[লেহ জেলা, লাদাখ, চুচোট-আইয়োকমা গ্রাম থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরে
- ২৮শে জুন ২০১৬]
-“গতকাল এখানে পা রেখে আগেই সব দরকারি ও সরকারি বিধিগুলি
এগিয়ে রেখেছিলাম, এইজন্যই তো আজকে সব এত তাড়াতাড়ি হয়ে গেল। এখন গন্তব্যে পৌঁছতে বেশি
সময় লাগবে না।”
গাড়ির ঝাঁকুনিতে পথ চলতে চলতে বললেন অগস্ত্য, সামনের সিটে
বসা লুইসি ও জোয়ানাকে উদ্দেশ করে। দুজনেই স্মিত হাস্যে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন সে
কথায়।
-“আমরা এখন তাহলে কোথায় যাচ্ছি অগুস্টা?”- উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা
করলেন লুইসি।
-“আপনাদের কথাবার্তায় বেশ কয়েকবার ‘কলস’ জনজাতির বসতির
কাছে ‘তিন বোন’-এর উপস্থিতির প্রসঙ্গ উঠে এসেছে; এখান থেকেই মোটামুটি আঁচ করতে পেরেছি
ব্যাপারটা। ভার্গবকাকা যেহেতু ‘কলস’দের আদি বসতিটি চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছেন, তাই
এখন আমাদের খুঁজে বের করতে হবে ঐ অঞ্চলের নিকটবর্ত্তী পাশাপাশি তিনটি জলপ্রপাত-”
-“জলপ্রপাত?” – বিষ্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন জোয়ানা। ইনি
একজন নির্বাক শ্রোতা, বেশিরভাগ সময়তেই চুপচাপ থাকতে পছন্দ করেন; এখন তিনি ছুঁড়ে দিলেন
প্রশ্নটি।
-“এখানকার স্থানীয় মানুষজন জলপ্রপাতগুলিকে ‘রমণী’ হিসেবে
দেখেন, আর এই ধারণা বহুযুগ ধরে বংশ-পরম্পরায় চলে আসছে। হয়তো প্রাচীনকালেও এই ধারণাটি
ছিল। গতকাল আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম এই অঞ্চলে কোথাও পাশাপাশি তিনটি জলপ্রপাত আছে কি
না; এখানকার আর্মির লোকজন অঞ্চলটিকে হাতের তালুর মত চেনেন। একজন প্রবীণ জওয়ান আমায়
বললেন যে ‘চুচোট আইয়োকমা’ গ্রামটির পঞ্চাশ কিলোমিটার দায়রার মধ্যে পাশাপাশি এরকম তিনটি
জলপ্রপাত পড়ে; উনি একটি ম্যাপও এঁকে দিয়েছেন আমায়। এই দেখুন, এই জায়গাটির নাম ‘রাবসাং’,
এখানেই পাশাপাশি তিনটি জলপ্রপাত আছে কয়েক কিলোমিটারের দূরত্বে। আমরা এখন এখানেই যাচ্ছি।”
-“ও! তা যেতে কতক্ষণ লাগতে পারে অগুস্টা?”- জিজ্ঞেস করলেন
লুইসি।
-“কোন ঠিক নেই! পাহাড়ি পথে ঘড়ি ধরে কোনকিছু বলা সম্ভব
নয়। একঘন্টাতেও চলে যেতে পারি, তিন ঘন্টাও লাগতে পারে, আবার ওর অনেক আগে আমাদের ফেরতও
চলে আসতে হতে পারে! সবকিছুই নির্ভর করছে রাস্তার ওপর। তবে এখন তো সদ্য বর্ষাকালের শুরু,
রাস্তাঘাট এখনও খুব খারাপ থাকবার কথা নয়। দেখা যাক!”
লুইসির দিকে একটু সমীহের চোখে তাকালেন অগস্ত্য। ফরাসি
এই মহিলাটিকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখেন তিনি। প্রথমদিন ভার্গবকাকা যখন তাকে ডেকে
এই দুই মহিলার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন এবং তাদের আসার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করেন, একটু অবাকই
হয়ে যান অগস্ত্য। সম্পূর্ণ অজানা একটি দেশে অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় দুটি অল্পবয়ষ্কা তরুণী?
তারপর সময় যত এগিয়েছে, বিষ্ময়ের পারদ চড়েছে ততখানিই। নিছক গালভরা ‘উইমেন্স লিবার্টি’র
কথা বলে আত্মপ্রসাদ অনুভব করা ‘গলুই-আহ্লাদি’ আধুনিকা নন, এই মহিলারা সত্যিই দুঃসাহসের
জীবন্ত প্রতীক!
