-“পুরো ক্যাম্পের দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল সার্জেন্ট
বরাট ও তাঁর টিমের ওপর। আমাদের ওপর দায়িত্ব ছিল মূলতঃ গবেষকদের নিরাপত্তা ও তাদের সঙ্গে
বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সহযোগিতা। এইভাবেই কাজ চলছিল। ৬ই অগাস্ট রাত্রি ১১:০০টার পর প্রকৃতির
ডাকে সাড়া দিয়ে ফিরবার সময় হঠাৎ খেয়াল করলাম-”
-“এক মিনিট!”- গম্ভীর গলায় বাধা দিয়ে কথা বলে উঠলেন
মেজর ডাম্বলে- “আপনার হাতে অস্ত্র ছিল সেই সময়?”
-“আজ্ঞে হ্যাঁ। নিরাপত্তাজনিত কারণে আমাদের বলাই
ছিল রাত্রে কোন প্রয়োজনে অন্ধকারের দিকে যেতে হলে সঙ্গে অস্ত্র রাখতেই হবে। আমি সেই
নির্দেশ পালন করি মাত্র।”
-“বেশ। তারপর বলুন।”
-“ফেরবার সময় সার্জেন্ট বরাটকে ঐরকম সতর্ক পদক্ষেপে
কাঁচের দেওয়ালের দিকে সশস্ত্র অবস্থায় এগিয়ে যেতে দেখে আমি থমকে দাঁড়াই। প্রথমে ভেবেছিলাম
সকলকে সতর্ক করি; কিন্তু কৌতুহলী হয়ে পড়েছিলাম উনি কি করেন সেটা দেখবার জন্য। তাই আমি
ওঁনার পিছু নিই। এবং বেশ খানিকক্ষণ পর বুঝতে পারলাম ওঁনার গন্তব্যস্থল আমি যা ভেবেছিলাম,
তাই! উনি কাঁচের দেওয়াল লক্ষ্য করে এগিয়ে গেলেন; আমি একটি মাঝারি আকারের পাথরখণ্ডের
পিছনে ‘কভার’ নিয়ে বসে পড়লাম।
এর পরের ঘটনাগুলি এত তাড়তাড়ি ঘটে গেল যে আমি অন্য
কিছু আর গুছিয়ে ভাববার সময়ই পাই নি! সার্জেন্ট দেওয়ালের সামনে থমকে দাঁড়িয়ে বোধ হয়
ভাবছিলেন এর পরে কি করা যায়; কিন্তু বেশিক্ষণ সেই চিন্তা তাঁকে করতে হয় নি। ডাঃ আগাশে
এখানে আছেন; তিনিও আশা করি আমার বক্তব্যের সঙ্গে একমত হবেন যে দেওয়ালের অপর প্রান্তটি
কিরকম যেন কুয়াসাচ্ছন্ন, যেন একটা গাঢ় কুয়াসা ঘিরে রয়েছে জায়গাটিকে, ভিতরটা ঠিক যেন
পরিষ্কার দেখা যায় না-”
ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালেন ডাঃ আগাশে। আমি বলতে লাগলাম-
-“এইভাবে দাঁড়িয়ে আছি আমরা দুজনই কাঁচের দেওয়ালের
এপাশে; উনি একেবারে দেওয়ালের সামনে, আমি অনেকটা পেছিয়ে একটি পাথরের আড়ালে। হঠাৎ দেখি,
সামনের অন্ধকার আর কুয়াসা ফুঁড়ে যেন বেরিয়ে এল দুটি মূর্তি। ভালো করে দেখে বুঝলাম,
যে প্রাণীগুলির মৃতদেহ আমরা এর আগে উদ্ধার করেছি, এগুলি সেই একই প্রজাতির প্রাণী! কিরকম
এটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে, আমার হাতের অ্যাসল্ট রাইফেলের লক্ খুললাম
যাতে দরকারে দ্রুত গুলি চালাতে পারি। তবে সত্যি বলতে কি, আমি ঢের বেশি অবাক হয়েছিলাম
সার্জেন্ট বরাটের অভিব্যাক্তি দেখে!
