-“আপনি কি নিশ্চিত অগুস্টা, এটাই সেই জায়গা?”
খরস্রোতা নদীর এপাড়ে দাঁড়িয়ে অপরপাড়ের ঢালুপথের শেষপ্রান্তে
খাড়া উঠে যাওয়া পাহাড়টির দিকে তাকিয়ে শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করলেন লুইসি। প্রত্যুত্তরে
ঘাড় নাড়ালেন অগস্ত্য।
-“‘পাহাড়ের গায়ে তিন বোন যেখানে খেলা করে’- আপনি পাশাপাশি
দুইটি জলপ্রপাতকে আগেই দেখেছেন লুইসি, এটি তৃতীয়টি। ‘এক বোনের একটি চক্ষু দিয়ে নেমে
আসছে ক্ষীণ অশ্রুধারা’- ঐ দেখুন, পাশাপাশি দুটি গুহামুখের একটি থেকে ক্ষীণ জলধারা নেমে
এসে মিশেছে মূল নদীস্রোতের সঙ্গে…আর তাছাড়া আমরা এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি তা কলসদের
বর্তমান বসতির সোজাসুজি উত্তর-পূবদিক; বিশ্বাস না হয় ম্যাপে দেখুন…কিন্তু ওদিকটায় এত
কুয়াশা কেন? পাথরখণ্ডগুলির এপাশে তো কোন কুয়াশা হয় নি!”
অগস্ত্যর মন বলছে এটিই সেই জায়গা; পাহাড়টি দেখেই নিশ্চিত
হয়েছেন তিনি। এই পাহাড়ের আকৃতি তার স্বপ্নে দেখা পাহাড়ের আকৃতির সাথে হুবহু সামঞ্জস্যপূর্ণ,
কোন তফাৎ নেই! দেখা মাত্রই একে চিনেছেন তিনি। স্বপ্নকে এখন বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে
থাকতে দেখে অগস্ত্যর বিশ্বাস- তিনি দাঁড়িয়ে আছেন তার গন্তব্যের থেকে মাত্র কয়েক মিটার
দূরে। এখন শুধু রহস্য উম্মোচনের পালা!
নদীর যে পাড়ে তারা এখন দাঁড়িয়ে সেটি প্রায় নদীর সমতলে;
পাড় নদীর থেকে কয়েক ফুট উঁচু হবে মাত্র। তাদের সঙ্গে থাকা আর্মি অফিসারটির নাম ডাম্বলে,
তিনি জানালেন- এই জায়গাটি প্রকৃতপক্ষে আগে অনেক উঁচুতে ছিল; কিন্তু পরবর্ত্তী যুগে
ক্রমাগত ভূমিকম্প ও বিধ্বংসী বন্যার ফলে নদীর এই পাড়ের উঁচু অংশটি ক্রমশঃ বসে গিয়ে
আজকের এই চেহারায় এসে দাঁড়িয়েছে! নদীর পাড় সন্নিহিত অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অজস্র
ছোট-বড় পাথরের টুকরোও অবশ্য সেই কথাই বলে।
একটু দূরে এগিয়েই একসার পাথরের সারি আড়াআড়িভাবে নদীটিকে
অতিক্রম করে ঐপাড়ে ঠেলে উঠেছে, যেন নদীর ওপর প্রকৃতি নিজ ইচ্ছায় একটি পাথরের সেতু নির্মাণ
করেছে। এই পাথরের সারি অতিক্রম করেই কুয়াশার বৃত্তে প্রবেশ করে নদীটি যেন একটু থমকে
তারপর অদূরে জলপ্রপাতের সৃষ্টি করে নীচে আছড়ে পড়েছে; স্বর্গীয় এই দৃশ্য!
-“চলুন, ঐপাড়ে যাওয়া যাক। জোয়ানা ততক্ষণে তৈরি হয়ে নিক,
এখানে দাঁড়িয়ে অহেতুক সময় নষ্ট না করে-”
লুইসির কথায় সম্মত হলেন অগস্ত্য; তারপর পাথরের সেতু ধরে
হাঁটতে হাঁটতে তারা দুজনেই চলে এলেন এপাড়ে। জোয়ানা সাংবাদিকতার কাজ করেন, নিজের অফিসের
জন্য একটি প্রতিবেদন লিখেই তিনি যোগ দেবেন ওদের সঙ্গে।
-“মিঃ ডাম্বলে কি বললেন?”
