Bahujuger Opaar hote (বহুযুগের ওপার হতে...) Suspense thriller, Paranormal Story and Historical fiction by Aritra Das on Mystic Tune of Tales
বহুযুগের ওপার হতে…
©অরিত্র দাস
-“রাষ্ট্রের প্রতি কর্তব্যপরায়ণ একজন দায়িত্বশীল নাগরিক
হিসেবে মহারাজের আদেশ পালনে আমি বাধ্য হে মহামন্ত্রী! আপনি আদেশ করুন।”
-“এটি আদেশ নয় সৌভদ্র, এটি অনুরোধ! এই দুঃসাহসিক কার্যে
দুটি বিষয় রয়েছে যা আপনাকে জয় করতেই হবে। প্রথমটি- আপনার মধ্যে লুকিয়ে থাকা ভয়। অভিযান
শেষে আপনি মগধে ফিরে নাও আসতে পারেন। অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এই কাজ! তাই মনস্থির করে বলুন।
আপনি সরে দাঁড়াতে চাইলে তা রাজদ্রোহীতা হিসেবে পরিগণিত হবে না। দ্বিতীয়টি- আপনার ভিতরে
লুকিয়ে থাকা লোভ। অনন্ত লোভ জয় করতে হবে আপনাকে। নাহলে সাধারণ্যে অপ্রকাশিত ঐ বস্তুটি
আপনি আপনার ব্যক্তিগত লালসায় ব্যবহার করতে চাইলে তৎক্ষণাৎ দেবতাদের সকল অভিশাপ বর্ষণ
হবে আপনার ওপর! এবারে বলুন- পারবেন তো এই দুস্তর কার্যটি করতে?”
-“আপনাকে আশ্বস্ত করলাম হে মহামন্ত্রী কৌটিল্য। মৌর্য
সম্রাটের বিরুদ্ধাচারণ করা, সাম্রাজ্যের বিরোধীতা করবার কোন মনোগত অভিপ্রায় আমার নেই।
আদেশ অনুসরণ করে এই কার্য আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করব। এখন দয়া করে বলুন- আমায় কি করতে
হবে-”
-“আমাদের কাছে গচ্ছিত থাকা দেবতাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ
যন্ত্র তাঁদের মন্দিরে গিয়ে প্রত্যার্পণ করে আসতে হবে।”
-“মহারাজ!”
আজ সকালে প্রকাশ্য সমাবেশে একটি বিশেষ ঘোষণা হয়; বহু-প্রতাপাণ্বিত
মৌর্য সম্রাট ও মৌর্য রাজবংশের স্থপতি মগধ-নরেশ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য প্রকাশ্যে অবসর ঘোষণা
করে সাম্রাজ্য নিজ পুত্র বিন্দুসারের দায়িত্বে অর্পণ করেছেন। তাঁর এই সিদ্ধান্তে অন্য
অনেকের মতই বিষ্মিত হয়েছিলেন সৌভদ্রও; এত হঠাৎ-সিদ্ধান্ত কেন? কানাঘুষোয় কিছু কথা শোনা
যাচ্ছিল বেশ কয়েকদিন ধরেই, সম্রাট নিজেও লোকসমক্ষে দর্শন দিচ্ছিলেন খুব অল্পই। তবে
গুজব ভেবে সেসব কথা উড়িয়ে দিয়েছিলেন প্রথমে। কিন্তু তারপর তিনি বিষ্মিত হয়ে যান যখন
স্বয়ং মহামন্ত্রী তাকে তলব করেন গুপ্ত অধিবেশন কক্ষে, একান্তে। সৌভদ্র আশা করেছিলেন
কেবল মহামন্ত্রী কৌটিল্যের সাহচর্য্য; কিন্তু দুজনের কথার মাঝখানে হঠাৎ সম্রাটের আগমন
চকিত করে তোলে দুজনকেই! বহু-প্রতাপাণ্বিত মৌর্যসম্রাটের গলার আওয়াজের পিছন পিছন তাঁর
দীর্ঘ, বলিষ্ঠ চেহারাটি অধিবেশন কক্ষের মধ্যে প্রবেশ করতেই আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ান দুজনেই,
সৌভদ্র প্রণাম জানান সম্রাটকে সসম্ভ্রমে।
-“তুমি? তুমি আবার আসতে গেলে কেন চন্দ্র? আমি তো কথা বলেই
নিচ্ছিলাম-”
-“আপনাকে আমি আমার নিজের অস্তিত্বের থেকেও বেশি বিশ্বাস
করি হে গুরুদেব! সন্দেহ নয়, আমার আসবার মূল কারণ- শংকা! রাজ-অমাত্য সৌভদ্র আমাদের সকলেরই
বিশেষ পরিচিত, আস্থাভাজন ব্যক্তি; বহু বছর উনি নিয়োজিত থেকেছেন রাজত্বের ভালো-মন্দ
দেখাশোনার কার্যে। এই কারণেই আপনি ছাড়া আর কারোর ওপরেই আমি আস্থা রাখতে পারি নি।”
শেষ কথাটি সম্রাট বললেন সৌভদ্রের দিকে তাকিয়ে, প্রত্যুত্তরে
মাথা নত করে সম্রাটকে আবার প্রণাম জানালেন তিনি। তারপর বললেন-
-“মহারাজ, আমার ওপরে ন্যস্ত হতে চলা দায়িত্বটি যদি একটু
বিশদে বলেন-”
একটু থমকে গেলেন সম্রাট, খানিকক্ষণের জন্য ভাবালু হয়ে
এল তাঁর মন। বেশ কিছুটা সময় নীরব থেকে অবশেষে তিনি বললেন-
-“সাম্রাজ্যের ঊষাযুগ তখন; একদিক থেকে বিদেশি যবনদের উৎপাত,
আরেকদিক থেকে নন্দদের সুবিশাল সৈন্য- সাঁড়াশির প্যাঁচে পড়ে ক্রমাগত আক্রমণে আমরা বিপর্যস্ত।
সাম্রাজ্যের রাজদণ্ড তখনও নন্দদের হাতে, আমাদের শক্তিবৃদ্ধিতে শংকিত হয়ে ওরা পূর্ণমাত্রায়
আক্রমণ হেনে চলেছিল আমাদের ওপর। বিদেশি যবনদের অধিপতি অলোকসুন্দর তখন এখানে ছিলেন না;
তাঁর অধীনস্থ এক সেনাপতির হাতে সাম্রাজ্যের দায়িত্বভার অর্পণ করে তিনি চলে গিয়েছিলেন
অন্যত্র। তিনি থাকলেও পরিস্থিতি হয়তো এতটা জটিল হত না; একইসাথে শক্তিশালী ও শিশুর মত
কোমল এই নরেশ যথেষ্ট স্নেহ করতেন আমায়।
মূলত নন্দদের বিরুদ্ধ-শক্তি হলেও আমার সৈন্যবল তখন মুষ্টিমেয়;
অল্প কিছুদিনের জন্য সাম্রাজ্যের স্বার্থে অপর এক স্বদেশী রাজার সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন
করেছিলাম বটে, কিন্তু সেই সখ্যতা ক্রমাগত বিশ্বাসঘাতকতার ফলে ক্ষণস্থায়ী হয়ে যায়। যাই
হোক, ক্রমাগত নন্দদের আক্রমণে, অনাহারে ও রোগে ভুগে আমাদের সৈন্য দিন দিন হ্রাস পেতে
থাকে; এতটাই, যে পরাজয় স্বীকার করবার প্রায় মুখে এসে দাঁড়িয়েছিলাম। মৃত্যুর প্রায় মুখে
চলে আসি আমি ও গুরুদেব। আর ঠিক এই সময়টিতেই ঘটে এক অভাবনীয় ঘটনা- দেবতাদের সান্নিধ্যলাভ,
তাঁদের আশীর্বাদ!
দেবতাদের অনুগ্রহে বেশ কয়েকটি দৈব অস্ত্র লাভ করি আমরা;
তার মধ্যে অন্যতম- একটি আশ্চর্য ‘নেত্র’! অদ্ভুত এই নেত্র, এর সাহায্যে বহুদূর থেকে
আগুয়মান সেনাদল যেমন চোখে পড়ে, তেমনি আবার কাছিয়ে আসা সেনাদলের মধ্যেও এক ভয়ঙ্কর বিশৃঙ্খলতার
সৃষ্টি করা যায়! এই নেত্র প্রতিপক্ষীয় সেনাদের মনে এক ভয়ঙ্কর বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে,
যার ফলে তারা নিজেরাই নিজেদের হননে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এই বিভ্রম সৃষ্টিকারী অস্ত্রটি,
এবং আনুষঙ্গিক কয়েকটি দৈব অস্ত্রের সাহায্যে অবশেষে আমরা সমর্থ হই হেরে যাওয়া যুদ্ধের
স্রোত নিজেদের দিকে ফিরিয়ে আনতে। বিদেশি যবন ও নন্দ- দুই প্রতিপক্ষকেই ধূলিসাৎ করে
দিয়ে ‘মৌর্য’ সাম্রাজ্যের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনা করতে! এই নিন, একে একবার হাতে নিয়ে
দেখুন।”
অধিবেশন কক্ষে প্রবেশের সময়তেই সম্রাটের হাতে কোন একটি
বস্তু চোখে পড়েছিল সৌভদ্রের, এখন সম্রাট স্বতোপ্রণোদিত হয়ে তার দিকে বস্তুটি বাড়িয়ে
ধরতেই আসন থেকে উঠে তা গ্রহণ করেন তিনি; এরপর খুঁটিয়ে দেখতে থাকেন সেটিকে। তার বিশ্বাস
করতে কষ্ট হচ্ছিল- এরকম ছোট ‘নেত্র’র মত অস্ত্রটির সাহায্যে সত্যিই কি সম্ভব এরকম এক
বিশাল সৈন্যদলকে বাগে আনা? যে সেনাদলের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার সামনে নতিস্বীকার করে
পথ পরিবর্তনে বাধ্য হন স্বয়ং যবনরাজ অলোকসুন্দর, সেই আস্ত ও মস্ত সেনাদলকে কি সত্যিই
বাগে আনা সম্ভব এই একরত্তি ‘নেত্র’র মত বস্তুটি দিয়ে?
পূর্ণবয়ষ্ক মানুষের চোখের আদলে তৈরি এই ‘নেত্র’ হাতের
তেলোর থেকে সামান্য ছোট, কিন্তু অস্বাভাবিক লঘু ওজনের। অসংখ্য আঁকিবুকি কাটা বাহারি
এই নেত্রটির চোখের মণির নীচেই আবার একটি ক্ষুদ্র কীলকের মত কিছু রয়েছে, মনে হয় এই কীলকটিকে
প্রয়োজনে এদিক-ওদিক ঘোরানো যায়। ধাতব অক্ষিপত্রের শেষ কোণে একটি নীলকান্ত মণি রয়েছে,
আর ঠিক তার পাশেই রয়েছে একটি ক্ষুদ্র চক্রের মত কিছু। জায়গায় জায়গায় গোলাকার পুঁতির
মত কিছু যেন চোখে পড়ল, কিন্তু এদের তাৎপর্য্য কিছু বোঝা গেল না। সম্পূর্ণ বিষয়টি কি?
দেখা শেষ করে সম্রাটের দিকে প্রশ্নবোধক চোখে তাকিয়ে রইলেন
সৌভদ্র। তারপর দ্বিধা কাটিয়ে প্রশ্ন করেন তিনি-
-“যদি কিছু মনে না করেন- কয়েকটি প্রশ্ন রাখতে পারি মহারাজ?”
-“করুন।”
-“এগুলি দৈব অস্ত্র- এর অর্থ দেবতাদের সাথে আপনার সাক্ষাৎ
হয়েছিল, তাই তো?”
মৃদু ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত।
-“আপনি ওদের কাছ থেকে সহায়তা নিজে যাচঞা করেছিলেন, না
কি ওঁনারা স্বয়ং স্বতোপ্রণোদিত হয়ে আপনাকে অস্ত্র প্রদান করেন?”
-“দেবতারা নিজে থেকে আমাকে এই অস্ত্রগুলি- হঠাৎ এই প্রশ্ন
কেন, সৌভদ্র?”
-“মহারাজ, পার্থিবদের ব্যক্তিগত মরণশীলতার সংগ্রামে দেবতারা
স্বতোপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে এসে সহযোগিতা করছেন- বিষয়টি কিন্তু তলিয়ে ভেবে দেখবার মতই;
কি কারণে হঠাৎ ওদের এই সক্রিয় সহযোগিতা? যাই হোক, কারণটা জেনেও আমরা কিছুই করতে পারব
না- দেবতাদের লীলা তাঁরাই বুঝুন! প্রশ্নটা হল- ওঁরা কি ওঁদের দান করা সবকটি অস্ত্র
ফেরৎ চেয়েছেন”
-“অন্য অস্ত্রগুলি সম্পর্কে ওঁনারা কিছু বলেন নি, তবে
এই বিশেষ অস্ত্রটি ওঁনারা একটি নির্দিষ্ট জায়গায় ফেরৎ দিতে বলেছিলেন। সেটিই করতে চলেছি
আমরা সকলে মিলে এখানে।”
-“দেবতারা কি নির্দিষ্ট কোন সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন প্রত্যার্পণের
বিষয়ে?”
-“না…ওরা বলেছিলেন প্রয়োজন মিটলে এটিকে স্বগৃহে প্রত্যার্পণ
করতে… অবশ্যই এবং যতটা দ্রুত সম্ভব, নাহলে এই অস্ত্র আমাদের পতনের কারণ হতে পারে-”
এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে ‘নেত্র’টিকে তুলে একবার খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করলেন সৌভদ্র। কি আছে এই একরত্তি বস্তুটিতে যা ফেরৎ পাওয়ার জন্য দেবতারা অধীর? খালি চোখে অবশ্য এর থেকে কিছু বুঝে ওঠা অসম্ভব! খানিকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে অবশেষে হাল ছেড়ে দিলেন তিনি।
-“আর কিছু জানতে চান, অমাত্য সৌভদ্র?”
-“আরও একটি প্রশ্ন ছিল, মহারাজ; কিন্তু শোভনতার প্রশ্নে
আমি চুপ করে যাই। আপনি অভয় দিলে প্রশ্নটা করতে পারি-”
-“করুন।”
-“অপরাধ নেবেন না মহারাজ, কিন্তু সত্যিই একটি বিষয়ে কৌতুহল
জাগছে মনে। মৌর্য্য সাম্রাজ্যের শত্রু অনেক; বর্তমান সময়ে মহারাজের বৃদ্ধ বয়স ও অশক্ত
শরীরের দূর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে শত্রুরা একটু একটু করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে সাম্রাজ্যের
বিভিন্ন প্রান্তে। আর আজ সকালের ঘোষণার পর তারা নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়বে সাম্রাজ্যের
বিনাশসাধনে। নতুন সম্রাট সিংহাসনে ভালো করে জাঁকিয়ে বসবার আগেই তারা চাইবে আসন ছিনিয়ে
নিতে। মূল শত্রু যবনরাও তাদের হৃত সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় নিজেদের শক্তি আবার
সংহত করছে বলে সংবাদে প্রকাশ। এমতাবস্থায় এরকম একটি শক্তিশালী অস্ত্রকে আপনি কাছছাড়া
করতে চাইছেন কেন?”
বেশ কিছুটা সময় নীরব রইলেন সম্রাট; বোধহয় তিনি মনে মনে
ভাবছিলেন এই ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তর দেবেন কি না। নীরবে সৌভদ্রও তাকিয়ে রইলেন মহারাজের
মুখের দিকে। বেশ কিছুক্ষণ পর অবশেষে সব জড়তা কাটিয়ে মুখ খুললেন সম্রাট-
-“কোন সাম্রাজ্যের সূচনার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে তার ধ্বংসের
বার্তা। আজ অবধি এমন একটি রাজবংশের নামোল্লেখ করুন তো সৌভদ্র, যার বিনাশ হয় নি? নেই,
খুঁজে পাবেন না। যখনই কোন নতুন রাজবংশ স্থাপনা হয়েছে তখনই তার বিরুদ্ধ শক্তিরও স্থাপনা
হয়েছে; সিংহাসনের বেলাতেও সেই একই নিয়ম- পূর্ববর্ত্ত রাজার অনুগত কর্ম্মী কোন কারণে
তার পুত্রকে রাজা হিসেবে দেখতে চান নি, এরকম উদাহরণও আছে। ‘আজীবন’ শব্দটি অলীক, রাজ-অমাত্য!
জাগতিক ও মরণশীল হিসেবে আমরাও কিন্তু এই নিয়মের বাইরে
নই। আজীবন আমি চেষ্টা করে গিয়েছি আমার সাম্রাজ্যকে সুদৃঢ় নিয়ম ও শৃঙ্খলার বন্ধনে বাঁধতে,
কিন্তু ভিতরেই যদি বিষবৃক্ষের বীজ লুকিয়ে থাকে তবে বাহ্যিক আড়ম্বর জমিয়ে রেখে লাভ কি?
গতকাল সকালে একটি ঘটনা ঘটে। আমার নাতিদের মধ্যে কয়েকজন
মৃগয়ার জন্য জঙ্গলে যাওয়া স্থির করে, একত্রে। এমনি সময়ে এরা একে অপরের প্রতি খড়্গহস্ত,
কিন্তু জঙ্গলে আসন্ন বিপদের কথা মাথায় রেখে এরা একত্রিত হয়।
এরা কিন্তু কেউই একটি বিষয় জানত না; বিশাল এই জঙ্গলে হাতির
সংখ্যা প্রচুর, আর ক্ষেত্রবিশেষে হাতি ধরবার জন্য বড় বড় ফাঁদ হিসেবে গর্ত খুঁড়ে রাখা
ছিল! জঙ্গল সম্পর্কে এদের অনভিজ্ঞতা ও পথপ্রদর্শক না নিয়ে যাওয়াটা যে মূর্খামী তা এরা
বুঝতেই পারে নি, কিন্তু এই বুঝতে না পারার মূল্য এদের চোকাতে হচ্ছিল একটু হলেই!
অর্বাচীনগুলির অজ্ঞতার পরিণাম বোঝা গেল একটু পরেই- সাধারণ
ভূমি ও হাতি ধরবার বিরাট গর্তের মধ্যে প্রভেদ করতে না পেরে বোকার মত তাতে পা দিয়ে ফেলে
দুইজন, ফলে দুজনেই পড়ে যায় গর্তে!”
চোখ বড় বড় করে মহারাজের কথা শুনছিলেন সৌভদ্র; বিষ্ময়ে
তিনি প্রশ্ন করে ওঠেন-
-“তারপর?”
-“অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। সৌভাগ্যক্রমে ফাঁদ-পাতিয়েদের একটি
দল ঘুরে দেখতে এসেছিল তাদের পাতা ফাঁদে কিছু পড়ল কি না; হাতির পরিবর্ত্তে দুই রাজপুত্রকে
সেখানে পেয়ে শশব্যস্তার সাথে তাদের উদ্ধার করে এরা তাদের ফেরৎ নিয়ে আসেন রাজধানীতে।
রাজকুমাররা এখন সংকটমুক্ত।”
-“এ তো অত্যন্ত আনন্দের কথা, মহারাজ! ইশ্বরকে ধন্যবাদ-”
-“কম আনন্দের কথাগুলি বরং বলি সৌভদ্র? দুজন গর্তে পড়েছিলেন
বটে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ঐ দলে ছিলেন তিনজন! তৃতীয়জনটি আমার কনিষ্ঠতম নাতি- অশোক; সপ্তমবর্ষীয়
এই বালক কিভাবে এবং কিসের কারণে ঐ বিপজ্জনক জঙ্গল অবধি পৌঁছল এই প্রশ্ন তুলবেন না,
গণ্ডগোলটি অন্যত্র!”
একটু নড়েচড়ে বসলেন সৌভদ্র; মহারাজের বলা এই নির্দোষ কথাগুলির
মধ্যে একটু অন্যরকম গন্ধ পেলেন তিনি। ‘সপ্তমবর্ষীয় এক বালক দুঃসাহসিক অভিযানের ডাকে
সাড়া দিয়ে তার দাদাদের সাথে জঙ্গলে গিয়েছিলেন’- বিষয়টি কি সত্যিই এতটা নির্দোষ নাকি
এর মধ্যে অন্য কোন গল্প লুকিয়ে আছে? কিছু না বলে মহারাজের দিকে তাকিয়ে থাকলেন তিনি।
মহারাজ অবশ্য কথা বলেই যাচ্ছিলেন একনাগাড়ে-
-“…সংকটমুক্ত হওয়ার পর সুসীমা-র সাথে কথা হয়; তার বক্তব্য,
তারা নিজে থেকে গর্তে পড়ে যায় নি, তাদের ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। আর এই কীর্তির নায়ক
আমার গুণের ছোট নাতি- অশোক!”
-“রাজকুমার অশোক? ঐ সপ্তমবর্ষীয় বালক? কিন্তু কেন? আপনি
কিছু জিজ্ঞেস করেন নি-”
-“অশোকের ভাষ্য অনুযায়ী তার দাদারা জঙ্গলের মধ্যে চেষ্টা
করেছিল তার প্রাণহরণ করতে, তাই বাধ্য হয়ে-”
চুপ করে গেলেন সৌভদ্র। ঠিক এই আশংকাটাই করছিলেন তিনি।
খানিকক্ষণ গুম হয়ে বসে থেকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন-
-“কজন জানেন বিষয়টি?”
-“সুসীমার পাশে আমি বসে ছিলাম, গুরুদেব স্বয়ং ও আমার পুত্র
বিন্দুসার- ব্যাস! বাইরের কাক-পক্ষীতেও ঘূণাক্ষরে টের পায় নি বিষয়টি।”
বেশ কিছুটা সময় নীরব থেকে মহারাজ আবার বলে উঠলেন-
-“সৌভদ্র, আস্ত জীবনকাল কাটিয়ে উঠে আজ আমি বার্ধক্যে।
জেতবার লক্ষ্যে প্রতিশোধস্পৃহায় পরিচালিত হয়ে জীবনের বিভিন্ন দশায় নানান কঠিন সিদ্ধান্ত
আমাকে নিতে হয়েছে যা সাধারণের যুক্তিতে বিশ্লেষণ করলে- নৃশংস! নিজের হাতে নিজের বন্ধুর
গলা কেটেছি রাত্রির অন্ধকারে ঠগীদের মত, ব্যক্তিগত আগ্রহে যুদ্ধপ্রচেষ্টার অন্যতম সহযোগীকে
হত্যা করেছি সাম্রাজ্য একা ভোগ করবার মোহে, বিভিন্ন প্রশ্নগুলিকে সমাধান করবার মোহে
সাম-দান-দণ্ড-ভেদ নীতি গ্রহণ করেছি বিনা দ্বিধায়, নির্বিকারচিত্তে। কিন্তু জীবনের অন্তিম
লগ্নে পৌঁছে সাম্রাজ্যের ভবিষ্যতের প্রশ্নে আজ আমি সত্যিই পরাস্ত! পুত্র বিন্দুসার
অত্যন্ত অপছন্দ করে তার এই কনিষ্ঠতম সন্তানটিকে, আবার উল্টোদিকেও তাই; অশোক প্রায় সহ্যই
করতে পারে না তার পিতাকে! বাস্তব বিচার করে বুঝলাম- আমার প্রেক্ষাপট থেকে সরে যাওয়াতেই
মঙ্গল। পিতৃহত্যার ইতিহাস আমাদের বংশে প্রথম নয়।”
বুকটা কেঁপে উঠল সৌভদ্রের, মহারাজের মুখে এই শেষ কথাটি
শুনে। এর আগে কানাঘুষোয় শুনেছিলেন তিনি ব্যাপারটা- মহারাজ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের জন্ম
কিন্তু কোন রাজপরিবারে নয়। ‘মুরী’ নামক কোন দাসীর গর্ভে প্রয়াত নন্দবংশীয় রাজা ধননন্দের
ঔরসে জন্ম হয়েছিল এঁনার; আবার যুদ্ধের পর ধননন্দের মৃত্যু ঘটেছিল মহারাজ চন্দ্রগুপ্তেরই
কোন এক গুপ্তঘাতকের হাতে; এক হিসেবে দেখতে গেলে… সেই কথাটারই কি স্বীকারোক্তি বেরিয়ে
এল মহারাজের মুখ দিয়ে?
নীরবে মহারাজের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন সৌভদ্র।
-“জৈনধর্মের মূল সুরটি আগেই আকৃষ্ট করেছিল আমায়; দীক্ষাগ্রহণ
আগেই হয়ে গিয়েছিল। গতকালকার এই ঘটনার পর বাণপ্রস্থে যাব বলে মনস্থির করেছি। আচার্য্য
ভদ্রবাহু আহ্বাণ জানিয়েছেন দাক্ষিণাত্যে তার সাথে যোগদান করবার জন্য; কিন্তু তার আগেই
আমি চাই- দেবতাদের উদ্দেশ্যে করা আমার এ অঙ্গীকার পালন করতে। এই উদ্দেশ্যেই আপনাকে
স্মরণ করা, এখন আপনি আমাকে এই গুরুদায়িত্ব থেকে মুক্ত করুন!”
মহারাজের কথার মধ্যে কিন্তু কোন আদেশ ছিল না, ছিল অনুনয়ের
বিষাদ! তা ধরতে পেরে কিছুক্ষণের জন্য হেঁট হয়ে গেল সৌভদ্রের মাথা, তারপর মাথা তুলে
তিনি বললেন-
-“আপনার আদেশ আমার শিরোধার্য; জীবনের ঝুঁকি নিয়ে স্বয়ং
আমি যাব আপনার নির্দেশ পালন করতে, দেবতাদের মন্দিরে এই বিপজ্জনক অস্ত্রটি প্রত্যার্পণ
করতে। কিন্তু তার আগে আপনাকে আরও একবার ভেবে দেখতে অনুরোধ করছি মহারাজ, সাম্রাজ্যের
ভবিষ্যৎ সুরক্ষার প্রশ্নে এত বলশালী অস্ত্রটি কাছছাড়া করতে আপনি সম্মত তো? সাম্রাজ্যে
অনধিকারপ্রবেশ ঘটবে না তো এর অনুপস্থিতিতে?”
-“দেবতাদের দান করা অপর অস্ত্রগুলি তো থাকবেই, ওদের দান
করা জ্ঞানবাণীতেও আমি হাত দিই নি ভবিষ্যতের প্রশ্নে। কিন্তু এই একটি ব্যাপারে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
তাছাড়া- গুরুদেব তো রইলেনই সঠিক মার্গনির্দেশের জন্য…”
-“বেশ। কবে তাহলে আমি যাত্রা শুরু করব, মহারাজ?”
