গর্ভগৃহের ভিতরটা কি ভীষণ অন্ধকার! বারদুয়েকবার হোঁচট
খেতে খেতে বেঁচে গেল ছেলেটি, তারপর একদিকের দেওয়াল ধরে ধীরে ধীরে এগোতে লাগল সে। তার
লক্ষ্য অবশ্য খুব একটা দূরে নয়, সামনে একটা মোড় মত রয়েছে, আর সেখান থেকে যেন একটা হালকা
আলোর প্রভা বাইরে এসে পড়েছে- অন্ধকার জগতের একমাত্র আলো! সেই আলোর দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে
গেল ছেলেটি। মোড়ে পৌঁছে সে কিন্তু সরাসরি ঘুরে গেল না আলোর উৎসের দিকে, বরং দেওয়াল
ধরে দাঁড়িয়ে আলোর দিকে একটা উঁকি মারল ছেলেটি-
এবং…অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেল সে, সামনের দৃশ্য দেখে!
মোড় ঘুরেই একটি বিশাল বড় ঘর, সূর্যমন্দিরে প্রবেশ করবার
সময় যেরকম তোরণ পেরিয়ে তারা ঢুকেছিলেন মন্দিরপ্রাঙ্গণে, ঘরটিতে অনুরূপ একটি তোরণ করে
রাখা একেবারে মাঝখানে; পার্থক্য এখানেই যে এটি শুধুই একটি তোরণ ঘরের মধ্যিখানে, যার
মাথায় বা আশেপাশে গাঁথনীর কোন বালাইই নেই! এর একপাশে একটি খাটো আকারের গম্বুজ বসানো,
যাতে অনেকগুলো সুইচ মত কিসব বসানো, আর তার মধ্যিখানে আটকানো একটি- আরে, এটা সেই মানুষের
ডানচোখের মত ‘চোখ’টা না? ওটা এত উজ্জ্বল হয়ে উঠল কিভাবে? এখানে আসবার আগে বাবা মহারাষ্ট্রে
গিয়েছিলেন, ফেরবার সময় তার সঙ্গে এই ‘চোখ’ ছিল, আর তার সাথে অতি পুরোন একটি লিপি- এই
দুটো জিনিষ নিয়েই তো বাবা প্রায় একমাস কাটিয়ে দিয়েছিলেন লাইব্রেরীতে- সেই ‘চোখ’টা এখানে
কি করছে?
ঐ তোরণটির সামনে স্থানুর মত দাঁড়িয়ে ছিলেন বাবা, সেটির
দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে! বাবাকে পিছন থেকে দেখতে পাচ্ছিল ছেলে, ফলে তিনি কি দেখছেন সামনের
ফাঁকা তোরণের ভিতর তা সে বুঝতে পারছে না। একটা হালকা আলোর আভা বিচ্ছুরিত হচ্ছে তোরণটি
থেকে, ব্যাস, ঐ অবধি! কিন্তু অপরপাড়ে ঘরের পিছনের দেওয়ালটি ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে
না তো? জায়গা থেকে নড়ল না ছেলেটি, দাঁড়িয়ে উঁকি মেরে দেখতে লাগল সে, কি হচ্ছে ঘরের
ভিতর।
এইভাবে কেটে গেল আরও বেশ কিছুটা সময়, উল্লেখযোগ্য কিছুই
ঘটে নি এতক্ষণে। অসহিষ্ণু হয়ে উঠছিল ছেলেটি; হাজার হোক, পৃথিবীতে কোন বাচ্চা আছে যে
এতক্ষণ চুপচাপ ধৈর্য্য ধরে দেওয়াল ধরে দাঁড়িয়ে থাকবে? তাছাড়া…সিঁড়িটা বন্ধ হয়ে গেলে?
এই কথাটা ভেবেই এতক্ষণে মন চঞ্চল হয়ে উঠল তার। সামনেই বাবা দাঁড়িয়ে, এবার তাকে নিয়ে
আসবার জন্য দেওয়াল ছেড়ে সদ্য কয়েক পা আগিয়েছে ছেলেটি; এমন সময়-
হঠাৎ মনে হল যেন সূর্যের আলো জ্বলে উঠল ঘরটিতে- এত উজ্জ্বল
হয়ে উঠল তোরণটি! আলোর তেজে চোখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ছেলেটির, এবার কয়েকমুহুর্ত পরে সেটি
স্তিমিত হয়ে আসতে চোখ মেলে তাকিয়ে সে অবাক হয়ে গেল!
