”

 

-“গ্রীন জোনে!”- সরোষে বলে উঠলেন সামনে বসা অফিসারটি- “আর তোমরা অবোধ শিশুদের মতন সে গাল-গল্পে বিশ্বাসও করে নাও-”

 

-“কেন? আমরা কেন যেতে পারি না ওখানে? সমস্যা কোথায়?”

 

-“এখানেই যে গ্রীন জোন-এর সবথেকে শস্তা যে হোটেলটি আছে তাতেও দুপুরের খাবারের পর যে বিলটি ধরানো হয় তা বাইরের সবচেয়ে দামী কোন হোটেলের থেকে চার-পাঁচগুণ বেশি ভারি- তুমি কি মনে কর যে তোমাদের ‘নির্দিষ্ট সময় অবধি’ পরিষেবায় সেই অনুপাতে সারাজীবন ওখানে বসিয়ে খাওয়ানো সম্ভব?”

 

একরাশ বিরক্তি নিয়ে থেমে গেলেন সিল্ক; এতক্ষণে তার ধৈর্যচ্যূতি ঘটছে। অফিসারটি অবশ্য কথা থামান নি-

 

-“তুমি বোধহয় খেয়াল কর নি, আমি একবারের জন্যও তোমার ‘ক্লিন মেডিক্যাল সার্টিফিকেট’ দেখতে চাই নি; তার কারণ- তোমার মালিকপক্ষ আমার বহুদিনের চেনা, আমি জানি তোমাদের কাজে নামানোর আগে প্রতিদিন একবার করে রুটিন চেকআপ হয়। তোমার বয়সের থেকে বেশিদিন ধরে আমি চিনি তোমার মালিকদের। অনেককে এভাবে আসতে-যেতে দেখেছি…আমার কথার উত্তর দাও…তোমার পড়াশোনা কদ্দুর?”

 

চুপ করে রইলেন সিল্ক। ব্যক্তিগত কোন প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার নিয়ম তাদের নেই। উত্তরের প্রত্যাশায় খানিকক্ষণ তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন অফিসারটি, তারপর যখন তিনি বুঝলেন এর কোন উত্তর হবে না, অধৈর্য্য হয়ে মাথা নেড়ে তিনি বললেন-

 

-“দেহ বিক্রী করে অন্ধকারের রাস্তায় চলে কি আনন্দ পাও তোমরা?”

 

এ কথায় যেন আগুন জ্বলে উঠল সিল্কের মাথায়; সোজা হয়ে বসে তিনি অফিসারটির চোখে চোখ রেখে বললেন-

 

-“লোকজনকে বিনা কারণে গুলি চালিয়ে মেরে ফেলে পৈশাচিক আনন্দ পাওয়ার থেকে ভাল দেহ বিক্রী করে অন্যকে আনন্দ দিয়ে উপার্জন করা- আপনার জন্য নির্দিষ্ট করা সময়সীমা পেরিয়ে গিয়েছে; আমি এখন যাব। আমার রেট-”

 

পার্স খুলে মিনি-সোয়াইপারটা বের করে এগিয়ে দিলেন সিল্ক; খানিকক্ষণ কড়াভাবে তার দিকে তাকিয়ে কোন কথা না বলে দাম মিটিয়ে দিলেন সামরিক পুরুষটি। ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসেন সিল্ক, দৃপ্ত পদক্ষেপে।

আয়নার সামনে বসে আগেরদিন ঘটে যাওয়া এই কথাগুলিই ভাবছিলেন সিল্ক, অন্যমনষ্কের মত নিজের চুল নাড়াচাড়া করতে করতে। এমন সময় দরজায় একবার নক হল; পরক্ষণেই দরজা খুলে ভিতরে আসলেন মনিকা- তার কোঅর্ডিনেটর। দুজনে প্রায় সমবয়ষ্ক হওয়ায় এবং দীর্ঘদিন একসাথে কাজ করবার সুবাদে তাদের সম্পর্কটিও অনেক সহজ হয়ে এসেছিল। সিল্ককে অন্যমনষ্ক হয়ে এখন আয়নার সামনে বসে থাকতে দেখে এগিয়ে এসে তার কাঁধে হাত রাখলেন মনিকা।

 

-“এই সেই ভদ্রলোক না, যিনি আগের দিন-”

 

নীরবে ঘাড় নাড়লেন সিল্ক। চুপ করে সমবেদনার দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন মনিকা, তারপর তার পাশের ফাঁকা টুলটির সামনে বসে পড়ে বললেন-

 

-“কি করবি…আমি তো অন্য রিপ্লেসমেন্টের কথা বলেছিলাম…ভদ্রলোক রীতিমতন জোর করলেন বিশেষত তোর ব্যাপারেই, তোকে ছাড়া উনি কারোর সঙ্গেই দেখা করবেন না এ কথা বলছিলেন বারবার-”

 

-“বোঝ! আর আমি কিনা বোকার মতন একে একটা ‘টিন-ক্যান’ ভেবেছিলাম!”

 

দুজনেই একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন একে অপরের দিকে তাকিয়ে। দুজনেই খুব ভালো করেই জানেন যে ‘মনিকা’, ‘সিল্ক’- অন্ধকার রাস্তায় চলবার কারণে ধার করা নাম মাত্র; একে অপরের বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও এই নামগুলির পিছনে থাকা আসল ব্যক্তিকে কেউ চিনতে চান নি কখনই- নিরাপত্তার কারণেই! কিন্তু নকল নামের পিছনে লুকিয়ে থাকা আসল শংকা, ভয় ও উদ্বেগ- এই অনুভূতিকে চিনতে ভুল হয় না কারোর কোন অবস্থাতেই। সিল্কের দিকে একবার তাকিয়ে দেখলেন মনিকা- কত বয়স হবে মেয়েটির? বাইশ, তেইশ…আচ্ছা ছাব্বিশই ধরা যাক। এই বয়সের অন্যান্য মেয়েরা সম্মানের জীবনের জন্য লড়াই করে, আর একে সেই রাজপথ ছেড়ে মাথা গুঁজতে হয়েছে কানাগলিতে- এর নেপথ্যে ‘মৃত্যুভয়’ ব্যাপারটাই মূখ্য কারণ নয় কি?

 

-“এই নে, রাখ এটা!”

 

বন্ধুর হাতে একটি স্টান-গান তুলে দিলেন মনিকা। অবাক হয়ে সেটি হাতে তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে লাগলেন সিল্ক।

 

-“একটা পেল্লাই ষাঁড়কে কয়েকঘন্টার জন্য অজ্ঞান করে ফেলতে পারে এর ইলেকট্রিক পালস্! বেশি বাড়াবাড়ি করলে ঝেড়ে দিবি। না, ভয় নেই; এটার প্লাসটিক কোটিং যেকোন মেটাল-ডিটেক্টরকে বেকুব বানিয়ে দেবে, আর এরা সচরাচর বডি-সার্চ করে না! যা, এটাকে সঙ্গে নিয়ে যা। শুধু ঘরে ঢোকবার আগে এটা পার্সে চালান করে দিবি-”

 

নিজের হাতে সিল্কের বুকের মাঝখানে ক্ষুদে অস্ত্রটিকে ঢুকিয়ে দিলেন মনিকা; তারপর তার কপালে একটা ছোট চুমু খেয়ে এক ছুটে বেরিয়ে গেলেন তিনি ঘর থেকে।

 

====================================================================

 

-“তোর ব্যাপারটা কি? কি হয়েছে বল তো?”

 

গাড়ি চালাতে চালাতে জিজ্ঞেস করলেন পাণ্ডে। দীর্ঘদিনের পুরোন বন্ধুর পাশে বসে আড়চোখে বন্ধুর হাবভাব দেখে শেষমেশ জিজ্ঞেস করলেন তিনি আর থাকতে না পেরে। তার ষষ্ঠেন্দ্রিয় বলে দিচ্ছিল আরিত্রীকের কোন একটা সমস্যা হয়েছে, নাহলে এতটা বেসামাল ও হয়ে পড়ত না।

 

ইস্ট এণ্ড গেটের বেশ কিছুটা আগে একটি ছোট ব্রীজ পড়ে; একটি সরু নদীর ওপর দিয়ে গিয়েছে এই প্রশস্ত ব্রীজ, জায়গাটি বেশ নির্জন। এই ব্রীজের মাঝামাঝি এসে গাড়ি দাঁড় করালেন পাণ্ডে; স্টার্ট বন্ধ করে এবার পাশে বসা আরিত্রীকের দিকে সপ্রশ্ন চোখে তাকিয়ে থাকলেন উনি। আর একটু আগিয়ে গেলেই এরপর চেকপোস্টের ঝামেলা শুরু হয়ে যাবে, তখন আর ব্যক্তিগতভাবে কথা বলার সুযোগ নাও মিলতে পারে।

 

একটা সাংঘাতিক ব্যাপার ঘটে যাচ্ছিল আজ ‘গ্রাউণ্ড জিরো’-য়। আরেকটু হলেই মারা পড়তেন আরিত্রীক, দুজন কুখ্যাত গ্যাং লিডারদের ছোঁড়া গুলিতে!