উনি কিন্তু ঠায় দাঁড়িয়েছিলেন মূর্তিদুটির দিকে
তাকিয়ে; এবার মূর্তিদুটি ইশারায় তাঁকে ডাকতেই তিনি যেন মন্ত্রমুগ্ধের মত এগিয়ে গেলেন
সামনের দিকে। আর বসে থাকতে পারলাম না; ওনাকে আটকাবার চেষ্টায় এগিয়ে গেলাম আড়াল ছেড়ে,
একেবারে ওঁনার কাছেই, কিন্তু আমি তাঁর কাছে পৌঁছবার আগেই উনি কাঁচের দেওয়াল ফুঁড়ে ঢুকে
গেলেন ভিতরে, আমি ওঁনার পিছনে দাঁড়িয়ে থেকেও ওঁনাকে আটকাতে পারলাম না!
এবারে আসি সবচেয়ে অদ্ভুত অংশটায়। প্রথমবার প্রাণীদুটিকে
একপলক দেখবার পর সার্জেন্ট বরাটকে এগিয়ে যেতে দেখেই আমি দৌড় দিয়েছিলাম ওঁনাকে থামানোর
জন্য; আমার দৃষ্টি ছিল সার্জেন্ট বরাটের দিকে। কিন্তু তারপর আমি যখন ফিরে তাকালাম প্রাণীদুটির
দিকে- চোখের সামনে আমি কোন বিকটদর্শন জানোয়ার দেখতে পাই নি, হা ঈশ্বর! সেখানে তখন দাঁড়িয়ে
সুলেখা ম্যাডাম ও অঙ্কুশ- সার্জেন্ট বরাটের মৃত স্ত্রী ও পুত্র!”
-“প্রথমবার আপনি যখন পাথরের আড়ালে ছিলেন, তখন কাঁচের
দেওয়াল থেকে কত দূরে ছিলেন আপনি?”- সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে প্রশ্নটি করলেন ডাঃ আগাশে;
এই প্রথম প্রশ্ন করলেন তিনি।
-“তা প্রায়…ত্রিশ-চল্লিশ ফুট তো বটেই!”
-“আর দ্বিতীয় বার?”
-“একেবারে সামনেই। দুই-আড়াই ফুট।”
-“হুমম…বলে যান।”
একটি ছোট নোটবই খুলে কথাটি টুকে নিলেন ডাঃ আগাশে;
সেদিকে তাকিয়ে একটু দম নিয়ে নিলাম। এর পরের ঘটনাগুলি এত পৈশাচিক ও শ্বাসরোধকারী যে
তা ভাবলেও আমার হাড় হিম হয়ে আসে; আর এখন তো বলা! জানি না কতটা গুছিয়ে বলতে পারব।
-“সার্জেন্ট বরাট দেওয়াল ভেদ করে অপর প্রান্তে
পৌঁছে হাঁটতে হাঁটতে তাঁর মৃত পরিবারের একেবারে সামনে দাঁড়ান। আনন্দের অভিব্যক্তিগুলি
পরিষ্কার ধরতে পারি আমি, যদিও কাঁচের দেওয়াল অতিক্রম করবার সাহস আমার হয় নি। দূরে দাঁড়িয়ে
দেখছিলাম পুরো বিষয়টা। উনি সামনে দাঁড়াতেই সুলেখা ম্যাডাম আনন্দে প্রথমে জড়িয়ে ধরেন
ওঁনাকে। তারপর পিছন দিকে একবার তাকিয়ে দেখেন- যেন কাউকে দেখতে চাইছেন অন্ধকারের মধ্যে।
তারপর-”
চুপ হয়ে গেলাম আমি। বোধহয় দৃশ্যের ভয়াবহতার কথা
স্মরণ করেই।
-“তারপর?”- অধৈর্য্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন মেজর ডাম্বলে।
খানিক অস্বস্তি নিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে তারপর আবার বললাম-
-“ম্যাডাম যখন মুখ সামনের দিকে ঘোরালেন, তখন সম্পূর্ণ
পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে সেই মুখ! বিরাট হাঁ, ওপরে-নীচে দুটি করে মোট চারটি তীক্ষ্ণ শ্বদন্ত,
আর বিকট মুখব্যাদান নিয়ে তিনি সরাসরি কামড়ে ধরলেন সার্জেন্ট বরাটের গলা! আর তাদের
‘ছেলে’? তারও আকৃতি পরিবর্তিত হয়ে ফিরে এল সেই আগের প্রাণী, সে আঘাত করল সার্জেন্ট
বরাটকে! পড়ে গেলেন সার্জেন্ট বরাট, আর তাঁর শায়িত দেহটিকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে লাগল দুইজনে;
পিছনের অন্ধকার থেকে লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে এল আরও সাত-আটজন, প্রত্যেকে তাঁকে ঘিরে ধরে
মাংস খেতে লাগল তাঁর!
