The Legacy of Ram- Prologue Part1 (দ্যা লেগ্যাসি অফ্ রাম- আদি পর্ব- প্রথম অধ্যায়) - A Bengali science fiction suspense story on Indian Mythology
দ্যা লেগ্যাসি অফ্ রাম- আদি পর্ব (The Legacy of Ram- Prologue): প্রথম অধ্যায়
-A Bengali Science fiction story by Aritra Das
The Legacy of Ram: Prologue |
দ্যা লেগ্যাসি অফ্ রাম প্রসঙ্গে কিছু কথা:
'দ্যা লেগ্যাসি অফ্ রাম' উপন্যাসসমগ্রটি পাঁচটি খণ্ডে বিভক্ত একটি অমনিবাস যার ভিত্তি সম্পূর্ণভাবে কাল্পনিক, এর সঙ্গে বাস্তবে মহাকাব্যের সাথে কোন মিলই নেই। এই উপন্যাসসমগ্রটি তৈরি হয়েছে এমন একটি সময়কালকে ভিত্তি করে যখন পৃথিবীতে মানুষ তার আদিম লগ্নে ছিল, তারা বিচরণ করত তাদের পূর্ববর্ত্তী উন্নত সভ্যতাগুলির সাথে- সময়ের সাথে সাথে যারা সরে যান প্রেক্ষাপট থেকে। এবং...দেবতারা...তাঁরা নেমে আসতেন পৃথিবীর বুকে, তাদের নির্মাণ করা প্রজাতিগুলির সাথে কথা বলার বাসনায়। কিন্তু কি ঘটল যার ফলে দেবতারা সরে গেলেন নেপথ্য থেকে, আর বিলুপ্ত হয়ে যেতে হল সেই উন্নততর প্রজাতিগুলিকে, পিছনে তাঁদের অস্তিত্বের প্রমাণ কিছু প্রাচীন ধ্বংসস্তুপ ও অজস্র গল্পগাঁথা ফেলে রেখে? কিভাবে ঘটল সেই গণবিলুপ্তি? দেবতা ও অসুরদের লক্ষাধিক প্রাচীন দ্বন্ধই কি এই সরে যাওয়ার পিছনে নেপথ্য কারণ? এই সকল প্রশ্নের উত্তর খোঁজার একটি কল্পিত উপাখ্যান, যা হয়তো পরবর্ত্তী ক্ষেত্রে জন্ম দেবে আরও শত সহস্র অনাদি প্রশ্নের। এই কাল্পনিক উপন্যাসের সময়কাল মহাকাব্যের পরে নয়, মহাকাব্যের আগে।
আজ থেকে শুরু হল এই উপন্যাসসমগ্রের প্রথম খণ্ড- 'আদি পর্ব'। আজ এর প্রথম অধ্যায়। ধারাবাহিক আকারে এই সমগ্র খণ্ডটি তুলে ধরা হবে এখানে। আপনাদের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ- কেমন লাগছে তা অবশ্যই মন্তব্যের আকারে জানাবেন আমাদের। নমস্কার।
পড়ুন লেগ্যাসি অফ্ রাম প্রসঙ্গে আমার কিছু কথা
দ্যা লেগ্যাসি অফ্ রাম: আদি পর্ব- প্রথম অধ্যায়
[খণ্ডচিত্র-১: একটি ঘৃণার জন্ম]
(গন্ধর্ব সভ্যতার সমসাময়িক কোন একটি সময়)
চারিদিকের চারটি