তোরণের অপরপ্রান্তে দাঁড়িগোঁফওয়ালা একটি লোক দাঁড়িয়ে,
তার বাম গালে একটা সদ্যকাটা দাগ, রক্ত বেরোচ্ছে সেখান দিয়ে! কিন্তু এখানে এই লোকটি
কোথা থেকে এল? তোরণের অপরপ্রান্তে তো কেউ ছিল না! আর ঘরটি এতটাই বিশাল ও ফাঁকা-ফাঁকা
যে তাতে লুকিয়ে থাকবার কোন প্রশ্নই নেই, তাহলে এই লোকটি এল কোথা থেকে?
কয়েকমুহুর্ত সেদিকে তাকিয়েই ব্যাপারটা বুঝতে পারল ছেলেটি,
লোকটি দাঁড়িয়ে আছে তোরণের ভিতর, আর যেখানে সে রয়েছে সেই জগৎটা অন্য! লোকটির পিছন দিকে
যে ঘরটি রয়েছে, তা তারা যে ঘরটিতে রয়েছে সেই পরিবেশের সঙ্গে খাপ খায় না; তাছাড়া…আবছাভাবে
মনে হল যেন তার পিছনে একটি মহিলাকে দেখা গেল, যদিও অন্ধকারে সেই মহিলার মুখ স্পষ্ট
নয়! ঘষা কাঁচের মধ্য দিয়ে তাকালে যেরকম দেখতে লাগে, সেইরকমই দেখতে লাগছে তোরণের ভিতরের
দৃশ্যগুলিকে, একমাত্র লোকটির মুখ-চোখই কিছুটা স্পষ্ট! কিন্তু…কিভাবে?
তোরণের মধ্যে থাকা লোকটি এবারে যেন পরিষ্কার দেখতে পেল
বাচ্চা ছেলেটিকে; আর দেখতে পেয়েই খুব উত্তেজিত ভাবে হাত নাড়তে নাড়তে কি একটা বলতে লাগল
সে, কিন্তু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটির কানে ঢুকল না একবর্ণ কথাও, সে শুধু শুনতে পেল
তার বাবা বলছেন-
-“কি বলছ, কিছু শুনতে পাচ্ছি না…কি? সরা-ও – সরাও? কি
সরাব?”
এই প্রশ্নের উত্তরে যেন আরও জোরে জোরে চেঁচিয়ে উঠল লোকটি,
অনর্গল হাত-পা নেড়ে কিসব বলে চলল সে একটানা, যদিও যথারীতি কিছুই শুনতে পেল না সে! এবারে
বাবা বললেন-
-“মহা…হনু…মনুকে…সরাও- মনুকে সরাব? কি বলছ তুমি আমার ছেলের
ব্যাপারে? আমার ছেলের নাম তুমি জানলে কি করে?”
উত্তরে আরও জোরে হাত নাড়তে লাগল তোরণের ভিতরে দাঁড়িয়ে
থাকা লোকটি, শেষে হাতনাড়া বন্ধ করে পিছনের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করতে পিছনে তাকিয়েই
তাকে দেখতে পেয়ে যেন চমকে উঠলেন বাবা!
-“মনুবাবা! তুমি এখানে? এখানে কি করছ?”
তারপরই তোরণের দিকে তাকিয়ে তিনি কাতর মিনতির স্বরে লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন-
-“দোহাই তোমাকে, আমার ছেলের কোন ক্ষতি কোর না…না!”
