Bengali Historical audio story|বহুযুগের ওপার হতে- পর্ব ১৩ |Aritra Das|Science Fiction novel
-“এ কোথায় চলে এলাম বলুন তো, অগুস্টা?”
উত্তরে কাঁধ শ্রাগ করলেন অগস্ত্য; বিষয়টির মাথা-মুণ্ডু কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না তিনি।
গুহামুখ দিয়ে পাহাড়ের ভিতরটায় ঢুকে পড়ে প্রথমটায় বেশ ফাঁপড়ে পড়েছিলেন দুজনেই, সূচীভেদ্য অন্ধকারে আশেপাশে দেখা যাচ্ছিল না কিছুই! বেশ কিছুক্ষণ একটানা দাঁড়িয়ে থেকে অন্ধকারে চোখ সয়ে আসতে দুজনে খেয়াল করেন- একটি লম্বা প্যাসেজের মাঝখানটা করে দাঁড়িয়ে আছেন তারা, যার শেষপ্রান্তে একটি হালকা লালচে হলুদ আভা বেরিয়ে আসছে যেন। আরও একটি বিষয় খেয়াল করে দেখেছেন দুজনই; তাদের মনে হল অন্ধকারে গোটা প্যাসেজ জুড়ে যেন অজস্র হাড়-গোড় ছড়ানো! নিশ্চিত হওয়া গেল প্যাসেজটি ধরে একেবারে শেষপ্রান্তে আলোক উৎসটির সামনে আসতে; দেখা গেল সেটি একটি প্রবেশদ্বার এবং তার সামনে পড়ে দুটি-তিনটি নরকঙ্কাল! দুজনেই ভয়ে সিঁটিয়ে গেলেন মানুষের ভঙ্গুর কঙ্কাল আবিষ্কার করে!
-“এসব কি ব্যাপার বলুন তো অগুস্টা…?”- ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন লুইসি।
-“ভয় পাবেন না; আমরা অনেকটা চলে এসেছি, এখন সামনে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আমাদের আর কিছু করণীয় নেই-”
কপাল ঠুকে দুজনেই ঢুকে গেলেন ভিতরে; দেখা গেল, একটি বিশালায়তন কক্ষের অন্দরে প্রবেশ করেছেন তারা!
কক্ষে ঢোকবার ঠিক মুখটিতেই একটি বড় পাথর লম্বালম্বিভাবে দাঁড় করানো অবস্থায় ছিল, সেটির গায়ে দেবনাগরী হরফে কিছু খোদাই করে রাখা ছিল। কৌতুহলী মুখে লেখাটি পড়ে দেখলেন অগস্ত্য।
-“কি লেখা ওতে?”- কৌতুহল ও আগ্রহ ভরে প্রশ্ন করলেন লুইসি।
-“‘একমাত্র নির্বাচিতরাই সময়-দর্পণ কক্ষে প্রবেশে সমর্থ’!”
-“মানে কি হতে পারে কথাটির?”
-“বুঝতে পারছি না…তবে আপনার এত সিঁটিয়ে যাওয়ার কোন কারণ
নেই লুইসি; সত্যিই যদি কোন বিপদ থাকত তবে আমরাও এতক্ষণে পড়ে থাকতাম দরজার ওপারে; কিন্তু
‘সময়-দর্পণ’ বলতে ওরা কি বোঝাতে চেয়েছে? এবার কিন্তু বিষয়টা অত্যন্ত জটিল হয়ে উঠছে!”
বিশাল এই কক্ষের দেওয়ালগুলিতে অজস্র চিত্র আঁকা। আবার লিপিও রয়েছে জায়গায় জায়গায়। উৎসাহভরে অগস্ত্য দেখলেন- লিপিগুলির মধ্যে ভারতীয় সিন্ধু, আর্য, খরোষ্ঠী, ব্রাহ্মী, প্রাকৃত বা পালি যেমন রয়েছে, তেমনি আবার হিয়েরোগ্লাফিক, কিউনিফর্ম পুরোন যুগের চাইনিজ বা জাপানিজ চিত্রলিপিও তেমনি উজ্জ্বলভাবে উপস্থিত; কিছু কিছু লিপি আবার অগস্ত্যর সম্পূর্ণ অচেনা। কতগুলি ভাষায় এই দেওয়াল-গ্রন্থাগার তৈরি কে জানে?