নাতিউচ্চ পাহাড়ের ঘেরাটোপে আটকে পড়া মাঝখানের এই সমতল ক্ষেত্রটির চারিদিকে তখন মৃত্যুর
উষরতা। মাথার ওপর তখন চক্রাকারে পাক খাচ্ছে শকুনের দল; ধূসর মালভূমির এই পার্বত্যময়
অংশটিতে মূলতঃ এদেরই রাজত্ব। এছাড়াও অন্যান্য প্রজাতির মাংসভূক পাখিরাও আছে এই দলে।
এরা অবশ্য কেউই চুপচাপ ছিল না এতক্ষণ ধরে, প্রত্যেকেই এরা ব্যস্ত ছিল এতক্ষণ মৃতদেহ
থেকে মাংস খুবলে খেতে! কিন্তু আচমকাই দোপেয়েদের একটা দল এসে পড়ায় ব্যস্ত হয়ে মুখের
খাবার ফেলে পালাতে হয় এদের; মুখ দিয়ে কর্কশ স্বরে তীব্র আপত্তি জানাতে জানাতে। উঠে
পড়ে তারা সাধের প্রান্তরটিকে ছেড়ে, খোলা আকাশের নিরাপদ দূরত্বে।
সবথেকে কাছের
নাতিদীর্ঘ পাহাড়ের মাথাটি কিন্তু অন্যান্য পাহাড়ের মত সূঁচোল নয়, বরং হঠাৎ দেখলে মনে
হবে যেন কেউ পাহাড়ের মাথাটি কেটে একটা সমতল ক্ষেত্রের মুখ দিতে চেয়েছে। এই অংশেই দেখা
গেল এক রাজপুরুষ ও তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন অঙ্গরক্ষককে। তাদের সকলেরই দৃষ্টি
ছিল সামনের সমতল ক্ষেত্রটির দিকে, হয়তো সেখানে কিছু খুঁজছিলেন তাঁরা; কিন্তু, কি?
সেখানে অবশ্য
দেখবার মত আর কিছু অবশিষ্ট ছিল না। মাথার ওপর সূর্যও তখন ঘন মেঘের আশ্রয়ে- চারিদিকের
পড়ন্ত, মরা আলোয় যা চোখে পড়ে তা কেবলই একটা একটানা মৃতদেহের সারি! পচা-গলা, সদ্যমৃত
– সব ধরণের মৃতদেহ সেই সারিতে। কোথাও একলা একটি মৃতদেহ, কোথাও তিন-চারজন একসাথে মরে
একটা স্তুপ রচনা করে শুয়ে রয়েছে – বিভিন্ন ভঙ্গিমায়, বিভিন্ন অবস্থানে অন্তিম শয়ানে
শায়িত সকলেই। মড়া রৌদ্রের বিষন্ন আলোয় ভয়ংকর এক পরিবেশ! পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ
নীচের দৃশ্যপট – মৃত্যুই একমাত্র সদাসত্য বাস্তব! খুব সম্ভবতঃ, কেউই আর বেঁচে নেই নীচের
দূর্ভাগাদের দলে।
-“আদেশ করুন,
মহারাজ!”-মহারাজের কাছে এগিয়ে এল এক প্রহরী।
-“এখানে একটি
সন্ধানী আলো বসাও। ভালো করে বোধগম্য হচ্ছে না কিছু। সন্ধানী আলো ফেলে দেখ কাউকে জীবিত
দেখা গেল কি না! মৃতদেহগুলি জায়গায় জায়গায় এরকম স্তুপাকৃতি হল কিভাবে? কে করেছে এই
ঘৃণ্য কাজ?”