-“কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই বটে, তবে যথাসম্ভব শীঘ্র
যাত্রা শুরু করাটাই বাঞ্জনীয় হবে…”- এতক্ষণে কথা বলে উঠলেন মহামন্ত্রী কৌটিল্য। গোটা
সময়টা জুড়ে তিনি চুপচাপ ছিলেন, শুনছিলেন দুইপক্ষের কথাবার্তা।
-“বেশ। তাহলে না হয় কাল ভোরেই মহামন্ত্রী-”
-“উত্তম, অমাত্য সৌভদ্র! তবে আরও একবার আপনাকে মনে করিয়ে
দিতে চাই- অভিযান অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ, পথ বিপদসংকুল। আপনি হয়তো আর কোনদিনই মগধে প্রত্যাবর্তন
করতে পারবেন না-”
-“রাজ-অনুগ্রহে একটি দীর্ঘ সময় মগধ তথা সাম্রাজ্যের দায়িত্বপালন
করেছি আনন্দের সাথে, হে মহামন্ত্রী! আপনারা শুধু আশীর্বাদ করুন, আমি যেন সফলকাম হই।”
একথায় সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালেন মহাপ্রতাপাণ্বিত সম্রাট
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য; দুহাত তুলে তিনি আশীর্বাদ করলেন রাজ-অমাত্য সৌভদ্রকে। আশীর্বাদ
সেরে তিনি উদাত্ত গলায় বললেন-
-“সঙ্গত কারণেই এই অধ্যায়টি আমরা গোপন রাখতে বাধ্য; সময়ের
আগে দেবতাদের অস্তিত্বের প্রশ্নটি মানুষের কাছে যত গোপন রাখা যায় ততই মঙ্গল; নাহলে
জনসমাজে অহেতুক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হতে পারে। হে সৌভদ্র, আপনার এই আত্মবলিদান বৃদ্ধা
ইতিহাসের কাছে অনূক্ত থেকে যাবে, কিন্তু কথা দিচ্ছি, আপনার অনুপস্থিতিতে আজীবন আপনার
পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব রাজবংশ নেবে। এ আমার প্রতিশ্রুতি! এখন গুরুদেবের সঙ্গে
যান। গন্তব্যস্থলের মানচিত্র ও আপনাকে সোপর্দ করা অস্ত্রটির কিছু প্রাথমিক প্রয়োগবিধি
উনি দেখিয়ে দেবেন আপনাকে যাতে পথে হঠাৎ সম্মুখীন হওয়া বিপদে আপনি অক্ষত থাকেন। এখন
আসুন তাহলে…”
সকলের অলক্ষ্যে একটি ছায়ামূর্তি সরে গেল গুপ্তকক্ষের একমাত্র
জানলাটির সামনে থেকে।
এই একরত্তি, ‘নেত্র’র মত বস্তুটি যে কি বিষম ও ভয়ানক বস্তু তা এখন হাড়ে হাড়ে বুঝেছেন সৌভদ্র।
মগধের গুপ্ত অধিবেশন কক্ষে মহারাজের সঙ্গে তার দীর্ঘ আলাপচারীতার
পর তিনি বিদায় নিলে সৌভদ্রকে নিয়ে একটি অপেক্ষাকৃত ছোট, নির্জন কক্ষে প্রবেশ করেন মহামন্ত্রী
কৌটিল্য। সেখানে তাকে একটি মানচিত্র দেওয়া হয়, যা থেকে বোঝা যায় যে উদ্দিষ্ট গন্তব্যস্থলটি
হিমালয় পর্তমালার কেন্দ্রে, পার্বত্য কোন এক অঞ্চলে অবস্থিত। এরপর ‘নেত্র’র প্রয়োগবিধি
সম্পর্কে কিছু প্রাথমিক শিক্ষা দান করেন মহামন্ত্রী; যদিও তার আগে তাকে বারংবার সাম্রাজ্যের
প্রতি তার দায়িত্বের কথা, সম্রাটের প্রতি কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়; মনে
করিয়ে দেওয়া হয় সম্রাটের প্রতি সৌভদ্রের প্রতিজ্ঞা ও আনুগত্যের বাণী। বিষ্মিত সৌভদ্র
প্রথমে বুঝে উঠতে পারেন নি একই কথা তাকে বারংবার শোনানো হচ্ছে কেন, কিন্তু অনেক পরে
তিনি এর তাৎপর্য্য বুঝতে পারেন রাজধানী থেকে অনেক দূরে, ‘করাল’ নামক এক ভয়াবহ বনভূমির
মাঝখানে। এই অস্ত্র হাতে পড়লে সাধারণ যে কোন মানুষের মনে সাম্রাজ্যের প্রতি লালসা জন্মানো
স্বাভাবিক!
যাওয়ার সময় ‘নেত্র’ পরিধানে অনুমতি দিয়েছিলেন কৌটিল্য-
শর্তসাপেক্ষে। সেই অনুযায়ী রাজধানীর প্রাচীর অতিক্রমণের পর ‘নেত্র’ পরে নেন সৌভদ্র।
এতে অবশ্য খুব বেশি সমস্যা হয় নি; বামচোখে সেটিকে মাপে মাপে বসাতেই দিব্যি আটকে গেল
সেটি চোখের সঙ্গে। ‘নেত্র’ পরে অবশ্য অবস্থার খুব বেশি কিছু তারতম্য অনুভব করেন নি
তিনি। এভাবেই একটানা চলে অবশেষে তিনি উপস্থিত হলেন ‘করাল’ বনভূমির প্রান্তসীমায়।
‘মগধ’ থেকে উত্তর-পশ্চিমে অনেকটা ছড়ানো এই বনাঞ্চল প্রকৃতপক্ষে
দুষ্কৃতিদের চারণভূমি- বহুযুগ ধরে ডাকাতদের স্বাভাবিক বাসস্থান হিসেবে পরিগণিতহওয়া
এই বনভূমি পারতপক্ষে এড়িয়ে চলতেন লোকজন। দিনের আলোতেও এখানে রাত্রির অন্ধকার; রাত্রিকালে
তো কথাই নেই! ডাকাতদের সঙ্গে বন্য শ্বাপদদের একত্র উপদ্রব- প্রাণ রাখাটাই তখন সবচেয়ে
বড় দায়! এই বনভূমি এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলেন সৌভদ্র, কিন্তু ঘুরে গেলে সময় ও ঝুঁকি, দুইই
বেড়ে যেত অকারণে। সাতপাঁচ ভেবে শেষে তিনি অশ্বের মুখ ঘোরান বনের দিকেই-
আর জঙ্গলপথে বেশ কিছুটা পথ অতিক্রম করবার পরই বিপদের সম্মুখীন
হন তিনি- কোথা থেকে একদল দস্যু এসে তার পথ আটকে দাঁড়ায়!
সৌভদ্র ‘অমাত্য’ পদাধিকারী বটে, কিন্তু তিনিও যথেষ্ট বলশালী
পুরুষ। ছোটবেলা থেকেই অস্ত্রচালনা বা শারীরিক অভ্যাসের সঙ্গে পরিচিত তিনি, যুদ্ধবিদ্যায়
যথেষ্ট আগ্রহ ছিল তার। সামনে দস্যুরা এসে দাঁড়াতেই তৎক্ষণাৎ শর ছুঁড়ে দুইজনকে ভূপতিত
করেন তিনি; কিন্তু অবশিষ্ট দস্যুরা তাকে মিলিতভাবে আক্রমণ করলে তিনি প্রমাদ গোণেন;
এতগুলি শত্রুর বিরুদ্ধে একা তিনি লড়াই করবেন কিভাবে? প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে প্রতিরোধ
করে তিনি কিছুটা সুবিধাজনক জায়গায় আসেন বটে, কিন্তু ক্রমশঃ তিনি বুঝতে পারেন যে অধিক
প্রতিরোধ নিষ্ফল- অশ্বের সুবিধা ও পিছনের গাছপালার অন্তরাল তাকে বেশিক্ষণ শত্রুদের
হাত থেকে বাঁচাবে না! এখনই বিকল্প কিছু ভাবতে হবে, নয়তো দেরি হয়ে যাবে।
হঠাৎ তার মনে পড়ে যায় ‘নেত্র’র কথা; মহামন্ত্রী কৌটিল্য
তাকে বলেছিলেন শত্রু অধিক হলেও তাদের হাত থেকে বাঁচতে ব্যবহার করা যেতে পারে একে, এই
সংক্রান্ত বেশ কিছু প্রয়োগবিধিও শিখিয়ে দেন তিনি। শেষ চেষ্টা হিসেবে একে প্রয়োগ করে
দেখাই যাক না কি হয়?
-“লাগে তুক, না লাগে তাক…যদি সত্যিই এই অস্ত্র কাজ করে
তাহলে আছি, নাহলে-”
যুদ্ধ করতে করতে তুলনামূলকভাবে ফাঁকা, প্রশস্ত একখণ্ড
ভূমিতে চলে এসেছিলেন সৌভদ্র, এবার লাফ দিয়ে তিনি নেমে এলেন অশ্বের পিঠ থেকে। বাম চোখ
থেকে ‘নেত্র’ খুলে তা হাতে ধরে হাত বাড়িয়ে দেন পশ্চাদ্ধাবনকারী দস্যুদের দিকে। এরপর
দাঁতে দাঁত চিপে ‘নেত্র’র মধ্যে থাকা নীলকান্তমণিটিকে একবার সজোরে চাপতেই-
দিনের আলোর মতন উজ্জ্বল আলোকরাশি বেরিয়ে এল ‘নেত্র’ থেকে,
বেরিয়ে এসেই তা স্পর্শ করল সামনে দৌড়ে আসা প্রতিটি দুষ্কৃতিকেই, আর তারপরই-
দেখা গেল এক বিষম বিশৃঙ্খলা; দুর্ধর্ষ দস্যুদলের প্রতিটি
সদস্য হাঁউমাঁউ করে চেঁচিয়ে উঠল সমস্বরে, সমবেতভাবে! বিষ্মিত সৌভদ্র দেখলেন- পা টলছে
তাদের, কেউই যেন সুস্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না একজায়গায়, উম্মত্তের মত আচরণ হয়ে উঠছে
তাদের! এইভাবে কিছুকাল চলবার পর হঠাৎ যেন ঘুম ভেঙে উঠলেন তারা সকলেই, সক্রোধে ফিরে
তাকালেন তারা একে অপরের দিকে, আর তারপরই যা ঘটল তা এককথায় বলতে গেলে- ‘কীচকবধ’!
দস্যুদের দেখে মনে হল যেন আজম্মকালের শত্রুকে দেখতে পেয়েছে
তারা নিজের দলের মধ্যেই- এতটাই জিঘাংসা ও ঘৃণা ফুটে উঠল তাদের অভিব্যক্তিতে পরষ্পরকে
দেখে; প্রচণ্ড আক্রোশে গর্জ্জন করে উঠল তারা একে অপরকে দর্শনমাত্র, তারপরই তারা ফেটে
পড়ল একে অপরের ওপর! হানাহানি, কাটাকাটি…বেশ কিছুক্ষণ নিজেদের দলের মধ্যেই প্রবল যুদ্ধ
চলবার পর অবশেষে যখন তা থামল তখন দেখা গেল- দু-চারজন বাদে দলের প্রতিটি সদস্যই মৃত!
সৌভদ্রের বিষ্মিত চোখের সামনে পুরো দলটিই প্রায় শেষ হয়ে গেল; বিশৃঙ্খলভাবে তাদের দেহগুলি
পড়ে রইল মাটিতে, চোখে-মুখে ভয়ংকর যাতনা ও জিঘাংসার মিশ্র অনুভূতি মেখে!
‘নেত্র’ থেকে আলো বেরোন অবশ্য বেশ কিছুক্ষণ আগেই বন্ধ
হয়ে গিয়েছিল। সামনের দস্যুদলটিতে যে কয়েকজন তখনও বেঁচে ছিল তাদের সৌভদ্র দূর থেকেই
শর ছুঁড়ে বধ করেন; এত উম্মত্তের মত আচরণ করছিল তারা যে সাহস করে আর কাছাকাছি যেতে পারেন
নি তিনি! তারপর সব শেষ হয়ে যাওয়ার পর এতক্ষণে নেত্রটি বের করে একদৃষ্টে সেটিকে নিরীক্ষণ
করতে থাকেন সৌভদ্র।
-“বুঝলাম!”- নিজের মনে স্বগতোক্তি করে ওঠেন সৌভদ্র- “এতক্ষণে
বুঝেছি কিসের আশংকা করছিলেন মহারাজ! সীমাহীন শক্তিসম্পন্ন এই অস্ত্র যদি কোন লোভী মানুষের
হাতে পড়ে, তবে কি হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়! না! এই অস্ত্র কখনোই ভুল হাতে পড়া উচিৎ
নয়!!”
‘নেত্র’কে স্বস্থানে আটকে নিয়ে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা অশ্বের
পিঠে একলাফে চড়ে বসলেন সৌভদ্র, শক্ত হাতে টেনে ধরলেন লাগাম। অভিযানের যথাযথ গুরুত্ব
বুঝেছেন তিনি; এখন লক্ষ্যে যেভাবেই হোক পৌঁছতেই হবে।
-“সিদ্ধা…”- অশ্বের কানের কাছে প্রায় ঝুঁকে পড়ে ফিসফিস
করে উঠলেন সৌভদ্র- “এখন কিন্তু তোর ঘাড়ে অনেক দায়িত্ব রে মা! এই ভয়ংকর অস্ত্রটিকে তার
সঠিক জায়গায় রেখে দিয়ে আসতে হবে, যে করেই হোক ওখানে পৌঁছতে হবে। তুই আমাকে নিয়ে যাবি
তো রে ওখানে?”
প্রত্যুত্তরে দুবার মাথা ঝাঁকাল সিদ্ধা, তারপর প্রবল এক
হ্রেষাধ্বণির সাথে আচমকা পিছনের দুটি পায়ে ভর দিয়ে কিছুক্ষণের জন্য উঠে দাঁড়াল সে।
সৌভদ্র বুঝে গেলেন সিদ্ধার মনোভাব, তেজি এই অশ্ব এখন শুধু দৌড়তে চায় সামনের দিকে! আর
দেরি করলেন না তিনি- লাগাম আলগা করে অশ্বের পেটের দুদিকে পা দিয়ে মৃদু আঘাত করতেই এগিয়ে
চলল সিদ্ধা, এক সরলরেখায় সোজা সামনের দিকে তীব্র গতিতে…
-“সুভাডোরাস! সুভাডোরাস!!”
খরস্রোতা নদীর এপ্রান্তের ভীমকায় উঁচু পাথরের প্রান্তসীমায়
দাঁড়িয়ে নীচের জলস্রোত ও তার আশপাশ ভালো করে পর্যবেক্ষণ করছিলেন সৌভদ্র; একটা উপায়
খুঁজছিলেন এই উঁচু পাথর থেকে নেমে খরস্রোতা নদীটিকে পার করে অপরপ্রান্তে পোঁছনোর। এতটাই
বিভোর ছিলেন তিনি পর্যবেক্ষণে যে পিছনে চলে আসা শত্রুদের সমাগম তিনি টের পান নি, এতক্ষণে
তার চটকা ভাঙল পিছন থেকে অশুদ্ধ, বিদেশী উচ্চারণে তার নাম ধরে কেউ ডাকাতে!
মুখোমুখি খাড়া দুটি বিশাল পাথরের মধ্য দিয়ে সরু খরস্রোতা
নদীটি বয়ে চলেছে পূর্ণবেগে। এখানকার পাহাড়ি নদীগুলি তেমন চওড়া নয়, কিন্তু স্রোত দুর্মদ!
সৌভদ্রের অবস্থান থেকে এগিয়ে নদীটির গতি কিছুটা খর্ব হয়েছে আড়াআড়ি এক সারিতে সজ্জিত
কয়েকটি পাথরে ধাক্কা খেয়ে; নদীর নীচ থেকে উঠে আসা এই পাথরখণ্ডগুলি পরপর এত সুন্দর সারিতে
একটি সেতুর মত বিন্যস্ত যাতে এগুলির সাহায্যে নিরুপদ্রবভাবে অপর প্রান্তে পৌছনো যাবে।
এই পাথরগুলিতে ধাক্কা খেয়ে নদীর তীব্র স্রোত একটু যেন থিতিয়ে এসেছে, তারপর মন্থর গতিবেগে
আরও বেশ কিছুটা পথ সামনে এগিয়ে খাড়া নীচের দিকে একটি জলপ্রপাত সৃষ্টি করে নেমে গিয়েছে
নদীটি। জলের ওপর পাথরের সারির অপরপ্রান্তের দৃশ্য অবশ্য খুব পরিষ্কার নয়, অদ্ভুত এক
কুয়াসার চাদর ঘিরে রেখেছে পাথরসীমার অপর প্রান্তের পুরো অঞ্চলটিকে, হয়তো তীব্র গতিবেগজনিত
কারণে সৃষ্ট জলোচ্ছাসই এই কুয়াসার কারণ, কে জানে? নদী পারাপারের জন্য পাথরখণ্ডগুলিকে
ব্যবহার করা যেতেই পারে, কিন্তু প্রশ্নটা হল- সৌভদ্র এই ভীমকায় পাথরের চূড়ো থেকে নামবেন
কোন পথ বেয়ে? ওপারে অবশ্য নদীর সমতলে কিছুটা পাড় দেখা যাচ্ছে বটে!
‘করাল’ বনভূমির বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার পর লোকালয়ে আর রাত্রিবাস
করবার সাহস দেখান নি সৌভদ্র; একজায়গায় বেশিক্ষণ থাকেনও নি, শুধু বিশ্রামের সময়টুকু
ছাড়া। জনপদগুলিকে যথাসম্ভব এড়িয়ে পথ চলেছেন তিনি; ভিড় বা লোকালয়ের মধ্যে যেতে হলে
‘নেত্র’ লুকিয়ে রেখেছেন গুপ্তস্থানে; এককথায়- সকলপ্রকার সাবধানতা অবলম্বন করেছিলেন
তিনি কৌতুহলি চোখগুলির থেকে নিজেকে এবং মহারাজের সোপর্দ করা বিপজ্জনক অস্ত্রটিকে লুকিয়ে
রাখতে। কিন্তু এত সতর্কতার পরেও বিধির বিধান খণ্ডানো যায় নি!
হিমালয় পর্বতমালার সীমানায় পৌঁছে একটু বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন
করলেন সৌভদ্র। এই পর্বতমালার কোলে ‘পাঙ্খৌলি’ নামক প্রদেশটিকে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলেন
তিনি। জনশ্রুতি অনুযায়ী বহুযুগ আগে পাহাড়ের গায়ে যখন ডানা লাগানো থাকত তখন কোন একবার
অনেকগুলি পাহাড় গা ঘেঁষাঘেঁষি করে নেমে এসে জড়ো হয়েছিল এক জায়গায়। পাহাড়গুলি যেখানে
নেমে আসে সেখানে একটি জনপদ ছিল; তার ওপর পাহাড়গুলি এসে বসাতে কি পরিমান বিশৃঙ্খলতা
ও অরাজকতার সৃষ্টি হয় তা সহজেই অনুমেয়! এখানকার মানুষদের দূর্দশায় দেবরাজ ইন্দ্র অত্যন্ত
ব্যথিত ও ক্রোধাণ্বিত হয়ে ওঠেন; সসৈন্য এসে তিনি ক্রোধে সবকটি পাহাড়ের পাখা কেটে দেন,
ফলে পাহাড়গুলি যুগ-যুগান্ত ধরে নিশ্চল, স্থবির হয়ে পড়ে থাকে এই অঞ্চলেই। এই কারণেই
এই প্রদেশটিতে পাহাড়ের পরিমান এত বেশি!
জনশ্রুতি নিয়ে অবশ্য এত মাথাব্যথা ছিল না সৌভদ্রের, তার
সতর্কতার কারণ অন্যত্র।
যবনরাজ অলোকসুন্দর জম্বুদ্বীপ ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় নব
অধিগৃহীত সাম্রাজ্যের দায়িত্বভার দিয়ে যান তাঁর অধীনস্থ বিশ্বস্ত এক সেনাপতির কাঁধে;
সৌভদ্র পরিচিত তাঁর চেহারার সঙ্গে, রাজকার্যে কয়েকবার যেতে হয়েছিল তাকে যবনদের সভায়,
বেশ কয়েকবার দেখেছেন উনি যবনরাজ অলোকসুন্দর নিয়োজিত এই সর্বাধিনায়ককে। এমনিতে স্বভাবভদ্র
এই মানুষটি কিন্তু সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রশ্নে ভীষণই কড়া ধাতের মানুষ; সম্রাটের প্রস্তাবগুলি
বাতিল করে দিয়ে তিনি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পড়েন, যদিও সম্রাটের প্রবল পরাক্রমের
সামনে তিনি কিছুই করে উঠতে পারেন নি। লম্বা একটি সময় যুদ্ধের পর অবশেষে পরাজয় স্বীকার
করেন এই সর্বাধিনায়ক; সন্ধির শর্ত অনুযায়ী যে অঞ্চলটি মৌর্য সম্রাটের অধীনস্থ হয় তা
সাম্রাজ্যের পশ্চিমে পঞ্চনদীর রাজ্য থেকে আরম্ভ করে প্রায় পারস্যদেশ অবধি বিস্তৃত ছিল!
কিন্তু জম্বুদ্বীপের উত্তরে হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলগুলিতে বিদেশি সর্বাধিনায়কের প্রভাব
অক্ষুন্নই থাকে। ফলত, এখন তিনি যেখানে দাঁড়িয়ে সেই ‘পাঙ্খৌলি’ প্রদেশ প্রকৃতপক্ষে শত্রু-এলাকা।
এখানকার অজস্র গিরিকন্দর শত্রু-অধ্যুষিত। ঘুরপথে শত্রুর নজর এড়িয়ে চলাটাই তখন সৌভদ্রের
প্রাথমিক লক্ষ্য।
চূড়ান্ত সতর্কতা অবলম্বন করে পথ চলছিলেন সৌভদ্র; ক্ষেত্রবিশেষে
‘নেত্র’র দূরবীক্ষণ কাজে লাগিয়ে গিরিগুহাগুলির অভ্যন্তরেও চোখ রেখেছেন তিনি, যদিও বেশিরভাগ
ক্ষেত্রেই তা কাজে দেয় নি। গুহাগুলির অভ্যন্তরে এত অন্ধকার যে নজরে পড়ে নি কিছুই। এভাবেই
নিরুপদ্রবে বেশ কিছুটা পথ অতিক্রমও করেন তিনি। কিন্তু…
কিন্তু বিধি বাম! কোন একটি গিরিখাত অতিক্রমণের পর তিনি
বুঝতে পারেন- পিছনে লোক লেগেছে। তখনই কিছু করেন নি তিনি, কিন্তু অপর একটি প্রান্তর
অতিক্রমণের সময় তিনি একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেন- অন্তত জনা-পঞ্চাশেক অশ্বারোহী দূর থেকে
পিছু নিয়েছে তার! বিষয়ের গুরুত্ব বুঝে অশ্বের গতি বাড়িয়ে দেন সৌভদ্র।
আর একটি বিষয় নিয়ে অবশ্য চাপা অস্বস্তির মধ্যে আছেন তিনি।
বোঝাই যাচ্ছে এই অশ্বারোহীর দল অনেকক্ষণ ধরে পিছু নিয়েছে সৌভদ্রের, কিন্তু এরা একটিবারের
জন্যও কিন্তু কাছিয়ে আসে নি, দূর থেকে পিছু ধাওয়া করেছে তাকে। এতদূর থেকে ‘নেত্র’ বিশেষ
কিছু কাজে আসবে না- মহামন্ত্রী কৌটিল্য দূরত্বের বিষয়টা বুঝিয়ে বলেছিলেন তাকে। তার
মানে…এরা কি জানে তার কাছে কি রয়েছে, এবং তার শক্তি কতখানি? দূরত্বের সুবিধা নিয়ে লুকিয়ে
পড়তে চেয়েছিলেন সৌভদ্র; কিন্তু এই পার্বত্য অঞ্চলটিকে বিদেশি যবনরা বেশ ভালো করেই চেনে
বোঝা গেল। যখনই সৌভদ্র আবার এগিয়ে গিয়েছেন আপদ বিদেয় হয়েছে ভেবে, অশ্বারোহী যবনরা ঠিক
খুঁজে বের করেছে তাকে! শেষে হাল ছেড়ে দেন তিনি, ‘সিদ্ধা’কে প্রাণপণে চালানো ছাড়া দ্বিতীয়
কোন রাস্তা ছিল না তার কাছে।
তবে সব সন্দেহের নিরসন ঘটল দ্বিপ্রহরে। মানচিত্রে গন্তব্যের
অবস্থান অনুযায়ী তার ঠিক সামনে একটি জঙ্গল পড়ে। দূর থেকে অবশেষে জঙ্গলটি দেখতে পান
সৌভদ্র। অশ্বের মুখ সেদিকে চালনা করতেই তার মনে হল- অনুসরণকারীরা চলে এসেছেন অনেকটা
কাছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে যেতেই একটি শর ‘সাঁ’ করে তার গলার কাছ দিয়ে বেরিয়ে গেল- অল্পের
জন্য জীবনরক্ষা হল তার! সোজা সামনে তাকাতে অবশ্য আর কোন শর ধেয়ে আসে নি তার দিকে।
-“বুঝে গেছে! ওরা জানে আমার কাছে কি আছে, কি আমার উদ্দেশ্য;
শুধু জানত না আমার গন্তব্য! এইজন্যই আমাকে অনুসরণ করা!!”
মনে মনে স্বগতোক্তি করলেন সৌভদ্র, তারপর সিদ্ধার গতি বাড়িয়ে
নিলেন। পিছনে লেগে থাকা অশ্বারোহী দলটির গতিও অবশ্য বেড়ে গেল তৎক্ষণাৎ! পিছনে ফিরে
আর তাকানোর প্রয়োজন নেই, তিনি বুঝে গিয়েছেন যে পিছনে তাকালেই ওরা শর চালাতে দ্বিধা
করবে না!
জঙ্গলে ঢুকে পড়বার পর একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটল! শেষের
কয়টি দিন প্রায় একটানা দ্রুতগতিতে চলে শারীরিক পরিশ্রমে একটু ক্লান্ত ছিল ‘সিদ্ধা’,
যদিও প্রভুকে একবারের জন্যও বুঝতে দেয় নি সে তার কষ্ট; জঙ্গলের মাঝামাঝি অংশে এসে আর
পথ চলতে পারে নি বেচারি অশ্ব; শ্রান্তিতে ধীরে ধীরে মাটিতে নেতিয়ে পড়ল সে, আর উঠল না!
অশ্বের দূরবস্থা দেখে তার পিঠ থেকে আগেই নেমে পড়েছিলেন সৌভদ্র, এখন তার মাথায় হাত বুলোতে
গিয়ে তিনি দেখেন- তার প্রিয়তম বাহন মৃত!
-“ঘুমিয়ে পড় সিদ্ধা মা! তুই তোর অর্ধের কাজ করেছিস, এখন
আমার অর্ধের পালা!!”
পিছনের জঙ্গলে খসখস করে আওয়াজ আসতেই ঘন অন্ধকারের মধ্যে
ফিরে তাকালেন সৌভদ্র; কাউকে দেখতে পেলেন না বটে, কিন্তু একটি শর অন্ধকার থেকে বেরিয়ে
এসে তার মাথার পাশ কেটে বেরিয়ে আমূল গিঁথে গেল পিছনের গাছের গুঁড়িতে! ইঙ্গিতটা পরিষ্কার;
এর অর্থ- ‘পিছনে তাকিও না’! নীচু হয়ে শায়িত সিদ্ধার পাশ থেকে তুলে নিলেন প্রয়োজনীয়
বস্তুসামগ্রী, তারপর সৌভদ্র সোজা দৌড় লাগালেন সামনের দিকে। বাকিটা পথ দৌড়েই অতিক্রম
করলেন তিনি।
এইভাবে একটানা সামনে দৌড়ে চলেই অবশেষে জঙ্গলের সীমানা
অতিক্রম করে তিনি এসে পৌঁছান রুক্ষ, পাথুরে প্রান্তরটির প্রান্তসীমায়। নীচেই সেই খরস্রোতা
নদী, আর অপর পাড়ে তার গন্তব্য- নদীর সমতলে একুখানি পা রাখবার মত পাড়, তারপরই শুরু একটি
ঢালুপথ যা সোজা উঠে শেষ হয়েছে পাশাপাশি দুটি গুহাসমেত একটি পাহাড়ের পাদদেশে; পাশাপাশি
দুটি গুহাপথের একটি থেকে বেরিয়ে এসেছে ক্ষীণ একটি জলের ধারা যা সোজা এসে মিলিত হয়েছে
নীচের খরস্রোতা নদীতে, তারপর দোঁহায় মিলে সোজা সামনে এগিয়ে গিয়ে জলপ্রাত হয়ে ঝরে পড়েছে
নীচে। পুরো এলাকাটিই যেন এক বিষণ্ণ কুয়াশার চাদরে মোড়া।
দাঁড়িয়ে পড়ে ভাবছিলেন সৌভদ্র অদূরে সজ্জিত আড়াআড়ি পাথরের
সারি অবধি পৌঁছবেন কি করে, এমন সময় পিছন থেকে বিদেশি, অশুদ্ধ উচ্চারণে তার নাম শুনে
পিছনে তাকান তিনি…এবং…বিষ্মিত হয়ে যান!
তার ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়ে একসার ধানুকি, সবকটি ধনুকে শর
জোড়া এবং প্রতিটি শরের মুখ তার দিকে ফেরানো। কিন্তু বিষ্ময় এখানে নয়। বিদেশি সৈন্যগুলির
মধ্য থেকে দীর্ঘ, বলিষ্ঠ চেহারার যে দলপতি এগিয়ে এলেন সামনে তাকে তো ভালো করেই চেনেন
সৌভদ্র; ইনি তো সেই সেনাপতি যার ঘাড়ে সাম্রাজ্যের দায়িত্বভার অর্পণ করে প্রস্থান করেছিলেন
যবনরাজ অলোকসুন্দর! ওঁনার অবর্তমানে ইনিই তো সর্বাধিনায়ক, তাহলে শাসনভার ফেলে রেখে
সৌভদ্রের পিছু ধাওয়া করে এঁনার কি লাভ? দ্রুত চারদিকে একবার তাকিয়ে দেখলেন সৌভদ্র,
নাঃ, পালাবার কোন পথ খোলা নেই!