তবে আসল বিষয়টি অগস্ত্য আবিষ্কার করলেন বিরাট এই কক্ষের মাঝামাঝি। কক্ষে আলো বলতে একটি বিষণ্ণ, লালচে-হলুদ আলো যা ঘরের প্রান্তপ্রদেশগুলির অন্ধকার তাড়াতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ! চারদিক তাকিয়ে দেখতে গিয়ে কক্ষের মাঝখানে চোখ পড়ল অগস্ত্যর, আর তখনই তিনি দেখতে পেলেন-
সেই তোরণ, সেই তার পাশে দাঁড় করানো ছোট আকারের গম্বুজ! তবে ছোটবেলায় যেটিকে দেখেছিলেন অগস্ত্য, এগুলি সেরকম নয়, এগুলি আকারে যেন আরও বড়! ফ্যালফ্যাল করে সেদিকে তাকিয়ে ছিলেন অগস্ত্য; তারপর অদৃশ্য কোন এক দুর্নিবার আকর্ষণে সেদিকে মনের অজান্তে পা বাড়াতে যাবেন, এমন সময়-
-“ওদিকে কি ব্যাপার বলুন তো?”
অগস্ত্যর হাত পিছন থেকে টেনে ধরেছিলেন লুইসি, এবারে তার কথামতন সেদিকে তাকালেন অগস্ত্য। দেখা গেল তাদের মুখোমুখি দেওয়ালের প্রায় শেষপ্রান্তে একটুকু ফাঁক দিয়ে বাইরের অন্ধকারে এসে ঠিকরে পড়ছে একসার উজ্জ্বল আলোকমালা!
-“ওদিকেও একটা দরজা আছে মনে হয়। চলুন, গিয়ে দেখি!”
পায়ে পায়ে দুজনে এগিয়ে এলেন দরজার সামনে; তারপর ভিতরে উঁকি মেরে দেখে থমকে গেলেন উভয়েই। এ কি অবাক কাণ্ড?
ঘরের ভিতরটা উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত; এত দুধসাদা, উজ্জ্বল সেই আলো যেন চোখ ঝলসে যায়, আর তার সাথে বেশ গাঢ় একটি কুয়াশার আস্তরণ যা আলোর ঔজ্জ্বল্যকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে হয়। এই কুয়াশার আস্তরণের মধ্যে বাইরে থেকে উঁকি মেরে দুজনে অস্পষ্টভাবে দেখতে পেলেন-
একটি লোকের পিছন দিক থেকে অস্পষ্ট একটি ছায়া! লোকটির দেহ সম্পূর্ণ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু আবছা ভাবে যা দেখা যাচ্ছে তাতে মনে হল অতি প্রাচীন এক পোশাক তার পরণে, যেন যাত্রাপালার কোন অভিজাত পৌরাণিক চরিত্র একই পোশাক পরে চলে এসেছেন বাস্তব জীবনে! কুয়াশার মধ্যে মনে হল তার কাঁধে একটি তূণীর, যাতে অনেকগুলি শর রাখা! লোকটি স্থির, কিন্তু তার দাঁড়াবার ভঙ্গীতে মনে হল পথ চলবার উদ্দেশ্যে এক পা বাড়িয়ে হঠাৎ স্থির হয়ে গেলে দেহভঙ্গী যেরকম হয়ে যায়, এরও যেন সেই একই অবস্থা! যেন পথ চলতে চলতে হঠাৎ কোন কারণে স্থির হয়ে গিয়েছে তার দেহ ;কিন্তু কেন?