কিছুকাল চুপ
করে থাকল প্রহরী; তারপর বলল-
-“এরা নিজেরাই,
মহারাজ! প্রচণ্ড ক্ষুধায় শেষপর্যন্ত যুঝতে না পেরে যখন এরা বুঝল মৃত্যু আসন্ন, তখন
শেষবিদায় নেওয়ার জন্য এরা একে অপরের সান্নিধ্যে আসবার চেষ্টা করেছিল। কয়েকজন সমর্থ
হলেও, বেশিরভাগই অবশ্য অসমর্থ, অকৃতকার্য হন! তাঁরা পথমধ্যেই শ্রান্তিতে মৃত্যুর কোলে
ঢলে পড়েছেন। মৃতদেহগুলি জায়গায় জায়গায় গাদাগাদি হয়ে থাকবার এটিই সবচেয়ে বড় কারণ।”
অনুতপ্ত চোখে
সামনের দৃশ্যপটের দিকে তাকিয়ে থাকলেন রাজপুরুষটি, তিনি মহারাজ শান্তনু। সত্যিই বড় করুণ
দৃশ্য, ভাবলেই চোখে জল এসে যায়; দেখলে পরে তো কথাই নেই! ভাবা যায়? ক্ষুধায় কাতর কঙ্কালসার
কয়েকটি দেহ বুকে হামাগুড়ি দিয়ে পরস্পরের সান্নিধ্যে আসতে চেয়েছিল; এইটুকুনই তো মোটে
অন্তর একে অপরের থেকে, সেটাও অতিক্রম করা গেল না! ক্ষুধা কি নির্মম, ভয়ংকর, জান্তব
সত্য! ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে শেষ মুহুর্ত অবধি এরা সৌজন্যতার সীমা অতিক্রম করেন নি; মহামাংস
ভক্ষণ করে নিজেকে নামিয়ে আনেন নি পশুদের স্তরে!
একটি দীর্ঘশ্বাস
বেরিয়ে এল মহারাজ শান্তনুর বুক থেকে – এড়ানো যেত; এই অকারণ মৃত্যুমিছিল এড়ানো যেত!
কিন্তু গন্ধর্ব প্রজাতির ক্রমবর্ধমান লোভ ও লালসাই ডেকে এনেছে এই মহামারীকে, নিজের
ঘরে! যখন এই ঘটনা ঘটছে, তখন তাকে প্রতিহত করবার সামর্থ্য তাঁর ছিল না; আর যখন সামর্থ্য
এল তখন মৃত্যু তার প্রভাব বিস্তার করে চলে গেল তাঁকে আকন্ঠ পাপবোধে নিমজ্জিত করে। ওপরে,
মেঘের আড়ালে থাকা সূর্যের দিকে একবার তাকালেন মহারাজ শান্তনু – “যদি একজনকেও বাঁচানো
যেত!”- মনে মনে স্বগতোক্তি করে উঠলেন তিনি।
কিংবদন্তী ‘ইক্ষকু’বংশের
একটি শাখা ‘চন্দ্রবংশ’। এই বংশ পরবর্তীকালে তার সর্বাধিক সফল রাজপুরুষের নামে পরিচিত
হয় ‘কুরুবংশ’নামে। এই বংশেরই নবীনতম এবং বর্তমান রাজা মহারাজ শান্তনু। পিতা দর্পের
মৃত্যুর পর রাজবংশ তথা সিংহাসনের পরবর্ত্তী প্রজন্ম। বংশের নাম পরিবর্তন হয় বটে, কিন্তু
একটি মৌলিক বিষয় অক্ষুণ্ণই থাকে – তা হল পশ্চিমে বৈতরণী নদীর ওপারে থাকা পাঞ্চালদের
সঙ্গে মতবিরোধ; কালের সদা-প্রবাহমানতার নিরিখে যার ধরণের আমূল পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে।
সবথেকে আগে যে
জিনিষটির পরিবর্তন ঘটে তা হল, গন্ধর্বদের জীবনদর্শন ও মূল্যবোধ। অতীতের পারষ্পরিক বিবাদ
যা মূলতঃ কলহ বা ছোটখাটো কিছু হাতাহাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত, বর্তমানে তাই এসে ঠেকেছে
মরণপণ যুদ্ধে। অতীতের শান্তিপ্রিয় গন্ধর্ব প্রজাতি আজ রক্তলোলুপ, আগ্রাসী ও লোভী জাতিতে