-“পালাবার চেষ্টা করে কোন লাভ নেই সুভাডোরাস! তোমাকে আমরা
সব দিক দিয়ে ঘিরে- ‘নেত্র’ থেকে হাত সরাও, ওতে তুমি নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনবে! দুদিকে
হাত ছড়িয়ে দাঁড়াও পাখিদের মত…হ্যাঁ, ওতেই হবে।”- অশুদ্ধ উচ্চারণে স্থানীয় প্রাকৃত ভাষায়
বলে উঠলেন সর্বাধিনায়ক; এই অঞ্চলে বহুবছর কাটানোর সুবাদে আঞ্চলিক ভাষাগুলির সঙ্গে পরিচিত
তিনি।
-“আপনি জানতেন আমি যে আসতে চলেছি এখানে? কিভাবে?”- সর্বাধিনায়কের
কথামতন দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন সৌভদ্র। তার প্রশ্নের উত্তরে সর্বাধিনায়ক বললেন-
-“তোমাদের রাজসভায় সদাই আমাদের গুপ্তচর নিয়োজিত ছিল। হ্যাঁ,
আমি জানি ‘নেত্র’র ব্যাপারে, সেই তলোয়ার ও সেই মায়াবি চাদরের বিষয়ে, যা দেবতাদের কাছ
থেকে স্যাণ্ড্রোকোটাস লাভ করেছিলেন…যুদ্ধক্ষেত্রে আমাদের অজেয় সেনা বারংবার বিপর্যস্ত
হয়েছে এই মায়াবি বস্তুগুলির কাছে, নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়েছি আমরা। আজ তোমার কাছ
থেকে প্রথমে ‘নেত্র’ উদ্ধার করব, তারপর স্যাণ্ড্রোকোটাসের কাছ থেকে বাকি সবকটি দৈব
সামগ্রী, তারপর…গোটা জম্বুদ্বীপ অধিকার করতে কতক্ষণ?”
‘তলোয়ার’, ‘মায়াবি
চাদর’? সর্বাধিনায়ক কি ক্রমাগত পরাজয়ে উন্মাদ হয়ে গিয়েছেন? এসব বিষয়ে…ও হ্যাঁ, কয়েকটি
দৈব অস্ত্রের বিষয়ে মহারাজ একবার উল্লেখ করেছিলেন বটে, কিন্তু সেগুলি কি সেই বিষয়ে
ঘূণাক্ষরেও জানান নি কিছু! অজস্র প্রশ্ন নিয়ে সর্বাধিনায়কের মুখের দিকে তাকালেন সৌভদ্র।
-“স্যাণ্ড্রোকোটাস এই বিষয়ে আর কিছু বলে নি না তোমাকে?
জানতাম! ও, আর ওর ঐ ধূর্ত শৃগালের মতন মন্ত্রণাদাতা ব্রাহ্মণটি! যাক, আমরা ভালোমতই
চিনি ওর অস্ত্রগুলিকে, তাই আর বেশি কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। ‘নেত্র’টা দাও, কোন ক্ষতি হবে
না তোমার। আর হ্যাঁ, কোনপ্রকার চালাকি তোমার মৃত্যু- না!!”
চতুর সর্বাধিনায়ক বোধহয় ভেবেছিলেন কথার মারপ্যাঁচে ভুলিয়ে
সৌভদ্রকে বন্দী করবেন, কিন্তু সৌভদ্রও যে একজন পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ এই সত্যটি ভুলে
গিয়েছিলেন তিনি। সর্বাধিনায়কের কথার মাঝখানে কয়েকপা পেছিয়ে যান তিনি, তারপর পিছনে ঘুরেই
সটাং ঝাঁপ মারেন খরস্রোতা নদীর জলে! আর্তনাদ করে উঠেছিলেন সর্বাধিনায়ক, সৌভদ্রকে জলে
ঝাঁপ মারতে দেখে।
নদীগর্ভে প্রথমে বেশ কিছুক্ষণ ডুবে থাকেন সৌভদ্র, তারপর
অবশেষে তার দেহটা এসে ঠেকে যায় জলের নীচ থেকে মাথা তুলে দাঁড়িয় থাকা পাথরের সারিগুলির
মধ্যে একটি মধ্যম আকৃতির পাথরে। সেটি ধরে জল থেকে ওপরে উঠে আসেন তিনি, তারপর টানটান
হয়ে শুয়ে পড়েন পাথরের মেঝের সমতলে। হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছিলেন সৌভদ্র; জলের তীব্র স্রোতের
বিরুদ্ধে তার এই কয়েক মুহুর্তের সংগ্রাম যেন শরীর থেকে পুরোটা দম শুষে নিয়েছিল প্রায়!
পাথরের ওপর টানটান হয়ে শুয়ে থেকে হাঁ করে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলেন
সৌভদ্র, এতক্ষণে অনেকটা ধাতস্থ হয়ে উঠেছেন তিনি। তিনি শত্রুদের নাগালের বাইরে, এখন
পাথরগুলি টপকে ওপাড়ে যাওয়াটা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। একটু অন্যমনষ্ক হয়ে গিয়েছিলেন তিনি,
পরপর ঘটে যাওয়া উত্তেজক মুহুর্তগুলির তাড়নায়, এমন সময় একটি তীক্ষ্ণ নির্দেশের আওয়াজ
তার কানে ভেসে আসাতে তাকিয়ে দেখেন- যে উঁচু পাথরটি থেকে তিনি ঝাঁপ মেরেছিলেন নদীগর্ভে,
তার প্রান্তসীমায় সার বেঁধে দাঁড়িয়ে ধানুকির দল- উদ্যত ধনুক হাতে!
ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ালেন সৌভদ্র; আর রক্ষা নেই! তাকে জীবন্ত
ধরতে না পেরে এবারে তাকে ধরবার মরীয়া চেষ্টায় শরবর্ষণ করতে চলেছেন সর্বাধিনায়ক! সামনের
পরপর বিন্যস্ত পাথরখণ্ডগুলির দিকে তাকালেন তিনি, একমুহুর্ত সময় নিলেন, তারপর সোজা দৌড়
লাগালেন সামনের দিকে। আর ঠিক সেই মুহুর্তেই আরও একটি তীক্ষ্ন আওয়াজের সাথে সাথে অজস্র
শর ধেয়ে এল তার দিকে, বাতাসের বুক চিরে!
ঈশ্বরের অসীম করুণায় অবশেষে অক্ষত দেহে অপর পাড়ে পৌঁছান
সৌভদ্র। নিরুপদ্রবেই পৌঁছান তিনি; শত্রুদের নিক্ষেপ করা শরগুলির একটিও কেশাগ্রও স্পর্শ
করতে পারে নি তার! অক্ষত দেহেই পৌঁছিয়ে গিয়েছেন তিনি অপর সীমায়, ঢালুপথের ঠিক মুখটিতে।
নদীর অপরপাড়ে দেখা যাচ্ছে বলিষ্ঠ সর্বাধিনায়কের হতাশ দেহাবয়বটি; বিজয়গর্বে তার দিকে
তাকিয়ে মনস্থির করলেন সৌভদ্র, এঁনার হতাশ মুখশ্রীটি তাকে একবার দেখতেই হবে। এই উদ্দেশ্যেই
‘নেত্র’ সক্রিয় করতে গেলেন তিনি, আর তা করতে গিয়েই-
‘নেত্র’ চোখে নেই! এতক্ষণ ধরে তার বামচোখে আটকে ছিল ‘নেত্র’টি,
কিন্তু এখন যথাস্থানে সেটি নেই! হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন সৌভদ্র; ভয়ের ও আতংকের
একটি ঠাণ্ডা স্রোত নেমে এল তার শিরদাঁড়া বেয়ে! কি হবে এবার?
পাগলের মত আথাল-পাথাল করে নিজের দেহের সর্বত্র ‘নেত্র’কে
খুঁজলেন সৌভদ্র; না নেই! তার স্পষ্ট মনে আছে গোটা সময় ধরে তা বামচোখে সম্পৃক্ত ছিল,
এখন নেই; তার অর্থ জলে ঝাঁপ মারবার পর তীব্র স্রোতের ঝাপটে কোনভাবে চোখ থেকে খুলে গিয়েছে
তা! এর মানে দাঁড়ায়…‘নেত্র’ এখন নদীগর্ভে?
হতাশ হয়ে দূর থেকে ক্ষীণভাবে নজরে আসা কুয়াসার চাদরে মোড়া
জলপ্রপাতের দিকে বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকলেন সৌভদ্র; হতাশায় মাথা নাড়তে লাগলেন তিনি।
‘নেত্র’ ঐ নদীর জলে ভেসে গিয়েছে…দেবতাদের মন্দিরের পাদপ্রান্তে এসে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন
তার অভীষ্ট সাধনে!
সমতল পাড়টিতে দাঁড়িয়ে কোমরে হাত দিয়ে তিনি সেকথাই ভাবছিলেন;
অদূরে ঢালুপথটির সূচনা, ঐখান থেকেই শুরু হালকা কুয়াসার রাজত্ব, এমন সময়-
চমকে উঠলেন সৌভদ্র, কঁকিয়ে উঠলেন যাতনায়! একটি শর এসে
তাকে সরাসরি বিদ্ধ করেছে ডানদিকের পাঁজরের পিছনদিকটা ঘেঁষে! বিষ্মিত হয়ে ফিরে তাকালেন
তিনি- যবন সর্বাধিনায়ক স্বয়ং ছুঁড়েছেন শরটি; এখন সেটি লক্ষ্য বিদ্ধ করাতে বিজয়ীর দৃপ্ত
ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে তিনি উল্টোদিকের ভীমকায় পাথরের চূড়োয়। এতদূর থেকে মুখ দেখা যাচ্ছে
না বটে তার, কিন্তু সৌভদ্র নিশ্চিত- বিজয়ীর উল্লাস সে চোখে-মুখে!
শরটি তাকে আঘাত করেছে সরাসরি পিছন দিক থেকে, অভিমুখ ওপর
থেকে নীচে। অনেকটা বিঁধে রয়েছে শরটি সৌভদ্রের পাঁজর ভেদ করে। শরটিকে টেনে খুলতে গিয়েও
শেষ মুহুর্ত্তে সে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেন তিনি; একে খুললেই যে রক্তপাত হবে তাতে
তার মৃত্যু নিশ্চিত! ওপরে মুখ তুলে দেবতাদের মন্দিরটি একবার দেখে নিলেন তিনি, তারপর
সাত-পাঁচ ভেবে কুয়াসার বলয়ে প্রবেশ করে চড়তে শুরু করে দিলেন তিনি ঢালুপথ বেয়ে। সবার
আগে প্রয়োজন প্রাণরক্ষা, তারপর বাকি কথা।
ঢালুপথটি বেয়ে উঠে আসবার সময় মধ্যিখানে একবারের জন্য পিছনে
ফিরে তাকিয়েছিলেন সৌভদ্র, কিন্তু আরও একটি বিষ্ময় অপেক্ষারত ছিল তার জন্য। উল্টোদিকের
প্রস্তরখণ্ডের চূড়ো সম্পূর্ণ ফাঁকা, পরিত্যক্ত! ঐটুকু সময়ের মধ্যেই অন্তর্হিত হয়ে গিয়েছে
সর্বাধিনায়কসহ যবনদের সম্পূর্ণ দলটি! বিষয়টি তাকে একটু অবাক করলেও এ নিয়ে আর মাথা ঘামান
নি সৌভদ্র; ঢালুপথ বেয়ে সম্পূর্ণ উঠে অবশেষে তিনি ঢুকে পড়েন পাশাপাশি দুটি গুহার মধ্যে
যেটি শুকনো ছিল, সেইটিতে, পিছনের পৃথিবীকে পিছনেই ফেলে রেখে!
[১লা জানুয়ারি, ১৯৭৩- ডান্যাং শহরের ১০ মাইল উপকন্ঠে, দক্ষিণ ভিয়েতনাম]
-“ভি.সি! ডানদিক দিয়ে!!!”
-“বন্দুক হাতে মরা মুরগির মত না ঝিমিয়ে একটু দিল খুলে গুলি কর, ছোঁড়ারা…”
-“মুরগি মরলে আবার ঝিমোবে কি? যত্তসব অপদা-”
-“এটা কি ওয়েলস ইংরেজিতে বাতচিৎ আর কথায় ভুল ধরবার সময়? ডানদিকটা ফাঁকা কর, ডানদিকে…”
-“প্যান্টটা চেঞ্জ করে আসব সার্জ? শেলিং-এর সময় থেকে ভিজা প্যান্ট পরে গুলি চালাচ্ছি-”
-“যাও সামনের ঐ ভি.সি.গুলোকে জিজ্ঞেস করে এস-”
-“ওর আর প্যান্ট চেঞ্জের দরকার হবে না সার্জ…ও গুলি খেয়েছে!”
আড়চোখে নিজের বাঁদিকে তাকালেন সার্জেন্ট গিবস; তার পাশে
দাঁড়িয়ে ভিজে প্যান্ট চেঞ্জের আবেদন জানাচ্ছিলেন কনস্টেবল স্যালি; আবেদন জানানোর পরই
একটাই গুলি লাগে বাম চোয়ালের নীচে, খুব সম্ভবতঃ আর্তনাদ করবারও সময় পান নি তিনি! রক্তস্নাত
হয়ে মাটিতে পড়ে গিবসের আরও একজন সহযোদ্ধা। একপলক তাকে দেখে নিয়েই সামনের অন্ধকার লক্ষ্য
করে গুলি চালাতে লাগলেন গিবস, তিনি ঐভাবে মাটিতে শুয়ে থাকতে চান না!
দক্ষিণ ভিয়েতনামের ডান্যাং শহর থেকে মাত্র দশমাইল দূরে
এসে আটকে গিয়েছিলেন সার্জেন্ট গিবস ও তার ইউনিটের প্রতিটি সদস্য। খাতায়-কলমে ‘অস্ত্রবিরতি’
চলছে; মার্কিন সরকার ভিয়েতনামের মাটি থেকে সমস্ত সৈন্য প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন,
প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গিবসদের ওপরে আদেশ ছিল কাছাকাছির মধ্যে দক্ষিণ ভিয়েতনামের ডান্যাং
শহরের সদর সেনা দপ্তরে রিপোর্ট করতে হবে, পরবর্ত্তী নির্দেশ না আসা অবধি ঐখানেই অবস্থান
করতে হবে। সেই মতন সরে আসছিলেন তিনি, তার ইউনিটের সকল সেনা সমেত।
কিন্তু ‘অস্ত্রবিরতি’-র মাঝখানে আবার আগুন জ্বলে উঠল;
ভিয়েতকংদের কাছে কি বার্তা গেল খোদায় মালুম, আবার শুরু হল যুদ্ধ! এদিকে মার্কিন আর্মির
প্রায় প্রতিটি ইউনিট সরে এসেছে তাদের গুরুত্বপূর্ণ চেকপোস্ট থেকে; এই অবস্থায় নতুন
করে দাবানল জ্বলে উঠতে সবচেয়ে বেশি অসুবিধা ভোগ করলেন তারা। রেশন নেই, সাপ্লাই নেই-
মৃত্যু ছেয়ে ফেলল তাদের চারদিক থেকে! গিবসরাও ফিরছিলেন নিজেদের গন্তব্যে, তারাও আটকা
পড়ে গেলেন স্বস্থানে, ভিয়েতকংদের ক্রমাগত আক্রমণ বিপর্যস্ত করে তুলল তাদের।
‘পিপলস্ আর্মি’র প্রতিরোধ এইভাবে যে তাদের বিপদে ফেলে
দেবে তা বোধহয় ভাবতেও পারেন নি গিবস; শেষ তিনদিন নরকদর্শন হয়েছে তাদের। নিজপক্ষের প্রচুর
যোদ্ধা খুইয়েছেন তারা এই শেষ তিন দিনে; মুষ্টিমেয় যে কয়জন সঙ্গী বেঁচে ছিলেন তাদের
নিয়েই প্রতিরোধ করে কোনমতে শেষপর্যন্ত জয়লাভ করেন তিনি, পশ্চাদপসারণ করে অবশেষে পালাতে
বাধ্য হয় ভিয়েতকংরা! তাদের পক্ষেও যে ক্ষতির বহর মারাত্মক, তা ধরতে পেরেছিলেন গিবস-
যুদ্ধান্তে পড়ে থাকা মৃতদেহের স্তুপ ও উদ্ধার হওয়া অস্ত্রশস্ত্রের বহর দেখে।
যুদ্ধের পর ক্ষয়ক্ষতির সম্পর্কে বিস্তারিত রিপোর্ট তৈরি
করে সদর দপ্তরে তা পাঠিয়ে একটি ইজিচেয়ার খুঁজে পেয়ে কোনমতে সেটিকে খাড়া করে তাতে গা
এলিয়ে বসেছিলেন গিবস; রাত্রিবেলায় এই তিনঘন্টার যুদ্ধ তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত
করে দিয়েছে! ক্লান্তিতে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন তিনি, এমন সময় অর্ডারলি এসে খবর
দেন- একজন আদত ভিয়েতকং জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে!
বিশ্রাম মাথায় উঠল; লাফ দিয়ে উঠে পড়লেন সার্জেন্ট গিবস!
যুদ্ধের এই আচমকা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শত্রুপক্ষের সেনাবাহিনীর একজন নিয়মিত সদস্য
যে অত্যন্ত দামী, সে বিষয়ে কোন কিছু আর বলবার অপেক্ষা রাখে না।
-“ডককে খবর পাঠাও-”
-“ডাক্তারসাহেব আগেই খবর পেয়ে গিয়েছেন স্যার, তিনি এখন
রোগীর সেবায়-”
-“রোগী?”
-“তিনটে গুলি বুকে লেগেছে স্যার! আমরা যখন ওকে পাই খুব আস্তে শ্বাস পড়ছিল, আমরা তো ভেবেছিলাম মৃত! একটা হালকা গোঙানির আওয়াজে বুঝতে পারি যে ভিতরে কিছু জান তখনও আছে-”
-“চল!”
কাছেই একটি পুরনো প্যাগোডা ছিল, ক্রমাগত শেলিং-এ বর্তমানে
কোনমতে তার কাঠামোটি টিঁকে আছে মাত্র। সেখানেই এনে রাখা হয়েছিল যুদ্ধবন্দীকে; অর্ডারলি
দূর থেকে তা দেখিয়ে দিতেই সেখানে প্রবেশ করলেন গিবস। মেঝেতে শোয়ানো হয়েছে গুলি-লাগা
ভিয়েতকংটিকে, পাশে বসে তাকে পরীক্ষা করছিলেন ইউনিটের সবেধন নীলমণি ডাক্তার ডসন; গিবস
প্রবেশ করতে দেখা শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।
-“ডক?”
মাথা নাড়লেন ডাক্তার, তারপর কাছিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বললেন-
-“এর নাম বন্ খুয়াম। এর তিনটি গুলি লেগেছে সার্জ! প্রথম
দুটি অতটা মারাত্মক নয়, কিন্তু তৃতীয়টি একেবারে হার্টের মূল ধমনী ফাটিয়ে দিয়েছে। এর
স্থায়ীত্ব বেশিক্ষণ নয়! মর্ফিন দিয়েছি, রোগীর জ্ঞানও ফেরৎ এসেছে। যা জিজ্ঞেস করবার
এইবেলা জিজ্ঞেস করে একে শান্তিতে মরতে দিন।”
ডাক্তারের হাত থেকে আর্মি ট্যাগটি নিয়ে সেটি উল্টে নামটা
দেখে নিলেন, তারপর ধীরপায়ে রোগীর পাশে এসে বসলেন গিবস; তাকালেন তার দিকে। একজন প্রৌঢ়
কমিউনিস্ট সৈনিক, ‘রেডস্টার’ ইউনিফর্ম পরণে। ঘনঘন শ্বাস পড়ছে শীর্ণ, রোগা শরীরটিকে
বাঁচিয়ে রাখবার জন্য, কিন্তু অসম্ভব বলিষ্ঠ মনের জোর নিশ্চই, নাহলে এই প্রবল যাতনা
নিয়েও লোকটি এরকম শান্তভাবে শুয়ে থাকতে পারে কি করে? খানিকক্ষণ গিবস তাকিয়ে থাকলেন
তার আধবোঁজা চোখের দিকে, তারপর সাহস করে ডাকলেন-
-“খুয়াম!”
নিজের নাম শুনে তার দিকে ধীরে ধীরে মাথা ঘোরালেন প্রৌঢ়
ভিয়েতনামি যোদ্ধাটি।
-“আমার নাম সার্জেন্ট-”
-“ফিলিপ এডুইন গিবস! আমি চিনি আপনাকে। দুসপ্তাহ ধরে আমরা
তীক্ষ্ণ নজর রেখেছিলাম আপনার ইউনিটের গতিবিধির ওপর!”
এই কথা বলে প্যান্টের ডানদিকের পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটি
পুরোন ছবি বের করে আনেন খুয়াম; কাঁপা-কাঁপা হাতে তার দিকে ছবিটি বাড়িয়ে ধরেন খুয়াম।
সেটিকে হাতে নিয়ে দেখেন গিবস- তাদের ইউনিটের মার্চ চলাকালীন স্ন্যাপ করা একটি ছবি।
-“তোমাদের পরিকল্পনাটি বল। ‘অস্ত্রবিরতি’ সত্ত্বেও তোমরা
হঠাৎ ফিরতি-আক্রমণ শুরু করলে কেন?”
একটা স্মিতহাস্য হাসলেন খুয়াম; কিছুটা দমকা কাশি বেরিয়ে
এল তার মুখ দিয়ে, সামলে উঠে তিনি বললেন-
-“আপনারা উন্নত দেশের উন্নত জনজাতির সভ্য মানুষেরা আমাদের
দেশে অস্ত্র, বিমান আর ট্যাঙ্ক নিয়ে ঢুকে যা ইচ্ছে তাই করবেন, আর আমরা একটি থালায় আমাদের
দেশকে তুলে ডালির মত সাজিয়ে আপনাদের হাতে তুলে দেব- এতটা সৌজন্যতা আশা করা উচিৎ নয়,
সার্জ!”
চুপ করে গেলেন সার্জেন্ট গিবস। ড্রিফটিং-এর আগে তিনি ইতিহাসের
অধ্যাপক ছিলেন, অধ্যাপনা করতেন; একেবারে জন্মগত ‘ব্রাস-হেলমেট’ তিনি নন! কোথাও গিয়ে
খুয়ামের বক্তব্যের সঙ্গে তিনি সহমত হলেন। কিন্তু…ভাবালুতার সময় এটি নয়; যা করবার তাড়াতাড়ি
করতে হবে-
-“তিনদিন ধরে আমাদের ওপর এই ক্রমাগত আক্রমণের পিছনে কারণ
কি? কত প্রাণ চলে গেল-”
এই প্রশ্নে হঠাৎ বড় বড় হয়ে এল খুয়ামের চোখ, একটি লম্বা
শ্বাস টানলেন তিনি, তারপর একটু চুপ থেকে শক্তিসঞ্চয় করে নিয়ে গিবসের দিকে তাকিয়ে খুয়াম
বললেন-
-“আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে সার্জ…আমার তিনকুলে কেউ নেই,
বন্ধুরাও আমায় ফেলে পালিয়েছে…আপনাকে একটি জিনিষ দিয়ে যাব, রাখবেন? অনুগ্রহ করে আমার
ডানপায়ের জুতোটা খুলে আমায় একটু দিন-”
এই অদ্ভুত অনুরোধে একটু অবাক হয়ে গেলেন গিবস; ব্যাপারটা
বিপজ্জনক হতে পারে, জুতোয় কোন অস্ত্র লুকিয়ে রাখা নেই তো? দোনামোনা করে শেষে খুয়ামের
জুতোটি খুললেন গিবস, তারপর তা ধরিয়ে দিলেন খুয়ামের হাতে।
সেটি নিয়ে একটি অদ্ভুত কাণ্ড করলেন খুয়াম! জুতোর গোড়ালি
ধরে হালকা একটু চাপ দিতেই পাশের একটি অংশ ডালার মত খুলে গেল, এরপর সেখানে হাত গলিয়ে
একটি মাঝারি আকারের অদ্ভুত চোখ আকৃতির একটি বস্তুকে বের করে আনলেন তিনি। প্যাগোডায়
স্মিত হয়ে আসা কৃত্রিম আলোয় একবার তিনি ঘুরিয়ে দেখলেন সেটিকে কিছুক্ষণ, তারপর তা তুলে
দিলেন গিবসের হাতে।
-“কি এটি?”- জিজ্ঞেস করলেন গিবস। উত্তরে ঘন ঘন শ্বাস টানতে
টানতে খুয়াম বললেন-
-“’পেইয়ুদু’ গ্রামে আমার বাড়ি, জায়গাটা উত্তর ভিয়েতনামে…আমরা
ওখানে সম্ভ্রান্ত ও প্রাচীনতম বংশের সন্তান…এই চোখটি আমাদের কাছে দীর্ঘ সময় ধরে ছিল…আপনাদের
লোকেরা আমাদের গ্রামটি ধ্বংস করবার আগে কোনমতে আমি এটিকে নিয়ে পালিয়ে আসি…অত্যন্ত প্রাচীন
ও পবিত্র বস্তু এটি…জনশ্রুতি- আমাদের পূর্বপুরুষদের হাতে আসবার আগে যাদের কাছে এটি
ছিল, তারা একে পবিত্র ইরাবতী নদীর জলে কুড়িয়ে পেয়ে দীর্ঘসময়ের জন্য নিজের কাছে রাখে…তারপর
ওরা চলে আসে আমাদের দেশে…”
-“খুয়াম, খুয়াম! আপনি আমাদের ভুল পথে চালনা করছেন; আপনাদের
পরবর্ত্তী পরিকল্পনা বলুন-”
-“এই মরণশীল খেলাটা থেকে বেরিয়ে আসুন সার্জ!”- প্রায় নিস্তেজ
হয়ে আসছিলেন খুয়াম কথা বলতে বলতে, এখন গিবসের বাধাদানে অসহিষ্ণু হয়ে চাপা গলায় ঝাঁঝিয়ে
উঠলেন তিনি- “সময়কে পিছনে ফেলে ঊর্দ্ধে উঠে এসেছে এই ‘চোখ’! পাহাড়ের কোলে সহস্রাব্দ
প্রাচীন ‘কলস’ জাতি…তারই ধারে-কাছে কোথাও তিন বোন খেলা করছে…এক বোন কাঁদছে…তার একচোখে
সরু অশ্রুজলের ধারা…সেখানেই পাবেন সেই দরজা…দুটি চাবি একসাথে জুড়ে গেলে ভেঙে যাবে সময়ের
ভেদ, খুলে যাবে বন্ধ দুয়ার-”
প্রলাপ বকছেন খুয়াম, আসন্ন মৃত্যুর ছায়া ঘনিয়ে এসেছে তার
চোখে-মুখে! কিন্তু…কিছু একটা রহস্য ছিল তার প্রলাপের মধ্যে, গিবস বাধ্য হলেন একবার
চোখ নামিয়ে তার হাতে ধরা অদ্ভুত বস্তুটির দিকে তাকাতে। এটা কি কোন চাবি? কিন্তু কোন
দরজার চাবি এটি? কোথায় সে দরজা? আর কি অদ্ভুত গড়ণ এই চাবির! মানুষের বাঁ-চোখের মত দেখতে
অনেকটা, হালকা, কিন্তু অত্যন্ত সুদৃঢ় কোন ধাতব বস্তু দিয়ে তৈরি এই চাবি, এর সারা গায়ে
আবার বেশ বাহারি নকশাকাটা! প্রাচীন শিল্পকলার এক অপূর্ব নিদর্শন, আর চাবিটিও দেখে মনে
হচ্ছে অনেক প্রাচীন। কৌতুহলে চাবিটিকে আলোর দিকে ফেরালেন গিবস- অতি পরিচিত অপর একটি
প্রাচীন বস্তুর সঙ্গে এর গঠনগত একটি সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না?