নির্ঘন্ট মেনে তাদের গোটা দলটিই ঘিরে ফেলেছিল পুরো জায়গাটিকে। পাণ্ডে ভেবেছিলেন আরেকটু কাছিয়ে এসে ঘিরে ফেলবেন অপরাধীদের; কিন্তু মোক্ষম সময়ে নিজপক্ষের একজন তরুণ সৈনিকের নির্বুদ্ধিতায় অপরাধীরা বুঝে যান তাদের উপস্থিতি। মুহুর্তে কভার নিয়ে গুলিবৃষ্টি শুরু করে দেন তারা; পরিবর্তে বাধ্য হয়ে গুলি চালাতে হয় সেনাদলকেও। বিপজ্জনক একটি পরিস্থিতির সূচনা হয় মুহুর্ত্তে!

 

শত্রুদের পোজিশনের দূর্ভেদ্যতা মেপে এবার একটি বিকল্প সিদ্ধান্ত নেন আরিত্রীক, কয়েকজনকে সাথে নিয়ে পাশ দিয়ে ঘুরে শত্রুদের আক্রমণ করবার কথা ভাবেন তিনি। সেইমতন পাণ্ডে সমেত কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে নিজেদের বন্দুকে সাপ্রেসর লাগিয়ে পাশে ঘুরে যান তারা, বাকি সঙ্গীদের পিছনে ফেলে রেখে।

 

যাত্রাপথে বেশ কয়েকবার শত্রুর মুখোমুখি হতে হয় তাদের; বোঝাই যাচ্ছে বেশ পাকামাথা কেউ পরিচালনা করছে দলটিকে, নয়তো স্থলযুদ্ধের এতটা খুঁটিনাটি বিষয় কোন রাস্তার গুণ্ডাদলের কাছ থেকে আশা করা যায় না। নেহাত সুশৃঙ্খল ট্রেনিং-এর অভাবে ঘুরপথের প্রহরীরা মাৎ খেয়ে গেল বলে আর্মির এই দলটির কাছে, নয়তো পোজিশনগুলি বুঝে লোক রেখে দেওয়ার পরিকল্পনাটি কিন্তু খারাপ ছিল না!

 

যাই হোক, অবশেষে তারা এসে পৌঁছান সেই বিরাট ঘরটিতে, যেখানে দলের চাঁইগুলি একত্র হয়ে প্রতিরোধ করছিল এতক্ষণ ধরে। একটা বন্ধ দরজার সামনে এসে চোখের ইশারা করলেন আরিত্রীক; তারপর এক লাথিতে দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকেই-

 

অভিযান চলাকালীন আগেই লক্ষ্য করেছিলেন পাণ্ডে- তার বন্ধুর যেন আজকের লড়াইতে কোন মন নেই। কিরকম যেন একটি অলস, গা-ছাড়া ভাব; গুলিবৃষ্টির মাঝেই থেকে থেকে অন্যমনষ্ক হয়ে যাওয়া; একবার তো মোশন ডিটেক্টরের ফাঁদেই পড়ে যাচ্ছিলেন আরেকটু হলে, হাবিলদার চুংমা সতর্ক থাকায় বেঁচে গেলেন এ যাত্রা! কিন্তু বিষয়টি যে ভালোভাবেই মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তা বিলক্ষণ বোঝা গেল আরিত্রীক দরজা ভেঙে ভিতরে ঢোকবার পর; একদম অরক্ষিত অবস্থায় পেয়ে গেছিলেন দুই বন্দুকধারীকে একেবারে সামনেই। ইজি টার্গেট, শুধু ট্রিগার চেপবার অপেক্ষা! কিন্তু-

 

সামনে দুই বন্দুকধারীকে দেখেও হাঁ করে দাঁড়িয়েই রইলেন আরিত্রীক, মন্ত্রমুগ্ধের মত ওদের দিকে তাকিয়ে! ঘটনার আকষ্মিকতায় বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলেন তারাও, আসন্ন মৃত্যুর গন্ধে তাদের স্বাভাবিক নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কয়েক সেকেণ্ডের জন্য; তারপর সম্বিৎ ফিরে আসতেই পরপর দুটি গুলি সোজা এসে বিদ্ধ করে আরিত্রীককে! আরও গুলি চালাতে পারত দুষ্কৃতিরা, কিন্তু গর্জ্জে ওঠে আরিত্রীকের সঙ্গীদের হাতের বন্দুক; পরমুহুর্ত্তেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে দুইজন দুষ্কৃতিই। আরিত্রীক অবশ্য আগেই লুটিয়ে পড়ে ছিলেন মাটিতেই।

 

না, ‘কুম্ভ’ বাহিনীর জন্য বরাদ্দ ‘লাইটওয়েট আর্মর’ ভেদ করে শত্রুপক্ষের গুলি আরিত্রীকের শরীর ছুঁতে না পারায় অক্ষত ছিলেন তিনি, উঠে ফের তিনি যোগ দেন মূল অভিযানে এবং অভিযানও শেষ হয় নিরুপদ্রবে, কিন্তু এই ঘটনা বিচলিত করে তোলে পাণ্ডের মন। আরিত্রীক তাদের ইউনিটের একজন নির্ভরযোগ্য সদস্য, তার এ হেন আচরণ ঠিক-

 

-“বুড়ো হাড়ের জোর যে কমে নি এ ব্যাপারে আমি একশ শতাংশের চেয়ে বেশি নিশ্চিন্ত। এবারে ব্যাপারটা কি হয়েছিল বল তো খোলসা করে! তুই আজকে শত্রুদের দেখে ব্যোমকে গেলি কেন? হাঁ করে ওদের দিকে তাকিয়ে কি ভাবছিলি?”

 

গাড়ির কাঁচগুলো নামিয়ে দিয়েছিলেন পাণ্ডে, ফলে হাওয়া-চলাচল হচ্ছিল সবদিক দিয়েই। এবার তার চোখের দিকে চোখ রেখে ঠোঁটদুটি নড়ে উঠল আরিত্রীকের, যেন কিছু বলতে চাইছেন তিনি-

 

 

-“এস। বস এইখানে।”

 

সিল্ককে দরজা খুলে ভিতরে মাথা বাড়াতে দেখে তাকে ভিতরে ডেকে নিলেন আরিত্রীক। যাক, ও এসেছে, আর নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই এসেছে এটাই স্বস্তির। এবার ধীরে ধীরে আসল কাজের কথাটা পাড়া যাক, দেখা যাক কি হয়।

 

সিল্ক মনে হল একটু অবাক হয়ে গিয়েছে, আর একটু অপ্রস্তুতও। এরকম শান্ত অভ্যর্থনা তিনি আশাও করেন নি! তার মুখের ভাবে পরিষ্কার ফুটে উঠল বিষ্ময়, তারপর সাত-পাঁচ ভেবে বসে পড়লেন সামনের চেয়ারটিতে।

 

-“তোমার সোয়াইপারটি একটু দেখি…তোমার এক ঘন্টার পারিশ্রমিকটা…হ্যাঁ, এতেই হবে। বোস, এক মিনিট।”

 

ভিতর থেকে নিজের হাতে চা বানিয়ে নিয়ে এলেন আরিত্রীক, নিজের হাতে পরিবেশনও করলেন তা। সিল্ক কিছু বললেন না, তিনি শুধু চুপচাপ নজর রাখছিলেন পরিস্থিতির দিকে। তবে স্বীকার করতে লজ্জা নেই, এখনও অবধি ফাঁকা ঘরে উল্টো দিকে বসা ভদ্রলোকটির মতিগতি তার বোধবুদ্ধির বাইরে চলে গিয়েছিল সম্পূর্ণভাবেই।

 

-“সিল্ক, আমার হাতে সময় নেই বেশি, তাই সংক্ষেপে তোমায় একটি অনুরোধ করব আমি; রাখবে?”- লম্বা একটা সময় পরে অবশেষে কথা বলা শুরু করলেন আরিত্রীক। প্রত্যুত্তরে জিজ্ঞাসু চোখ মেলে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন সিল্ক, মুখে কিছুই বললেন না। খানিকক্ষণ চুপ থেকে অবশেষে আবার মুখ খুললেন আরিত্রীক-