পরিণত! অবশ্য,জীবনযাত্রার সামগ্রিক মান এখন উন্নত; নিন্দুকেরা অবশ্য বলে প্রযুক্তির
ওপর এই অকারণ, সর্বাঙ্গীন ভরসা গন্ধর্বদের জীবনযাত্রাকে জটিল করে তুলেছে মাত্র – যদিও
সিংহভাগ গন্ধর্ব এই তত্ত্ব মানতে গররাজি। মোটের ওপর, সমস্ত তর্ক-বিতর্কের উর্দ্ধে উঠে
বলা যায়, একদিকে বিজ্ঞান যত অঙ্গীভূত হয়েছে গন্ধর্বদের শিরায়-উপশিরায়, অপরদিকে সামাজিক
মূল্যায়ণগুলির মান কমেছে বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্কে। গন্ধর্বরা
আজ আর কোন আঞ্চলিক, উপজাতিভিত্তিক গোষ্ঠী নয়, তারা এখন পাড়ি জমাতে সক্ষম মহাবিশ্বের
অন্যত্রও, সীমিত স্তরে, দেবতাদের আশীর্বাদে। -‘আমরা যদি দেবতাদের মতই সবকিছু করতে সক্ষম,
তবে দেবতাদের প্রয়োজন আর কিসে’- এই হল চুম্বকসারে বর্তমান গন্ধর্ব নীতি। এই মানসিকতারই
প্রতিফলন গন্ধর্বদের অন্তরে।
এই আগ্রাসী মানসিকতারই
চরম প্রতিফলন ঘটেছিল মহারাজ দর্পের আমলে। পাঞ্চালদের সঙ্গে প্রাচীনতম এই বিরোধ তিনি
নিষ্পত্তি করতে চেয়েছিলেন এককথায় – পাশবিকতার হাত ধরে। পাঞ্চালরা বর্তমানে একটু দূর্বল
অবস্থানে ছিলেন; মহারাজ সৃঞ্জয়ের মৃত্যুর পর তাদের বংশে আর কোন সুদক্ষ রাজা জন্মগ্রহণ
করেন নি যিনি বংশকে চালনা করবেন বিচক্ষণতার সঙ্গে। সুযোগ বুঝে মহারাজ দর্প অবশ্য যে
কীর্তিটা করলেন তা এককথায় ন্যক্কারজনক – সামান্য এক ছুতোয় একটি পাঞ্চালবংশ আক্রমণ করে
অধিকার করে বসলেন তিনি। তবে, তাঁর এর পরের কীর্তিটি আরও জঘন্য, নারকীয়!
প্রথমে সদ্য
অধিকৃত পাঞ্চাল রাজ্যটির একশ জন ভাইকে বন্দী করা হয়েছিল এবং কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছিল।
কিন্তু, তাঁর ক্রুর ও নিষ্ঠুর বুদ্ধির ছাপ তিনি রাখলেন এই সিদ্ধান্তে। কোন সাধারণ কারাগারে
এই একশজন ভাইকে না রেখে তাদেরকে এনে রাখা হয়েছিল চারিদিক নাতিউচ্চ পাহাড়ে ঘেরা মধ্যিখানের
সমতল এই উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে। চারটি পাহাড়ের মাথাতেই প্রহরার ব্যবস্থা করেন তিনি, যাতে
কেউ পালাতে না পারে এই জায়গাটি থেকে। রোদে পুড়ে, জলে ভিজে আস্তে আস্তে মৃত্যু এসে গ্রাস
করে নেবে সকল বিরোধী রাজপুত্রদের – এই ছিল তাঁর মনোগত অভিপ্রায়।
কিন্তু অদ্ভুত
কড়া জীবন এই রাজপুত্রদের! ঝড়-জল মাথায় নিয়েও দিব্যি বেঁচে রইলেন এঁরা! এ তো সরাসরি
রাজদ্রোহীতা! দর্পের মত একজন প্রবল পরাক্রান্ত রাজার সিদ্ধান্তের মুখের ওপর এ যেন প্রবল
চপেটাঘাত! সিদ্ধান্ত নিলেন মহারাজ দর্প। এবারে অন্য ঔষধ। প্রহরীদের ডেকে আদেশ দিলেন
তিনি – এখন থেকে একজন বন্দীর সমপরিমান খাদ্য বণ্টন করা হবে একশজন ভাইয়ের মধ্যে! এইভাবে
দিনের পর দিন তিলমাত্র খাদ্যগ্রহণ করে দেখি কতক্ষণ বেঁচে থাকে ব্যাটারা!