-“খুয়াম, এটি কি ‘আই অফ্ হোরা’-”
খুয়ামের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটি করতে যাচ্ছিলেন গিবস, কিন্তু
মুখ ঘুরিয়ে বুঝলেন- তার আর দরকার নেই; কোন প্রশ্নেরই উত্তর আর দেবেন না খুয়াম, সমস্ত
জাগতিক প্রশ্নের ঊর্দ্ধে চলে গিয়েছেন তিনি! চোখ খোলা রেখেই প্রয়াত হয়েছেন খুয়াম, তার
হিমশীতল চোখদুটি এখন স্থিরভাবে নিবদ্ধ গিবসের দিকে; একরাশ প্রত্যাশা আর আবেগ জড়িয়ে
সেই চোখে। খানিকক্ষণ নরমভাবে সেই চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন গিবস, তারপর নিজের হাত দিয়ে
সেই খোলা চোখের পাতাদুটিকে বন্ধ করে দিয়ে ভগ্নপ্রায় প্যাগোডার থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি।
হাতে ধরা মানুষের চোখের মত আকৃতির সেই অদ্ভুত চাবি, তার সদ্যপ্রয়াত মালিক তখন চিরঘুমে
আচ্ছন্ন দেবতার উদ্দেশ্যে সমর্পণ করা ভগ্নপ্রায় প্যাগোডার ভিতর।
-“‘কলস’ জাতি…তিন বোন যেখানে খেলা করে…এক বোনের চোখ দিয়ে
বেরিয়ে আসে অশ্রুধারা…দরজা…মন্দির…মানে কি এই কথাগুলির? মৃত্যুকালীন বিকার, না বাস্তব?”
নিজের মনে স্বগতোক্তি করলেন গিবসন, চোখের সামনে হাতে ধরা চাবিটিকে তুলে ধরে। মিশরীয় ‘আই অফ্ হোরাস’-এর সঙ্গে বহুলাংশে সাদৃশ্যপূর্ণ এই স্থাপত্যটি ততক্ষণে একরাশ প্রশ্ন মেলে ধরেছে তার মনে; এর উত্তর তাকে পেতেই হবে!
[অবন্তীপুর, অনন্তনাগ জেলা, শ্রীনগর- ২৮শে জুন ১৯৯৭]
-“এই তো সাব, এসে গিয়েছি! এই জায়গাটাই অবন্তীপুর। ঐটা
সূর্যমন্দির সাব, স্থানীয় লোকজন এই মন্দিরটিকে ইহুদি মন্দির বলে, হিঁদু মন্দিরকে কেন
যে ইহুদিদের মন্দির বলে কে জানে? আমি গাড়িটা আগে লাগাচ্ছি সাব, এখানে গাড়ি রাখবার নিয়ম
নেই।”
-“ঠিক আছে। মনুবাবা, তুমি এস আমার সঙ্গে। সামনে ঐ মন্দিরটা
দেখছ? ওর নাম সূর্যমন্দির। খাতায়-কলমে এর প্রতিষ্ঠা হয় ৭৩০খৃীষ্টাব্দে, কিন্তু জনশ্রুতি
বলে এর প্রতিষ্ঠা ঢের আগে, অনেক আগে এখানে নাকি অন্য এক মন্দির ছিল। স্কুলে যীশুখৃষ্ট
পড়েছ না তোমরা? আমরা সকলেই জানি যে ওঁনাকে ক্রুশে তুলে মারা হয়েছিল, তাই তো? কিন্তু
ক্যাথলিকদের একাংশের মতে ঘটনাটি ঠিক নয়। ওঁনার এক শিষ্য, যাকে দেখতে অনেকটা ওঁনার মতই,
তাকে তোলা হয়েছিল ক্রূশে, আর যীশুখৃষ্টকে লুকিয়ে আনা হয়েছিল- হুঁ হুঁ…বল তো কোথায়?
এই মন্দিরে! পুরোটাই কিংবদন্তীর ওপর দাঁড়িয়ে, এর কোন লিখিত প্রমাণ নেই। কি সুন্দর জায়গাটা,
দেখেছ?”
মন্দিরটির দিকে তাকিয়ে হতাশ হয়ে গেল ‘মনুবাবা’, ভদ্রলোকের
বাচ্চা ছেলে। একে তো জায়গাটায় লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে, তার মধ্যে আবার সামনের মন্দিরটা
কিরকম যেন ভাঙাচোরা, তাদের স্কুলের পাশেই ঐ হানাবাড়িটার মত, যেখানে দিনের আলোয় ঢুকলেও
গা ছমছম করে ওঠে; ওরা কয়েকজন মিলে একবার ঢুকেছিল ঐ বাড়িটাতে। বেশিক্ষণ থাকে নি অবশ্য
তারা, ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল কিছুক্ষণ পরেই! এখানেও সেই ভয়ই লাগছে বাচ্চাটির; মনে হচ্ছে
এই বুঝি ভূতে এসে গলা টিপে ধরল বলে!
বাবার বলা কথাগুলি একটুও কানে ঢুকল না বাচ্চাটির; তাও
সে ঘাড় কাৎ করে একবার শুধু ‘হ্যাঁ’ বলল বাধ্য ছেলের মত, তারপর বিরস মুখে তাকিয়ে রইল
সামনে। এই ভুতুড়ে মন্দিরে একবারের জন্যও ঢুকতে চায় না সে।
-“কিচ্ছু ভয় নেই মনুবাবা-” – মাথায় হাত বুলিয়ে অভয় দিলেন
বাবা- “একবারটি আমার সঙ্গে চল, এখানে খানিকক্ষণ থেকে তারপর তোমাকে নিয়ে ঘুরতে যাব,
কেমন? দেখবে, জায়গাটা তোমারও ভালো লাগবে।”
‘ভালো লাগবে’ না ছাই? তার পিতৃদেবকে বিলক্ষণ চেনে বাচ্চাটি;
কোন একটা পুরোন জায়গায় গিয়ে একবার ঢুকলেই হল- সেখানে পারলে রাতটাও কাবার করে ফেলবেন
তিনি! কতই বা বয়েস বাচ্চাটির? আট, দশ? স্কুলের বন্ধুদের মুখে ‘কাশ্মীর’ জায়গাটির নাম
এতবার শুনেছে যে শুনে শুনে একটা অদ্ভুত আকর্ষণ তৈরি হয়েছিল তার জায়গাটির প্রতি। তাই
প্রথমবার বাবার মুখে যখন ‘কাশ্মীর যাব’ কথাটা শোনে সে, আনন্দে নেচে উঠেছিল তার শিশু
মন। এখন স্কুলের বন্ধুদের কাছে সেও গর্ব করে বলতে পারবে- ‘আমিও কাশ্মীর গিয়েছি’!
কিন্তু বাবাটাও কেমন যেন! প্রথমদিন এসেই সিধা চলে গেল
তাকে নিয়ে- কোথায়? না, এখানে নাকি বাবাদের অফিসের একটি ব্রাঞ্চ আছে, সেখানে! প্রথম
দিনটি তো সেখানেই কাটল; আর আজ ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার নাম করে এই ভাঙাচোরা বিরাট মন্দিরের
সামনে? আজকে মা থাকলে বাবা কিছুতেই এমন কাজ করত না; বাবার ওপর মাঝেমধ্যে তার অভিমান
হয়-
মনে মনে বাচ্চাটি যে বিষয়টা নিয়ে ভয় পাচ্ছিল তাই হল! অনেকগুলি
সিঁড়ি পেরিয়ে একটি বাহারি তোরণ, সেই তোরণ দিয়ে ঢুকে একটি ছোট মন্দির, তারপর অনেকটা
খোলা মাঠমতন পেরিয়ে একসার স্তম্ভঘেরা বিশাল একটি দালান পেরিয়েই বিরাট উঁচু একটি মন্দির।
সেই মন্দিরের সামনে আবার একটি বাহারি কুয়োমতন কিছু একটা রয়েছে, তার মুখটা আবার ঢাকা
দেওয়া! যে মন্দির দিয়ে এখানে ঢুকতে হয় তার প্রবেশপথের সিঁড়িগুলি অতিক্রম করবার পর থেকেই
বাবার শারীরিক ভাবভঙ্গীই গেল পাল্টে; ছোট মন্দিরটির প্রতিটি সিঁড়ি, প্রতিটি দরজা, প্রতিটি
মেঝে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে না দেখা অবধি তার মনে যেন কোন শান্তি নেই! জায়গায় জায়গায় শুয়ে
পড়ে, লাফিয়ে উঠে, হামাগুড়ি দিয়ে, ডিগবাজি খেয়ে, পাশ ফিরে, চিৎ হয়ে, উপুড় হয়ে- হাতে
একটি আতসকাঁচ নিয়ে কতরকমভাবে যে তিনি কিসব পরীক্ষা করতে লাগলেন কে জানে? ছোট মন্দির
ও তার আশেপাশের ধ্বংসস্তুপটিকে এইভাবেই পরীক্ষা করে দেখলেন তিনি, তারপর বিজয়গর্বে ছেলেকে
নিয়ে মার্চ করতে করতে ঢুকে পড়লেন মূল মন্দির চত্বরে। একটি থামের আড়ালে ছেলেকে রেখে
জগৎ-সংসার ভুলে আবার তিনি লেগে পড়লেন পরীক্ষায়, হাতে রইল পেনসিল, থুড়ি- আতসকাঁচ!
থামটির পিছনে ব্যাজার মুখে দাঁড়িয়ে বাবার কর্মকাণ্ড দেখতে
লাগল ছেলে। বিরাট এই ঘরের ভিতরটি প্রায় অন্ধকার, সবকিছু কিরকম যেন অস্পষ্ট, ধোঁয়া ধোঁয়া!
ঘরের ছাদ অবশ্য ভেঙে পড়েছে, আর সেখানেই হয়েছে বিপত্তি; ভাঙা বিরাট দুটি পাথরের টুকরো
আড়াআড়িভাবে এমনভাবে ঢেকে রেখেছে ঘরটাকে যে সূর্যের আলো খুব ক্ষীণভাবে প্রবেশ করতে পারছে
এখানে। হাতের টর্চ জ্বালিয়ে কষ্ট করে বাবা এখানে কিসের খোঁজ করছেন কে জানে?
সোমবার, দুপুরবেলা। তার মধ্যে এখানে খুব বেশি লোকের যাতায়াত
নেই। ফলে জায়গাটি জনবিরল। একটা পাখি উড়ছিল অনেক দূর আকাশ দিয়ে, সেদিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণের
জন্য অন্যমনষ্ক হয়ে গিয়েছিল ছেলেটি, এমন সময় চটকা ভাঙল বাবার ডাকে-
-“মনুবাবা, এদিকে এস তো একবার!”
মূল মন্দিরের এককোণে একটা থামের সামনে টর্চ জ্বেলে পাথরের
মূর্তির মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন বাবা, কৌতুহলি হয়ে এগিয়ে এল ছেলে।
-“কি হয়েছে, বাবা?”
-“এই চিহ্নটা দেখতে পাচ্ছ?”
ভাঙা থামটির নীচের দিক করে একটুখানি জায়গা তার সন্নিহিত
অঞ্চল থেকে গোল চাকতির মত উঠে এসেছে যেন; চাকতির মত সামান্য উঠে আসা এই গোলাকার অঞ্চলটি
আকারে ছোট, ভালো করে একে খেয়াল না করলে বোঝাই যাবে না। সেদিকে ঘাড় নামিয়ে তার ওপর খোদাই
করা ছবিটি দেখতে লাগল ছেলেটি। প্রথমে অন্ধকারে কিছু বোঝা যাচ্ছিল না, তারপর চোখ একটু
সয়ে আসতে মনে হল- কোন একজন রাজা সিংহাসনে বসে, তার মাথার ওপর সূর্য, সেই সূর্য থেকে
আলো বেরিয়ে নীচে রাজার মাথায় এসে স্পর্শ করছে। কিন্তু তাতে কি?
-“এটি মৌর্যযুগের চিহ্ন, মনুবাবা; সেইযুগের যে মুদ্রা
আবিষ্কার হয়েছে তাতে এই ধরণের ছবি পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু সেই চিত্র এখানে কি করছে? এই
মন্দিরের ভিত্তিস্থাপনার ইতিহাস অবশ্য আরও তিন-চারশ বছর আগে, তাও সেটি ৪০০খৃীষ্টাব্দের
কথা; মৌর্যযুগের অবসান ১৮০খৃীষ্টপূর্বাব্দের আশেপাশে; তবে কি…জনশ্রুতি সত্যি?”
বাবা নিজের মনে কথা বলছিলেন, হাঁ করে তা শুনছিল ছেলে।
এই পর্যন্ত বলে কথা থামিয়ে চাকতির মত অংশটিতে হাত বুলিয়ে দেখছিলেন বাবা; সামান্য ধূলো
লেগেছিল তাতে, হাত বুলিয়ে তা পরিষ্কার করতে গিয়ে-
বাবার আঙুলের চাপে যেন সামান্য দেবে বসে গেল চাকতিটি,
আর তা হতেই একটি বিচিত্র, চাপা ঘর্ ঘর্ শব্দে মুখরিত হয়ে উঠল গোটা ঘর, যেন কোথাও কোন
বন্ধ দরজা খুলে যাচ্ছে! কিন্তু কোথায় সেই বন্ধ দরজা? মূল মন্দিরটিতে কোথাও তো কোন দরজা
বন্ধ নেই! অথচ আওয়াজটা মনে হচ্ছে খুব কাছেই!
-“মনুবাবা, কুইক!”
বাবার সঙ্গে দৌড়তে দৌড়তে বাইরে বেরিয়ে আসে ছেলে। ঢুকবার
সময় সে খেয়াল করেছিল- মূল মন্দিরের সামনেই একটি মুখঢাকা কূয়ো ছিল; এখন দেখা গেল, বন্ধমুখ
দুহাট হয়ে খুলে যাচ্ছে, ভিতরে দেখা যাচ্ছে একসার সিঁড়ি, যা সোজা গিয়ে শেষ হচ্ছে একটি
উন্মুক্ত দরজার সামনে! সেই দরজায় কোন কপাট ছিল না, তবে আসল ভয়ের কারণটা অবশ্য অন্যত্র।
সিঁড়ির মুখটায় এবং দরজার সামনেটায় দুটি মানুষের কঙ্কাল
পড়ে! হামাগুড়ি দেওয়ার ভঙ্গীতে অন্তিম শয়ানে শুয়ে তারা, যেন মৃত্যুর আগে অবধি তারা শেষ
চেষ্টা করেছে গর্ভগৃহ থেকে বেরিয়ে আসার, কিন্তু পারে নি! নরকঙ্কাল দেখেই ভয়ের চোটে
ছেলে লুকোয় বাবার পিছনে; ঠিকই ধরেছিল সে, এই জায়গাটি ভূতের বাড়িই বটে!
-“অসাধারণ বুদ্ধি!”- সবকিছু খুঁটিয়ে দেখে প্রশংসা করার
ভঙ্গীতে বলে উঠলেন বাবা- “প্রথমে একটি গর্ভগৃহ বানানো হল, তারপর তা চাপা দেওয়ার জন্য
তার ওপর একটি জলাধার বানানো হল; ঢোকার মুখটা একটা বড় পাথর দিয়ে ঢেকে তার ওপর জল পরিপূর্ণ
করে রাখা হল- আসবার সময় পাথরের ওপর জলের রেখা দেখতে পেয়েছি…কি বুদ্ধি দেখেছ মনুবাবা?
আজকে আমরা যেমন পাথর ঢাকা দেখেছি, ঠিক তেমনি ঐ আমলেও জল সম্পূর্ণ শুকিয়ে যাওয়ার পরেও
লোকে ওখানে ঐরকমই পাথর দেখতে পেত; কেউ ভাবতেও পারে নি পাথরের নীচে এরকম একটা গর্ভগৃহের
কথা-”
-“আর ঐ কঙ্কালদুটো, বাবা?”
-“ওদের গায়ের পোশাকগুলিতে মুসলিম যুগের নিদর্শন আছে…পঞ্চদশ
শতকে কাশ্মীরের তদানীন্তন শাসক সিকান্দার শাহ মিরি এই হিন্দু দেবতার মন্দির ভেঙে ফেলবার
নির্দেশ দেন; পুরো একবছর সময় লাগে মন্দিরটি ভাঙতে। মনে হয় ঐসময় কেউ এই গুপ্তপথের হদিশ
পায়; পরে সুবিধাজনক সময়ে এসে গুপ্তগৃহের দরজা খোলে, কাজ হাঁসিল করবার মতলবে ঢুকে পড়ে
এখানে। কিন্তু কোন কারণে পালাতে গিয়ে গুপ্তগৃহের প্রবেশপথটি আটকে গিয়ে দমবন্ধ হয়ে এরা
এখানেই মারা যায়…আপাতদৃষ্টিতে এটি একটি সম্ভাবনা অবশ্য; এরা পরবর্তী যুগের লোকও হতে
পারে; শুধু দুটো প্রশ্ন- প্রবেশপথের দরজাটা কতক্ষণ খোলা থাকে, আর ভিতরে কি আছে?”
একদৃষ্টে কিছুক্ষণ গর্ভগৃহের প্রবেশদ্বারের দিকে তাকিয়ে
রইলেন বাবা, মনে মনে কর্তব্য স্থির করে নিলেন, তারপর বললেন-
-“নাঃ, পুরো বিষয়টির তদন্ত না করে কাউকে কিছু বলা যাবে
না! এখন দুপুর দুটো; মনুবাবা, আমার মনে হয় সূর্যের আলোর সঙ্গে ঐ সংকেতের কোন একটা সম্পর্ক
রয়েছে। তুমি একটা কাজ কর, মন দিয়ে শোন; তুমি এখানেই বসে থাকবে, পাহারা দেবে। এই হুইসলটা
রাখ, যদি দেখ দরজাটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে খুব জোর হুইসল বাজাবে, আর বাজাতেই থাকবে, যতক্ষণ
না আমি বেরিয়ে আসি! এখান থেকে নড়বে না, ধর!”
ছেলের হাতে হুইসল ধরিয়ে দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে যাচ্ছিলেন
বাবা, পিছন থেকে জামা খামচে ধরল ছেলে।
-“যেও না!”
ছেলের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে ফিরে তাকালেন বাবা।
-“ভয় করছে মনুবাবা? ভয় পেতে নেই। তুমি এখানেই থাকবে, দরজা
বন্ধ হয়ে গেলে দৌড়ে ড্রাইভারকাকুকে ডেকে আনবে, ভার্গবকাকাকে ফোন করবে, কেমন? এখানে
কিছুটা এগিয়েই একটি পাবলিক ফোন বুথ আছে, আর নাম্বার তো তোমায় দিয়েই দিয়েছি। ভয় পেও
না, কেমন?”
স্মিত হাসি হাসলেন বাবা, তার দিকে তাকিয়ে রইল ছেলে। বাবার
উপরের পাটিতে দুটি দাঁত নেই, ফোকলা মুখে হাসলে তাকে খুব সুন্দর দেখায়! ছেলের মাথায়
হাত বুলিয়ে একটা ছোট চুমু খেয়ে গর্ভগৃহের সিঁড়িতে পা রাখলেন বাবা; কিছুক্ষণ পর তাঁর
দেহটা অদৃশ্য হয়ে গেল গর্ভগৃহের দরজার ওপারে। সিঁড়ির মুখে বসে থেকে ধীরে ধীরে তাকে
চলে যেতে দেখল ছেলে।
বাস্তবজীবনে সেই শেষ আলাপচারীতা পিতা-পুত্রের! একটিই আফশোষ,
বাবার জামার পিছনদিকটা একটু বেশি জোরে যদি টেনে ধরে রাখতে পারত সে!!
কেটে গেল বেশ দীর্ঘ একটি সময়। কিন্তু বাবাকে ফিরতে না
দেখে এবার অস্থির হয়ে উঠল বাচ্চাটি। প্রথমে উশখুশ, তারপর ছটফট; শেষে আরও কিছুক্ষণ পরে
চরম উদ্বেগ! বাবা কোন বিপদের মধ্যে পড়ল না তো?
সূর্যমন্দিরে ঢোকবার পথটির দিকে উৎসুক হয়ে দুবার তাকাল
বাচ্চা ছেলেটি। কি করবে সে? ড্রাইভারকাকুকে ডেকে আনবে? ভার্গবকাকাকে ফোন করবে? না কি?
পড়ে থাকা কঙ্কালদুটির দিকে কিছুক্ষণ ভয়ার্ত চোখ মেলে তাকিয়ে
থাকল ছেলেটি। তারপর দ্রুত মনস্থির করে নিল। না। আগে সে নিজেই খুঁজে নিয়ে আসবে বাবাকে,
তারপর না হয়-
দ্বিতীয়বার কিছু না ভেবে দ্রুতপায়ে খোলা সিঁড়ি বেয়ে নীচে
নেমে গেল ছেলেটি; দ্রুতপায়ে প্রবেশ করল গর্ভগৃহের অভ্যন্তরে। বাবাকে যে করেই হোক খুঁজে
নিয়ে আসবার বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সে!
**************************************************************************
গর্ভগৃহের ভিতরটা কি ভীষণ অন্ধকার! বারদুয়েকবার হোঁচট
খেতে খেতে বেঁচে গেল ছেলেটি, তারপর একদিকের দেওয়াল ধরে ধীরে ধীরে এগোতে লাগল সে। তার
লক্ষ্য অবশ্য খুব একটা দূরে নয়, সামনে একটা মোড় মত রয়েছে, আর সেখান থেকে যেন একটা হালকা
আলোর প্রভা বাইরে এসে পড়েছে- অন্ধকার জগতের একমাত্র আলো! সেই আলোর দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে
গেল ছেলেটি। মোড়ে পৌঁছে সে কিন্তু সরাসরি ঘুরে গেল না আলোর উৎসের দিকে, বরং দেওয়াল
ধরে দাঁড়িয়ে আলোর দিকে একটা উঁকি মারল ছেলেটি-
এবং…অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেল সে, সামনের দৃশ্য দেখে!
মোড় ঘুরেই একটি বিশাল বড় ঘর, সূর্যমন্দিরে প্রবেশ করবার
সময় যেরকম তোরণ পেরিয়ে তারা ঢুকেছিলেন মন্দিরপ্রাঙ্গণে, ঘরটিতে অনুরূপ একটি তোরণ করে
রাখা একেবারে মাঝখানে; পার্থক্য এখানেই যে এটি শুধুই একটি তোরণ ঘরের মধ্যিখানে, যার
মাথায় বা আশেপাশে গাঁথনীর কোন বালাইই নেই! এর একপাশে একটি খাটো আকারের গম্বুজ বসানো,
যাতে অনেকগুলো সুইচ মত কিসব বসানো, আর তার মধ্যিখানে আটকানো একটি- আরে, এটা সেই মানুষের
ডানচোখের মত ‘চোখ’টা না? ওটা এত উজ্জ্বল হয়ে উঠল কিভাবে? এখানে আসবার আগে বাবা মহারাষ্ট্রে
গিয়েছিলেন, ফেরবার সময় তার সঙ্গে এই ‘চোখ’ ছিল, আর তার সাথে অতি পুরোন একটি লিপি- এই
দুটো জিনিষ নিয়েই তো বাবা প্রায় একমাস কাটিয়ে দিয়েছিলেন লাইব্রেরীতে- সেই ‘চোখ’টা এখানে
কি করছে?
ঐ তোরণটির সামনে স্থানুর মত দাঁড়িয়ে ছিলেন বাবা, সেটির
দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে! বাবাকে পিছন থেকে দেখতে পাচ্ছিল ছেলে, ফলে তিনি কি দেখছেন সামনের
ফাঁকা তোরণের ভিতর তা সে বুঝতে পারছে না। একটা হালকা আলোর আভা বিচ্ছুরিত হচ্ছে তোরণটি
থেকে, ব্যাস, ঐ অবধি! কিন্তু অপরপাড়ে ঘরের পিছনের দেওয়ালটি ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে
না তো? জায়গা থেকে নড়ল না ছেলেটি, দাঁড়িয়ে উঁকি মেরে দেখতে লাগল সে, কি হচ্ছে ঘরের
ভিতর।
এইভাবে কেটে গেল আরও বেশ কিছুটা সময়, উল্লেখযোগ্য কিছুই
ঘটে নি এতক্ষণে। অসহিষ্ণু হয়ে উঠছিল ছেলেটি; হাজার হোক, পৃথিবীতে কোন বাচ্চা আছে যে
এতক্ষণ চুপচাপ ধৈর্য্য ধরে দেওয়াল ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে? তাছাড়া…সিঁড়িটা বন্ধ হয়ে গেলে?
এই কথাটা ভেবেই এতক্ষণে মন চঞ্চল হয়ে উঠল তার। সামনেই বাবা দাঁড়িয়ে, এবার তাকে নিয়ে
আসবার জন্য দেওয়াল ছেড়ে সদ্য কয়েক পা আগিয়েছে ছেলেটি; এমন সময়-
হঠাৎ মনে হল যেন সূর্যের আলো জ্বলে উঠল ঘরটিতে- এত উজ্জ্বল
হয়ে উঠল তোরণটি! আলোর তেজে চোখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ছেলেটির, এবার কয়েকমুহুর্ত পরে সেটি
স্তিমিত হয়ে আসতে চোখ মেলে তাকিয়ে সে অবাক হয়ে গেল!
তোরণের অপরপ্রান্তে দাঁড়িগোঁফওয়ালা একটি লোক দাঁড়িয়ে,
তার বাম গালে একটা সদ্যকাটা দাগ, রক্ত বেরোচ্ছে সেখান দিয়ে! কিন্তু এখানে এই লোকটি
কোথা থেকে এল? তোরণের অপরপ্রান্তে তো কেউ ছিল না! আর ঘরটি এতটাই বিশাল ও ফাঁকা-ফাঁকা
যে তাতে লুকিয়ে থাকবার কোন প্রশ্নই নেই, তাহলে এই লোকটি এল কোথা থেকে?
কয়েকমুহুর্ত সেদিকে তাকিয়েই ব্যাপারটা বুঝতে পারল ছেলেটি,
লোকটি দাঁড়িয়ে আছে তোরণের ভিতর, আর যেখানে সে রয়েছে সেই জগৎটা অন্য! লোকটির পিছন দিকে
যে ঘরটি রয়েছে, তা তারা যে ঘরটিতে রয়েছে সেই পরিবেশের সঙ্গে খাপ খায় না; তাছাড়া…আবছাভাবে
মনে হল যেন তার পিছনে একটি মহিলাকে দেখা গেল, যদিও অন্ধকারে সেই মহিলার মুখ স্পষ্ট
নয়! ঘষা কাঁচের মধ্য দিয়ে তাকালে যেরকম দেখতে লাগে, সেইরকমই দেখতে লাগছে তোরণের ভিতরের
দৃশ্যগুলিকে, একমাত্র লোকটির মুখ-চোখই কিছুটা স্পষ্ট! কিন্তু…কিভাবে?
তোরণের মধ্যে থাকা লোকটি এবারে যেন পরিষ্কার দেখতে পেল
বাচ্চা ছেলেটিকে; আর দেখতে পেয়েই খুব উত্তেজিত ভাবে হাত নাড়তে নাড়তে কি একটা বলতে লাগল
সে, কিন্তু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির কানে ঢুকল না একবর্ণ কথাও, সে শুধু শুনতে পেল
তার বাবা বলছেন-
-“কি বলছ, কিছু শুনতে পাচ্ছি না…কি? সরা-ও – সরাও? কি
সরাব?”
এই প্রশ্নের উত্তরে যেন আরও জোরে জোরে চেঁচিয়ে উঠল লোকটি,
অনর্গল হাত-পা নেড়ে কিসব বলে চলল সে একটানা, যদিও যথারীতি কিছুই শুনতে পেল না সে! এবারে
বাবা বললেন-
-“মহা…হনু…মনুকে…সরাও- মনুকে সরাব? কি বলছ তুমি আমার ছেলের
ব্যাপারে? আমার ছেলের নাম তুমি জানলে কি করে?”
উত্তরে আরও জোরে হাত নাড়তে লাগল তোরণের ভিতরে দাঁড়িয়ে
থাকা লোকটি, শেষে হাতনাড়া বন্ধ করে পিছনের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করতে পিছনে তাকিয়েই
তাকে দেখতে পেয়ে যেন চমকে উঠলেন বাবা!
-“মনুবাবা! তুমি এখানে? এখানে কি করছ?”
তারপরই তোরণের দিকে তাকিয়ে তিনি কাতর মিনতির স্বরে লোকটিকে
উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন-
-“দোহাই তোমাকে, আমার ছেলের কোন ক্ষতি কোর না…না!”
এইবার যা ঘটল তাতে বুদ্ধি সম্পূর্ণ লোপ পেয়ে গেল ছেলেটির;
পরিষ্কার দেখা গেল তোরণটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এল লোকটির একটি হাত, সে যেন বাড়িয়ে ধরেছে হাতটি
কোন কিছুকে ধরবার অভিপ্রায়ে! এই হাতটি বেরিয়ে আসতেই সাংঘাতিক ভয় পেয়ে গেলেন বাবা; পিছনদিকে
একবার তাকিয়ে আদরের ছেলেকে বাঁচানোর অভিপ্রায়ে পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা গম্বুজটির ওপর হুমড়ি
খেয়ে পড়ে মাঝখান থেকে ডান ‘চোখ’টা খুলে নিলেন তিনি; আর তা করতেই-
হঠাৎ উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল তোরণ; তার থেকে নির্গত
উজ্জ্বলতম প্রভা যেন কার্যত কানা করে ফেলল ছেলেটিকে! কোনমতে চোখের সামনে হাত নিয়ে এসে
ঐ তীব্র আলোককে প্রতিহত করতে পারল ছেলেটি; তারপর সেই তীব্র আলোক যখন অন্তর্হিত হল,
ধীরে ধীরে চোখ সয়ে আসতে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখল সে- ঘর ফাঁকা, তার বাবা কোথাও নেই!
