Bengali Historical audio story|বহুযুগের ওপার হতে- পর্ব ১৪ |Aritra Das|Science Fiction novel
...এই পর্যন্ত বলে চুপ করে গেলেন অগস্ত্য। বিষয়টা এতটই অবাস্তব
যে উপযুক্ত প্রমাণ না পেলে এই বিষয়ে মুখ খোলাই উচিৎ নয়। লুইসি তখনও বড় বড় চোখ মেলে
তাকিয়ে রয়েছেন ভেসে থাকা কাঠের টুকরোটির দিকে; এবার তাকে ডেকে দুজনে পায়ে পায়ে এসে
দাঁড়ালেন বাইরের বিরাট কক্ষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা সুবিশাল তোরণটির সামনে।
-“হে ভগবান!!”
বিষ্ময়োক্তি বেরিয়ে এল অগস্ত্যর মুখ দিয়ে, তোরণটির দিকে
তাকিয়ে। সেটিকে তিনি শুধু চিনতে পেরেছেন বলে নয়, তার বিষ্ময়ের কারণ অন্যত্র।
প্রায়ান্ধকার কক্ষটিতে দূর থেকে তোরণের মাথার কাছটা ভালো
করে খেয়াল করতে পারেন নি তিনি, এখন কাছে এসে তা লক্ষ্য করেই অগস্ত্যর বিষ্ময়োক্তি।
তোরণের মাথায় যে জিনিষটির স্থাপত্য দেখে অবাক হয়েছেন তিনি, তা বর্তমানে ভারত সরকার
স্বীকৃত চিহ্ন, যা সর্বত্র সরকারি কাজে ব্যবহার হয়!
-“ওটা কি…অশোকস্তম্ভ?”- থতমত হয়ে প্রশ্ন করলেন লুইসি;
উত্তরে দুবার ঘাড় নাড়লেন অগস্ত্য। তার মানে মার্তণ্ড জেলায় ভিন্ন একটি মন্দিরে ভিন্ন
পরিবেশে দাঁড়িয়ে তার বাবার অনুমান একেবারে নির্ভুল ছিল? এই গোটা কর্মকাণ্ডটির সঙ্গে
মৌর্যদের প্রত্যক্ষ যোগ রয়েছে? পাশে দাঁড় করানো নাতিউচ্চ গম্বুজের দিকে দৃষ্টি ঘোরাতেই
মাঝামাঝি অংশে একটি অবতল ফাঁক চোখে পড়ল তার।
-“আপনার চাবিটি ওতে লাগান তো!”
গম্ভীর গলায় লুইসিকে বলতেই নিজের কাছে রাখা কৃত্রিম ‘চোখ’টি
বের করে গম্বুজের অবতল অংশে সেটিকে বসালেন লুইসি, বসাতেই মাপে মাপে বসে গেল ওটি; আর
তা হতেই পরপর ঘটে গেল অদ্ভুত সব প্রক্রিয়া!
‘চোখ’টি জায়গায় বসতেই খুব সুন্দরভাবে আটকে গেল পাথরের
গায়ে; তারপর অদ্ভুত আলো ফুটে উঠল সেখানে। ইতিমধ্যে গোটা কক্ষ জুড়ে একটি ঘরঘর শব্দ প্রতিধ্বনিত
হতে লাগল, খটাং-খট ধরণের বিচিত্র শব্দ অনুররিত হতে লাগল গোটা কক্ষ জুড়ে, যেন কোথাও
মাপে মাপে কিছু একটা জুড়ে গেল পরষ্পরের সঙ্গে, তার সঙ্গে বিভিন্ন ধাতব, বিচিত্র সব
আওয়াজ, যেন সদ্য ঘুম ভেঙে কাজে লেগেছে একরাশ কলকব্জা! এইবার দেখা গেল, তোরণটির গা বেয়ে
বিভিন্ন আলোর বিচ্ছুরণ ঘটতে লাগল, আর তার সাথে সাথে তোরণের মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটি,
যা দিয়ে এতক্ষণ কক্ষের অপর প্রান্তটি দেখা যাচ্ছিল- তা ক্রমশঃ অদৃশ্য হয়ে যেতে লাগল
একটি কাঁচের মত পর্দার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে। প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হতেই দেখা গেল-
তোরণটি একটি আয়নার চেহারা নিয়েছে, কিন্তু তাতে মুখোমুখি দাঁড়ানো অগস্ত্যর কোন প্রতিচ্ছবিই
নেই!