-“ওর কি গায়ে তীর লেগেছে?”
লুইসির এই হঠাৎ-প্রশ্নে ভালো করে তাকিয়ে দেখেন অগস্ত্য- সত্যিই তো! লুইসির দৃষ্টিশক্তির প্রশংসা করতে হবে, এতটা দূর থেকে একচান্সে ঠিক দেখে ফেলেছেন উনি- বাস্তবিকই মনে হল লোকটির কোমরের পিছন দিক দিয়ে একটি তীর এসে তাকে যেন বিদ্ধ করেছে পাঁজরার নীচে! কিন্তু তীরবিদ্ধ অবস্থায় আহত, পৌরাণিক পোশাক পরা এই ব্যক্তিটি চলতে চলতে এরকম বেয়াড়াভাবে থেমে গেলেন কেন? ভুঁরু কুঁচকে সামনেই তাকিয়ে থাকলেন অগস্ত্য; গভীরভাবে একটা কিছু যেন চিন্তা করছেন তিনি।
-“হোয়াই ডাস হি স্টপ? লেম্মি সি-”
এই বলে এক পা এগিয়ে গিয়েছিলেন লুইসি, কিন্তু হঠাৎ পিছন থেকে অগস্ত্য এক হ্যাঁচকা টানে তাকে সরিয়ে নিয়ে আসেন দরজার সামনে থেকে! অবাক হয়ে লুইসি তাকিয়ে থাকেন তার দিকে।
-“দাঁড়ান!”
দরজার কোণায় একখণ্ড কাঠের টুকরো পড়ে ছিল; কোন কিছুর ভাঙা টুকরো হবে বোধহয়। এখন সেটিকে তুলে নিয়ে লুইসির দিকে একবার তাকালেন অগস্ত্য, তারপর কাঠের ছোট টুকরোটি সজোরে ছুঁড়ে মারলেন ঘরের ভিতরে থাকা লোকটির দিকে। আর তা করতেই-
দেখা গেল- দরজার ওপারে কুয়াশার বৃত্তের মধ্যে কাঠের টুকরোটি প্রবেশের পর সেটি কিন্তু আর মাটিতে পড়ল না; একভাবে বাতাসেই স্থির হয়ে ভেসে রইল সেটি! দৃশ্যটি এতটাই অপ্রত্যাশিত ও অদ্ভুত যে সেদিকে হাঁ করে তাকিয়ে থেকে নির্বাক হয়ে রইলেন দুজনেই!
-“এ ক-কি ব্যাপার হল অগুস্টা?”- অবশেষে কোনমতে সামলিয়ে উঠে বললেন লুইসি- “ঘরের ভিতর কি জিরো-গ্র্যাভিটি করে রাখা আছে না কি? কাঠের টুকরোটা ভেসে রয়েছে কেমন করে? ভাগ্যিস আমাকে পিছন থেকে আটকালেন, নাহলে তো আমিও এতক্ষণে ভিতরে আটকে-”
-“এটা মোটেও ‘জিরো-গ্র্যাভিটি’র ব্যাপার নয় লুইসি…খেয়াল করে দেখুন, লোকটির পা কিন্তু মাটিতেই, মানে এখান থেকে দেখে যা মনে হচ্ছে…এ অন্য ব্যাপার! আমার ধারণা-”
এই পর্যন্ত বলে চুপ করে গেলেন অগস্ত্য। বিষয়টা এতটই অবাস্তব যে উপযুক্ত প্রমাণ না পেলে এই বিষয়ে মুখ খোলাই উচিৎ নয়। লুইসি তখনও বড় বড় চোখ মেলে তাকিয়ে রয়েছেন ভেসে থাকা কাঠের টুকরোটির দিকে; এবার তাকে ডেকে দুজনে পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ালেন বাইরের বিরাট কক্ষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা সুবিশাল তোরণটির সামনে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আমাদের ব্লগগুলি আপনাদের কেমন লাগছে? অবশ্যই জানান আমাদের-