আশেপাশে তাকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠে ‘বাবা, বাবা’ বলে একটানা ডেকে গেল ছেলেটি, কিন্তু না,
কোথাও দেখতে পেল না তার বাবাকে! এবার বাবা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেখানে ঘাড় ঘুরিয়ে
দেখল ছেলেটি; শূণ্যগর্ভ তোরণের সামনের মেঝেতে কি একটা জিনিষ যেন পড়ে রয়েছে, কাছে গিয়ে
দেখা গেল- বাবার চশমাটি পড়ে রয়েছে মেঝেতে, তার একদিকের ডাঁটি ভাঙা! চশমাটিকে পকেটে
ভরে এবার তোরণের দিকে একদৃষ্টে তাকাল ছেলে- ফাঁকা তোরণটি আবার স্বাভাবিক! এই তোরণ থেকে
নিঃসৃত ঐ রাক্ষুসে আলোটিই কিছুক্ষণ আগে জীবন্ত গিলে খেয়েছে তার বাবাকে! জ্বলন্ত চোখে
সেই শূণ্য তোরণের দিকে তাকিয়ে রইল ছেলে।
ও কি, পিছন থেকে একটি মৃদু ঘরঘর আওয়াজ কানে আসছে না? তার
মানে…গর্ভগৃহে প্রবেশের মূল দরজাটি কি তবে আবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে? তোরণটির দিকে শেষবারের
মত আরও একবার জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে দেখল সে, তারপরই দৌড় লাগাল ছেলেটি বাইরে যাওয়ার পথটির
দিকে। অন্ধকারে কোনমতে হাতড়ে হাতড়ে সিঁড়ি অবধি পৌঁছিয়ে মাথা তুলে দেখে- ধীরে ধীরে প্রবেশপথের
মুখটাতে বসানো পাথরদুটি আবার সরে আসছে জায়গায়, আর কিছুটা পরিসর আছে মাত্র সম্পূর্ণ
বন্ধ হতে। কালবিলম্ব না করে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এল ছেলেটি, বাইরের মুক্ত পৃথিবীতে
কোনমতে পা রাখবার পরক্ষণেই সজোরে বন্ধ হয়ে গেল কুয়োর দরজার মুখ! ঘুরে একবার পিছনে তাকিয়ে
দেখল সে, তারপর ফিরে তাকাল পশ্চিমের অস্তগামী সূর্যের দিকে। দরজা খোলা-বন্ধের সঙ্গে
দিনের আলোর সম্পর্কের ব্যাপারটা বাবা তার মানে ঠিকই অনুমান করেছিলেন!
পকেট হাতড়ে বাবার স্মৃতিখানি বের করে আনল ছেলেটি- একদিকের ডাঁটি ভাঙ্গা একটি চশমার অবশেষ! হাতটি সামনের দিকে তুলে ধরে ভালো করে চশমাটিকে দেখতে লাগল সে; তারপর দেখা শেষ হতে গম্ভীরমুখে নিজের পকেটে ভরে নিয়ে কুয়োটির দিকে একবার তাকিয়ে বহির্দ্বারের দিকে এগোতে লাগল দৃপ্ত পদক্ষেপে। একদিনে বড় হয়ে গিয়েছে বাচ্চা, গুরুদায়িত্ব এখন তার কাঁধে- এই ধাঁধার সমাধান করে তার বাবাকে আবার ফেরৎ নিয়ে আসা! চোখের জল মুছে নিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ায় ছেলেটি- কান্নার সময় এখন নয়; এই ধাঁধা তাকে সমাধান করতেই হবে।
আরামদায়ক উষ্ণ আবহাওয়ায় হিমেল ঠাণ্ডার পরশ গায়ে মেখে একটা
কম্বল জড়িয়ে জানলার ধারে ঠেস দিয়ে বসে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তা নিজেও
টের পান নি অগস্ত্য; এখন ঘুমের মধ্যে এই অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে আচমকা ঘুম ভেঙে গেল তার।
বহুযুগ পর আবার ফেরৎ এল স্বপ্নটা; মধ্যিখানে এর রেশটুকু
পর্যন্ত মিলিয়ে গিয়েছিল মাথা থেকে। অদ্ভুত আকৃতিবিশিষ্ট একটি পাহাড়, যার সঙ্গে আকৃতিগত
সাদৃশ্য আঙ্কোরভাটের ঘন্টার মত আকৃতিবিশিষ্ট মন্দিরগুলির সঙ্গে! স্বপ্নে এই পাহাড়ে
প্রবেশ করে এক দীর্ঘদেহী, বিরাট লম্বা এক পুরুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে তার। বিরাট লম্বা
এই পুরুষটির দেহ দেখা যাচ্ছে না, সর্বাঙ্গ কুয়াশায় আবৃত হয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে বিশেষ একটি
কোণে তর্জ্জনী নির্দেশ করছেন তিনি। সেদিকে মুখ ঘোরালেই দেখা যাচ্ছে একটি তোরণ, শুধুই
একটি তোরণ, যার আগাপাশতলায় কোথাও কোন গাঁথনি নেই!
এই স্বপ্নটা দেখলেই একটি অস্বস্তির মধ্যে ঘুম ভাঙে অগস্ত্যর।
স্বপ্নটি এতটাই সত্যি, এতটাই জীবন্ত বলে মনে হয় যে ঘুম ভাঙবার বেশ কিছুক্ষণ পরেও চাপা
একটি আতঙ্কের রেশ কাজ করে তার মধ্যে। ছোটবেলায় অনেকসময় ঘুম ভেঙে উঠে কেঁদে ফেলতেন তিনি,
পরবর্ত্তীকালে ব্যাপারটা তার গা সওয়া হয়ে যায়। মধ্যিখানে দীর্ঘদিন তো এই স্বপ্ন আর
তাড়া করে ফেরে নি তাকে; বহুদিন পর আজ আবার প্রথমবার ফিরে এল সেই স্বপ্ন। কিন্তু, হঠাৎ?
কম্বলটা ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে রেস্ট হাউসের জানলা দিয়ে
বাইরের বরফে ঢাকা রাস্তার দিকে তাকিয়ে মনটা উদাস হয়ে গিয়েছিল অগস্ত্যর, একমনে কিছু
একটা চিন্তা করছিলেন তিনি, এমন সময় দরজায় নকের আওয়াজ হতে ‘কাম ইন’ বলাতে দরজা ঠেলে
ভিতরে ঢুকলেন লুইসি, দুহাতে দুটি কফি-ভর্ত্তি মগ নিয়ে। একটা অগস্ত্যর সামনের টেবিলে
রেখে ভোরবেলার মিষ্টি হাসি হেসে ‘গুড মর্নিং’ বললেন তিনি, উত্তরে একটি সুন্দর হাসি
হেসে প্রতি-সম্ভাষণ জানালেন অগস্ত্যও।
-“ঘুম ঠিক হয়েছে তো?”- কফি খেতে খেতে বললেন লুইসি; উত্তরে
ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলাতে এবারে শুরু হল হালকা কথাবার্ত্তা; একথা-সেকথার পর বেশ কিছুক্ষণ
বাদে কথাপ্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন লুইসি-
-“অগুস্টা, একা কথা জিজ্ঞেস করব, কিছু মনে করবেন না তো?”
তার নামের এই অসংশোধিত উচ্চারণ এখন অনেকটাই গা-সওয়া হয়ে
গিয়েছে অগস্ত্যর; এখন আর তার কোন অসুবিধাই হয় না এরকম একটি অদ্ভুত নামে সাড়া দিতে।
ফরাসি এই মহিলাটির পক্ষে কোনমতেই সম্ভব হয় এর থেকে পরিষ্কার উচ্চারণে তাকে ডাকা। নীরবে
প্রশ্নবোধক চোখ মেলে তিনি তাকিয়ে রইলেন লুইসির মুখের দিকে।
-“আসলে জোয়ানার মনে গতকাল একটি প্রশ্নের উদয় হয়…আমরা অবিশ্বাস
করছি না আপনাকে, মিঃ ভার্গব যখন স্বয়ং পাঠিয়েছেন আপনাকে তখন আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে আপনার
ওপর অগাধ আস্থা তাঁর, কিন্তু…”
-“প্রশ্নটা বলুন!”- স্মিত হাস্যে বললেন অগস্ত্য। তিনি
জানেন, বিদেশ-বিভুঁইয়ে এসে কতটা কঠিন কারোর ওপরে বিশ্বাস রেখে চলা; কিছু মনে করলেন
না তিনি লুইসির এ হেন আচরণে। অগস্ত্যর কথায় মুখ নীচু করে কি ভাবলেন লুইসি, তারপর নিজের
মোবাইল ঘেঁটে ভারতের উত্তরাঞ্চলের একটি বর্ধিত ম্যাপ বের করে বললেন-
-“আচ্ছা, ‘কলস’ গ্রামগুলির তো থাকার কথা এই অঞ্চলে, আমরা
এখন যেখানে আছি সেখান থেকে অনেকটাই উত্তর-পশ্চিমদিকে, তাহলে আমরা আমাদের গন্তব্য থেকে
এতটা সরে এলাম কেন তা ঠিক বুঝতে-”
অগস্ত্যর কফিপান হয়ে গিয়েছিল; তিনি কফি-মগটিকে সরিয়ে রাখলেন
একদিকে, তারপর লুইসির অনুমতিক্রমে মোবাইলটি সামনের টেবিলে রেখে বলতে লাগলেন-
-“এখানে অনেক কিছু বোঝবার আছে লুইসি, আপনি ধৈর্য্য ধরে
আমার কথা শুনুন।
এখানে দেখুন, ম্যাপে এই জায়গাটি হল ‘গিলগট’ প্রদেশ। এই
জায়গাটি ধরে আপনি যদি সোজা একটি সরলরেখা ধরে এগিয়ে যান, তাহলে এই হল ‘কলস ভ্যালি’ যা
‘চিত্রল’ জেলার মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। এই তামাম উপত্যকা অঞ্চলটি স্থানীয় লোকজনের কাছে
‘কাফিরিস্থান’ নামে পরিচিত। এখানে প্রকৃতি ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ, ভূমি সাংঘাতিক উঁচু-নীচু,
বিপদ যেকোন দিক দিয়ে আসতে পারে। তবে মূল বিপদের কারণ অন্যত্র- দুটি দেশের রাজনৈতিক
পরিস্থিতি।
প্রথমেই বলে রাখি, যে ‘কলস’ জাতির কাছে আমরা পৌঁছতে চেষ্টা
করছি তাদের তিনটি গ্রাম এই ‘কলস’ উপত্যকার মধ্যেই পড়ে যাচ্ছে। জায়গাটিকে ‘কাফিরিস্থান’
বলা হয়, কারণ এই জনজাতি যে ধর্ম মেনে চলে, মনে করা হয় যে সেটি হিন্দুধর্মের বহু প্রাচীন
আচার-ব্যবহারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই জায়গাটির লেজের কাছটি আবার স্পর্শ করেছে আফগানিস্তানের
একটি অংশকে, ফলে অনেক সময় তালিবানিরাও ঢুকে পড়ে এই অঞ্চলে। অত্যাচার চালায়, মারধোর
করে। তবে সবকিছু সয়েও এরা এখনও টিঁকিয়ে রেখেছে নিজেদের অস্তিত্বকে।
আরও একটি সমস্যা এখানে পৌঁছনোর; ম্যাপে এই যে জায়গাগুলি
দেখতে পাচ্ছেন, এই যে গিলগট, চিত্রল…এই জায়গাগুলি কিন্তু কোনটাই আমাদের ভূখণ্ড নয়।
এগুলি বর্তমানে পাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত। বুঝতেই পারছেন- বর্তমান রাজনৈতিক আবহে পাকিস্তান
সরকার কোনমতেই অনুমতি দেবে না এখানে কোন ভারতীয় নাগরিককে প্রবেশ করতে। তবে আরও একটি
গুরুতর কারণ আছে এখানে না যাওয়ার পিছনে।
আপনাদের এখানে নিয়ে আসবার আগে ভার্গবকাকার সঙ্গে আমার
একটি দীর্ঘমেয়াদী আলোচনা হয়; দীর্ঘ আলাপচারীতার শেষে আমরা দুজনই একমত হই- যে ‘কলস’
জাতির খোঁজ আপনারা করছেন তা কখনোই আপনি ‘কলস উপত্যকা’ য় পেতে পারেন না; কারণ এই ক্ষেত্রটি
এই জনগোষ্ঠীর আদিম বিচরণস্থান ছিল না। ওরা ওদের উৎপত্তিস্থল থেকে সরে এসেছিল এখানে
মাত্র তিন-চারশ, কি পাঁচশ বছর আগে। ওদের উৎপত্তি কোথায় তা জানতে অনেক অনুসন্ধান করতে
হয় ভার্গবকাকাকে। এ.এস.আই.য়ে কাজ করবার সুবাদে প্রাচীন প্রমাণগুলির ব্যাপারে তিনি জানতেন;
নথিপত্র ঘেঁটে তিনিই আবিষ্কার করেন যে আমরা এখন যেখানে যাব বলে তৈরি হচ্ছি সেই ‘লেহ’
জেলার ‘চুচোট-আইয়োকমা’ গ্রামের কাছেই পাহাড়ের কোলে এদের জন্ম, ওখানে দীর্ঘদিন বসবাসের
পর কোন কারণে ওরা সরে যায় ওদের বর্তমান অবস্থানে! তাই অনুসন্ধান যদি করতেই হয় তবে এখানেই
এটি করা ভালো। ওখানে আপনি কিছু নাও পেতে পারেন।”
-“ইন্টারেস্টিং…আচ্ছা একটা ব্যাপার বলুন তো…চারদিক মুসলমান-অধ্যূষিত
এই জনজাতির আচার-ব্যবহারে হঠাৎ ‘হিন্দু-প্রভাব’ চলে এল কি করে? এ তো সত্যিই অত্যন্ত
আশ্চর্যের বিষয়, এটা কি করে সম্ভব হল?”
-“আমার ব্যক্তিগত ধারণা ওগুলি হিন্দু আচার-ব্যবহার নয়
লুইসি…ওগুলি পুরোন গ্রীক সভ্যতার ধর্মীয় আচার-আচরণ, তার সঙ্গে আঞ্চলিক প্রভাব! আপনি
ঐ জনগোষ্ঠীর ছবিগুলি দেখেছেন?”
-“‘কলস’ জাতির লোকজনের ছবি? হ্যাঁ। প্রথমবার ওদের দেখে
আমি ভেবেছিলাম ইওরোপীয় পর্যটকরা ওখানে গিয়ে ওরকম সেজে বোধহয় ছবিগুলি তুলেছে; সত্যি
বলতে কি প্রথমবার ঐ ছবিগুলি দেখে আমি একটু বিরক্তই হয়েছিলাম-”
-“আপনি শুধু নন, যেকোন আনকোরা চোখ প্রথমবার যখন ওদের ছবি
দেখবে তখনই সেই মনে এরকম কোন ধারণার সৃষ্টি হবে। এর নেপথ্যে একটি কাহিনি আছে, যার দুটি
ভাগ। প্রথম ভাগ সেই সময় যখন ককেশাস পর্বত থেকে একটি জনজাতি সমতলে নেমে এসে দুটি ভাগে
ভাগ হয়ে গেল। একটি জনজাতি চলে গেল পশ্চিমে, সুদূর পশ্চিমে; সেখানে গিয়ে সৃষ্টি করল
প্রাচীন ‘ইউনানি’ সভ্যতা, যা পরবর্ত্তীকালে ‘গ্রীকসভ্যতা’ নামে পরিচিত হয়। আর একটি
জনজাতি চলে এল পূর্বদিকে। তারা আবার দুটি দলে ভেঙে গেল; দ্বিতীয় দলটি এসে পৌঁছল ভারতের
উপকন্ঠে, এখানকার প্রাচীন, সুসংহত জনগোষ্ঠীর সঙ্গে লড়াই করে সৃষ্টি করল ‘আর্যাবর্ত’!
ফলে বোঝাই যাচ্ছে কোন একটি সূত্র ধরে গ্রীক ও আর্য- দুটি সভ্যতার ধর্মীয় আচার-আচরণে
কোথাও একটি মিল ঠিকই রয়ে গিয়েছিল। দুটি ক্ষেত্রেই কিন্তু আঞ্চলিক ও রাজনৈতিক প্রভাব
পড়ে ধর্মাচরণের উন্নতিকরণ হয়। একটি উদাহরণ আমি মেলে ধরব- ‘আর্য দেব-দেবীদের সঙ্গে অনার্য
টোটেমদের পূজো’! এই সংহতি একদিনে হয় নি।
এই গল্পের দ্বিতীয় ভাগ- ৩২৭খৃীষ্টপূর্বাব্দে আলেকজাণ্ডার
দ্যা গ্রেট-এর ভারত আক্রমণ। তৎকালীন ভারত তখন বহুভাগে বিভক্ত। ভারতের মূল ভূখণ্ডে একটি
বিরাট অংশের একচ্ছত্র অধিপতি ধনানন্দ। তার বিরুদ্ধ-শক্তি তখন একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী-
যার নেতৃত্বে ‘কৌটিল্য’ নামক একজন ব্রাহ্মণসন্তান, আর পুরোধায় ‘চন্দ্রগুপ্ত’ বলে একজন
অখ্যাত পুরুষ, যিনি নিজের পদবীধারণ করেন ‘মৌর্য’। জনশ্রুতি অনুযায়ী এই সিংহ-হৃদয় পুরুষের
মা ‘মূরী’ ছিলেন নন্দ বংশের নিয়োগ করা পরিচারক, একজন রূপবতী দাসী; ধনানন্দের ঔরসে অবৈধ
উপায়ে চন্দ্রগুপ্তের জন্ম হয়। জনরোষ ঠেকাবার জন্য গোপনে ধনানন্দ মা-ছেলেকে মারবার আদেশ
দিলে মগধ থেকে মা তার সদ্যজাত সন্তানকে নিয়ে পালিয়ে যান, শিশু চন্দ্রগুপ্তের পরবর্ত্তীকালে
ঠাঁই হয় কৌটিল্যর আশ্রয়ে।”
জোয়ানাও কখন যেন এসে যোগ দিয়েছিলেন এই আলোচনাচক্রে; তিনি
ও লুইসি- দুজনেই মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনতে থাকেন অগস্ত্যর বিবৃতি-
-“ধনানন্দকে পরাস্ত করে মগধ সাম্রাজ্যের ওপর একাধিপত্য
কায়েম করেন এই অখ্যাত রাজা, তাঁর স্থাপনা করা রাজবংশের নাম হয় ‘মৌর্য সাম্রাজ্য’। তাঁর
বাহুবল ও কৌটিল্যের নীতি অনুযায়ী সাম্রাজ্য বর্ধিত হয়; আয়তনে এতটাই বড় হয়ে যায় এই রাজ্য
যে ‘কলিঙ্গ’ বাদে অপর কোন সমকক্ষ রাজ্য তখন ভূ-ভারতে ছিল না। দাক্ষিণাত্য অবশ্য বরাবরই
স্বতন্ত্র্য ছিল আর্যাবর্তের প্রভাব থেকে।
কিন্তু এই সময় মূলত গ্রীকরা চন্দ্রগুপ্তের মূল প্রতিদ্বন্ধী
হয়ে ওঠে। আর্যাবর্তের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে তখন গ্রীক প্রভাব ছিল। আলেকজাণ্ডার
যাওয়ার সময় ‘সেকেণ্ড ইন কমাণ্ড’ করে যান তাঁর এক সেনাপতি সেলুকাসকে; মূলতঃ তার সঙ্গেই
যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয় চন্দ্রগুপ্তকে। দীর্ঘকালব্যাপী যুদ্ধের পর অবশেষে পরাজয় স্বীকার
করেন সেলুকাস, সন্ধি হয় তাঁদের মধ্যে।
বুঝতেই পারছেন লুইসি, ‘কলস’ জাতির উৎপত্তি কিসের থেকে।
এদের বিবাহ কিন্তু নিজেদের জনজাতির মধ্যেই হয়, খুব বেশি মিশ্রণের প্রভাব এখনও এদের
মধ্যে আসে নি। ফলে এরা এখনও তাদের প্রাচীন পিতাদের বাহ্যিক ও সামাজিক বৈশিষ্টগুলি ধরে
রেখেছে।”
-“আর একটি কথা, অগুস্টা…”- অগস্ত্যের কথা শেষ হতেই জিজ্ঞাসা
করলেন লুইসি- “আপনি বলেছেন ধনানন্দ বকলমে চন্দ্রগুপ্তের পিতা, তিনি যুদ্ধে পরাস্ত হওয়ার
পর কি ঘটল? চন্দ্রগুপ্ত কি তাকে বধ করেন?”
অগস্ত্য স্থিরভাবে কিছুক্ষণ তাকালেন লুইসির মুখের দিকে,
তিনি বুঝতে পেরেছেন তার বক্তব্য।
-“আপনি জানতে চান চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য নিজের হাতে তাঁর পিতাকে
বধ করেছিলেন কি না- ঠিক তো?”
ঘাড় নাড়লেন লুইসি ও জোয়ানা- দুজনেই। বোঝা গেল দুজনই সমানভাবে
আগ্রহী মহারাজ ধনানন্দের পরিণতি কি হল তা জানতে।
-“সমসাময়িক ইতিহাস
বলে মহারাজ চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য তার পিতা তথা ভূতপূর্ব সম্রাট ধনানন্দকে ছেড়ে দিয়েছিলেন,
রাজ্য থেকে নির্বাসিত করেছিলেন তাকে। কিন্তু জনশ্রুতি বলে- কৌটিল্য শত্রুর শেষ রাখেন
নি, গোপন আততায়ী দিয়ে তিনিই নাকি বধ করিয়েছিলেন ধনানন্দকে!”
-“এও তো একপ্রকার পিতৃহত্যা! মহারাজ চন্দ্রগুপ্ত কি জানতেন
না কৌটিল্যের এই পদক্ষেপ?”- সমস্বরে বলে ওঠেন দুজনই।
একথায় আচমকা চুপ হয়ে যান অগস্ত্য; খানিকক্ষণের জন্য চিন্তার
সাগরে যেন ডুবে যান তিনি। কিছুক্ষণ পর সম্বিৎ ফিরে পেয়ে তিনি বলে ওঠেন-
-“ভার্গবকাকা এখানকার আর্মি অফিসারদের সঙ্গে কথা বলে রেখেছেন;
যাওয়ার সময় আমরা ওদের সঙ্গে দেখা করে প্রোটেকশন নিয়ে যাব। এখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি
অস্থির, তাই সঙ্গে গার্ডস রাখতে হবে। আপনারা তৈরি হন, এখন সাতটা বাজে, ঘন্টাখানেকের
মধ্যে আমরা বেরিয়ে পড়ব।”
অগস্ত্যকে বিদায় জানিয়ে ঘর থেকে বেরোবার সময় আবার একবার ফিরে আসেন লুইসি; দরজাটা বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছিলেন তিনি। সেইসময় একপলকের জন্য চোখে পড়ল- একটি পুরোন আমলের চশমা চোখের সামনে মেলে ধরে একদৃষ্টে তাকিয়ে অন্যমনষ্কের মত কি যেন ভাবছেন অগস্ত্য; চশমাটার একদিকের ডাঁটি ভাঙ্গা! মুখে আর কিছু বললেন না লুইসি, দরজাটা টেনে বন্ধ করে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন তিনি।
[লেহ জেলা, লাদাখ, চুচোট-আইয়োকমা গ্রাম থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে
- ২৮শে জুন ২০১৬]
-“গতকাল এখানে পা রেখে আগেই সব দরকারি ও সরকারি বিধিগুলি
এগিয়ে রেখেছিলাম, এইজন্যই তো আজকে সব এত তাড়াতাড়ি হয়ে গেল। এখন গন্তব্যে পৌঁছতে বেশি
সময় লাগবে না।”
গাড়ির ঝাঁকুনিতে পথ চলতে চলতে বললেন অগস্ত্য, সামনের সিটে
বসা লুইসি ও জোয়ানাকে উদ্দেশ করে। দুজনেই স্মিত হাস্যে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন সে
কথায়।
-“আমরা এখন তাহলে কোথায় যাচ্ছি অগুস্টা?”- উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা
করলেন লুইসি।
-“আপনাদের কথাবার্তায় বেশ কয়েকবার ‘কলস’ জনজাতির বসতির
কাছে ‘তিন বোন’-এর উপস্থিতির প্রসঙ্গ উঠে এসেছে; এখান থেকেই মোটামুটি আঁচ করতে পেরেছি
ব্যাপারটা। ভার্গবকাকা যেহেতু ‘কলস’দের আদি বসতিটি চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছেন, তাই
এখন আমাদের খুঁজে বের করতে হবে ঐ অঞ্চলের নিকটবর্ত্তী পাশাপাশি তিনটি জলপ্রপাত-”
-“জলপ্রপাত?” – বিষ্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন জোয়ানা। ইনি
একজন নির্বাক শ্রোতা, বেশিরভাগ সময়তেই চুপচাপ থাকতে পছন্দ করেন; এখন তিনি ছুঁড়ে দিলেন
প্রশ্নটি।
-“এখানকার স্থানীয় মানুষজন জলপ্রপাতগুলিকে ‘রমণী’ হিসেবে
দেখেন, আর এই ধারণা বহুযুগ ধরে বংশ-পরম্পরায় চলে আসছে। হয়তো প্রাচীনকালেও এই ধারণাটি
ছিল। গতকাল আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম এই অঞ্চলে কোথাও পাশাপাশি তিনটি জলপ্রপাত আছে কি
না; এখানকার আর্মির লোকজন অঞ্চলটিকে হাতের তালুর মত চেনেন। একজন প্রবীণ জওয়ান আমায়
বললেন যে ‘চুচোট আইয়োকমা’ গ্রামটির পঞ্চাশ কিলোমিটার দায়রার মধ্যে পাশাপাশি এরকম তিনটি
জলপ্রপাত পড়ে; উনি একটি ম্যাপও এঁকে দিয়েছেন আমায়। এই দেখুন, এই জায়গাটির নাম ‘রাবসাং’,
এখানেই পাশাপাশি তিনটি জলপ্রপাত আছে কয়েক কিলোমিটারের দূরত্বে। আমরা এখন এখানেই যাচ্ছি।”
-“ও! তা যেতে কতক্ষণ লাগতে পারে অগুস্টা?”- জিজ্ঞেস করলেন
লুইসি।
-“কোন ঠিক নেই! পাহাড়ি পথে ঘড়ি ধরে কোনকিছু বলা সম্ভব
নয়। একঘন্টাতেও চলে যেতে পারি, তিন ঘন্টাও লাগতে পারে, আবার ওর অনেক আগে আমাদের ফেরতও
চলে আসতে হতে পারে! সবকিছুই নির্ভর করছে রাস্তার ওপর। তবে এখন তো সদ্য বর্ষাকালের শুরু,
রাস্তাঘাট এখনও খুব খারাপ থাকবার কথা নয়। দেখা যাক!”
লুইসির দিকে একটু সমীহের চোখে তাকালেন অগস্ত্য। ফরাসি
এই মহিলাটিকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখেন তিনি। প্রথমদিন ভার্গবকাকা যখন তাকে ডেকে
এই দুই মহিলার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন এবং তাদের আসার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করেন, একটু অবাকই
হয়ে যান অগস্ত্য। সম্পূর্ণ অজানা একটি দেশে অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় দুটি অল্পবয়ষ্কা তরুণী?
তারপর সময় যত এগিয়েছে, বিষ্ময়ের পারদ চড়েছে ততখানিই। নিছক গালভরা ‘উইমেন্স লিবার্টি’র
কথা বলে আত্মপ্রসাদ অনুভব করা ‘গলুই-আহ্লাদি’ আধুনিকা নন, এই মহিলারা সত্যিই দুঃসাহসের
জীবন্ত প্রতীক!