 

-“তোমাকে একটি প্রস্তাব দেওয়ার ছিল; যদি তুমি সম্মত থাক।”

 

এই অবধি বলে সোফা থেকে উঠে ঘরের কোণে রাখা একটি ছোট দেরাজ থেকে একতাড়া মোটা কাগজ বের করে আনলেন আরিত্রীক; সেটি এনে সামনের ছোট গোল টেবিলটিকে টেনে এনে তার ওপর কাগজগুলিকে রেখে তিনি বললেন-

 

-“তিন সপ্তাহ বাদে আমার অবসরের পর আমাকে পাঠানো হচ্ছে গ্রীন জোন-এ; এরপর থেকে আমি পাকাপাকিভাবে ওখানকার অধিবাসী হব। সরকারের কাছ থেকে এটি আমার পাওনা; আমার পরিবার থাকলে তারাও এই সুবিধা ভোগ করত-”

 

-“এখানে আমার কি করণীয়?”- কথার মাঝখানে হঠাৎ প্রশ্ন করলেন সিল্ক। তার দিকে নরম দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকালেন আরিত্রীক, তারপর বললেন-

 

-“আমি চাই, তোমাকে আমার সঙ্গে নিয়ে যেতে…আসবে তুমি?”

 

এরকম একটা বেখাপ্পা প্রস্তাবে খানিকক্ষণের জন্য বিমূঢ় হয়ে গেলেন সিল্ক; খানিকক্ষণের জন্য কোন কথাই বলতেই পারলেন তিনি শুধু বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া। গ্রীন জোন…এত সহজে? স্বপ্নের দেশে মন উড়ে গিয়েছিল তার; চোখের সামনে তিনি শুধু দেখতে পাচ্ছিলেন গ্রীন জোনের উঁচু কংক্রীটের দেওয়ালের ওপারে থাকা বিরাট উঁচু উঁচু স্কাইস্ক্র্যাপার, ভাইরাসবিহীন পরিবেশ, আর…আর রকমারি সব দুর্লভ খাবার! মনিকার সঙ্গে কথাবার্তায় বিভিন্ন সময়ে তিনি জানতে পেরেছিলেন ওখানকার বড়লোক অধিবাসী আর তাদের বিভিন্ন রকমারি খাবারের ব্যাপারে। খাদ্য…এই জিনিষটির প্রতি অসীম দূর্বলতা কাজ করত তার মনে, এর অভাবেই তো…

 

কিন্তু কঠোর বাস্তবের মাঝখানে ‘ফ্যান্টাসি’ বেশিক্ষণ কাজ করে না। একটি কথা মাথায় আসতেই আচমকা এক ঝটকায় বাস্তবে ফিরে এল সিল্কের মন। সম্পূর্ণ সম্বিৎ ফিরে পেয়ে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন-

 

-“আমাকে নিয়ে যাবেন আপনি, তাই তো?”

 

ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন আরিত্রীক। লক্ষ্য করলেন- আস্তে আস্তে চোখের দৃষ্টি খর উঠছে সিল্কের। প্রস্তুত হওয়ার আগেই তীব্রগতিতে ছুটে এল পরের প্রশ্নটি-

 

-“কি পরিচয়ে আমি যাব আপনার সাথে?”

 

-“কেন? বললাম যে আমার পরিবার হিসেবে-”

 

-“এর অর্থ- আপনার স্ত্রী পরিচয়ে? তার মানে আমাকে বিয়ে করবেন আপনি, তাই তো?”

 

মাথা নীচু করে ফেললেন আরিত্রীক এক লহমার জন্য; তারপর মাথা নেড়ে ‘না’ বললেন ইশারায়। ততক্ষণে উল্টোদিকের চেয়ারে বসে খিলখিল করে হেসে উঠেছেন সিল্ক।

 

-“বুঝুন বখেড়া! আপনি আমাকে নিয়ে যেতে চান আপনার ‘স্ত্রী’ পরিচয়ে, অথচ আপনি আমায় বিয়ে করতে চান না! তাহলে আমি কি আপনার রক্ষিতা হয়ে যাব ওখানে? যদ্দুর জানি- রক্ষিতাদের তো ওখানে অনুমতি দেওয়া হয় না ভিতরে প্রবেশের! তাহলে আপনার ক্ষেত্রে সে নিয়মের বাত্যয় হবে কেন-”

 

-“‘কন্যা’! আমি তোমাকে ওখানে নিয়ে যাব আমার ‘মেয়ে’ পরিচয়ে-”

 

-“সে তো আরই অসম্ভব! আপনি খাতায়-কলমে একজন ব্যাচেলর, এই তিন সপ্তাহে আপনার মেয়ে- আপনার বুদ্ধিখানা ভালোই ছিল, আমাকে টোপ দিয়ে সম্পূর্ণ অজানা এক জগতে নিয়ে যাওয়া, তারপর সেখানে পৌঁছিয়ে আমাকে আপনার বিনিপয়সার ক্রীতদাসী বানিয়ে যা খুশি তাই করিয়ে পার্সোনাল কিছু রোজগার- ধন্যবাদ! আমি রাজি নই আপনার সঙ্গে আসতে। আপন যোগ্যতায় একদিন আমি নিশ্চই যাব ওখানে। সময় শেষ, আমি আসি বরং আজকে।”

 

পার্সটা হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দরজার দিকে পা বাড়াচ্ছিলেন সিল্ক; এবার পিছন থেকে ভেসে আসা একটি প্রশ্নে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন তিনি-

 

-“তোমাদের অবসরের পর কিন্তু গ্রীন জোন-এ পাঠানো হয় না!”

 

পার্সের মুখটা সন্তপর্ণে খোলা রেখে এবারে বক্তার দিকে ফিরে তাকালেন সিল্ক। এই মুহুর্ত্তটার জন্য অপেক্ষা করছিলেন আরিত্রীক; সিল্ক ফিরে তাকাতেই তিনি প্রশ্ন করলেন-

 

-“কদিন হল রেবেকা গেছে গ্রীন জোন-এ?”

 

-“প্রায় দেড় মাস!”- উত্তর দিলেন সিল্ক। আরিত্রীকের প্রশ্নের মধ্যেই এমন কিছু ছিল যার জন্য উত্তর দেওয়াটাই সমীচীন মনে করলেন তিনি।

 

-“দেড় মা- আচ্ছা, একটা কথা ভেবে বল তো; বিগত দেড় মাসে রেবেকা কোন যোগাযোগ করেছে তোমার সাথে? কোন হলোগ্রাফ, মেইল, ফোন- নিদেনপক্ষে একটা চিঠি- কোন রকম যোগাযোগ হয়েছে তোমাদের মধ্যে?”

 

চোখ নামিয়ে একটু চিন্তা করে নিলেন সিল্ক, তারপর বললেন-

 

-“না!”

 

-“তোমাদের মধ্যে কোন ঝগড়া, মন কষাকষি, বন্ধুত্বে ছেদ…এমন কিছু যার জন্য রেবেকা তোমার বা তোমাদের মধ্যে কারোর সঙ্গেই যোগাযোগ রাখবার প্রয়োজন মনে করে নি?”

 

-“এরকম কিছু ঘটে নি।”

 

-“তাহলে তুমিই বল, কি সেই কারণ যার জন্য রেবেকা পুরো নীরব হয়ে গেল; তোমাদের মধ্যে কেউ তার কোন কথা আর শুনতে পেল না তার তথাকথিত গ্রীন জোন-এর ওপারে চলে যাওয়ার পর? এই নীরবতার কারণ কি?”

 

মেঝের দিকে চোখ নামিয়ে কার্য-কারণ সম্পর্ক খুঁজে বের করার চেষ্টা করলেন সিল্ক। সত্যিই তো! ব্যাপারটা তলিয়ে ভেবে দেখেন নি তো তিনি? আর শুধু রেবেকাই বা কেন, তার পরিচিত আরও তিন-চারজন মেয়ে অবসর নিয়ে চলে গেছেন গ্রীন জোন-এ বিগত এক বছরে, এরপর তারা যেন হারিয়েই গিয়েছেন একপ্রকার, তাদের কথা আর শোনাই যায় নি এরপর! বখেড়াটা কোথায়? আকাশ-পাতাল ভাবছিলেন সিল্ক, চটকাটা ভাঙল আরিত্রীকের কথায়-

 

-“প্রতিবছর তোমাদের মধ্যে বয়স হয়ে যাওয়া বা দূর্বল হয়ে পড়া অশক্ত মেয়েদের নির্বাচন করা হয়। সকলের সামনে একটা লোকদেখানো বিদায়-সম্বর্ধনা দেওয়া হয় এদের, ঢাক-ঢোল পিটিয়ে হাতে তুলে দেওয়া হয় গ্রীন জোন-এর পাসপোর্ট। তারপর…আড়ালে নিয়ে গিয়ে এদের মেরে ফেলা হয়! ফাঁকা জায়গাটি পূরণ করা হয় তোমাদের মতন নতুন, টাটকা ফুলদের দিয়ে!!”