-“নদীটা ক্রস করেই ওপাড়ে গিয়ে দাঁড়াতে, আর ওনারা না আসা
অবধি আমরা যেন জায়গা থেকে না নড়ি। এই চত্ত্বর থেকে বর্ডার মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে,
হোস্টাইলরা এখানে ঢুকে পড়ে যখন-তখন! ওরা ইউনিটে খবর পাঠিয়ে আমাদের সঙ্গদান করবেন।”-
লুইসির প্রশ্নের উত্তরে বললেন অগস্ত্য।
অত্যন্ত নির্জন পরিবেশ জায়গাটি জুড়ে। এত নিস্তব্ধ এই অঞ্চলটি
যে অদূরে জলপ্রপাতের শব্দটা বেশ জোরে কানে লাগছে; অথচ এখানকার লোকজনের মতে এই জলপ্রপাতের
উচ্চতা কিন্তু খুব বেশি নয়! খানিকণ নীরবে এই নৈশব্দ্য অনুভব করলেন দুজনেই, তারপর লুইসি
বললেন-
-“তখন গাড়িতে কিছু একটা বলতে গিয়েছিলেন চাবির ব্যাপারে…”
প্রসঙ্গটি আবার মনে পড়ে গেল অগস্ত্যর, তিনি তার বাবার
বিষয়ে বললেন লুইসিকে, পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পুরোটা। অগস্ত্যর সম্পূর্ণ বক্তব্য মন দিয়ে
শুনলেন লুইসি, তারপর বললেন-
-“তাহলে? দ্বিতীয় চাবিটিও এর মানে রয়েছে? কিন্তু…এর ভূমিকাটি
তাহলে কোথায়? আপনি যা বললেন তার থেকে পরিষ্কার যে দ্বিতীয় চাবিটি ব্যবহার হয়েছিল বটে,
কিন্তু তা তো আপনার বাবার সাথে সাথেই- ভালো কথা, চাবিটি উনি পান কোথা থেকে?”
-“কাশ্মীর যাওয়ার আগে বাবা মহারাষ্ট্রে গিয়েছিলেন; ফেরবার
সময় সাথে করে উনি নিয়ে আসেন এই চাবি, আর একটি লিপি। এর থেকে বেশি কিছু তখন জানতে পারি
নি। তবে পরবর্ত্তীকালে লিপিটি কোনভাবে হাতে এলে আমি ওটিকে পর্যবেক্ষণ করি। যদিও এর
বেশিরভাগ জায়গা আমি পাঠোদ্ধার করতে পারি নি-”
-“কি ছিল লিপিটিতে?”
-“লিপিটি খরোষ্ঠী ভাষায় লেখা হয়েছিল। ঐ লিপিটি পাঠোদ্ধার
করতে বাবাকে একজন প্রখ্যাত ভাষাবিদের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল। তবে মোটের ওপর যা বুঝেছি-
আমাদের দেশের একদম পশ্চিমদিকে কোন এক জঙ্গুলে জাতির কাছ থেকে বাবা উদ্ধার করেন ঐ ‘চোখ’,
যা নিয়ে আমরা দুজনেই গিয়েছিলাম অনন্তনাগের সূর্যমন্দিরে। বাবা চেয়েছিলেন বিষয়টি আগেই
দেখে নিয়ে তারপর এ বিষয়ে সকলকে জানাতে, কিন্তু তার আগেই-”
-“আপনার বাবার রহস্যময় অন্তর্ধান ঘটে। জানি। ডাঃ ভার্গব
আমাদের জানিয়েছিলেন এ কথা। তিনি এও বলেছিলেন- এ বিষয়ে যদি কেউ যোগ্য সহায়তা করতে পারে
তবে তা আপনি। সূত্রগুলি পরপর মিলছে এসে একটিই বিন্দুতে! কিন্তু একটিই ব্যাপার ঠিক বুঝে
উঠতে পারছি না অগুস্তা- দুটি ভিন্ন চাবি, একটি চাবি উদ্ধার হল ইরাবতী নদীতে, অর্থাৎ
মায়ানমারে; সময়ের স্রোতে ভাসতে ভাসতে সেটি চলে এল দক্ষিণ ভিয়েতনামে। অপর একটি চাবি
আপনার বাবা উদ্ধার করেন মহারাষ্ট্রের পশ্চিমদিক ঘেঁষে জঙ্গলের এক আদিবাসী গোষ্ঠীর কাছ
থেকে, অথচ দুটিরই যোগসূত্র ভারতের হিমালয়! এর উদ্দেশ্যটা কি? কিচ্ছু বুঝতে পারছি না
ব্যাপারটা-”
-“প্রাচীন ও বর্তমান ভারত অতি রহস্যময় দেশ লুইসি; ‘দেবতাদের
আপন ভূমি’ এই দেশ কত রহস্য বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে তা কেউ বলতে পারে না। তবে আমার বিশ্বাস-
এই চাবির রহস্যটি যেদিন খুলে যাবে, সেদিন বিজ্ঞানের নতুন কোন দিক উম্মোচন হবে। বাকিটা
ভাগ্য! জোয়ানার এখনও হয় নি?”