ভার্গবকাকা অবশ্য আরও একটি কথা বলেছেন তাদের আড়ালে ডেকে-
তার জীবনের যে বৃহত্তর প্রশ্নের মুখে তিনি দৌড়ে বেরিয়েছেন আজীবন, তার উত্তর এই দুইজনের
কাছে থাকতে পারে; রহস্যটা অবশ্য এর থেকে বেশি ভেঙে বলেন নি তিনি। কি বোঝাতে চেয়েছেন
ভার্গবকাকা সেদিন?
অগস্ত্যকে একভাবে তাদের দিকে চেয়ে থাকতে দেখে জোয়ানা হেসে
লুইসির কানে কানে কিসব বললেন, তাতে লুইসিও প্রথমে হেসে উঠলেন একচোট, তারপর হাসতে হাসতেই
বললেন-
-“কি ব্যাপার অগুস্টা, আপনি কি কিছু হারিয়ে ফেলেছেন আমাদের
কাছে?”
প্রশ্নটির মর্মার্থ বুঝে একটু লজ্জা পেয়ে গেলেন অগস্ত্য;
পাশের সীটে বসা আর্মি আর্মি অফিসারের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, তিনিও তখন হাসি চাপতে ব্যস্ত
একদিকে মুখ ফিরিয়ে! প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে উঠে অবশেষে তিনি বললেন-
-“পাহাড় আর জঙ্গলের ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে আপনাদের মত অল্পবয়সী
মেয়েরা যে অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজে আসবেন তা আমি ঠিক- আচ্ছা, আপনাদের মোটিভেশনটা ঠিক কি
ছিল?”
এ কথার উত্তরে একটু থমকালেন লুইসি, তারপর রুকস্যাকের সাইডপকেট
থেকে প্রথমে বের করে আনলেন একটি ফটো ও নোটবুক। সে দুটি তিনি তুলে দিলেন অগস্ত্যর হাতে।
দেখেই বোঝা গেল জিনিষগুলি বেশ পুরোন। এবার ফটোটির ওপর আঙুল রেখে তিনি বললেন-
-“আমার বাবা ফিলিপ এডুইন গিবস। ইনি জাতিগতভাবে ফরাসি,
পড়াশোনা ও চাকরি মার্কিন মুলুকে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় ইনি সেনাবাহিনিতে নাম লেখান;
অসীম সাহসিকতা ও অসামান্য বীরত্বের কারণে শেষে সার্জেন্ট পোস্টে প্রমোটেড হন। যুদ্ধের
একেবারে শেষের দিকে ডান্যাং শহরের উপকন্ঠে একটি আশ্চর্য ঘটনার সম্মুখীন হন তিনি-”
সার্জেন্ট গিবসের সঙ্গে ‘রেডস্টার’ খুয়ানের সাক্ষাৎকার
পর্বটি এরপর তিনি মেলে ধরেন অগস্ত্যর সামনে, মন দিয়ে পুরোটা শোনেন তিনি। পুরোটা ব্যক্ত
করে এরপর তিনি দ্বিতীয়বার হাত ঢোকান রুকস্যাকের সাইডপকেটে, আর এবার যে জিনিষটি বের
করে আনেন তিনি, তা দেখে হতচকিত হয়ে যান অগস্ত্য। এ কি?
লুইসি তার দিকে বাড়িয়ে ধরেছেন সেই ‘চোখ’, যা বহুকাল আগে
তিনি দেখেছেন বাবার কাছে! তফাৎ শুধু এখানেই যে বাবার কাছে যেটি দেখেছিলেন, সেটি মানুষের
ডান চোখের আদলে তৈরি, আর এটি বাঁ চোখের আদলে! এই প্রভেদটুকুনি ছাড়া অন্য কোন প্রভেদ
নেই দুটি ক্ষেত্রেই; একই কারুকার্য, একই আকার ও প্রকৃতি- সবই এক প্রকারের!
হাঁ করে ‘চোখ’টির দিকে তাকিয়ে রইলেন অগস্ত্য, উত্তেজনায়
বুক কেঁপে উঠছে তার। এত বছর পর সেই অভিশপ্ত চোখের জোড়াটি ফেরৎ এল তার কাছে, তাহলে কি
এবার বাবাকে খুঁজে-
-“যুদ্ধের বীভৎসতা বাবার মনটাকে পুরোমাত্রায় বিষিয়ে দিয়েছিল…”-
বলতে থাকেন লুইসি -“যুদ্ধের উপান্তে আর আমেরিকায় ফেরৎ যান নি তিনি, সোজা চলে আসেন ফ্রান্সে।
ইতিহাসের অধ্যাপনার অভিজ্ঞতার কারণে চাকরি পেতে অসুবিধে হয় নি তার, আজীবন ফ্রান্সেই
কাটান তিনি। তবে যে দরজা খোলে এই চাবি দিয়ে তার অনেক খোঁজ করেছিলেন তিনি। পাকিস্তানেও
গিয়েছিলেন; অনুমতিও যোগাড় করেছিলেন তিনি ওখানে ঘোরাঘুরির। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে প্রথমে
সোভিয়েত-তালিবান যুদ্ধ ও পরে তালিবান শাসনের উথ্থানের কারণে পাকিস্তান সরকার সেই অনুমোদন
প্রত্যাহার করে নেন। নোটবুকের লেখাগুলি ওনার নিজের-”
নোটবুকটা খুলে সেটি খুব মন দিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন অগস্ত্য;
দেখা শেষ হলে তিনি সেটি ফেরৎ দেন লুইসিকে, তারপর বলেন-
-“‘কলস’দের স্থানান্তরিত হওয়ার বিষয়টি বোধহয় তিনি জানতেন
না, নাহলে আমার বিশ্বাস উনি জায়গাটি নিশ্চই ধরে ফেলতেন। তবে ‘তিন বোন’এর ব্যাপারটা
যে প্রকৃতপক্ষে জলপ্রপাত তা তিনি নিশ্চিতভাবে বুঝেছিলেন- ওঁনার নোটবুকে লেখা আছে ব্যাপারটা।
আচ্ছা, ‘কলস’দের বর্তমান বসতি অঞ্চল থেকে উনি আর কিছু জানতে পারলেন কি?”
-“ওদের একটি অদ্ভুত ধর্মীয় আচরণের বিষয়ে উনি বলতেন আমায়…‘কলস’
জনজাতির লোকজন প্রতিবছর শীতের গোড়ায় একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করে- কোন এক আত্মার
শান্তির উদ্দেশ্যে এই অনুষ্ঠানের চল ওদের মধ্যে-”
-“কিরকম?”
-“এমনিতেই ওদের আচার আচরণ বিবিধ, বারোমাসে তেরো পার্বণ
না হলেও সংখ্যাটা দশের নীচে কিছুতেই হবে না তা নিশ্চিত; তার মধ্যে এই ধর্মীয় অনুষ্ঠানটি
একেবারে স্বতন্ত্র্য! ওদের বিশ্বাস- বহুকাল আগে কোন এক বিদেশি আগন্তুক এসে ছিলেন ওদের
এলাকায়, দেবতাদের মন্দিরে স্বর্গে যাওয়ার দরজা খুলে দিতে। স্বর্গের দরজা খোলবার দুটি
চাবির মধ্যে একটি চাবি ওঁনার কাছে ছিল, কিন্তু সেই চাবি হারিয়ে ফেলায় দেবতা ওঁনার প্রতি
রুষ্ট হন এবং এবং চিরকালের জন্য তাঁর আত্মাকে বন্দী করে রাখেন নিজ মন্দিরের বলয়ে! প্রতিবছর
‘কলস’দের তিনটি গ্রামের লোকেরা সমবেত হন, একইসাথে উত্তর-পূর্বদিকে মুখ করে সকলেই মঙ্গলোচ্চারণ
করে, স্তুতিগান গায়। এই রেওয়াজ নাকি বহু প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে ওদের মধ্যে।”
-“দুটি চাবি…হুঁ…এই চাবির ব্যাপারটি কি?”
-“আমার বাবা প্রয়াত হন এ বছর ১১ই জানুয়ারি। আমৃত্যু তিনি
বিশ্বাস করে এসেছেন এই ‘চোখ’এর মত বস্তুটি একটি চাবি। প্রয়াত খুয়ামও এই কথা বলেছিলেন
তাঁকে। এটি যদি একটি চাবি হয়, এবং এটি যদি মানুষের বাঁ চোখ হিসেবে ধরা হয়, তবে-”
-“তবে মানুষের ডান চোখের মতও একটি চাবি থাকা উচিৎ, তাই
না?”
-“বিষয়টি তো তাই দাঁড়ায়, যদিও বাবা কখনোই খুঁজে পান নি
সেই ডান ‘চোখ’। সেটি আদৌ আছে কি না-”
এ কথায় একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল অগস্ত্যর বুক থেকে;
তারপর একটু নীরব থেকে তিনি বললেন-
-“আছে! ওটি-”
অগস্ত্য মুখ খুলেছিলেন তার জীবনের ভয়াবহতম অভিজ্ঞতা লুইসির
সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার জন্য; এমন সময় ড্রাইভারের পাশের সীট থেকে গার্ডবাহাদুর হেঁকে
উঠলেন-
-“সাব! রাবসাং উওয়টার ফলস্ আ গৈলা!!”
একটু পরেই গাড়িটা থেমে যেতেই সকলে জিপ থেকে নেমে এগিয়ে
গেলেন জলপ্রপাতের দিকে।
**************************************************************************
-“আপনি কি নিশ্চিত অগুস্টা, এটাই সেই জায়গা?”
খরস্রোতা নদীর এপাড়ে দাঁড়িয়ে অপরপাড়ের ঢালুপথের শেষপ্রান্তে
খাড়া উঠে যাওয়া পাহাড়টির দিকে তাকিয়ে শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করলেন লুইসি। প্রত্যুত্তরে
ঘাড় নাড়ালেন অগস্ত্য।
-“‘পাহাড়ের গায়ে তিন বোন যেখানে খেলা করে’- আপনি পাশাপাশি
দুইটি জলপ্রপাতকে আগেই দেখেছেন লুইসি, এটি তৃতীয়টি। ‘এক বোনের একটি চক্ষু দিয়ে নেমে
আসছে ক্ষীণ অশ্রুধারা’- ঐ দেখুন, পাশাপাশি দুটি গুহামুখের একটি থেকে ক্ষীণ জলধারা নেমে
এসে মিশেছে মূল নদীস্রোতের সঙ্গে…আর তাছাড়া আমরা এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তা কলসদের
বর্তমান বসতির সোজাসুজি উত্তর-পূবদিক; বিশ্বাস না হয় ম্যাপে দেখুন…কিন্তু ওদিকটায় এত
কুয়াশা কেন? পাথরখণ্ডগুলির এপাশে তো কোন কুয়াশা হয় নি!”
অগস্ত্যর মন বলছে এটিই সেই জায়গা; পাহাড়টি দেখেই নিশ্চিত
হয়েছেন তিনি। এই পাহাড়ের আকৃতি তার স্বপ্নে দেখা পাহাড়ের আকৃতির সাথে হুবহু সামঞ্জস্যপূর্ণ,
কোন তফাৎ নেই! দেখা মাত্রই একে চিনেছেন তিনি। স্বপ্নকে এখন বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে
থাকতে দেখে অগস্ত্যর বিশ্বাস- তিনি দাঁড়িয়ে আছেন তার গন্তব্যের থেকে মাত্র কয়েক মিটার
দূরে। এখন শুধু রহস্য উম্মোচনের পালা!
নদীর যে পাড়ে তারা এখন দাঁড়িয়ে সেটি প্রায় নদীর সমতলে;
পাড় নদীর থেকে কয়েক ফুট উঁচু হবে মাত্র। তাদের সঙ্গে থাকা আর্মি অফিসারটির নাম ডাম্বলে,
তিনি জানালেন- এই জায়গাটি প্রকৃতপক্ষে আগে অনেক উঁচুতে ছিল; কিন্তু পরবর্ত্তী যুগে
ক্রমাগত ভূমিকম্প ও বিধ্বংসী বন্যার ফলে নদীর এই পাড়ের উঁচু অংশটি ক্রমশঃ বসে গিয়ে
আজকের এই চেহারায় এসে দাঁড়িয়েছে! নদীর পাড় সন্নিহিত অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অজস্র
ছোট-বড় পাথরের টুকরোও অবশ্য সেই কথাই বলে।
একটু দূরে এগিয়েই একসার পাথরের সারি আড়াআড়িভাবে নদীটিকে
অতিক্রম করে ঐপাড়ে ঠেলে উঠেছে, যেন নদীর ওপর প্রকৃতি নিজ ইচ্ছায় একটি পাথরের সেতু নির্মাণ
করেছে। এই পাথরের সারি অতিক্রম করেই কুয়াশার বৃত্তে প্রবেশ করে নদীটি যেন একটু থমকে
তারপর অদূরে জলপ্রপাতের সৃষ্টি করে নীচে আছড়ে পড়েছে; স্বর্গীয় এই দৃশ্য!
-“চলুন, ঐপাড়ে যাওয়া যাক। জোয়ানা ততক্ষণে তৈরি হয়ে নিক,
এখানে দাঁড়িয়ে অহেতুক সময় নষ্ট না করে-”
লুইসির কথায় সম্মত হলেন অগস্ত্য; তারপর পাথরের সেতু ধরে
হাঁটতে হাঁটতে তারা দুজনেই চলে এলেন এপাড়ে। জোয়ানা সাংবাদিকতার কাজ করেন, নিজের অফিসের
জন্য একটি প্রতিবেদন লিখেই তিনি যোগ দেবেন ওদের সঙ্গে।
-“মিঃ ডাম্বলে কি বললেন?”
-“নদীটা ক্রস করেই ওপাড়ে গিয়ে দাঁড়াতে, আর ওনারা না আসা
অবধি আমরা যেন জায়গা থেকে না নড়ি। এই চত্ত্বর থেকে বর্ডার মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে,
হোস্টাইলরা এখানে ঢুকে পড়ে যখন-তখন! ওরা ইউনিটে খবর পাঠিয়ে আমাদের সঙ্গদান করবেন।”-
লুইসির প্রশ্নের উত্তরে বললেন অগস্ত্য।
অত্যন্ত নির্জন পরিবেশ জায়গাটি জুড়ে। এত নিস্তব্ধ এই অঞ্চলটি
যে অদূরে জলপ্রপাতের শব্দটা বেশ জোরে কানে লাগছে; অথচ এখানকার লোকজনের মতে এই জলপ্রপাতের
উচ্চতা কিন্তু খুব বেশি নয়! খানিকণ নীরবে এই নৈশব্দ্য অনুভব করলেন দুজনেই, তারপর লুইসি
বললেন-
-“তখন গাড়িতে কিছু একটা বলতে গিয়েছিলেন চাবির ব্যাপারে…”
প্রসঙ্গটি আবার মনে পড়ে গেল অগস্ত্যর, তিনি তার বাবার
বিষয়ে বললেন লুইসিকে, পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পুরোটা। অগস্ত্যর সম্পূর্ণ বক্তব্য মন দিয়ে
শুনলেন লুইসি, তারপর বললেন-
-“তাহলে? দ্বিতীয় চাবিটিও এর মানে রয়েছে? কিন্তু…এর ভূমিকাটি
তাহলে কোথায়? আপনি যা বললেন তার থেকে পরিষ্কার যে দ্বিতীয় চাবিটি ব্যবহার হয়েছিল বটে,
কিন্তু তা তো আপনার বাবার সাথে সাথেই- ভালো কথা, চাবিটি উনি পান কোথা থেকে?”
-“কাশ্মীর যাওয়ার আগে বাবা মহারাষ্ট্রে গিয়েছিলেন; ফেরবার
সময় সাথে করে উনি নিয়ে আসেন এই চাবি, আর একটি লিপি। এর থেকে বেশি কিছু তখন জানতে পারি
নি। তবে পরবর্ত্তীকালে লিপিটি কোনভাবে হাতে এলে আমি ওটিকে পর্যবেক্ষণ করি। যদিও এর
বেশিরভাগ জায়গা আমি পাঠোদ্ধার করতে পারি নি-”
-“কি ছিল লিপিটিতে?”
-“লিপিটি খরোষ্ঠী ভাষায় লেখা হয়েছিল। ঐ লিপিটি পাঠোদ্ধার
করতে বাবাকে একজন প্রখ্যাত ভাষাবিদের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল। তবে মোটের ওপর যা বুঝেছি-
আমাদের দেশের একদম পশ্চিমদিকে কোন এক জঙ্গুলে জাতির কাছ থেকে বাবা উদ্ধার করেন ঐ ‘চোখ’,
যা নিয়ে আমরা দুজনেই গিয়েছিলাম অনন্তনাগের সূর্যমন্দিরে। বাবা চেয়েছিলেন বিষয়টি আগেই
দেখে নিয়ে তারপর এ বিষয়ে সকলকে জানাতে, কিন্তু তার আগেই-”
-“আপনার বাবার রহস্যময় অন্তর্ধান ঘটে। জানি। ডাঃ ভার্গব
আমাদের জানিয়েছিলেন এ কথা। তিনি এও বলেছিলেন- এ বিষয়ে যদি কেউ যোগ্য সহায়তা করতে পারে
তবে তা আপনি। সূত্রগুলি পরপর মিলছে এসে একটিই বিন্দুতে! কিন্তু একটিই ব্যাপার ঠিক বুঝে
উঠতে পারছি না অগুস্তা- দুটি ভিন্ন চাবি, একটি চাবি উদ্ধার হল ইরাবতী নদীতে, অর্থাৎ
মায়ানমারে; সময়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে সেটি চলে এল দক্ষিণ ভিয়েতনামে। অপর একটি চাবি
আপনার বাবা উদ্ধার করেন মহারাষ্ট্রের পশ্চিমদিক ঘেঁষে জঙ্গলের এক আদিবাসী গোষ্ঠীর কাছ
থেকে, অথচ দুটিরই যোগসূত্র ভারতের হিমালয়! এর উদ্দেশ্যটা কি? কিচ্ছু বুঝতে পারছি না
ব্যাপারটা-”
-“প্রাচীন ও বর্তমান ভারত অতি রহস্যময় দেশ লুইসি; ‘দেবতাদের
আপন ভূমি’ এই দেশ কত রহস্য বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে তা কেউ বলতে পারে না। তবে আমার বিশ্বাস-
এই চাবির রহস্যটি যেদিন খুলে যাবে, সেদিন বিজ্ঞানের নতুন কোন দিক উম্মোচন হবে। বাকিটা
ভাগ্য! জোয়ানার এখনও হয় নি?”
সেটা দেখার জন্যই সদ্য ঘাড় ঘুরিয়েছেন দুজনেই, এমন সময়
অগস্ত্যর মনে হল একটা আগুনে পোকা যেন উড়ে গেল তার বাঁ গালের পাশ দিয়ে, আর যাওয়ার সময়
তার বিষাক্ত দাঁড়ার প্রান্তভাগ যেন হালকাভাবে ছুঁইয়ে গেল তাকে! প্রথমে বিষয়ের গুরুত্ব
অতটা বুঝতে পারেন নি তিনি, একটা চিনচিনে ব্যথা আর হালকা জ্বালা নিয়ে তিনি ফিরে তাকালেন
লুইসির দিকে। দেখা গেল, একমুখ বিষ্ময় নিয়ে লুইসি হাঁ করে তাকিয়ে তার দিকে!
-“ওটা কি…রক্ত…অগুস্টা?”
গালে হাত বুলিয়ে সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে দেখলেন অগস্ত্য-
রক্তই তো! বাঁ গালে যে ক্ষতস্থান তৈরি হয়েছে তা থেকে বেরোন তার নিজেরই তাজা রক্ত! কিন্তু
কোন পোকা কামড়ালো তাকে?
-“অ্যামবুশ! টেক কাভার!!!”
ক্যাপ্টেন ডাম্বলের প্রবল চিৎকারে চটকা ভাঙ্গল সকলের!
একজন গার্ড দৌড়ে এসে একপ্রকার কোলপাঁজা করে তুলে নিয়ে গিল জোয়ানাকে; একটি পাথরের ওপর
বসে একমনে প্রতিবেদন লিখছিলেন তিনি; বেচারির নোটবুক আর পেনসিল পড়ে রইল মাটিতেই! দুটি
পৃথক দলে ভাগ হয়ে জোয়ানাসমেত সকলেই বসে পড়লেন ইতস্তত বিক্ষিপ্ত পাথরের চাঙরার আড়ালে,
একজন ওখান থেকেই অগস্ত্যদের নির্দেশ দিলেন যা হোক কিছুর আড়ালে কভার নিতে! ওপাড়ের জঙ্গলের
ঠিক মুখটাতেই দেখা গেল আরও পরপর কয়েকটি আলোর ঝলকানি, তারপরই তাদের পাশ দিয়ে বেরিয়ে
গেল পরপর আরও কয়েকটি বুলেট!
-“তাড়াতাড়ি…আমাদের কভার নিতে হবে!”
-“কোথায়? এ পাড়ে তো কোন পাথরের টুকরো নেই-”
-“ঢালুপথ বেয়ে চড়তে শুরু করুন লুইসি, ঐ পাহাড়েই এখন আমাদের
আশ্রয় নিতে হবে, এ ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই!”
-“কিন্তু জোয়ানা?”
একথায় ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন অগস্ত্য। উল্টোদিকের গার্ডরা
ততক্ষণে বুঝতে পেরেছেন যে এমন কিছুই নেই এ পাড়ে যার পিছনে অগস্ত্যরা কভার নিতে পারেন;
এ কথা বুঝে জঙ্গলের লাইন লক্ষ্য করে পাথরের আড়াল থেকে পাগলের মত গুলি ছুঁড়ে যাচ্ছেন
তারা যাতে শত্রুদের ফায়ারিং নিজেদের দিকে টেনে নেওয়া যায়! আর হচ্ছেও তাই, শত্রুদের
সব কটি বন্দুকের নল এখন তাদের দিকে ঘুরে গিয়েছে। এই সুযোগে মেজর ডাম্বলে প্রাণপণে চেষ্টা
করছেন নিজের ইউনিটের সঙ্গে যোগাযোগ করতে।
-“জোয়ানা ওদের সঙ্গে রয়েছে, ব্যাক-আপ টিমও তাড়াতাড়িই চলে
আসবে; আসুন, ততক্ষণে আমরা গুহায় ঢুকে পড়ি; সব থামলে না হয়-”
আর দ্বিরুক্তি করেন নি লুইসি; অগস্ত্যের সঙ্গে তিনিও শুরু
করে দিলেন ঢালুপথটি বেয়ে ওপরের পাহাড়ের পাহাড়ের দিকে চড়তে। একটু পরে দুজনেই ঢুকে পড়লেন
পাহাড়ের পাশাপাশি দুটি গুহামুখের শুকনোটিতে, ভিতরে অন্তর্হিত হয়ে গেলেন তারা।
-“এ কোথায় চলে এলাম বলুন তো, অগুস্টা?”
উত্তরে কাঁধ শ্রাগ করলেন অগস্ত্য; বিষয়টির মাথা-মুণ্ডু
কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি।
গুহামুখ দিয়ে পাহাড়ের ভিতরটায় ঢুকে পড়ে প্রথমটায় বেশ ফাঁপড়ে
পড়েছিলেন দুজনেই, সূচীভেদ্য অন্ধকারে আশেপাশে দেখা যাচ্ছিল না কিছুই! বেশ কিছুক্ষণ
একটানা দাঁড়িয়ে থেকে অন্ধকারে চোখ সয়ে আসতে দুজনে খেয়াল করেন- একটি লম্বা প্যাসেজের
মাঝখানটা করে দাঁড়িয়ে আছেন তারা, যার শেষপ্রান্তে একটি হালকা লালচে হলুদ আভা বেরিয়ে
আসছে যেন। আরও একটি বিষয় খেয়াল করে দেখেছেন দুজনই; তাদের মনে হল অন্ধকারে গোটা প্যাসেজ
জুড়ে যেন অজস্র হাড়-গোড় ছড়ানো! নিশ্চিত হওয়া গেল প্যাসেজটি ধরে একেবারে শেষপ্রান্তে
আলোক উৎসটির সামনে আসতে; দেখা গেল সেটি একটি প্রবেশদ্বার এবং তার সামনে পড়ে দুটি-তিনটি
নরকঙ্কাল! দুজনেই ভয়ে সিঁটিয়ে গেলেন মানুষের ভঙ্গুর কঙ্কাল আবিষ্কার করে!
-“এসব কি ব্যাপার বলুন তো অগুস্টা…?”- ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস
করলেন লুইসি।
-“ভয় পাবেন না; আমরা অনেকটা চলে এসেছি, এখন সামনে এগিয়ে
যাওয়া ছাড়া আমাদের আর কিছু করণীয় নেই-”
কপাল ঠুকে দুজনেই ঢুকে গেলেন ভিতরে; দেখা গেল, একটি বিশালায়তন
কক্ষের অন্দরে প্রবেশ করেছেন তারা!
কক্ষে ঢোকবার ঠিক মুখটিতেই একটি বড় পাথর লম্বালম্বিভাবে
দাঁড় করানো অবস্থায় ছিল, সেটির গায়ে দেবনাগরী হরফে কিছু খোদাই করে রাখা ছিল। কৌতুহলী
মুখে লেখাটি পড়ে দেখলেন অগস্ত্য।
-“কি লেখা ওতে?”- কৌতুহল ও আগ্রহ ভরে প্রশ্ন করলেন লুইসি।
-“‘একমাত্র নির্বাচিতরাই সময়-দর্পণ কক্ষে প্রবেশে সমর্থ’!”
-“মানে কি হতে পারে কথাটির?”
-“বুঝতে পারছি না…তবে আপনার এত সিঁটিয়ে যাওয়ার কোন কারণ
নেই লুইসি; সত্যিই যদি কোন বিপদ থাকত তবে আমরাও এতক্ষণে পড়ে থাকতাম দরজার ওপারে; কিন্তু
‘সময়-দর্পণ’ বলতে ওরা কি বোঝাতে চেয়েছে? এবার কিন্তু বিষয়টা অত্যন্ত জটিল হয়ে উঠছে!”
বিশাল এই কক্ষের দেওয়ালগুলিতে অজস্র চিত্র আঁকা। আবার
লিপিও রয়েছে জায়গায় জায়গায়। উৎসাহভরে অগস্ত্য দেখলেন- লিপিগুলির মধ্যে ভারতীয় সিন্ধু,
আর্য, খরোষ্ঠী, ব্রাহ্মী, প্রাকৃত বা পালি যেমন রয়েছে, তেমনি আবার হিয়েরোগ্লাফিক, কিউনিফর্ম
পুরোন যুগের চাইনিজ বা জাপানিজ চিত্রলিপিও তেমনি উজ্জ্বলভাবে উপস্থিত; কিছু কিছু লিপি
আবার অগস্ত্যর সম্পূর্ণ অচেনা। কতগুলি ভাষায় এই দেওয়াল-গ্রন্থাগার তৈরি কে জানে?
তবে আসল বিষয়টি অগস্ত্য আবিষ্কার করলেন বিরাট এই কক্ষের
মাঝামাঝি। কক্ষে আলো বলতে একটি বিষণ্ণ, লালচে-হলুদ আলো যা ঘরের প্রান্তপ্রদেশগুলির
অন্ধকার তাড়াতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ! চারদিক তাকিয়ে দেখতে গিয়ে কক্ষের মাঝখানে চোখ
পড়ল অগস্ত্যর, আর তখনই তিনি দেখতে পেলেন-
সেই তোরণ, সেই তার পাশে দাঁড় করানো ছোট আকারের গম্বুজ!
তবে ছোটবেলায় যেটিকে দেখেছিলেন অগস্ত্য, এগুলি সেরকম নয়, এগুলি আকারে যেন আরও বড়! ফ্যালফ্যাল
করে সেদিকে তাকিয়ে ছিলেন অগস্ত্য; তারপর অদৃশ্য কোন এক দুর্নিবার আকর্ষণে সেদিকে মনের
অজান্তে পা বাড়াতে যাবেন, এমন সময়-
-“ওদিকে কি ব্যাপার বলুন তো?”
অগস্ত্যর হাত পিছন থেকে টেনে ধরেছিলেন লুইসি, এবারে তার
কথামতন সেদিকে তাকালেন অগস্ত্য। দেখা গেল তাদের মুখোমুখি দেওয়ালের প্রায় শেষপ্রান্তে
একটুকু ফাঁক দিয়ে বাইরের অন্ধকারে এসে ঠিকরে পড়ছে একসার উজ্জ্বল আলোকমালা!
-“ওদিকেও একটা দরজা আছে মনে হয়। চলুন, গিয়ে দেখি!”