 

হাঁ হয়ে গিয়েছিলেন সিল্ক, আরিত্রীকের মুখে কথাগুলি শুনে; এরকমই কিছু একটা অনুমান করছিলেন তিনি, এখন সেটাই শুনতে পেয়ে খানিকক্ষণের জন্য স্থবির হয়ে যান তিনি! বহুকষ্টে বেশ কিছুক্ষণ পর একটি প্রশ্ন উঠে আসে তার কন্ঠ দিয়ে-

 

-“আপনি কি তাই মনে করেন?”

 

-“আমি জানি। এটাই সত্য, এটাই বাস্তব।”

 

খরদৃষ্টি মেলে খানিকক্ষণ আরিত্রীকের দিকে তাকালেন সিল্ক, তারপর আর একটিও কথা বললেন না তিনি; পার্স হাতে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলেন তিনি ঘর ছেড়ে। তাকে অবশ্য ঠিক প্রত্যয়ী দেখাচ্ছিল না-

 

 

চুপ করে আরিত্রীকের কথা শুনছিলেন পাণ্ডে; শুনতে শুনতে ভুরু কুঁচকে এসেছিল, গাড়ির ভিতরে বইতে থাকা অবিরাম ঠাণ্ডা হাওয়ার স্রোতের মধ্যেও গরম লাগছিল তার। এ কি বলছে আরু, তার পুরোন বন্ধু? এমন ঘটনা কি বাস্তবে সত্যিই ঘটা সম্ভব? আর এমনটা ঘটলই বা কি করে? পাল্টা জিজ্ঞেস করেছিলেন তিনি; কিন্তু মাথা নেড়ে দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে স্বীকার করলেন আরিত্রীক- পূর্ব-ইতিহাসের কোনকিছুই তিনি জানেন না। উৎসমুখের আর্গল খুলে যাওয়ায় ঘটনাস্রোতের প্রবাহে তিনি ভেসে গিয়েছেন মাত্র, কিন্তু এর উৎপত্তি কোথায় সে সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র কোন ধারণা নেই।

 

-“আরু, তুই বিয়ে করলি না কেন তা আমি ভালো করেই জানি; সমাজের ‘একচোখো সাইক্লপসের দৃষ্টি’ তোর পছন্দ নয়, ‘উইমেনস্ লিব’-এর নামে যে নোংরামো চলছে তা তোর কাছে ভয়ংকর ঘৃণার্হ- তোর মুখটা বাদ দিলে তুই যে পয়েন্টগুলো মাঝেমধ্যেই তুলে ধরতিস সেগুলি এত জোরালো যে উপেক্ষার কোন জায়গাই ছিল না এতে; সেক্ষেত্রে তুই ‘আর্টিফিসিয়াল ইনসেমিনিশন’-এর দিকে যেতে পারতিস…আইনি কোন জটিলতা ছিল না; আরে, কেউ তো তোকে ‘বাবা’ বলে ডাকত! তোকে একদিন বলেছিলাম তোর এই বহুগামীতা তোকে একদিন বিপদে ফেলবে; দেখলি তো, কি পাপ হয়ে যাচ্ছিল তোর হাতে? হতে হতে বেঁচে গিয়েছিস এই ঢের; যাক…এখন কি করতে চাইছিস?”

 

সামনের ড্যাশবোর্ডে খুটখুট করছিলেন আরিত্রীক, মাথা নীচের দিকে নামিয়ে। বন্ধুবরের কথা শেষ হতে মুখ তুলে একবার তাকালেন সামনের দীর্ঘ রাস্তার দিকে। তারপর খানিকক্ষণ চুপ করে এবার একইরকম নিষ্পলক দৃষ্টি নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন-

 

-“এই সমস্যা সমাধানের একটিই উপায় আছে, আর তোর সাহায্য ছাড়া এই সমস্যার সমাধান হবে না!”

 

-“কি উপায়?”

 

বিশদে উপায় বুঝিয়ে বললেন আরিত্রীক, মন দিয়ে তা শুনলেন পাণ্ডে। তারপর আরিত্রীকের কথা শেষ হতে তিনি বলে উঠলেন-

 

-“কিন্তু তুই এই ফাটকাটা খেলতেই বা চাইছিস কেন, মানে…মেয়েটাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তুইই বা এতটা বদ্ধপরিকর কেন? পুরো বিষয়টা যখন ভাগ্যের হাতে চলে গিয়েছে, সেখানে-”

 

আর্মরের একটি পকেট থেকে একটি অডিও-ডিভাইস বের করে গাড়ির প্লেয়ারের মধ্যে সেটিকে ভরে চালিয়ে দিলেন আরিত্রীক, আপন খেয়ালে চলতে লাগল তা। ভিতর থেকে বিভিন্ন কন্ঠে শোনা যেতে লাগল নানা কথোপকথন; বিষয়বস্তু শুনতে শুনতে একসময় মাথার চুল খাড়া হয়ে এল পাণ্ডের- শেষে আর থাকতে না পেরে চাপা গলায় আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি-

 

-“এসব কি ব্যাপার বলতো?”

 

-“ওদের তথাকথিত ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’-এর গোপন কোন শলা-পরামর্শ, যা কোন একটি সময় কোন একটি অজ্ঞাত কারণে রেকর্ড করা হয়েছিল; ওদের একজন মৃত নেতার মৃতদেহ থেকে আমাদের একজন তরুণ সদস্য উদ্ধার করে এই রেকর্ডটিকে। আমাদের ‘টেক-স্যাভি’ নাহালের কাছ থেকে এর একটা কপি করিয়ে আনি তোকে শোনাবার জন্য। এই অডিও-ক্লিপ অনুযায়ী, ওরা ওদের ব্রথেল সংগঠন থেকে প্রায় প্রতিমাসে বেশ কয়েকজন মেয়েকে সরিয়ে আনত বয়স হয়ে যাওয়া বা অশক্ত শরীরের অছিলায়, তারপর এই সব মেয়েদের শারীরিক পর্যবেক্ষণের নাম করে এদের মেরে শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি চড়া দামে বেচত গ্রিন জোন-এর ওপারে থাকা শাঁসালো খদ্দেরদের কাছে, মোটা দামে! এইটি ছিল ওদের পয়সা রোজগারের অন্যতম পথ-”

চুপ করে তাকিয়ে থাকলেন পাণ্ডে, কিন্তু চুপ থাকেন নি আরিত্রীক। তিনি যোগ করলেন-

 

-“এই নিরুপায় মেয়েগুলি গ্রীন জোন-এ পৌঁছত বটে, কিন্তু অন্যের শরীরের একটি অংশ হিসেবে! চোখ, দাঁত, হৃৎপিণ্ড, যকৃত- শরীরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে, কিন্তু ওয়ান পিস ও জীবন্ত অবস্থায় কখনোই নয়! এবার বল-”

 

না, আর কিছু বলতে পারেন নি পাণ্ডে, বলবার আর কিছু ছিলও না। খানিকক্ষণ চুপচাপ থাকলেন তিনি, তারপর বললেন-

 

-“আমার এক মামাতো ভাই কাজ করে ‘লিগ্যাল ট্রান্সপোর্ট’ ডিপার্টমেন্টে। ওকে জানাতে হবে। তাছাড়া দত্তক রেজিস্টার আপিস… আমাকে একটা দিন সময় দে- আর একটা কথা, এমনি কৌতুহলে জিজ্ঞাসা করছি- তুই ঐ দুজনকে তখন গুলি করলি না কেন? কি দেখছিলি ওদের সামনে হাঁ করে?”

 

এ প্রশ্নে মুখ ঘুরিয়ে সামনের দিকে তাকালেন আরিত্রীক, তারপর স্বপ্নালু ভঙ্গীতে বললেন-

 

-“মানুষের মন সবচেয়ে বড় টাইম-মেশিন, পাণ্ডে! সময়যাত্রার প্রাথমিক নিয়মের মতই এখানেও তুই কোন কিছু পরিবর্তন করতে পারবি না, শুধু তোর কলঙ্কময় অতীতটিকে একবার উঁকি মেরে যাওয়া ছাড়া! এই ব্যাপারটাই তখন ঘটেছিল আমার সাথে-”

 

-“কিরকম?”