-“সময়-দর্পণ! তাহলে…এটি একটি পোর্টাল? কিন্তু এ দিয়ে কোন
বিশ্বে যাওয়া যাবে?”
কখন যে লুইসি পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন তা টেরই পান নি অগস্ত্য-
এতটাই নিবিষ্ট ছিলেন তিনি পুরো প্রক্রিয়াটি দেখতে। এখন লুইসির কথায় সম্বিৎ ফিরে এল
তার; লুইসিকে কিছু বলতে যাবেন তিনি, এমন সময়-
পর্দায় ধীরে ধীরে চলমান একটি দৃশ্য ফুটে উঠল; কাঁচের গায়ে
স্পষ্ট দেখা গেল- ওপারে দাঁড়িয়ে চাকচিক্যবিহীন সাধারণ পোশাক পরা একজন লোক! গভীর মনোনিবেশের
সঙ্গে তিনি তাকিয়ে রয়েছেন সিধা অগস্ত্যর দিকেই। তার পিঠে একটি সাধারণ ব্যাগ, চোখে চশমা,
আর…এখনও অবধি ঐ চশমাটির দুটি ডাঁটিই অবশ্য অক্ষত আছে!
-“বাবা!”
একটা প্রবল বিষ্ময় মেশানো আর্তনাদ বেরিয়ে এল অগস্ত্যর
গলা চিরে; তিনি এখনও বুঝে উঠতে পারছেন না এই আশ্চর্য সমাপতনের বিষয়টি; যে বাবাকে তিনি
অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখেছেন চোখের সামনে, তিনি এখন দাঁড়িয়ে তার সামনে, খুব বেশি হলে কয়েকহাত
দূরত্বে, কাঁচের পর্দার ওপারে! বোধবুদ্ধি হারিয়ে আরও বেশ কয়েকবার প্রবল জোর আর্তনাদ
করেই চললেন তিনি গলা ফাটিয়ে; বাবা কি শুনতে পাচ্ছেন না তার ডাক?
-“বাবা, বাবা, তুমি দেখতে পাচ্ছ, শুনতে পাচ্ছ আমাকে?”
একটানা এইভাবে বেশ কয়েকবার ডাকবার পর মনে হল যেন কাজ হল;
এইবারে মনে হল যেন বাবা শুনতে পেয়েছেন তার কথা, এতক্ষণে ডান হাতটা আস্তে করে তুললেন
তিনি; উত্তরে অগস্ত্যও তার ডানহাত একবার তুললেন। মনে হল, বাবা চমকে উঠলেন অপর প্রান্তে!
-“বাবা…বাবা…বাবা…”
হঠাৎ একটি কথা মনে পড়তে থমকে গেলেন অগস্ত্য; তার দৃষ্টি
চলে গেল সামনে দাঁড়ানো বাবাকে ছাপিয়ে পিছন দিকে, ঘরের প্রবেশদ্বারের দিকে। দেওয়ালের
কোণ থেকে একটা মুখ উঁকি মারছে না? হ্যাঁ ঐ তো, একটি বাচ্চার মুখ উঁকি মারছে দেওয়ালের
ঐপার থেকে, ঐ তো, দেওয়াল ছেড়ে এগিয়ে এল ছেলেটি-
ভয়ে মাথার চুল খাড়া হয়ে এল অগস্ত্যর; সাময়িককালের জন্য
থমকিয়ে গিয়েছিলেন তিনি নিজের বাল্য প্রতিরূপটিকে চোখের সামনে দেখে; এখন হঠাৎ আড়ষ্টভাব
কাটিয়ে সবেগে হাত-পা নাড়তে নাড়তে প্রবল জোর চিৎকার করে উঠলেন তিনি-
-“বাবা…মনু ঠিক তোমার পিছনে…ওকে সরাও, তুমিও সরে যাও!!”