পায়ে পায়ে দুজনে এগিয়ে এলেন দরজার সামনে; তারপর ভিতরে
উঁকি মেরে দেখে থমকে গেলেন উভয়েই। এ কি অবাক কাণ্ড?
ঘরের ভিতরটা উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত; এত দুধসাদা, উজ্জ্বল
সেই আলো যেন চোখ ঝলসে যায়, আর তার সাথে বেশ গাঢ় একটি কুয়াশার আস্তরণ যা আলোর ঔজ্জ্বল্যকে
আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে হয়। এই কুয়াশার আস্তরণের মধ্যে বাইরে থেকে উঁকি মেরে দুজনে
অস্পষ্টভাবে দেখতে পেলেন-
একটি লোকের পিছন দিক থেকে অস্পষ্ট একটি ছায়া! লোকটির দেহ
সম্পূর্ণ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু আবছা ভাবে যা দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হল অতি প্রাচীন
এক পোশাক তার পরণে, যেন যাত্রাপালার কোন অভিজাত পৌরাণিক চরিত্র একই পোশাক পরে চলে এসেছেন
বাস্তব জীবনে! কুয়াশার মধ্যে মনে হল তার কাঁধে একটি তূণীর, যাতে অনেকগুলি শর রাখা!
লোকটি স্থির, কিন্তু তার দাঁড়াবার ভঙ্গীতে মনে হল পথ চলবার উদ্দেশ্যে এক পা বাড়িয়ে
হঠাৎ স্থির হয়ে গেলে দেহভঙ্গী যেরকম হয়ে যায়, এরও যেন সেই একই অবস্থা! যেন পথ চলতে
চলতে হঠাৎ কোন কারণে স্থির হয়ে গিয়েছে তার দেহ। কিন্তু কেন?
-“ওর কি গায়ে তীর লেগেছে?”
লুইসির এই হঠাৎ-প্রশ্নে ভালো করে তাকিয়ে দেখেন অগস্ত্য-
সত্যিই তো! লুইসির দৃষ্টিশক্তির প্রশংসা করতে হবে, এতটা দূর থেকে একচান্সে ঠিক দেখে
ফেলেছেন উনি- বাস্তবিকই মনে হল লোকটির কোমরের পিছন দিক দিয়ে একটি তীর এসে তাকে যেন
বিদ্ধ করেছে পাঁজরার নীচে! কিন্তু তীরবিদ্ধ অবস্থায় আহত, পৌরাণিক পোশাক পরা এই ব্যক্তিটি
চলতে চলতে এরকম বেয়াড়াভাবে থেমে গেলেন কেন? ভুঁরু কুঁচকে সামনেই তাকিয়ে থাকলেন অগস্ত্য;
গভীরভাবে একটা কিছু যেন চিন্তা করছেন তিনি।
-“হোয়াই ডাস হি স্টপ? লেম্মি সি-”
এই বলে এক পা এগিয়ে গিয়েছিলেন লুইসি, কিন্তু হঠাৎ পিছন
থেকে অগস্ত্য এক হ্যাঁচকা টানে তাকে সরিয়ে নিয়ে আসেন দরজার সামনে থেকে! অবাক হয়ে লুইসি
তাকিয়ে থাকেন তার দিকে।
-“দাঁড়ান!”
দরজার কোণায় একখণ্ড কাঠের টুকরো পড়ে ছিল; কোন কিছুর ভাঙা
টুকরো হবে বোধহয়। এখন সেটিকে তুলে নিয়ে লুইসির দিকে একবার তাকালেন অগস্ত্য, তারপর কাঠের
ছোট টুকরোটি সজোরে ছুঁড়ে মারলেন ঘরের ভিতরে থাকা লোকটির দিকে। আর তা করতেই-
দেখা গেল- দরজার ওপারে কুয়াশার বৃত্তের মধ্যে কাঠের টুকরোটি
প্রবেশের পর সেটি কিন্তু আর মাটিতে পড়ল না; একভাবে বাতাসেই স্থির হয়ে ভেসে রইল সেটি!
দৃশ্যটি এতটাই অপ্রত্যাশিত ও অদ্ভুত যে সেদিকে হাঁ করে তাকিয়ে থেকে নির্বাক হয়ে রইলেন
দুজনেই!
-“এ ক-কি ব্যাপার হল অগুস্টা?”- অবশেষে কোনমতে সামলিয়ে
উঠে বললেন লুইসি- “ঘরের ভিতর কি জিরো-গ্র্যাভিটি করে রাখা আছে না কি? কাঠের টুকরোটা
ভেসে রয়েছে কেমন করে? ভাগ্যিস আমাকে পিছন থেকে আটকালেন, নাহলে তো আমিও এতক্ষণে ভিতরে
আটকে-”
-“এটা মোটেও ‘জিরো-গ্র্যাভিটি’র ব্যাপার নয় লুইসি…খেয়াল
করে দেখুন, লোকটির পা কিন্তু মাটিতেই, মানে এখান থেকে দেখে যা মনে হচ্ছে…এ অন্য ব্যাপার!
আমার ধারণা-”
এই পর্যন্ত বলে চুপ করে গেলেন অগস্ত্য। বিষয়টা এতটই অবাস্তব
যে উপযুক্ত প্রমাণ না পেলে এই বিষয়ে মুখ খোলাই উচিৎ নয়। লুইসি তখনও বড় বড় চোখ মেলে
তাকিয়ে রয়েছেন ভেসে থাকা কাঠের টুকরোটির দিকে; এবার তাকে ডেকে দুজনে পায়ে পায়ে এসে
দাঁড়ালেন বাইরের বিরাট কক্ষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা সুবিশাল তোরণটির সামনে।
-“হে ভগবান!!”
বিষ্ময়োক্তি বেরিয়ে এল অগস্ত্যর মুখ দিয়ে, তোরণটির দিকে
তাকিয়ে। সেটিকে তিনি শুধু চিনতে পেরেছেন বলে নয়, তার বিষ্ময়ের কারণ অন্যত্র।
প্রায়ান্ধকার কক্ষটিতে দূর থেকে তোরণের মাথার কাছটা ভালো
করে খেয়াল করতে পারেন নি তিনি, এখন কাছে এসে তা লক্ষ্য করেই অগস্ত্যর বিষ্ময়োক্তি।
তোরণের মাথায় যে জিনিষটির স্থাপত্য দেখে অবাক হয়েছেন তিনি, তা বর্তমানে ভারত সরকার
স্বীকৃত চিহ্ন, যা সর্বত্র সরকারি কাজে ব্যবহার হয়!
-“ওটা কি…অশোকস্তম্ভ?”- থতমত হয়ে প্রশ্ন করলেন লুইসি;
উত্তরে দুবার ঘাড় নাড়লেন অগস্ত্য। তার মানে মার্তণ্ড জেলায় ভিন্ন একটি মন্দিরে ভিন্ন
পরিবেশে দাঁড়িয়ে তার বাবার অনুমান একেবারে নির্ভুল ছিল? এই গোটা কর্মকাণ্ডটির সঙ্গে
মৌর্যদের প্রত্যক্ষ যোগ রয়েছে? পাশে দাঁড় করানো নাতিউচ্চ গম্বুজের দিকে দৃষ্টি ঘোরাতেই
মাঝামাঝি অংশে একটি অবতল ফাঁক চোখে পড়ল তার।
-“আপনার চাবিটি ওতে লাগান তো!”
গম্ভীর গলায় লুইসিকে বলতেই নিজের কাছে রাখা কৃত্রিম ‘চোখ’টি
বের করে গম্বুজের অবতল অংশে সেটিকে বসালেন লুইসি, বসাতেই মাপে মাপে বসে গেল ওটি; আর
তা হতেই পরপর ঘটে গেল অদ্ভুত সব প্রক্রিয়া!
‘চোখ’টি জায়গায় বসতেই খুব সুন্দরভাবে আটকে গেল পাথরের
গায়ে; তারপর অদ্ভুত আলো ফুটে উঠল সেখানে। ইতিমধ্যে গোটা কক্ষ জুড়ে একটি ঘরঘর শব্দ প্রতিধ্বনিত
হতে লাগল, খটাং-খট ধরণের বিচিত্র শব্দ অনুররিত হতে লাগল গোটা কক্ষ জুড়ে, যেন কোথাও
মাপে মাপে কিছু একটা জুড়ে গেল পরষ্পরের সঙ্গে, তার সঙ্গে বিভিন্ন ধাতব, বিচিত্র সব
আওয়াজ, যেন সদ্য ঘুম ভেঙে কাজে লেগেছে একরাশ কলকব্জা! এইবার দেখা গেল, তোরণটির গা বেয়ে
বিভিন্ন আলোর বিচ্ছুরণ ঘটতে লাগল, আর তার সাথে সাথে তোরণের মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটি,
যা দিয়ে এতক্ষণ কক্ষের অপর প্রান্তটি দেখা যাচ্ছিল- তা ক্রমশঃ অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগল
একটি কাঁচের মত পর্দার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে। প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হতেই দেখা গেল-
তোরণটি একটি আয়নার চেহারা নিয়েছে, কিন্তু তাতে মুখোমুখি দাঁড়ানো অগস্ত্যর কোন প্রতিচ্ছবিই
নেই!
-“সময়-দর্পণ! তাহলে…এটি একটি পোর্টাল? কিন্তু এ দিয়ে কোন
বিশ্বে যাওয়া যাবে?”
কখন যে লুইসি পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন তা টেরই পান নি অগস্ত্য-
এতটাই নিবিষ্ট ছিলেন তিনি পুরো প্রক্রিয়াটি দেখতে। এখন লুইসির কথায় সম্বিৎ ফিরে এল
তার; লুইসিকে কিছু বলতে যাবেন তিনি, এমন সময়-
পর্দায় ধীরে ধীরে চলমান একটি দৃশ্য ফুটে উঠল; কাঁচের গায়ে
স্পষ্ট দেখা গেল- ওপারে দাঁড়িয়ে চাকচিক্যবিহীন সাধারণ পোশাক পরা একজন লোক! গভীর মনোনিবেশের
সঙ্গে তিনি তাকিয়ে রয়েছেন সিধা অগস্ত্যর দিকেই। তার পিঠে একটি সাধারণ ব্যাগ, চোখে চশমা,
আর…এখনও অবধি ঐ চশমাটির দুটি ডাঁটিই অবশ্য অক্ষত আছে!
-“বাবা!”
একটা প্রবল বিষ্ময় মেশানো আর্তনাদ বেরিয়ে এল অগস্ত্যর
গলা চিরে; তিনি এখনও বুঝে উঠতে পারছেন না এই আশ্চর্য সমাপতনের বিষয়টি; যে বাবাকে তিনি
অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখেছেন চোখের সামনে, তিনি এখন দাঁড়িয়ে তার সামনে, খুব বেশি হলে কয়েকহাত
দূরত্বে, কাঁচের পর্দার ওপারে! বোধবুদ্ধি হারিয়ে আরও বেশ কয়েকবার প্রবল জোর আর্তনাদ
করেই চললেন তিনি গলা ফাটিয়ে; বাবা কি শুনতে পাচ্ছেন না তার ডাক?
-“বাবা, বাবা, তুমি দেখতে পাচ্ছ, শুনতে পাচ্ছ আমাকে?”
একটানা এইভাবে বেশ কয়েকবার ডাকবার পর মনে হল যেন কাজ হল;
এইবারে মনে হল যেন বাবা শুনতে পেয়েছেন তার কথা, এতক্ষণে ডান হাতটা আস্তে করে তুললেন
তিনি; উত্তরে অগস্ত্যও তার ডানহাত একবার তুললেন। মনে হল, বাবা চমকে উঠলেন অপর প্রান্তে!
-“বাবা…বাবা…বাবা…”
হঠাৎ একটি কথা মনে পড়তে থমকে গেলেন অগস্ত্য; তার দৃষ্টি
চলে গেল সামনে দাঁড়ানো বাবাকে ছাপিয়ে পিছন দিকে, ঘরের প্রবেশদ্বারের দিকে। দেওয়ালের
কোণ থেকে একটা মুখ উঁকি মারছে না? হ্যাঁ ঐ তো, একটি বাচ্চার মুখ উঁকি মারছে দেওয়ালের
ঐপার থেকে, ঐ তো, দেওয়াল ছেড়ে এগিয়ে এল ছেলেটি-
ভয়ে মাথার চুল খাড়া হয়ে এল অগস্ত্যর; সাময়িককালের জন্য
থমকিয়ে গিয়েছিলেন তিনি নিজের বাল্য প্রতিরূপটিকে চোখের সামনে দেখে; এখন হঠাৎ আড়ষ্টভাব
কাটিয়ে সবেগে হাত-পা নাড়তে নাড়তে প্রবল জোর চিৎকার করে উঠলেন তিনি-
-“বাবা…মনু ঠিক তোমার পিছনে…ওকে সরাও, তুমিও সরে যাও!!”
বাবার কথায় মনে হল তিনি আবছাভাবে হলেও এখন শুনতে পাচ্ছেন
অগস্ত্যের কথা, একটি ক্ষীণ প্রশ্ন ভেসে এল অগস্ত্য ও লুইসি- দুজনের কানেই-
-“কি বলছ, কিছু শুনতে পাচ্ছি না…কি? সরা-ও – সরাও? কি
সরাব?”
আরও প্রবল হয়ে এল অগস্ত্যের হাত নাড়ানো; সর্বশক্তি দিয়ে
চেঁচিয়ে তিনি বলতে লাগলেন-
-“আমি মনু বলছি বাবা…তোমার আদরের মনু…সরে যাও এখান থেকে…মনুকে
নিয়ে…”
-“মহা…হনু…মনুকে…সরাও- মনুকে সরাব? কি বলছ তুমি আমার ছেলের
ব্যাপারে? আমার ছেলের নাম তুমি জানলে কি করে?”
তারপর পিছনে ঘুরেই নিজের বাচ্চা ছেলেকে দেখতে পেয়ে তিনি
বললেন-
-“মনুবাবা! তুমি এখানে? এখানে কি করছ?”
অগস্ত্যর আর চেঁচানোর ক্ষমতা নেই, উত্তেজনায় বাকরুদ্ধ
হয়ে এসেছে তার; কোনমতে হাতের ইশারায় তিনি বোঝাতে চাইলেন পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা মনুকে নিয়ে
তার বাবা যেন সরে যান দর্পণের সামনে থেকে; এইটা বোঝানোর জন্য দর্পণের আরও কাছে সরে
এলেন তিনি, এমন সময়-
উত্তেজনায় দর্পণের অনেকটা কাছে চলে গিয়েছিলেন অগস্ত্য,
এমন সময় তার বাঁহাত হঠাৎ যেন কাঁচ ফুঁড়ে চলে গেল অপর প্রান্তে; চমকে হাতখানি টেনে আনলেন
তিনি এপারে। তাকিয়ে দেখলেন- এই সীমিত সময়ের মধ্যেই তার হাতে জমে গিয়েছে বিন্দু বিন্দু
বরফের টুকরো! কিন্তু ঐদিন তো গর্ভগৃহের ভিতরটা এত ঠাণ্ডা ছিল না! এই দর্পণের সাহায্যে
তবে কি…সময়-সারণির অপর প্রান্তে যাওয়া যায়?
এরই মধ্যে পরপর ঘটে গেল হৃদয়বিদারক ঘটনাগুলি। সময়-দর্পণ ভেদ করে অপর প্রান্তে বেরিয়ে আসা যায় এটি উপলব্ধি করে অগস্ত্য ঢুকতে যান ওর ভিতরে, কিন্তু লুইসি জাপটে ধরেন তাকে পিছন থেকে। অপরদিকে অমঙ্গলের আশংকায় দর্পণের অপরপ্রান্তে দাঁড়ানো অগস্ত্যর বাবা হুমড়ি খেয়ে পড়েন ওপাশের গম্বুজের ওপর, টেনে বের করে আনেন ওদিকের চাবি, সেই কৃত্রিম ‘চোখ’; আর ঠিক এইসময়তেই লুইসি তাকে কোনক্রমে সরিয়ে আনেন দর্পণের সামনে থেকে; পরক্ষণেই দর্পণ থেকে একটি তীব্র আলোর ছটা একবার দেখা দিয়েই মিলিয়ে যায় অন্ধকারে! আস্তে আস্তে আবার স্বাভাবিক হয়ে আসে ঘরের আলো। একপাশে কেৎরে শুয়ে থেকে হাঁফাতে থাকেন দুজনেই।
-“ঐ বাচ্চাটি কি আপনি ছিলেন? এরকমটাই ঘটেছিল সেদিন?”
ঘরের পরিবেশ একটু স্বাভাবিক হতেই গা ঝেড়ে উঠে পড়েন লুইসি।
পাশে আধশোওয়া হয়ে অসহায়ের মত গোঙাচ্ছিলেন অগস্ত্য; তাকে ধরে সাবধানে পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে
তাকে ভালো করে আগে পর্যবেক্ষণ করে নিলেন তিনি- না, শরীরের কোথাও কোন ক্ষত নেই। এবারে
অগস্ত্যর মুখের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলেন লুইসি- তার দুটো চোখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে জলের
ধারা; বাচ্চা ছেলেদের মত কাঁদছেন অগস্ত্য!
বেশ কিছুটা সময় অগস্ত্যকে কাঁদতে দিলেন লুইসি; কাঁদলে
মন হালকা হয়ে যায়। একভাবে টানা কিছুক্ষণ কেঁদে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে ওঠেন অগস্ত্য,
এরপর নিজেই উঠে বসেন তিনি। লুইসি তাকে প্রশ্নটা করতে ধীরে ধীরে ঘাড় নাড়েন তিনি, তারপর
আস্তে আস্তে বলেন-
-“২৮শে জুন, ১৯৯৭। ঐ দিনটি আমার নবম জন্মদিন ছিল; অনাথ
হওয়ার পক্ষে নিতান্তই অল্প বয়স। কথা ছিল- ওখান থেকে বাবা আমাকে ঘুরতে নিয়ে যাবেন, কিন্তু
অজানাকে জানবার আগ্রহে জগৎ ভুলে গিয়েছিলেন কাজপাগল মানুষটি! সূর্যমন্দিরের গর্ভগৃহ
আবিষ্কারের পর উনি একাই এগিয়ে যান রহস্যভেদে, সীমাহীন ঝুঁকি মাথায় নিয়ে! আমি গিয়েছিলাম
বালকোচিত কৌতুহলে, ওনার অলক্ষ্যে-”
একটু চুপ করলেন অগস্ত্য, তারপর ধীরে ধীরে, কেটে কেটে বললেন-
-“দুদিক দিয়েই দেখলে- বাবার অন্তর্ধানের জন্য আমিই দায়ী!
আমার বাল্যরূপ তাঁর মনে আশংকা সৃষ্টি করেছিল, আমার যুবকরূপ তার মনে ভয়ের সৃষ্টি করে।
ফলস্বরূপ তিনি বাধ্য হন ওরকম আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে। তাঁর মনে হয়েছিল- ওদিককার চাবি
বের করে নিলে হয়তো দেবতাদের ‘সময়-সেতু’ বন্ধ হয়ে যাবে, ফলে অমঙ্গলের হাত থেকে নিজের
সন্তানকে বাঁচানোর জন্য উনি এমন কাজ করে-”
-“অগুস্টা! এর জন্য তুমি দায়ী নও!”
কথাটা বলে লুইসি জড়িয়ে ধরলেন অগস্ত্যকে; একটি শিশুর মত
প্রবোধ দিলেন তাকে। বেশ কিছুটা সময় পরে ধীরে ধীরে শান্ত হলেন অগস্ত্য। স্বাভাবিক হয়ে
বসলেন তিনি।
-“কিন্তু গোটা ব্যাপারটি কি দাঁড়াল অগস্ত্য? আমি তো কিছুই
বুঝতে পারলাম না…আপনি বুঝেছেন কিছু? এই পুরো ব্যাপারটা কি?”
লুইসির প্রশ্নে তার দিকে মুখ তুলে তাকালেন অগস্ত্য, তারপর
ঘাড় নেড়ে বলতে শুরু করলেন-
-“সময়-দর্পণ থেকে যে তীব্র আলোর ছটা বেরিয়ে আসে, সেদিকে
মুহুর্তের ভগ্নাংশের জন্য আমার চোখ পড়ে, ঐটুকু সময়ই যথেষ্ট ছিল আমার মস্তিষ্কে ওদের
‘ডাটা’ ভরতে। হ্যাঁ লুইসি, আমাকে সব জানানো হয়েছে এই বিস্তৃত কর্মকাণ্ড সম্পর্কে; কাজেই
যা জানতে পেরেছি তাই বলি বরং।
আজ থেকে লক্ষাধিক বছর আগে একদল উন্নত প্রাণী আসে আমাদের
গ্রহে তাদের উন্নত প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান নিয়ে। তাদের মূল আকর্ষণ ছিল আমাদের গ্রহের খনিজ
কাঁচামালগুলি, কিন্তু নিজেদের স্বল্পসংখ্যার কারণে ঠিকঠাক কাজ করতে তাদের সমস্যা হচ্ছিল;
অথবা হয়তো অন্যান্য প্রতিযোগী দলগুলির সঙ্গে ভাগের দখলদারি নিয়ে গণ্ডগোল হচ্ছিল- মোদ্দা
কথা, নিজেদের প্রয়োজনেই ওঁরা ঝুঁকে পড়ে উন্নত প্রাণ সৃষ্টিতে; অবশেষে ‘মানুষ’ নামক
একরকম উন্নত প্রাণ তৈরিতে সমর্থ হন ওঁরা। এই প্রাণীগুলি নিজেদের সম্পর্কে খুব একটা
বিস্তৃত বিবরণ খোলসা করেন নি; যেহেতু ওঁরা উন্নত প্রযুক্তিসমৃদ্ধ এবং এদের উৎপত্তি
মহাকাশে, তাই প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী আমি এদের ‘দেবতা’ বলব।
সময়ের সাথে সাথে দেবতারা এই গ্রহে তাঁদের পূর্ণ আধিপত্য
বিস্তার করেন, তার সাথে মানুষদেরও বিবর্তন হয়। ল্যাজওয়ালা লোমশ দ্বিপদ থেকে বুদ্ধিমান
প্রাণীতে রূপান্তরিত হয় মানবগোষ্ঠী; তেমনটাই, যেমনটা বরাবর চেয়ে এসেছেন তাঁরা।
পৃথিবীতে তাঁদের অন্যান্য শত্রুদের ওপর সম্পূর্ণ কর্তৃত্বের
পর দেবতারা একটি পরিকল্পনা করেন, অতীত-ভবিষ্যৎ ও বর্তমানকে একটি সূত্রে আবদ্ধ করতে
চান তাঁরা কতগুলি ‘টাইম-পোর্টাল’এর মাধ্যমে, যাতে ভবিষ্যতে ঘটতে যাওয়া যেকোন বিদ্রোহ
বা মহাজাগতিক অনুপ্রবেশ এঁরা ঠেকাতে পারেন, দরকারে অতীতে গিয়ে! গোটা সৌরমণ্ডলকে বেশ
কয়েকটি ‘সময়-অঞ্চল’-এ ভাগ করে নিয়ে বিভিন্ন সূত্র ধরে সময় ও স্থান অনুযায়ী সুড়ঙ্গ তৈরি
করে নিতে সক্ষম হন দেবতারা। কিভাবে এই সুড়ঙ্গ ওঁরা তৈরি করেন তা আর জিজ্ঞেস করবেন না,
উত্তর দেওয়ার মত প্রজ্ঞা আমার নেই, ওঁরাও এই বিদ্যা আমায় জানান নি। এখানে তো শুধু স্থান
নয়, ‘সময়’ ও ‘মাত্রা’র ব্যাপারটাও কিন্তু সমভাবে প্রযোজ্য।
ওঁদের প্রোজেক্টের কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার পর বাঁধে গণ্ডগোল।
এতদিন সুড়ঙ্গ তৈরির কাজ হচ্ছিল সমমাত্রায় ও সমতলে। উদাহরণস্বরূপ- আজ থেকে কুড়ি বছর
পরের বিশ্বে ওঁরা কিন্তু কয়েক সেকেণ্ডে পৌঁছে যান নি, কুড়ি বছর সময়ই লেগেছে তাঁদের
ভবিষ্যৎ চাক্ষুস করতে, যেমনভাবে আমরা মরণশীলরা ভবিষ্যৎ দেখি বর্তমান হয়ে! কোন শর্টকাট
নয়, অনেক দিন ধরে এবং অনেকটা সময় নিয়ে এই কাজ সম্পূর্ণ হয়, কারণ ‘সময় যাত্রা’-র প্রযুক্তিকে
আত্মস্থ করবার জন্যই তো তাঁদের এই হলাহল মন্থণ! এই নতুন প্রযুক্তির লক্ষ্যই তো তাই,
সময়ের ওপর দেবতাদের কর্তৃত্বসাধন; এর আগে ‘সময় যাত্রা’ তাঁরা করতে পারতেন না।
‘সময়-সুড়ঙ্গ’ নির্মাণের পর এবার ওঁদের আসল মোকাবিলার সম্মুখীন
হতে হল- একে সক্রিয় করা। লুইসি, এটি কোন সাধারণ সুড়ঙ্গপথ নয় যে আমি একদিকের দরজা খুলে
দিলাম, আপনি আরেকদিকের দরজা খুলে দিলেন, লোক-চলাচল শুরু- না। এখানে কিন্তু ‘সময়’ মাত্রাটা
যোগ হবে যা অতীব গুরুত্বপূর্ণ! এই কারণেই দরকার ছিল পরিকল্পনা, এবং তার সাথে গণনা।
বিস্তর অঙ্ক কষে দেবতারা কয়েকটি পয়েন্ট আবিষ্কার করলেন যে সময়গুলিতে একে সক্রিয় করলে
পৃথিবীর সবকটি সময়-সুড়ঙ্গ সঠিকভাবে কাজ করবে। দরকার ছিল এই পরিকল্পনাকে বাস্তবরূপ দেওয়া।
এর জন্য দরকার ছিল উপযুক্ত চরিত্র; সঠিক পাত্র-পাত্রী
ও ঘটনাক্রম চয়ন। এই কাজটা হয়েছিল দীর্ঘদিন ধরে। ওঁরা আমাকে যা জানিয়েছেন ততটুকুর ওপর
ভিত্তি করে বলি- অতীতযুগে কোন এক ভাগ্যাহত সৈনিক-পুরুষের হাত ধরে এই দীর্ঘযাত্রার সূচনা।
দৈব অস্ত্রের লোভ দেখিয়ে প্রথমে তাকে বিবশ করে ফেলা হল, তারপর তার মনোনীত কোন ব্যক্তিকে
কায়দা করে মন্দিরে নিয়ে এসে ‘সময় জাল’-এ আটকে ফেলা হল, তারপর ভবিষ্যতের গর্ভ থেকে উপযুক্ত
পাত্র চয়ন করে ঘুরপথে তাদের কাছে চাবিগুলি পৌঁছিয়ে দেওয়া-”
-“অগুস্টা, ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না, একটু ভালো করে বুঝিয়ে
বলুন!”
খানিকটা সময় নিলেন অগস্ত্য, কি বলবেন তা ভেবে নিতে। একটু
চুপ করে থেকে অবশেষে তিনি বললেন-
-“আমার অনুমান, এই মন্দিরটিই ওদের ‘সময়-সুড়ঙ্গ’-এর সদরকেন্দ্র।
এটিই সেই গুরুত্বপূর্ণ জাংশন যেখান থেকে বিশ্বব্যাপী সবকটি সুড়ঙ্গের সময়-প্রবাহ স্থির
থাকে। দেবতারা নিশ্চই কোন যন্ত্রের উদ্ভাবনা করেছেন যার সাহায্যে সময়কে এক জায়গায় সঞ্চয়
করে রাখা যায়, একটি দীর্ঘ সময়ের জন্য; যেমন আমরা ব্যাটারি ব্যবহার করি, উদাহরণটা যদিও
সঠিক নয়, তাও একটা টানলাম। এই প্রযুক্তি আমাদের চিন্তনের বাইরে। পাশের ঘরে প্রাচীন
পুরুষটি আর বাতাসে ভাসমান কাঠের খণ্ডটি মনে পড়ছে? ওগুলি আমাদের চোখে স্থির, কারণ ঐ
দুটি ক্ষেত্রেই তাদের আশেপাশের সময় অত্যন্ত ধীরগতিতে প্রবহমান! আমার খটকা লেগেছিল মানুষটির
দাঁড়ানোর ভঙ্গী দেখে; নিজে থেকে স্থির হয়ে দাঁড়ালে ওরকম ভঙ্গী হয় না! উনি হাঁটছিলেন
লুইসি, হাঁটতে হাঁটতে আচমকা ওনাকে স্থির করে দেওয়া হয়েছে; একটা ফিল্মে আমরা ‘পস্’ বাটন
মারলে যা হয়, তাই! আজকে আমরা ওনাকে এই কৌণিক অবস্থানে দেখছি, হয় তো দশবছর বাদে ঘুরে
এসে দেখব উনি এক পা এগিয়ে গিয়েছেন- এতটাই ধীর ঐ ঘরের সময়ের প্রবাহ!