 

-“দরজা ভেঙে ভিতরে ঢোকার পরে বন্দুক তুলেছিলাম ফায়ার করব বলে, স্পষ্ট দেখলাম ওদের দুজনের মাঝখানে আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে…দহনার সেই মৃত ভাই! গুলি লেগে ডানদিকের মাথার খুলির বেশ কিছুটা উড়ে গিয়েছে, চোখে-মুখে সারা গায়ে রক্ত মেখে সে দাঁড়িয়ে কাতরভাবে অনুনয়ের ভঙ্গীতে, যেন আর গুলি চালাতে বারণ করছে! হাত নিজে থেকে নেমে গেল, আমি তাকিয়েই রইলাম ঐ ভয়ঙ্কর মুখের দিকে…তারপর…”

 

একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে গাড়ি স্টার্ট করলেন পাণ্ডে; আর একটিও কথা খরচ না করে। তার ওপর অর্পণ করা দায়িত্ব তাকে পালন করতেই হবে, বন্ধুর মুখ চেয়ে…

 

====================================================================

 

দুদিন পরের ঘটনা, রাত্রিবেলা…

 

সমস্ত বৈধকরণ প্রক্রিয়া সেরে এসে পরিতৃপ্ত মুখ নিয়ে ঘর আধো-অন্ধকার করে হাতে একটি পানীয়ের গ্লাস নিয়ে বসেছিলেন আরিত্রীক। একটা মৃদু, নরম গানের আওয়াজ সারাটা ঘর জুড়ে। তার পর্বের কাজগুলি সারা হয়ে গিয়েছে; আগামীকাল সকালে ট্রান্সপোর্ট ডিপার্টমেন্টের লোকজন যাবেন ভেরিফিকেশনের জন্য, ব্যাস! তারপর ওর পালিত কন্যা ওর সঙ্গে যাবেন কাঁটাতারের বেড়া আর কংক্রীটের উঁচু দেওয়াল পেরিয়ে অপরপাড়ে, এক স্বর্গরাজ্যে! কোন কিছুই আর থামাতে পারবে না এই অবশ্যম্ভাবী পরিণতিকে। এইবার শুধু পরিবার নিয়ে একটা সুন্দর সময় অতিবাহিত করতে পারবেন তিনি। পরিতৃপ্তির একটা ঢেঁকুড় বেরিয়ে এল তার মুখ দিয়ে।

 

-দুম দুম দুম-

 

সদর দরজায় হঠাৎ প্রবল ধাক্কা! এই মাঝরাত্রে আবার কে? একটু শংকিত হয়ে উঠলেন আরিত্রীক; দুদিন আগের অভিযানের কোন প্রতিবর্ত ক্রিয়া নয় তো? চট করে উঠে হাতের গ্লাসটি নামিয়ে রেখে পাশের ঘরে তাকের ওপর রাখা পিস্তলটি বের করে হাতে নিলেন তিনি। সাপ্রেসরটা এখনও লাগানো দেখে একটু ইতস্তত করলেন, তারপর দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে সাপ্রেসরসমেত পিস্তলটি হাতে নিয়েই লঘুপায়ে এগিয়ে গেলেন সদর দরজার দিকে। দরজায় শব্দ তখনও একটানা হয়েই চলেছে, যেন কেউ কাতর মিনতি জানাচ্ছে দরজা খোলবার জন্য! গানটা কিন্তু একবারের জন্যও বন্ধ করেন নি তিনি; দরজার বাইরে থাকা কাউকেই তিনি জানতে দিতে চান না ভিতরে কি হচ্ছে।

 

আই-হোল-এ চোখ রেখে অবাক হয়ে গেলেন আরিত্রীক- সিল্ক…এত রাত্রে? তাকে একঝলক দেখে সুস্থ মনে হচ্ছে না; পাঁজরের কাছে মনে হল রক্তের দাগ!

 

সাবধানতার বাঁধন ছিঁড়ে গেল; প্যান্টের পিছনে পিস্তল গুঁজে এবারে দরজা খুললেন আরিত্রীক। খুলতেই সিল্কের দেহটি তার গায়ের ওপর এলিয়ে পড়ে গেল একপ্রকার; কোনমতে তাকে ধরে ঘরের ভিতর মেঝেতে এনে শোয়ালেন আরিত্রীক।

 

-“কি হয়েছে সিল্ক?”

 

-“আমার পিছনে বন্দুক হাতে…ওরা আমায় মারতে আসছে…ওরা…মনিকাকে মেরে ফেলেছে, ও আমার বন্ধু-”

 

কোনমতে কথা কয়টা বলে জ্ঞান হারালেন সিল্ক।

 

সতর্ক হয়ে এবারে উঠে দাঁড়ালেন আরিত্রীক; বন্দুক হাতে সিল্কের পিছনে ধাওয়া করছে আততায়ীর দল, এর মানে- বিপদ! চট করে দরজার দিকে সরে গিয়ে সামনের টানা বারান্দার দিকে সতর্কভাবে তাকিয়ে দেখলেন তিনি- না, বিরাট লম্বা বারান্দাটির মধ্যে কাউকে দেখা যাচ্ছে না, কেউ কোথাও নেই।

 

দরজা বন্ধ করে চলে আসতে যাবেন আরিত্রীক, এমন সময় তার চোখে পড়ল টাটকা, তাজা রক্তের দাগ- গোটা বারান্দাজুড়ে সর্বত্র! সেদিকে দুই সেকেণ্ড তাকিয়ে কর্তব্য স্থির করে নিয়ে মাথার ওপর ঝুলতে থাকা পরপর তিনটি উজ্জ্বল লাইট গুলি ছুঁড়ে ভেঙে দিলেন তিনি; অন্ধকার হয়ে গেল তার ঘরের সামনের অঞ্চল। এক হিসেবে ভালো, সরাসরি অন্ধকারে তাদের খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা কম। এরপর দরজা চেপে বন্ধ করে বাথরুমে সিল্ককে বহন করে নিয়ে এসে বাথটবে রেখে কল খুলে দিলেন তিনি। আঘাতের জায়গাটার প্রাথমিক নিরাময় আগে হোক। বাঁ দিকের পাঁজরের নীচে আঘাত লেগেছিল সিল্কের। ঠাণ্ডা জলের সংস্পর্শে কিছুক্ষণ পর চেতনা ফিরে আসে তার।

 

-“কি হয়েছিল?”- সিল্কের চেতনা ফিরতে জিজ্ঞেস করে ওঠেন আরিত্রীক।

 

-“আপনি ঠিক বলেছিলেন…মাটির নীচের ঘরে…অপারেশান থিয়েটার…ওদের দেখেছিলাম…ওরা আমায় দেখে ফেলল…বন্দুক হাতে তাড়া…”

 

কষ্ট করে কথাগুলি বলে উঠলেন সিল্ক; মন দিয়ে তার কথা শুনলেন আরিত্রীক, তারপর তার মাথায় পরম স্নেহভরে হাত বুলিয়ে বললেন-

 

-“তুমি এখানে থাক, বাইরে যা কিছুই ঘটুক না কেন, নড়বে না; মনে থাকবে তো, সিল্ক?”