ভার্গবকাকা অবশ্য আরও একটি কথা বলেছেন তাদের আড়ালে ডেকে-
তার জীবনের যে বৃহত্তর প্রশ্নের মুখে তিনি দৌড়ে বেরিয়েছেন আজীবন, তার উত্তর এই দুইজনের
কাছে থাকতে পারে; রহস্যটা অবশ্য এর থেকে বেশি ভেঙে বলেন নি তিনি। কি বোঝাতে চেয়েছেন
ভার্গবকাকা সেদিন?
অগস্ত্যকে একভাবে তাদের দিকে চেয়ে থাকতে দেখে জোয়ানা হেসে
লুইসির কানে কানে কিসব বললেন, তাতে লুইসিও প্রথমে হেসে উঠলেন একচোট, তারপর হাসতে হাসতেই
বললেন-
-“কি ব্যাপার অগুস্টা, আপনি কি কিছু হারিয়ে ফেলেছেন আমাদের
কাছে?”
প্রশ্নটির মর্মার্থ বুঝে একটু লজ্জা পেয়ে গেলেন অগস্ত্য;
পাশের সীটে বসা আর্মি অফিসারের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, তিনিও তখন হাসি চাপতে ব্যস্ত একদিকে
মুখ ফিরিয়ে! প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে উঠে অবশেষে তিনি বললেন-
-“পাহাড় আর জঙ্গলের ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে আপনাদের মত অল্পবয়সী
মেয়েরা যে অ্যাডভেঞ্চারের খোঁজে আসবেন তা আমি ঠিক- আচ্ছা, আপনাদের মোটিভেশনটা ঠিক কি
ছিল?”
এ কথার উত্তরে একটু থমকালেন লুইসি, তারপর রুকস্যাকের সাইডপকেট
থেকে প্রথমে বের করে আনলেন একটি ফটো ও নোটবুক। সে দুটি তিনি তুলে দিলেন অগস্ত্যর হাতে।
দেখেই বোঝা গেল জিনিষগুলি বেশ পুরোন। এবার ফটোটির ওপর আঙুল রেখে তিনি বললেন-
-“আমার বাবা ফিলিপ এডুইন গিবস। ইনি জাতিগতভাবে ফরাসি,
পড়াশোনা ও চাকরি মার্কিন মুলুকে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় ইনি সেনাবাহিনিতে নাম লেখান;
অসীম সাহসিকতা ও অসামান্য বীরত্বের কারণে শেষে সার্জেন্ট পোস্টে প্রমোটেড হন। যুদ্ধের
একেবারে শেষের দিকে ডান্যাং শহরের উপকন্ঠে একটি আশ্চর্য ঘটনার সম্মুখীন হন তিনি-”
সার্জেন্ট গিবসের সঙ্গে ‘রেডস্টার’ খুয়ানের সাক্ষাৎকার
পর্বটি এরপর তিনি মেলে ধরেন অগস্ত্যর সামনে, মন দিয়ে পুরোটা শোনেন তিনি। পুরোটা ব্যক্ত
করে এরপর তিনি দ্বিতীয়বার হাত ঢোকান রুকস্যাকের সাইডপকেটে, আর এবার যে জিনিষটি বের
করে আনেন তিনি, তা দেখে হতচকিত হয়ে যান অগস্ত্য। এ কি?
লুইসি তার দিকে বাড়িয়ে ধরেছেন সেই ‘চোখ’, যা বহুকাল আগে
তিনি দেখেছেন বাবার কাছে! তফাৎ শুধু এখানেই যে বাবার কাছে যেটি দেখেছিলেন, সেটি মানুষের
ডান চোখের আদলে তৈরি, আর এটি বাঁ চোখের আদলে! এই প্রভেদটুকুনি ছাড়া অন্য কোন প্রভেদ
নেই দুটি ক্ষেত্রেই; একই কারুকার্য, একই আকার ও প্রকৃতি- সবই এক প্রকারের!