সেটা দেখার জন্যই সদ্য ঘাড় ঘুরিয়েছেন দুজনেই, এমন সময়
অগস্ত্যর মনে হল একটা আগুনে পোকা যেন উড়ে গেল তার বাঁ গালের পাশ দিয়ে, আর যাওয়ার সময়
তার বিষাক্ত দাঁড়ার প্রান্তভাগ যেন হালকাভাবে ছুঁইয়ে গেল তাকে! প্রথমে বিষয়ের গুরুত্ব
অতটা বুঝতে পারেন নি তিনি, একটা চিনচিনে ব্যথা আর হালকা জ্বালা নিয়ে তিনি ফিরে তাকালেন
লুইসির দিকে। দেখা গেল, একমুখ বিষ্ময় নিয়ে লুইসি হাঁ করে তাকিয়ে তার দিকে!
-“ওটা কি…রক্ত…অগুস্টা?”
গালে হাত বুলিয়ে সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে দেখলেন অগস্ত্য-
রক্তই তো! বাঁ গালে যে ক্ষতস্থান তৈরি হয়েছে তা থেকে বেরোন তার নিজেরই তাজা রক্ত! কিন্তু
কোন পোকা কামড়ালো তাকে?
-“অ্যামবুশ! টেক কাভার!!!”
ক্যাপ্টেন ডাম্বলের প্রবল চিৎকারে চটকা ভাঙ্গল সকলের!
একজন গার্ড দৌড়ে এসে একপ্রকার কোলপাঁজা করে তুলে নিয়ে গেল জোয়ানাকে; একটি পাথরের ওপর
বসে একমনে প্রতিবেদন লিখছিলেন তিনি; বেচারির নোটবুক আর পেনসিল পড়ে রইল মাটিতেই! দুটি
পৃথক দলে ভাগ হয়ে জোয়ানাসমেত সকলেই বসে পড়লেন ইতস্তত বিক্ষিপ্ত পাথরের চাঙরার আড়ালে,
একজন ওখান থেকেই অগস্ত্যদের নির্দেশ দিলেন যা হোক কিছুর আড়ালে কভার নিতে! ওপাড়ের জঙ্গলের
ঠিক মুখটাতেই দেখা গেল আরও পরপর কয়েকটি আলোর ঝলকানি, তারপরই তাদের পাশ দিয়ে বেরিয়ে
গেল পরপর আরও কয়েকটি বুলেট!
-“তাড়াতাড়ি…আমাদের কভার নিতে হবে!”
-“কোথায়? এ পাড়ে তো কোন পাথরের টুকরো নেই-”
-“ঢালুপথ বেয়ে চড়তে শুরু করুন লুইসি, ঐ পাহাড়েই এখন আমাদের
আশ্রয় নিতে হবে, এ ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই!”
-“কিন্তু জোয়ানা?”
একথায় ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন অগস্ত্য। উল্টোদিকের গার্ডরা
ততক্ষণে বুঝতে পেরেছেন যে এমন কিছুই নেই এ পাড়ে যার পিছনে অগস্ত্যরা কভার নিতে পারেন;
এ কথা বুঝে জঙ্গলের লাইন লক্ষ্য করে পাথরের আড়াল থেকে পাগলের মত গুলি ছুঁড়ে যাচ্ছেন
তারা যাতে শত্রুদের ফায়ারিং নিজেদের দিকে টেনে নেওয়া যায়! আর হচ্ছেও তাই, শত্রুদের
সব কটি বন্দুকের নল এখন তাদের দিকে ঘুরে গিয়েছে। এই সুযোগে মেজর ডাম্বলে প্রাণপণে চেষ্টা
করছেন নিজের ইউনিটের সঙ্গে যোগাযোগ করতে।
-“জোয়ানা ওদের সঙ্গে রয়েছে, ব্যাক-আপ টিমও তাড়াতাড়িই চলে
আসবে; আসুন, ততক্ষণে আমরা গুহায় ঢুকে পড়ি; সব থামলে না হয়-”
আর দ্বিরুক্তি করেন নি লুইসি; অগস্ত্যের সঙ্গে তিনিও শুরু করে দিলেন ঢালুপথটি বেয়ে ওপরের পাহাড়ের দিকে চড়তে। একটু পরে দুজনেই ঢুকে পড়লেন পাহাড়ের পাশাপাশি দুটি গুহামুখের শুকনোটিতে, ভিতরে অন্তর্হিত হয়ে গেলেন তারা।
================================================================
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আমাদের ব্লগগুলি আপনাদের কেমন লাগছে? অবশ্যই জানান আমাদের-