 

ঘাড় কাৎ হয়ে গিয়েছিল একদিকে সিল্কের; ঐ অবস্থাতেও কোনমতে অস্ফূটস্বরে তিনি বললেন-

 

-“দহনা! আমার নাম…দহনা।”

 

মৃদু আলোয় আরিত্রীক পরিষ্কার দেখতে পেলেন হতভাগ্য মেয়েটির ঘাড়ের কাছে ট্যাট্টু করা পক্ষীরাজ ঘোড়ার মলিন হয়ে আসা ছবিটি। অস্ফূটস্বরে একবার তার মুখ ফুটে শুধু বেরোল ‘জানি’ শব্দটি, তারপর তিনি বেরিয়ে এলেন বাথরুম থেকে, দহনাকে পিছনে ফেলে রেখে।

 

পরপর কতগুলি গুলির শব্দে সচকিত হয়ে উঠলেন আরিত্রীক, সদর দরজা ভেঙে যাওয়ার আওয়াজ এল কানে। আর সময় নেই, দুষ্কৃতিরা ঢুকে পড়েছে খোলা দরজা দিয়ে! মাথা নীচু করে সামনে এগিয়ে গেলেন তিনি। ঘর মৃদু আলোয় আলোকিত, পুরো ঘরটা তার কাছে চেনা- এটিই একমাত্র তার পক্ষে, যদিও শত্রুদের প্রকৃত সংখ্যাটি তার কাছে অজানা।

 

একটি বন্দুকের নল ভেসে উঠল অন্ধকারে, একেবারে তার মুখের সামনে! চমকে উঠলেন আরিত্রীক, তারপর বন্দুকের নলটি চেপে ধরে এক মোক্ষম হ্যাঁচকা টানে বন্দুকধারী তার সামনে ঝুঁকে পড়তেই মাথায় পিস্তলের নল ঠেকিয়ে শান্তভাবে ট্রিগার চিপলেন তিনি। একটা অস্ফূট অব্যয় মুখ দিয়ে বেরোল মাত্র, তারপরই মাটিতে পড়ে গেল শত্রুর দেহ! অপাঙ্গে একবার তা দেখে নিয়েই দুষ্কৃতির বন্দুকটা অধিকার করে নিলেন তিনি, তারপর তাকালেন সামনের দিকে।

 

আধো-অন্ধকারে সামনেই মনে হল ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা শত্রুর ছায়া; দেরি না করে সেই ছায়ামূর্তির মাথা লক্ষ্য করে একটি গুলি ছুঁড়লেন তিনি। সশব্দে ভূপতিত হল শত্রু, আর তা হতেই-

 

তিনি যে দেওয়ালের প্রান্তে কভার নিয়েছিলেন, তার অপরদিক থেকে পরপর ছুটে আসতে লাগল অবিরাম গুলি! চমকে উঠে দেওয়ালের শেষপ্রান্ত থেকে একটু ভিতরদিকে সরে এলেন আরিত্রীক; উত্তেজনায় একটু বেশিই ঝুঁকে পড়েছিলেন সামনের দিকে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে হাতের বন্দুকটার দিকে একবার তাকালেন তিনি, এটি আনসাপ্রেসড; ফলে গুলি চালাবার আওয়াজ কানে গিয়েছে শত্রুপক্ষের, এখন তারা প্রত্যুত্তরে গুলি চালাচ্ছে। এর ফলে একদিক দিয়ে সুবিধাই হল, শত্রুদের অবস্থান জেনে গেলেন তিনিও। একজন সদর দরজা দিয়ে ঢুকেই ডানদিকে রয়েছে, আর একজন খুব সম্ভবত কভার নিয়েছে একটু এগিয়েই সোফার এই পাড়ে সম্ভবত মধ্যম আকৃতির গোল টেবিলটিকে উল্টে, তার পিছনে। যে ঘরে কাণ্ডটি ঘটছে সেটি আকারে বেশ বড়, আর ঘরের মাঝামাঝি রয়েছে এই বিল্ডিংয়ের ভারবাহী স্তম্ভটি। একবার এর পিছনে আশ্রয় নিতে পারলে…গুলির শব্দে নিশ্চই ঘুম ভেঙেছে অ্যাপার্টমেন্টের বাকি বাসিন্দাদের; শত্রুরাও বুঝে গিয়েছে তাদের হাতে সময় বেশি নেই। এইজন্যই একজায়গায় আরিত্রীককে আটকে রেখে ওরাও নিশ্চই চাইছে সুবিধাজনক পোজিশন নিতে। এখন শুধু কে আগে সঠিক কভারে যাবে সেটির অপেক্ষা-

 

গুলির বৃষ্টি একটু থামল বলে মনে হল; ঐ তো, ম্যাগাজিন ভরবার আওয়াজ কানে আসছে…এইবার…

 

একটি লম্বা শ্বাস টেনে বন্দুকটিকে জোরে চেপে ধরে এইবার মাঝখানের স্তম্ভটির দিকে দৌড় লাগালেন আরিত্রীক, ক্রমাগত তার বাঁদিকে ফায়ার করতে করতে। শত্রুপক্ষের দিক থেকেও কয়েকবার ফায়ার হয়েছে এইসময়ে, তা এড়িয়ে কোনমতে স্তম্ভের পিছনে পৌঁছলেন তিনি। কভারে পৌঁছে ফায়ারিং বন্ধ হতে একটু মাথা বের করে দেখলেন- সদর দরজার ডানদিকে আশ্রয় নিয়েছিল যে শত্রু সে মাটিতে পড়ে, স্থির! একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরোল তার মুখ দিয়ে, যাক, আর একজন মাত্র থাকবার কথা! কিন্তু-

 

বুকের বাঁদিকটায় হঠাৎ একটি প্রবল যন্ত্রণা অনুভব করে সেদিকে তাকালেন আরিত্রীক- গুলি লেগেছে! উত্তেজনায় এতক্ষণ খেয়াল করেন নি, এবার পরিষ্কার দেখতে পেলেন নিজের শরীরের ক্ষতস্থানটিকে! দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণাটিকে সহ্য করতে চাইলেন আরিত্রীক, বুঝলেন, যেখানে গুলি লেগেছে তাতে-

 

একটা দীর্ঘ শ্বাস টেনে যন্ত্রণাটিকে উপেক্ষা করতে চাইলেন আরিত্রীক, ভুলে যেতে চাইলেন তার কামড়ের জোর! বন্দুকের ম্যাগাজিন খুলে পরখ করলেন একবার- নেই, আর কোন বুলেট অবশিষ্ট নেই এতে! বন্দুকটিকে সামনের মেঝেতে শুইয়ে এবার প্যান্টের পিছনদিকে রাখা নিজের পিস্তলটিকে টেনে বের করতে যাবেন, এমন সময়-

 

ভয়ের একটা ঠাণ্ডা স্রোত তার শিরদাঁড়া দিয়ে নেমে এল নীচে, স্থানু হয়ে গেলেন তিনি! পিস্তলটা নেই যথাস্থানে!!

 

তিনি আগে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেদিকে নজর ঘোরাতেই আধো-অন্ধকারে অস্পষ্টভাবে চোখে পড়ল পিস্তলের কালো রঙের বাঁটটা। মেঝেতে পড়ে রয়েছে সেটি; আসবার সময় কোনভাবে ঝাঁকুনিতে পড়ে গিয়েছে হয়তো। কিন্তু…তিনি অদ্দুর পৌঁছবেন কি করে? তার আর পিস্তলের মাঝে তুলনামূলক সুবিধাজনক জায়গায় ঘাপটি মেরে বসে রয়েছে শত্রু; বেরোতে গেলেই তো ব্যাটা গুলি ছুঁড়বে! এখন উপায়? ও ব্যাটা মাঝে-মাঝে ফায়ার করছে নিজের জায়গায় বসে, বোধহয় বোঝবার চেষ্টা করছে শত্রুর অবশিষ্ট ফায়ারপাওয়ার। একবার আরিত্রীকের ‘ভাঁড়ে মা ভবানী’ অবস্থাটা বুঝে গেলেই-

 

কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসেছিলেন আরিত্রীক তার কভারের পিছনে। হঠাৎ দেখলেন- পড়ে থাকা পিস্তলটির দিকে অন্ধকার ভেদ করে টালমাটাল পায়ে ছুটে এলেন দহনা; কোনমতে পড়ে থাকা পিস্তলটিকে কুড়িয়ে নিয়ে ছুঁড়ে দিলেন আরিত্রীকের দিকে। এদিকে শত্রুও দেখতে পেয়েছে তার ছুটে আসা- কালবিলম্ব না করে ফায়ারিং শুরু করে দিয়েছে সে! একটা গুলি গায়ে এসে লাগতেই ধপাস করে দহনা পড়ে গেলেন মেঝের ওপর, তার আগেই অবশ্য পিস্তলটা ছুঁড়ে দিতে পেরেছেন তিনি আরিত্রীকের দিকে। সেটি হাতে পেয়ে শত্রুর দিকে ফিরেই টেবিলের ধার থেকে তার উঠে আসা মাথাটা পরিষ্কার দেখতে পেলেন আরিত্রীক; পলকের মধ্যেই তার ছোঁড়া গুলি শত্রুর মাথা ভেদ করে চলে গেল অপর প্রান্তে! সশব্দে মাটিতে পড়ে গেল শত্রুর দেহ!!

 

দীর্ঘ কয়েকটি শ্বাস নিলেন আরিত্রীক; তিনি বুঝতে পারছিলেন প্রতিটি মুহুর্ত্তে মৃত্যুর করাল থাবার দিকে এগিয়ে চলেছেন তিনি। কোনমতে উঠে পিস্তলটিকে সামনের দিকে বাড়িয়ে টালমাটাল পায়ে এগিয়ে চললেন আরিত্রীক। মৃত, ভূপতিত শত্রুর কাছে এসে একটানে খুলে ফেললেন তার মুখের মাস্ক, হালকা আলোর দিকে তার মুখটা ঘুরিয়ে ধরতেই চমকে উঠলেন সবিষ্ময়ে!