চোখের সামনে এই ভয়ংকর দৃশ্য দেখে সৈনিকের সাহস
আবার ফেরৎ এল আমার। একটি প্রবল চীৎকার দিয়ে উঠলাম; হাতের বন্দুক তৈরিই ছিল- শুরু করলাম
এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে। আমার চীৎকার আর গুলিবর্ষণের শব্দ বোধ হয় ক্যাম্পের লোকজনেরও
কানে পৌঁছেছিল; একটু পরেই সকলে দৌড়ে আমার পাশে চলে এসে গুলি চালাতে শুরু করল সামনের
দিকে। রাক্ষসগুলির কয়েকটা ওখানেই মরে ভূত হয়ে পড়ে রইল; বাকি দু-চারটে লাফাতে লাফাতে
মিলিয়ে গেল অন্ধকারে, কুয়াসার অন্তরালে!
এই কাহিনির শেষ এখনো হয় নি। সব চুকে যাওয়ার পর
এইবার আমরা যখন দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে শলা-পরামর্শ করছি সার্জেন্ট বরাটের দেহ আনতে
‘চক্রব্যূহে’ ঢুকব কি না- ঠিক সেই মুহুর্তে ঘটল একটি অদ্ভুত বিষ্ময়! কাঁচের দেওয়ালটি
এতক্ষণ নিষ্প্রভ ছিল; এইবার দেখা গেল পুরো দেওয়ালটি জুড়ে একটি চতুষ্কোণী আয়তক্ষেত্রাকার
অঞ্চলে আলোর খেলা! সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তেই লাগল সেই আলোর তেজ!
-“পালাও এক্ষুণি! এ নিছক আলো নয়, শক্তিপুঞ্জ ফাটল
বলে!”
আমরা সম্মোহিতের মত তাকিয়ে দেখছিলাম সেই আলোর খেলা;
ডাঃ আগাশের আর্তনাদ শুনে সম্বিৎ ফিরল আমাদের। দুজন জওয়ান একপ্রকার কাঁধে তুলে নিল ডাঃ
আগাশেকে, তারপর সকলেই দৌড় লাগালাম দ্বীপের প্রান্তভূমিতে, জলের দিকে। কোনমতে একটানা
উসেইন বোল্টের মত দৌড়ে জল অবধি পৌঁছতে পেরেছিলাম আমরা; অন্ধকার তখন কোথায়? পুরো জায়গাটি
তখন রাত্রির অন্ধকারেও দিনের আলোর মতন আলোকিত!
স্পীডবোটে সকলে উঠে একটুখানি এগিয়ে যেতে না যেতেই
বিকট এক বিস্ফোরণ! ঢেউয়ের বেগ সামলাতে না পেরে একটি নৌকো উল্টে যায়, এত ভয়ংকর ছিল সেই
বিস্ফোরণের অভিঘাত! যাই হোক, আলো-শব্দ-উত্তেজনা- সব প্রশমিত হওয়ার পর আমরা দেখলাম,
পিছন দিকের জঙ্গলের গাছগুলি আগুনে দাউদাউ করে জ্বলছে! একটিই শুধু খেদ থেকে গেল- তাড়াহুড়ায়
আমরা সার্জেন্ট বরাটের দেহটি আনতে পারলাম না! সেটি কিন্তু রয়েই গেল ঐ অভিশপ্ত দ্বীপে।”
এই পর্যন্ত বলে থেমে গেলাম আমি। অবসাদে ও বেদনায় গলা বসে গিয়েছিল প্রায়; যাই হোক, শেষ অবধি বিবরণটা শেষ করতে পারলাম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। কিছু বাদ পড়ে গেল কি না কে জানে? টেবিলের উল্টোদিকে বসে দুইজনই মনোযোগ দিয়ে শুনলেন আমার কথা, তারপর ডাঃ আগাশে কথা বলে উঠলেন-
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আমাদের ব্লগগুলি আপনাদের কেমন লাগছে? অবশ্যই জানান আমাদের-