এইবার একটা কথা বলুন তো, যদি আমরা ওনাকে এই জালে আটকা
পড়তে না দেখতাম, তাহলে বিষয়টি কি দাঁড়াত? আমরাও ঐ জালে আটকা পড়তাম, ‘সময়-সুড়ঙ্গ’ সক্রিয়
হত না, দেবতাদের একটি সামরিক পরিকল্পনা আরও কয়েকহাজার বছর পিছিয়ে যেত! বোঝা গেল, ঐ
প্রাচীন পুরুষটির প্রয়োজনীয়তা? উনি এক্ষেত্রে একটি বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ; অনেকটা ঐ সাইনবোর্ডের
মত, যার গায়ে লেখা থাকে- ‘এখানে প্রবেশ নিষেধ’!”
-“ঐ জন্যই প্রবেশপথে ওরকমভাবে লেখা- একমাত্র নির্বাচিতরাই
সময়-দর্পণ কক্ষে প্রবেশে সমর্থ!’ যারা এই পরিকল্পনার নির্বাচিত পাত্র-পাত্রী, একমাত্র
তারাই জীবিত অবস্থায় ‘সময়-দর্পণ’ কক্ষে প্রবেশ করতে পারবে…এক মিনিট! এর অর্থ এই জায়গাটিতে
কোন যান্ত্রিক মনিটর বসানো আছে? নাকি, সে কোন জীবিত ব্যক্তি?”- কক্ষের চারদিকে ভয়ে
ভয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন লুইসি।
-“হতে পারে। আর একটা কথা মাথায় এল। আমার ধারণা আমরা এখানে
ঢোকবার সময় যে ‘কুয়াসা’ দেখেছিলাম, তা প্রকৃতপক্ষে মনে হয় পঞ্জীভূত সময়ের বায়বীয় রূপ,
যা কুয়াশার মত আকার পরিগ্রহ করেছে…আর আমরা তার মধ্যে প্রবেশ করেছি-”
-“এর মানে-???”
বাকিটা আর বলতে পারলেন না লুইসি, গলা আটকে গেল তার। স্থিরদৃষ্টিতে
তিনি তাকিয়ে রইলেন অগস্ত্যর দিকে। অগস্ত্যও কিছুক্ষণ একভাবে তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে
উত্তর দিলেন-
-“মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকুন লুইসি…আমরা যদি এখান থেকে
বাইরে যেতেও পারি, তাও আমরা কোন এক অজানা ভবিষ্যত পৃথিবীতে গিয়ে পড়ব-”
আর কিছু বলতে পারলেন না লুইসি, ধপাস করে বসে পড়লেন মেঝেতে।
খানিকক্ষণ সমবেদনার দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন অগস্ত্য; তারপর গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ে
বললেন-
-“চলুন, পাশের ঘরে যাওয়া যাক, লোকটির অবস্থা দেখে আসি-”
-“কিন্তু…”
-“কোন ‘কিন্তু’ নয় লুইসি; এই মন্দিরপ্রাঙ্গণে যতক্ষণ বসে
থাকবেন তত বেশি সময় ব্যয় হবে নীচের পৃথিবীতে; আমি চাই আমাদের সমসাময়িক চরিত্রগুলি থাকতে
থাকতে বাইরে বেরোতে, যাতে কেউ অন্তত আমাদের চিনতে পারে। এখানে বসে থাকলে সুরাহা হবে
না। আসুন!”
পাশের ছোট ঘরে তিনটি অদ্ভুত বিষয় চোখে পড়ল দুজনের।
প্রথমত- গাঢ় কুয়াশার মত যে আস্তরণটি ছিল তা প্রায় কেটে
গিয়েছে। দ্বিতীয়ত- কাঠের খণ্ড ও প্রাচীন পুরুষটি- দুজনেই মেঝেতে ভূপতিত! আর তৃতীয়ত-
ঘরটির শেষপ্রান্তে একটি বিরাট উঁচু কফিনের মত কোন আধার লম্বালম্বিভাবে দাঁড় করানো,
যাতে অনেকগুলি নল জোড়া। এই নলগুলির উৎপত্তি আবার একটি কন্ট্রোল প্যানেল থেকে। কফিনের
ভিতরটিও অনুরূপ সাদা কুয়াশার চাদরে সম্পূর্ণ আবৃত!
বাইরে থেকে একনজরে ঘরের পরিবেশ দেখলেন অগস্ত্য ও লুইসি
দুইজনেই। এরপর তাদের দৃষ্টি ঘুরে গেল মেঝেতে পড়ে থাকা লোকটির দিকে। তিনি এখনও যে জীবিত
তা তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসা কাতরানির আওয়াজে পরিষ্কার। তার পাশে পড়ে একটি ধনুক, আর
তার কোমরে দীর্ঘ তলোয়ার।
-“ভিতরে ঢুকবেন নাকি?”- জিজ্ঞেস করলেন লুইসি।
-“একদমই না! ভিতরে কি গণ্ডগোল আছে তা জানি না।”- ফিসফিসিয়ে
উত্তর দিলেন অগস্ত্য।
লোকটির মুখ ছিল নীচের দিকে, এখন পাশ ফিরে উপরের দিকে মুখ
তুলে শ্বাস নিলেন তিনি বেশ কিছুক্ষণ। এরপর দরজার দিকে তার দৃষ্টি ঘুরতেই দুজন অপরিচিত
তরুণ-তরুণীকে দ্বারপ্রান্ত থেকে উঁকি মারতে দেখে চমকে উঠে ধনুকটা বাগিয়ে ধরে একলাফে
উঠে দাঁড়াতে গেলেন তিনি, কিন্তু পারলেন না। দূর্বল পায়ে উঠে দাঁড়ানোর সামর্থ্য নেই,
দূর্বল হাতে ধনুক বা তলোয়ার- কোনটাই আর তুলবার ক্ষমতা নেই তার! অসহায়ের মত একবার তাকিয়ে
দেখলেন তিনি নিজের শরবিদ্ধ ক্ষতস্থানটির দিকে, তারপর ঘৃণাভরে ফিরে দেখলেন তাদের দিকে।
কোমরের পিছন দিক থেকে তার হাতে উঠে এল একটি নাতিদীর্ঘ ছুরি, তারপর কোনমতে বুকে ঘষটে
ঘষটে তিনি এগিয়ে এলেন অগস্ত্যদের দিকে। আঘাত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তিনি!
অগস্ত্য আর লুইসি মুখ চাওয়াচায়ি করে নিলেন এই অদ্ভুত আক্রোশ
দেখে, তারপর দরজার সামনে থেকে পায়ে পায়ে পিছিয়ে এলেন বেশ কয়েক পা। লোকটি অবশ্য হতোদ্যম
হলেন না; নতুন উদ্যমে তিনিও বুক ঘষে এগিয়েই আসতে থাকলেন! এইভাবে ছোট ঘরটির দরজা অতিক্রম
করে বাইরের প্রশস্ত কক্ষটিতে আসতেই আর দেরি করলেন না অগস্ত্যরা; দুজনে দুদিক থেকে গিয়ে
কায়দা করে লোকটির হাত থেকে ছুরিটি বের করে নিতে সমর্থ হলেন শেষকতক। দূর্বল, অশক্ত শরীরে
অতিরিক্ত ধকল আর নিতে পারেন নি লোকটি; ক্ষান্ত হয়ে মেঝেতে শুয়ে তিনি জোরে জোরে শ্বাস
নিতে লাগলেন। ছুরিটি পরীক্ষা করে প্যান্টের পিছনে রেখে এবার তার শুশ্রুষা করবার জন্য
এগিয়ে গেলেন অগস্ত্য, সাথে লুইসি।
লোকটি ভেবেছিলেন তার মৃত্যু বোধহয় আসন্ন; কিন্তু এখন এই
অপরিচিত তরুণ-তরুণীকে তার সেবা করতে দেখে ধীরে ধীরে শংকা কেটে গেল তার মন থেকে। অশক্ত,
আধ-জড়ানো, ভাঙা কন্ঠে দেবনাগরী ভাষ্যে তিনি জিজ্ঞেস করলেন-
-“কস্তম? কা তৌ যবনৌ?”
‘যবন’? দ্বাদশ শতকের গ্রন্থগুলিতে বিদেশি হানাদার হিসেবে
মুসলমানদের ‘যবন’ বলে অভিহিত করা হয়েছে, তবে কি ইনি ঐ সময়কালীন মানুষ? ওনার পা ডলে
দিচ্ছিলেন অগস্ত্য; একটু থমকে গেলেন তিনি কথাটা শুনে। সংস্কৃত ভাষায় যথেষ্ট দখল ছিল
তার, ঐ ভাষার ওপরে তার জন্মগত দক্ষতা, সংস্কৃত ভাষ্যে তিনি বললেন-
-“আপনি কোথায় থাকতেন? এই পাহাড়ের ভিতর মন্দিরে কিভাবে
এলেন?”
এতক্ষণে যেন অবসর পেলেন মানুষটি; তার আশপাশে ভালো করে
তাকালেন, দেখে নিলেন সবকিছু, তারপর অনেকক্ষণ হতবাক মুখে কি যেন ভাবলেন, যেন মনে করতে
চেষ্টা করলেন পূর্বের ঘটনা! শেষে খুব আস্তে আস্তে, ক্ষীণস্বরে তিনি বললেন-
-“আমি…আমার নাম…সৌভদ্র। আমি রাজ-অমাত্য…মহারাজ চন্দ্রগুপ্ত
মৌর্য আমাদের নরেশ…তার নির্দেশে কিছু একটি বস্তু রাখতে এখানে আসা…পথে যবন-আক্রমণ…নৃপতি
অলোকসুন্দরের সেনাপতি…শরপ্রহার…”
হাঁ হয়ে মধ্যবয়ষ্ক, প্রৌঢ় লোকটির দিকে তাকিয়ে রইলেন অগস্ত্য;
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য…অলোকসুন্দর…এদের সমসাময়িক এই সামরিক পুরুষটি? এর অর্থ দাঁড়ায়- এই
ব্যক্তি এখানে আটকা পড়েছিলেন আড়াই হাজার বছরেরও বেশি সময়!
পাশে বসে থাকা লুইসি দেবনাগরী বোধহয় জানেন না, নাহলে নিশ্চিতভাবেই
ভেঙে পড়তেন তিনি। অগস্ত্যও আর কিছু ভাঙলেন না তার সামনে; কোনমতে ঢোঁক গিলে এর পরের
প্রশ্নটি করলেন তিনি সৌভদ্রকে-
-“তোরণের মধ্যে থাকা ঐ চিহ্নগুলি- পদ্মের ওপর চারটি সিংহের
মুখ বসানো ঐ ভাষ্কর্য- ওটি কার কীর্তি? আপনার?”
-“না! কিন্তু…এ তো স্বয়ং মহারাজের নিজস্ব সৃষ্টি; সাম-দান-দণ্ড-ভেদ
– এই চারটি নীতি সবিস্তারে লেখা হয়েছিল যে তালপত্রে তাতে মহারাজ স্বয়ং চিত্রিত করেছেন
এটি, এর অর্থ চতুর্দিশায় মহারাজের সিংহ-শাসন…কিন্তু এর স্থাপত্যরূপ এখানে কি করছে?”
-“এটি মহারাজ চন্দ্রগুপ্তের সৃষ্টি? আপনি নিশ্চিত?”- দ্ধিধাজড়িত
কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন অগস্ত্য। প্রত্যুত্তরে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন সৌভদ্র।
অবিশ্বাসী, হতবাক চোখে সৌভদ্রের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন
অগস্ত্য; তারপর সমবেদনার সুরে বললেন-
-“আপনি আপনার সময় থেকে অনেকটা এগিয়ে এসেছেন সৌভদ্র; সত্যিটা
অত্যন্ত বেশিমাত্রায় কড়া! আপনি বরং বিশ্রাম নিন-”
-“‘অনেকটা সময়’? কোথায়? আমি তো সদ্য সদ্য মন্দিরে প্রবেশ
করে অন্ধকার গলিপথ অতিক্রম করে মূল কক্ষে এলাম; তারপর এক ছায়ামূর্তি আমায় পথ দেখিয়ে
পাশের একটি ছোট কক্ষে নিয়ে এলেন, কিছু কথা হল, ব্যাস!”
-“ছায়ামূর্তি?”
আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন সৌভদ্র; এমন সময় বাধা পড়ল তাদের
কথায়। গোটা পাহাড়টি প্রথমে যেন দুলে উঠল আচমকা, তারপর থরথর করে কাঁপতে লাগল সেটি; যেন
কিছু একটায় সজোরে ঘেঁটি ধরে নাড়াচ্ছে আস্ত পাহাড়টিকে!
-“এ কি ব্যাপার?”- সভয়ে উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন অগস্ত্য;
লুইসিও উঠে দাঁড়িয়েছেন তার সাথে সাথে- “গোটা পাহাড়টি এভাবে কাঁপছে কেন?”
-“দেবতারা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন; তোমরাও আর দেরি কোর
না, বেরিয়ে পড় এক্ষুণি-”- ক্ষীণস্বরে বলে উঠলেন সৌভদ্র- “ঐ দেখ, পূর্বদিকের একটি দরজা
খুলে গিয়েছে…তোমরা চলে যাও-”
কক্ষটির একদিকে বাস্তবিকই একটি ছোট দরজা খুলে গিয়েছে দেখা
গেল; সেদিকে দেখে এবার সৌভদ্রের দিকে তাকালেন অগস্ত্য-
-“আপনি চলতে পারবেন না, কোন ভয় নেই, আমরা আপনাকে বহন করে
নিয়ে যাব…আসুন-”
-“না!”
সৌভদ্রকে চ্যাঙদোলা করে দুদিক দিয়ে তুলতে যাচ্ছিলেন দুজনে,
কিন্তু প্রবলভাবে বাধাদান দিলেন সৌভদ্র স্বয়ং! বললেন-
-“আমার ওপর দেবতাদের নির্দেশ রয়েছে তাঁদের সঙ্গদান করবার!
আমি আপনাদের সঙ্গে আসতে পারব না…আপনারা বরং আসুন!”
এইবারে অত্যন্ত অসহায় বোধ করলেন অগস্ত্য; তার মনোগত সদিচ্ছা
ছিল না সৌভদ্রকে পিছনে ফেলে রেখে যেতে; এনার পাদুটি শুকিয়ে এসেছে, ঐ পা নিয়ে আর কোনদিনই
উঠে দাঁড়াতে পারবেন না তিনি। অগস্ত্যরা সাহায্য না করলে এমন কি নিজে থেকে উঠে বসবার
সামর্থ্যটুকু পর্যন্ত নেই প্রাচীন ভারতের একমাত্র প্রতিভূ জীবিত এই ব্যক্তিটির! এনাকে
পিছনে ফেলে রেখে যেতে মন সায় দিচ্ছিল না তার। কিন্তু-
-“দেবতারা আমার দায়িত্ব নিয়েছেন, আপনাদের শঙ্কার কোন কারণ
নেই! আপনারা চলে যান, থাকবেন না এখানে! ঐ দেখুন-”
একটি বড় পাথরের চাঙর খসে পড়ল পাহাড়ের ছাদ থেকে; মেঝেতে
পড়ে সশব্দে ভেঙে গেল সেটি! করুণভাবে একে অপরের দিকে তাকালেন অগস্ত্য ও লুইসি; তারপর
দুজনেই ফিরে তাকালেন সৌভদ্রের দিকে। তাদের একত্রে ফিরে তাকাতে দেখে আবার কিছু একটা
বলতে যাচ্ছিলেন তিনি, এমন সময়-
আচমকা ভয়ার্ত একটি চিৎকার করে অগস্ত্যর পিছনে এসে সভয়ে
আত্মগোপন করলেন লুইসি; অগস্ত্যর মুখ ফেরানো ছিল তার দিকে; কি হয়েছে দেখার জন্য পিছনে
মুখ ঘোরাতেই-
মাথা ঘুরে গেল অগস্ত্যর! কে ইনি? ইনি তো সেই স্বপ্নে দেখা
পুরুষটি! ইনিই তো অতীতে বারংবার ফেরৎ আসতেন তার স্বপ্নে, একেই তো তিনি দেখেছিলেন খানিকক্ষণ
আগেও আজ সকালের স্বপ্নে, গুহায় প্রবেশের আগে অবশ্যই, আজ সকালবেলা! সেই এক চেহারা, সেই
এক দাঁড়াবার ভঙ্গী- বাঁ হাত তুলে বিশেষ একটি কোণে নির্দেশ করছেন তিনি! তবে নিশ্চিতভাবেই
তিনি আর তোরণকে নির্দেশ করছে না; তার হাত ইঙ্গিত করছে তোরণের ঠিক পিছনেই, উম্মুক্ত
হওয়া বহির্দ্বারের দিকে!
-“চলে আসুন-”
লুইসিকে টেনে নিয়ে বহির্বারের দিকে ছুটে চললেন অগস্ত্য।
-“কিন্তু উনি?”- সৌভদ্রের কথা বলতে চাইলেন বোধহয় লুইসি;
ততক্ষণে দরজার কাছে পৌঁছে গিয়েছেন তারা; একথায় দুজনেই একত্রে পিছনে তাকিয়ে দেখলেন-
ততক্ষণে পড়ে থাকা সৌভদ্রের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন বিরাট, দীর্ঘদেহী সেই পুরুষটি। সমবেতভাবে
দুজনেই এখন তাকিয়ে রয়েছেন তাদের দিকে।
-“উনি ওঁনার সময় থেকে অনেকটাই আগে এগিয়ে এসেছেন, লুইসি।
এই কারণেই হয়তো দেবতারা আশ্রয় দিয়েছেন ওঁকে! কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে এখনও হয়তো আশা
আছে, তাই আর দেরি নয়, চলুন এখান থেকে বেরোন যাক।”
বহির্দ্বার দিয়ে বাইরে বেরিয়েই আলোকিত একটি প্যাসেজ দেখা
গেল, একবার ডানদিকে ঘুরে অনেকটা সোজা চলে গিয়ে তারপর আবার বাঁ দিকে ঘুরে গিয়েছে সেটি,
মধ্যিখানে আবার একটু সরু চ্যানেল দিয়ে বয়ে চলেছে জলের অবিরাম স্রোত। গোটা পাহাড়ের দুলুনিতে
মাটিতে পা রাখাই দায়, তার মধ্যে আবার বড় বড় পাথরের টুকরো খসে খসে পড়ছে যত্রতত্র! এরই
মধ্যে কোনক্রমে সামনের দিকে চলে অবশেষে দ্বিতীয় গুহামুখটি ধরে বাইরে বেরিয়ে এলেন দুজনে।
তারপর একপ্রকার দৌড়ে ঢালুপথ বেয়ে নেমে পাথরের সারি অতিক্রম করে নদীর ওপাড়ে চলে এলেন
তারা। অসম্ভব শ্রান্তি হয়েছিল এই গোটা পথটি পার করতে, এখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তারা হাঁফাতে
লাগলেন দুজনেই।
-“ঐ দেখুন অগুস্টা!”
ঢোকবার সময়তেই অগস্ত্যরা খেয়াল করেছিলেন- পাহাড়ের মাথাটি
যেন অদ্ভুত, ঘন্টার মত আকৃতিবিশিষ্ট! এখন দেখা গেল, প্রচুর আলো আর ধোঁয়ার সঙ্গে সেই
ঘন্টাটি যেন ধীরে ধীরে ঠেলে উঠছে ওপরে; একটুখানি উঠেই সেই বিশাল আকারের ঘন্টা যেন এক
মুহুর্ত্তের জন্য থেমে গেল; পরক্ষণেই তীব্রগতিতে উপরে উঠে আলোকবিন্দু হয়ে মিলিয়ে গেল
উর্দ্ধাকাশে! ফাঁকা আকাশের নীচে এখন শুধু অগস্ত্য, লুইসি, আর নদীর অপর পাড়ে সেই পাহাড়,
যার মাথাটা এখন সমতল ক্ষেত্র মাত্র; হঠাৎ দেখলে মনে হবে যেন পাহাড়ের মাথাটা কেটে নিয়েছে
কেউ!
-“এখন তাহলে আমাদের কি করণীয়, অগুস্টা?”
লুইসির প্রশ্নে একবার ক্ষীণভাবে মাথা নেড়ে অদূরে একটি
বড় পাথরের ওপর বসলেন অগস্ত্য; ক্লান্ত হয়ে গিয়েছেন তিনি, ভবিষ্যতের প্রশ্নে। তাছাড়া…বাবাকে
তিনি ফেরৎ আনতে ব্যর্থ; এই চিন্তাটাই বোধহয় কুরে কুরে খাচ্ছিল তাকে। যা লেখা থাকে সময়-সারণিতে,
তা পরিবর্তন করা যায় না! মাথা নত করে বসে রইলেন তিনি, মুখে আর কোন শব্দ করলেন না। পায়ে
পায়ে তার দিকে এগিয়ে এলেন লুইসি।
-“আমি একটা কথা বলব?”
মাথা তুলে লুইসির দিকে তাকালেন অগস্ত্য।
-“আপনি মিঃ ভার্গবকে একটা ফোন করুন, এক্ষুণি!”
-“বেশ! কিন্তু আমরা যদি ভার্গবকাকার সময় থেকে অনেকটা এগিয়ে
এসে থাকি?”
-“সেক্ষেত্রে আমরা একসাথে আমাদের ভাগ্যর সঙ্গে লড়াই করব
অগুস্টা! কিন্তু…ঈশ্বরের দিব্যি, আপনি একবার ফোনটা করে দেখুন!”
বিষয়টা দ্বিতীয়বার ভেবে নিয়ে পকেট থেকে মোবাইল বের করে
সেটিকে সক্রিয় করলেন অগস্ত্য; উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন মনে মনে- লাইন সক্রিয় থাকবে তো? কল
সম্পূর্ণরূপে কানেকশন হবে তো? সর্বোপরি- ভার্গবকাকাই ধরবেন তো তাদের কল? মনে মনে ঈশ্বরকে
ডাকতে লাগলেন অগস্ত্য; উত্তেজনায় বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল তার!
কল সম্পূর্ণ হয়েছে- অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করতে লাগলেন
দুজনে-
কিমাশ্চর্যম, রিং হচ্ছে! উত্তেজনায় হাত কাঁপতে লাগল অগস্ত্যের!!
-“হ্যালো, ভার্গবকাকা-?”
[৭৪ খৃীষ্টাব্দ; অধুনা ভারতবর্ষের পশ্চিম দিক]
অদূরেই বনভূমির সীমানা; ঠিক তার আগেই ভূমি উঁচু হয়ে একটি
ঢিবির আকার নিয়েছে; ঐ তো সামনে সেই সুবিশাল বটগাছ, যা প্রায় ঝুঁকে পড়েছে ঢিবির ওপর।
এটাই তো সেই জায়গা, স্বপ্নে যেখানে তাকে বারংবার আসতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল! সবকিছুই
তো হুবহু মিলে যাচ্ছে!
ঘোড়ার পিঠে বসে অবাক হয়ে সে কথাই ভাবছিলেন বলিষ্ঠ যুবক,
সামনের দৃশ্যের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে! এতটা সাদৃশ্য কি সত্যিই বাস্তব জগতে সম্ভব? সাতপাঁচ
ভেবে ঢিবির দিকে ঘোড়া চালিয়ে দিলেন তিনি, এখানেই আসতে বলা হয়েছিল তাকে। দেখাই যাক না,
ভাগ্যে কি রয়েছে।
ঢিবির ওপরটা কিন্তু নির্জন নয়; একজন পাগলাটে চেহারার খর্ব
আকৃতির মানুষ বসে রয়েছেন সেখানে। তার চুল উষ্কোখুষ্কো, কিন্তু মুখ একদম পরিষ্কার, দাঁড়ি-গোঁফবিহীন,
পরিধেয় বস্ত্রটি ফর্দাফাঁই; জায়গায় জায়গায় ছিঁড়ে রয়েছে সেগুলি। লোকটির পরিধেয়র দিকে
একবার ভালো করে তাকালেন যুবক; গ্রামবাসীরা ঠিক কথাই বলেছিল বটে, এরকম অদ্ভুত চাপা,
আঁটোসাঁটো পরিধেয় জীবনে কোনদিন দেখেন নি তারা! এখানে আসবার আগে জায়গাটি, এবং এখানকার
নতুন অধিবাসী সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েই এসেছিলেন তিনি।
এই অচেনা আগন্তুককে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে নিয়ে ঘোড়া
থেকে নেমে সোজা তার দিকে এগিয়ে এলেন যুবক। অপরদিকে যুবককে এগিয়ে আসতে দেখে স্থির হয়ে
বসলেন আগন্তুক।
-“আমি…স্বপ্নাদেশ পেয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি; আমি-”
-“মহারাজ ভীম কদফেসিসের পুত্র আপনি?”
শুকনো ঠোঁটদুটিকে জিভ দিয়ে একবার চেটে নিলেন যুবক। তারপর
আলতো করে একবার ঘাড় নাড়লেন তিনি। এবারে নড়েচড়ে বসলেন আগন্তুক।
-“দেবতাদের আদেশে আপনাদের যুদ্ধপ্রচেষ্টায় ক্ষীণ সহযোগিতা
করতেই আমার আগমন, তবে সশরীরে যুদ্ধের জন্য নয়! আপনার জন্য কিছু শক্তিশালী অস্ত্র এবং
একটি লিপি পাঠিয়েছেন দেবতারা, আমার হাত দিয়ে। আপনি তা গ্রহণ করতে সম্মত তো?”
হাতজোড় করে দুবার ঘাড় নাড়ালেন যুবক।
-“এই যে-”
কোমরের পাশ থেকে একটি ধাতব ‘চোখ’ যুবকের হাতে তুলে দিলেন
যুবক। হাতে নিয়ে সেটিকে উল্টেপাল্টে দেখলেন তিনি; অনেকটা মানুষের ডান চোখের মত দেখতে
এই পাতটি; হাতের তেলোর তেকে সামান্য ছোট, এবং অসম্ভব লঘু ওজনের! বস্তুটিকে ভালো করে
দেখে নিয়ে এবার আগন্তুকের দিকে তাকালেন যুবক।
-“আরও দু-একটি বস্তু দেবতারা আমায় দিয়েছেন আপনাকে সোপর্দ
করবার জন্য; সেগুলি আর এইটির প্রয়োগবিধি আপনাকে শিখিয়ে দিয়ে আমার মুক্তি। এগুলির সাহায্যে
ইতিহাস আপনাকে আশ্চর্য শক্তিসম্পণ্ণ এক রাজা হিসেবে মনে রাখবে, রাজকুমার কণিষ্ক!”
একটি অদ্ভুত হাসি হাসলেন আগন্তুক; এইবার তার মুখের দিকে
নজর গেল যুবকের। ঐ আগন্তুকের ওপরের পাটির দুটি দাঁত নেই!
-“আপনি কে, প্রভু?”
এই প্রশ্নে বিষাদগ্রস্ত হয়ে উঠলেন আগন্তুক; কি ভাবতে গিয়ে
আনমনা হয়ে উঠলেন তিনি। তারপর ‘কণিষ্ক’ নামের যুবকটির দিকে তাকিয়ে চোখে চোখ রেখে স্থির
গলায় তিনি বললেন-
-“এমন কেউ, যার বিচরণ সময়রেখার ঐপাড়ে, রাজকুমার! আসুন,
আপনাকে বরং এক এক করে এদের প্রয়োগবিধি শেখাই-”
হাতজোড় করে আগন্তুকের সামনে বসে রইলেন যুবক। দূরে, আকাশের
কোল ঘেঁষে একটি বাজপাখি উড়ে গেল তাদের মাথার ওপর দিয়ে…
সমাপ্ত
©অরিত্র দাস
Important Links:
আপডেটেড থাকুন আমার প্রোফাইলের সাথে
আপনি আমাদের ইউটিউব চ্যানেলও দেখতে পারেন
আপনি আমাকে টুইট করতে পারেন
প্রতিলিপি-তে আমার প্রোফাইল চেক করতে পারেন এখানে
আমাকে আপনি দেখতে পারেন গুগল প্লে স্টোর-এ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আমাদের ব্লগগুলি আপনাদের কেমন লাগছে? অবশ্যই জানান আমাদের-