 

-“মেজর ধীঁলোন?”

 

বাঁ কানের রগের কাছে গুলি লেগে ঘিলু ছটকে এসেছে বাইরে, মুখের বাঁ দিকটিও ফেটে গিয়ে প্রায় বিকৃত, তার মধ্যে ঘরের আলো-আঁধারি পরিবেশ; কিন্তু নিজের পুরোন মেজরকে চিনতে এক সেকেণ্ডও দেরি হয় নি আরিত্রীকের। এতক্ষণে ষড়যন্ত্রের গোড়ায় পৌঁছতে পেরেছেন তিনি, চিনতে পেরেছেন দলের ভিতরে লুকিয়ে থাকা বিশ্বাসঘাতকটিকে।

 

-“আমি হয়তো থাকব না, কিন্তু আমার ভেবে আনন্দ লাগছে যে তুমিও আর বেঁচে থেকে কোন চক্রান্ত করতে পারবে না…শুয়োর কোথাকার!”

 

স্বগতোক্তির মত কথাকয়টা বলে ঘৃণাভরে মেজর ধীলোনের মুখটিকে একপাশে ঘৃণাভরে ঠেলে দিলেন তিনি। উঠে দাঁড়াবারও আর শক্তি অবশিষ্ট নেই আরিত্রীকের মধ্যে; কোনমতে হ্যাঁচরাতে হ্যাঁচরাতে তিনি ফেরৎ এলেন মেঝেতে পড়ে থাকা দহনার কাছে, কোনমতে পাশে বসে নিজের কোলে তুলে নিলেন দহনার মাথা।

 

-“নীলকাকু…?”

 

দহনার মাথায় পরম স্নেহে হাত বোলাতে বোলাতে দুবার ঘাড় নাড়ালেন আরিত্রীক; কিছু বলবার জন্য ওষ্ঠ নড়ে উঠেছিল তার, কিন্তু আর কিছু বলবার সুযোগ পেলেন না তিনি; তার আগেই-

 

হঠাৎ প্রথমে যেন একটা কালো পর্দা নেমে এল তার চোখের ওপর; গাঢ় অন্ধকারে কিছুই ঠাওর হচ্ছিল না আশেপাশে। তারপর…ধীরে ধীরে সরে গেল সেই পর্দা! উজ্জ্বল আলোয় ভরে উঠল চারদিক। অন্ধকারে চোখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আরিত্রীকের, এখন ধীরে ধীরে চোখ মেললেন তিনি। উজ্জ্বল আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে আসা ব্যাপারটি সয়ে যেতেই পাশে তাকিয়ে এখন খেয়াল করলেন- তার দত্তক নেওয়া মেয়ে দহনা তার পাশেই পা ছড়িয়ে বসে; অপার আনন্দে উজ্জ্বল তার কোমল চোখদুটি নিয়ে একরাশ হাসি ছড়িয়ে আরিত্রীকের দিকে তাকিয়ে। এ তো সেই দহনা, যাকে বহুবছর আগে আরিত্রীক খুঁজে পেয়েছিলেন, স্লীম্যানাবাদের সেই বধ্যভূমিতে!

 

-“নীলকাকু…”- ডেকে উঠল দহনা-

 

-“‘নীলকাকু’? না রে মামনি…আজ থেকে আমি কিন্তু তোর বাবা!”

 

একটু অভিমান হল নাকি দহনার, কথাটা শুনে? খানিকক্ষণ ছলছল চোখে তার দিকে তাকিয়ে থেকে অবশেষে কচি গলায় সে বলল-

 

-“তাহলে তুমি আর আমাকে নিতে এলে না কেন সেদিনের পর? ওরা এসে আমাকে জোর করে তুলে নিয়ে গেল-”

 

-“ভুল হয়ে গিয়েছে রে মা! ওরা যে চালাকি করছে তা আমি বুঝতে পারি নি…তারপর যখন তোকে নিতে গেলাম তখন শুনলাম তুই নাকি হোম থেকে চলে গিয়েছিস…কত খুঁজলাম তোকে…”

 

শুনতে শুনতে আবার হাস্যময় হয়ে উঠল দহনা; আরিত্রীকের কথা শুনে উজ্জ্বল হাসিতে ভরে উঠল তার মুখ। কথা শেষে এবার উঠে পড়ল সে, পাকা মেয়ের মত বলে উঠল-

 

-“আচ্ছা, ঠিক আছে। তোমাকে তাহলে এবার থেকে ‘বাবা’ বলেই না হয় ডাকব! এবারে চল আমার সাথে-”

 

-“কোথায় রে মা?”

 

-“কেন? আমাদের বাড়িতে?”

 

-“আমাদের বাড়ি! কোথায়?”

 

উত্তরে আর কোন কথা না বলে উল্টোদিকে হাত বাড়িয়ে ধরল দহনা; সেদিকে তাকিয়ে বিষ্মিত হয়ে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন আরিত্রীক। নিজের মনের অজ্ঞাতে তার মুখ দিয়ে ‘বাঃ’ শব্দটি বেরিয়ে এল!

 

সামনেই একসার ঘন সবুজ গাছের সারির মধ্য দিয়ে সরু, পায়ে চলা এক চিলতে রাস্তা; ঘন গাছপালার মধ্য দিয়ে ফাঁকে-ফোঁকরে দেখা যাচ্ছে পিছনে অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়ানো একটি পুরনো ধাঁচের বাড়ি। অজস্র পাখিদের কলতান গোটা পরিবেশ জুড়ে। মুগ্ধ হয়ে সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন আরিত্রীক, চোখ নামাতে পারলেন না এই অপার সৌন্দর্য্যের দিক থেকে!

 

-“তাহলে এরকমই দেখতে…গ্রীন জোন? এ তো স্বর্গ!”- স্বগতোক্তি করে উঠলেন আরিত্রীক।

 

-“পিছনে একটা ইয়া ব্বড় পুকুরও আছে, জান বাবা?”

 

-“তাই মা?”

 

আর কিছু না বলে তার নতুন বাবার দিকে নিজের কচি হাত বাড়িয়ে ধরল দহনা। একপলক পিছনে ঘুরে দেখলেন আরিত্রীক- নাঃ! কোন বিপদ নেই কোথাও পিছনে, তাদের ঘাড়ে লাফিয়ে পড়বার জন্য! নির্দ্বিধায় দহনার বাড়ানো হাত ধরলেন তিনি; তারপর দুজনে এগিয়ে চললেন সামনে- শান্তির পথে, আলোর পথে, হাত ধরাধরি করে…

 

*****************************************************************************

 

-“সরি স্যার, কিন্তু কয়েকঘন্টা আগে এখানে একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গিয়েছে। অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দারা ‘ল এনফোর্সেস’ বিভাগে খবর দেন…এখানে একটি গানফাইট চলে…বেশ কয়েকটি মৃতদেহ পাওয়া গিয়েছে এখান থেকে। আপনাকে একটু কনফার্ম করতে হবে…”

 

বিহ্বল চোখ নিয়ে তাকিয়ে রইলেন পাণ্ডে, তিনি আর কোন কথা শুনতেও পাচ্ছেন না, বলতেও পারছেন না! তার বন্ধুর বাসা তিনি ভালো করেই চেনেন। কতদিন বলেছেন বন্ধুকে, এই ধরণের নিরাপত্তাবিহীন জায়গা ছেড়ে সেনা-ব্যারাকের মধ্যে এসে থাকতে…ছলছল চোখে অসহায়ের মত তাকিয়ে রইলেন তিনি।

 

তাকে অবশ্য ততক্ষণে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ভিতরে; চাদরে ঢাকা দুটি দেহের সামনে এনে দাঁড় করানোর পর মহিলা ‘এনফোর্সার’টি বললেন-

 

অ্যাপার্টমেন্টের লোকেরা পুরুষটির মৃতদেহ শনাক্ত করেছে; উনি এখানকার অনেকদিনের বাসিন্দা। আমরা অবশ্য মহিলাটির মৃতদেহ শনাক্ত করতে…আপনি কি চেনেন একে?