এইবার যা ঘটল তাতে বুদ্ধি সম্পূর্ণ লোপ পেয়ে গেল ছেলেটির; পরিষ্কার দেখা গেল তোরণটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এল লোকটির একটি হাত, সে যেন বাড়িয়ে ধরেছে হাতটি কোন কিছুকে ধরবার অভিপ্রায়ে! এই হাতটি বেরিয়ে আসতেই সাংঘাতিক ভয় পেয়ে গেলেন বাবা; পিছনদিকে একবার তাকিয়ে আদরের ছেলেকে বাঁচানোর অভিপ্রায়ে পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা গম্বুজটির ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে মাঝখান থেকে ডান ‘চোখ’টা খুলে নিলেন তিনি; আর তা করতেই-
হঠাৎ উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল তোরণ; তার থেকে নির্গত উজ্জ্বলতম প্রভা যেন কার্যত কানা করে ফেলল ছেলেটিকে! কোনমতে চোখের সামনে হাত নিয়ে এসে ঐ তীব্র আলোককে প্রতিহত করতে পারল ছেলেটি; তারপর সেই তীব্র আলোক যখন অন্তর্হিত হল, ধীরে ধীরে চোখ সয়ে আসতে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখল সে- ঘর ফাঁকা, তার বাবা কোথাও নেই! আশেপাশে তাকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠে ‘বাবা, বাবা’ বলে একটানা ডেকে গেল ছেলেটি, কিন্তু না, কোথাও দেখতে পেল না তার বাবাকে! এবার বাবা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেখানে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল ছেলেটি; শূণ্যগর্ভ তোরণের সামনের মেঝেতে কি একটা জিনিষ যেন পড়ে রয়েছে, কাছে গিয়ে দেখা গেল- বাবার চশমাটি পড়ে রয়েছে মেঝেতে, তার একদিকের ডাঁটি ভাঙা! চশমাটিকে পকেটে ভরে এবার তোরণের দিকে একদৃষ্টে তাকাল ছেলে- ফাঁকা তোরণটি আবার স্বাভাবিক! এই তোরণ থেকে নিঃসৃত ঐ রাক্ষুসে আলোটিই কিছুক্ষণ আগে জীবন্ত গিলে খেয়েছে তার বাবাকে! জ্বলন্ত চোখে সেই শূণ্য তোরণের দিকে তাকিয়ে রইল ছেলে।
ও কি, পিছন থেকে একটি মৃদু ঘড়ঘড় আওয়াজ কানে আসছে না? তার মানে…গর্ভগৃহে প্রবেশের মূল দরজাটি কি তবে আবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে? তোরণটির দিকে শেষবারের মত আরও একবার জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে দেখল সে, তারপরই দৌড় লাগাল ছেলেটি বাইরে যাওয়ার পথটির দিকে। অন্ধকারে কোনমতে হাতড়ে হাতড়ে সিঁড়ি অবধি পৌঁছিয়ে মাথা তুলে দেখে- ধীরে ধীরে প্রবেশপথের মুখটাতে বসানো পাথরদুটি আবার সরে আসছে জায়গায়, আর কিছুটা পরিসর আছে মাত্র সম্পূর্ণ বন্ধ হতে। কালবিলম্ব না করে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এল ছেলেটি, বাইরের মুক্ত পৃথিবীতে কোনমতে পা রাখবার পরক্ষণেই সজোরে বন্ধ হয়ে গেল কুয়োর দরজার মুখ! ঘুরে একবার পিছনে তাকিয়ে দেখল সে, তারপর ফিরে তাকাল পশ্চিমের অস্তগামী সূর্যের দিকে। দরজা খোলা-বন্ধের সঙ্গে দিনের আলোর সম্পর্কের ব্যাপারটা বাবা তার মানে ঠিকই অনুমান করেছিলেন!
পকেট হাতড়ে বাবার স্মৃতিখানি বের করে আনল ছেলেটি- একদিকের ডাঁটি ভাঙ্গা একটি চশমার অবশেষ! হাতটি সামনের দিকে তুলে ধরে ভালো করে চশমাটিকে দেখতে লাগল সে; তারপর দেখা শেষ হতে গম্ভীরমুখে নিজের পকেটে ভরে নিয়ে কুয়োটির দিকে একবার তাকিয়ে বহির্দ্বারের দিকে এগোতে লাগল দৃপ্ত পদক্ষেপে। একদিনে বড় হয়ে গিয়েছে বাচ্চা, গুরুদায়িত্ব এখন তার কাঁধে- এই ধাঁধার সমাধান করে তার বাবাকে আবার ফেরৎ নিয়ে আসা! চোখের জল মুছে নিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ায় ছেলেটি- কান্নার সময় এখন নয়; এই ধাঁধা তাকে সমাধান করতেই হবে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আমাদের ব্লগগুলি আপনাদের কেমন লাগছে? অবশ্যই জানান আমাদের-