বাবার কথায় মনে হল তিনি আবছাভাবে হলেও এখন শুনতে পাচ্ছেন
অগস্ত্যের কথা, একটি ক্ষীণ প্রশ্ন ভেসে এল অগস্ত্য ও লুইসি- দুজনের কানেই-
-“কি বলছ, কিছু শুনতে পাচ্ছি না…কি? সরা-ও – সরাও? কি
সরাব?”
আরও প্রবল হয়ে এল অগস্ত্যের হাত নাড়ানো; সর্বশক্তি দিয়ে
চেঁচিয়ে তিনি বলতে লাগলেন-
-“আমি মনু বলছি বাবা…তোমার আদরের মনু…সরে যাও এখান থেকে…মনুকে
নিয়ে…”
-“মহা…হনু…মনুকে…সরাও- মনুকে সরাব? কি বলছ তুমি আমার ছেলের
ব্যাপারে? আমার ছেলের নাম তুমি জানলে কি করে?”
তারপর পিছনে ঘুরেই নিজের বাচ্চা ছেলেকে দেখতে পেয়ে তিনি
বললেন-
-“মনুবাবা! তুমি এখানে? এখানে কি করছ?”
অগস্ত্যর আর চেঁচানোর ক্ষমতা নেই, উত্তেজনায় বাকরুদ্ধ
হয়ে এসেছে তার; কোনমতে হাতের ইশারায় তিনি বোঝাতে চাইলেন পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা মনুকে নিয়ে
তার বাবা যেন সরে যান দর্পণের সামনে থেকে; এইটা বোঝানোর জন্য দর্পণের আরও কাছে সরে
এলেন তিনি, এমন সময়-
উত্তেজনায় দর্পণের অনেকটা কাছে চলে গিয়েছিলেন অগস্ত্য,
এমন সময় তার বাঁহাত হঠাৎ যেন কাঁচ ফুঁড়ে চলে গেল অপর প্রান্তে; চমকে হাতখানি টেনে আনলেন
তিনি এপারে। তাকিয়ে দেখলেন- এই সীমিত সময়ের মধ্যেই তার হাতে জমে গিয়েছে বিন্দু বিন্দু
বরফের টুকরো! কিন্তু ঐদিন তো গর্ভগৃহের ভিতরটা এত ঠাণ্ডা ছিল না! এই দর্পণের সাহায্যে
তবে কি…সময়-সারণির অপর প্রান্তে যাওয়া যায়?
এরই মধ্যে পরপর ঘটে গেল হৃদয়বিদারক ঘটনাগুলি। সময়-দর্পণ ভেদ করে অপর প্রান্তে বেরিয়ে আসা যায় এটি উপলব্ধি করে অগস্ত্য ঢুকতে যান ওর ভিতরে, কিন্তু লুইসি জাপটে ধরেন তাকে পিছন থেকে। অপরদিকে অমঙ্গলের আশংকায় দর্পণের অপরপ্রান্তে দাঁড়ানো অগস্ত্যর বাবা হুমড়ি খেয়ে পড়েন ওপাশের গম্বুজের ওপর, টেনে বের করে আনেন ওদিকের চাবি, সেই কৃত্রিম ‘চোখ’; আর ঠিক এইসময়তেই লুইসি তাকে কোনক্রমে সরিয়ে আনেন দর্পণের সামনে থেকে; পরক্ষণেই দর্পণ থেকে একটি তীব্র আলোর ছটা একবার দেখা দিয়েই মিলিয়ে যায় অন্ধকারে! আস্তে আস্তে আবার স্বাভাবিক হয়ে আসে ঘরের আলো। একপাশে কেৎরে শুয়ে থেকে হাঁফাতে থাকেন দুজনেই।
=============================================================
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আমাদের ব্লগগুলি আপনাদের কেমন লাগছে? অবশ্যই জানান আমাদের-