 

প্রথম দেহের মুখ থেকে চাদর সরাতেই একটি তীব্র শক খেলেন পাণ্ডে; তার স্নেহের আরু শুয়ে রয়েছেন প্রস্তরবৎ, কঠিন মুখ নিয়ে। কিন্তু… তাই কি? বন্ধুর মৃতদেহ দেখে মাথাঘোরার প্রাথমিক ধাক্কা সামলে উঠে এবার ভালো করে তাকালেন পাণ্ডে- একটি প্রসন্ন, স্মিত হাসি দেখা যাচ্ছে না বন্ধুর মুখে? যাক, সুখের মৃত্যু মরেছে ব্যাটা…স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন পাণ্ডে।

 

-“একটিই গুলি লেগেছে, একদম সরাসরি হার্টে। মহিলাটির দেহে অবশ্য মাল্টিপল উণ্ডস দেখা গিয়েছে…”- বলে উঠলেন মহিলা অফিসারটি। কোন কথা না বলে এবার পাশে শুয়ে থাকা মৃতদেহটির মুখের ঢাকনা সরালেন পাণ্ডে। একটি অল্পবয়ষ্ক মেয়ের মুখ, চোখদুটি খোলা, স্থির। মেয়েটির ঘাড় একদিকে একটু কাৎ করতেই ঘাড়ের পিছনদিকের ট্যাট্টু করা পক্ষীরাজ ঘোড়া যেন তাকে লক্ষ্য করে সজোরে হেসে উঠল!

 

-“আমার বন্ধু এবং ‘কুম্ভ’ বাহিনীর প্রাক্তন অ্যাসোসিয়েট কমাণ্ড- ক্যাপ্টেন আরিত্রীক মজুমদার ও তার দত্তক নেওয়া কন্যা, দহনা।”

 

-“আপনি কনফার্ম করছেন?”

 

আর কথা না বাড়িয়ে ঈষৎ ঘাড় নাড়লেন পাণ্ডে। তারপর চুপচাপ তিনি বসে রইলেন মৃত বন্ধুর পাশে। মুখোমুখি 

দেওয়ালে দেওয়াল-ঘড়ির কাঁটা এগোতে লাগল টিক টক শব্দ করে…


Cover Image photos downloaded from Pixabay Images: 

girl-child image

man with gun


Story©Aritra Das


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

The Legacy of Ram: Prologue- Part4 (দ্যা লেগ্যাসি অফ্ রাম: আদি পর্ব- অধ্যায়৪)- A mystery, post-apocalyptic fiction Bengali Novel series by Aritra Das

দ্যা লেগ্যাসি অফ্ রাম- আদি পর্ব (The Legacy of Ram- Prologue):  অধ্যায়৪  ( PART4 ) - A Bengali science fiction, mystery, suspense thriller and post-apocalyptic fiction novel series by Aritra Das, the Bengali writer   The Legacy of Ram: Prologue (আদি পর্ব) Part4 [দ্যা লেগ্যাসি অফ্ রাম- আদি পর্ব (প্রলগ) গল্পটির প্রথম তিনটি পর্ব প্রকাশিত হয়ে গিয়েছে, পেজে গল্পের শেষে অন্যান্য লিঙ্কগুলি পাওয়া যাবে। অবশ্যই পড়বেন] দ্যা লেগ্যাসি অফ্ রাম: আদি পর্ব- অধ্যায়৪ অধ্যায়৩ থেকে শেষের কিছুটা অংশ- -“অভিযুক্ত… দ্যূহ… অভিযুক্ত… দ্যূহ… দ্যূহ…” একটি কথাই পর্যায়ক্রমে উচ্চারণ করে চলেছে ‘মদন’! অস্পষ্টভাবে ‘ব্যূহ’ কথাটি মহর্ষির কানে শোনাল ‘দ্যূহ’। কিন্তু সেদিকে তখন মন নেই তাঁর, তিনি শুধু বিস্মিত এই ভেবে যে এই আদিম মানব দম্পতি তা হলে কথা বলতেও সক্ষম! তিনি আবিষ্ট হয়ে তাকিয়েই থাকলেন তাদের দিকে। -“বিচারকরা সকলেই আপনার জন্য অপেক্ষমান, মহর্ষি! চলুন, আর বেশি দেরি করা উচিৎ হবে না। আমি উপযাচক হয়ে এগিয়ে এসেছিলাম আপনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আসুন।” -“আমাকে পথ দেখান, ভগবান!”   মাথা নীচু করে ভগবান শ্রীবি

What is the story-plot of the series? A Summery from the Writer's End of the Series of The Legacy of Ram- A Bengali science fiction action-adventure and Suspense novel by Aritra Das, the Author

দ্যা লেগ্যাসি অফ্ রাম- নিঃসঙ্গ যাত্রার সূচনা - গল্পের প্লট ও এই প্রসঙ্গে কিছু কথা আপনাদের সাথে - © অরিত্র দাস Discussing the plot of The Legacy of Ram by Aritra Das এর আগের ব্লগটিতে আলোচনা করা হয়েছিল মূলতঃ ‘লেগ্যাসি’ সমগ্রটির চরিত্রগুলির নামকরণ নিয়ে বিশদে। এই ব্লগে আমি গল্পটির প্লট নিয়ে দু-চার কথা আলোচনা করব; তবে আলোচনা যত দীর্ঘই হোক না কেন, যা বলব তার থেকে বাকি থেকে যাবে অনেক বেশি! এতটা দীর্ঘ, জটিল, বিভিন্ন তত্ত্ব ও প্রাচীন সভ্যতাগুলিকে ছুঁয়ে যাওয়া ঘটনাবহুল উপন্যাস এই ‘লেগ্যাসি’ পর্বটি যে একে একটি সীমিত ক্ষেত্রে বেঁধে রাখা খুবই কষ্টসাধ্য কাজ!   এই প্রসঙ্গে প্রথমেই যে কথাটি স্বীকার করে নেওয়া ভাল তা হল- আমি মহাকাব্যের একটি অন্ধ অনুকরণ গড়ে তুলতে চাই নি!   এই ছোট্ট কথাটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রসঙ্গক্রমে অনেকগুলি কথা চলে আসে মনে, কিন্তু সেই সব কথার পুরোটা এই একটি ব্লগের মধ্যে লিখে ফেলা সম্ভব নয় (যেমনটা প্রথমেই উল্লেখ করেছি), তাই আমি যা লিখব, তা হবে আমার সেই চিন্তাধারার একটি নির্যাস মাত্র, পুরো বিষয়টি কিন্তু নয়।   আরও একটি কথা বলে রাখা প্রয়োজন, ‘লেজেণ্ড’ বা ‘লেগ্যাসি’- কোনটিই কিন্তু কোন

A Confession from the Writer's End Part2 on the Series of The Legacy of Ram- A Bengali science fiction action-adventure and Suspense novel by Aritra Das, the Author

দ্যা লেগ্যাসি অফ্ রাম- নিঃসঙ্গ যাত্রার সূচনা প্রসঙ্গে দু-চার কথা পর্ব২- বিবিধ চরিত্রগুলির নামকরণ - © অরিত্র দাস On the new novel 'The Legacy of Ram' এর আগের আলোচনায় মোটামুটি ‘লেগ্যাসি’ পর্বটির মূল ধারাটি আপনাদের কাছে তুলে ধরেছিলাম; এই পর্বে আমি আলোচনা করব এই সমগ্রটিতে ব্যবহার করা নামগুলি প্রসঙ্গে। প্রসঙ্গক্রমে আপনাদের জানাই- মূল গল্পটি প্রাথমিকভাবে ভেবে রাখা হয়েছিল আগেই, কিন্তু ‘সলতে পাকানোর পর্বে’ এসে যে বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে বেশি ঝামেলায় পড়েছিলাম- চরিত্রগুলির নাম, ও সঙ্গতি মিলিয়ে আনুষঙ্গিক কিছু স্থান বা অন্যান্য বিষয়ের নামকরণ। একটু খোলসা করলে বিষয়টি আশা করি পরিষ্কার হবে।   যেমনটি আমি আগেও বলেছি- ‘লেগ্যাসি’ সমগ্রটিতে গল্প কিন্তু এগিয়ে চলেছে পৃথক, সমান্তরাল দুটি খাতে। এই দুটি খাত কখনোই একটি বিন্দুতে এসে মিলিত হতে পারে না, কারণ- এদের সময়কাল ভিন্ন। একটি খাত গন্ধর্বদের নিয়ে, আধুনিক মানব বিকাশের অনেক আগের সময় সেটি; এমন একটি সময়কাল যখন গন্ধর্বরা প্রযুক্তিগতভাবে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি। কিন্তু- তাদের বিলাসিতা, জীবনের মূল্যবোধ সম্পর্কে পরিবর্তিত দৃষ্টিভঙ্গী এবং স্বজাতির প্রতি ভ্রান্ত নী