হাঁ করে ‘চোখ’টির দিকে তাকিয়ে রইলেন অগস্ত্য, উত্তেজনায়
বুক কেঁপে উঠছে তার। এত বছর পর সেই অভিশপ্ত চোখের জোড়াটি ফেরৎ এল তার কাছে, তাহলে কি
এবার বাবাকে খুঁজে-
-“যুদ্ধের বীভৎসতা বাবার মনটাকে পুরোমাত্রায় বিষিয়ে দিয়েছিল…”-
বলতে থাকেন লুইসি -“যুদ্ধের উপান্তে আর আমেরিকায় ফেরৎ যান নি তিনি, সোজা চলে আসেন ফ্রান্সে।
ইতিহাসের অধ্যাপনার অভিজ্ঞতার কারণে চাকরি পেতে অসুবিধে হয় নি তার, আজীবন ফ্রান্সেই
কাটান তিনি। তবে যে দরজা খোলে এই চাবি দিয়ে তার অনেক খোঁজ করেছিলেন তিনি। পাকিস্তানেও
গিয়েছিলেন; অনুমতিও যোগাড় করেছিলেন তিনি ওখানে ঘোরাঘুরির। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে প্রথমে
সোভিয়েত-তালিবান যুদ্ধ ও পরে তালিবান শাসনের উথ্থানের কারণে পাকিস্তান সরকার সেই অনুমোদন
প্রত্যাহার করে নেন। নোটবুকের লেখাগুলি ওনার নিজের-”
নোটবুকটা খুলে সেটি খুব মন দিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন অগস্ত্য;
দেখা শেষ হলে তিনি সেটি ফেরৎ দেন লুইসিকে, তারপর বলেন-
-“‘কলস’দের স্থানান্তরিত হওয়ার বিষয়টি বোধহয় তিনি জানতেন
না, নাহলে আমার বিশ্বাস উনি জায়গাটি নিশ্চই ধরে ফেলতেন। তবে ‘তিন বোন’এর ব্যাপারটা
যে প্রকৃতপক্ষে জলপ্রপাত তা তিনি নিশ্চিতভাবে বুঝেছিলেন- ওঁনার নোটবুকে লেখা আছে ব্যাপারটা।
আচ্ছা, ‘কলস’দের বর্তমান বসতি অঞ্চল থেকে উনি আর কিছু জানতে পারলেন কি?”
-“ওদের একটি অদ্ভুত ধর্মীয় আচরণের বিষয়ে উনি বলতেন আমায়…‘কলস’
জনজাতির লোকজন প্রতিবছর শীতের গোড়ায় একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করে- কোন এক আত্মার
শান্তির উদ্দেশ্যে এই অনুষ্ঠানের চল ওদের মধ্যে-”
-“কিরকম?”
-“এমনিতেই ওদের আচার আচরণ বিবিধ, বারোমাসে তেরো পার্বণ
না হলেও সংখ্যাটা দশের নীচে কিছুতেই হবে না তা নিশ্চিত; তার মধ্যে এই ধর্মীয় অনুষ্ঠানটি
একেবারে স্বতন্ত্র্য! ওদের বিশ্বাস- বহুকাল আগে কোন এক বিদেশি আগন্তুক এসে ছিলেন ওদের
এলাকায়, দেবতাদের মন্দিরে স্বর্গে যাওয়ার দরজা খুলে দিতে। স্বর্গের দরজা খোলবার দুটি
চাবির মধ্যে একটি চাবি ওঁনার কাছে ছিল, কিন্তু সেই চাবি হারিয়ে ফেলায় দেবতা ওঁনার প্রতি
রুষ্ট হন এবং এবং চিরকালের জন্য তাঁর আত্মাকে বন্দী করে রাখেন নিজ মন্দিরের বলয়ে! প্রতিবছর
‘কলস’দের তিনটি গ্রামের লোকেরা সমবেত হন, একইসাথে উত্তর-পূর্বদিকে মুখ করে সকলেই মঙ্গলোচ্চারণ
করে, স্তুতিগান গায়। এই রেওয়াজ নাকি বহু প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে ওদের মধ্যে।”
-“দুটি চাবি…হুঁ…এই চাবির ব্যাপারটি কি?”
-“আমার বাবা প্রয়াত হন এ বছর ১১ই জানুয়ারি। আমৃত্যু তিনি
বিশ্বাস করে এসেছেন এই ‘চোখ’এর মত বস্তুটি একটি চাবি। প্রয়াত খুয়ামও এই কথা বলেছিলেন
তাঁকে। এটি যদি একটি চাবি হয়, এবং এটি যদি মানুষের বাঁ চোখ হিসেবে ধরা হয়, তবে-”
-“তবে মানুষের ডান চোখের মতও একটি চাবি থাকা উচিৎ, তাই
না?”
-“বিষয়টি তো তাই দাঁড়ায়, যদিও বাবা কখনোই খুঁজে পান নি
সেই ডান ‘চোখ’। সেটি আদৌ আছে কি না-”
এ কথায় একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল অগস্ত্যর বুক থেকে;
তারপর একটু নীরব থেকে তিনি বললেন-
-“আছে! ওটি-”
অগস্ত্য মুখ খুলেছিলেন তার জীবনের ভয়াবহতম অভিজ্ঞতা লুইসির
সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার জন্য; এমন সময় ড্রাইভারের পাশের সীট থেকে গার্ডবাহাদুর হেঁকে
উঠলেন-
-“সাব! রাবসাং উওয়টার ফলস্ আ গৈলা!!”
একটু পরেই গাড়িটা থেমে যেতেই সকলে জিপ থেকে নেমে এগিয়ে
গেলেন জলপ্রপাতের দিকে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আমাদের ব্লগগুলি আপনাদের কেমন লাগছে? অবশ্যই জানান আমাদের-