সৌভাগ্যের বিষয়,
তাঁর এই গবেষণার কোন প্রত্যক্ষ ফললাভের আগেই ৺গঙ্গাপ্রাপ্তি হয় মহারাজ দর্পের। মারা
যান তিনি, তাঁর জায়গায় স্থলাভিষিক্ত হন শান্তনু; আমাদের পূর্ব পরিচিত এই রাজপুরুষটি।
পিতার এ হেন
মতবাদকে কোনদিনই অবশ্য সমর্থন করেন নি মহারাজ শান্তনু; তিনি বরাবর হিংসার পরিপন্থী।
যদিও পিতার কোনপ্রকার সিদ্ধান্তকেই তিনি কোনদিন আটকানোর চেষ্টাও করেন নি; দুএকবার ক্ষীণ
প্রতিবাদ করা ছাড়া। তিনি জানতেন, প্রতিবাদ এক্ষেত্রে নিস্ফল। মহারাজ দর্পের মাথাটি
ছিল পাথরের মত শক্ত ও অনমনীয়; একবার তিনি যা ভাবতেন তা তিনি করতেনই। পিতা অবশ্য সব
ব্যাপারই নিজের এই পুত্রটির কাছে খোলসা করতেন না; উক্ত পাঞ্চাল প্রদেশ আক্রমণ সংক্রান্ত
বিষয়টি যেমন তিনি সম্পূর্ণ চেপে গিয়েছিলেন শান্তনুর কাছে।
এই কারণেই, সমগ্র
বিষয়টি জানতে পেরেই দৌড়ে এসেছেন শান্তনু; অনির্বার্য দূর্দৈব ঠেকাতে, এই অকারণ মৃত্যুমিছিল
বন্ধ করতে। কিন্তু, বোধ হয় দেরি হয়ে গেল আসতে।
-“মহারাজ! শীঘ্র
ওদিকে দেখুন! মনে হয়…ওটা কি? হাত?”
-“কোথায়?”
সন্ধানী আলোর
তীব্র ছটা ঘুরে গেল অদূরে বিক্ষিপ্ত কিছু মৃতদেহের স্তুপের দিকে। মৃতদেহগুলি ওখানে
গাদাগাদি করে একটা স্তুপের চেহারা নিয়ে রয়েছে; তার ওপর সন্ধানী আলো এসে পড়তেই দেখা
গেল – ভিতর থেকে বাইরের দিকে উঁচিয়ে রয়েছে একটি হাত, একটিই মাত্র ডান হাত! আকাশের দিকে
তোলা, দৃঢ় মুষ্টিবদ্ধ! যদিও ঐ একটিমাত্র হাত ছাড়া শরীরের বাকি অন্য অংশ আর দেখা যাচ্ছে
না; দেহের বাকিটা চাপা পড়ে আছে মৃতদেহের স্তুপে।
-“সেবক! কিছু
প্রহরী নিয়ে ওকে বহন করে শিবিরে নিয়ে যাও; খাদ্য ও পানীয় দিয়ে সুস্থ করে তোল ওকে। মনে
রেখ, ও কিন্তু একজন রাজপু- ও কি?”
অনেকক্ষণ ধরেই
মেঘ করেছিল আকাশে, এবার তার থেকে একটি বজ্রপাত ঘটল পূর্বদিকের পাহাড়ের মাথায়। বিকট
শব্দ ও আলোর ঝলকানি খানিক্ষণের জন্য স্থবির করে তুলল প্রত্যেককে।
-“ঝড়-বৃষ্টি
শুরু হল বলে; যাও, আর বেশি দেরি কোর না। ওকে নিয়ে এস। একদল প্রহরী নিয়ে ভাষ্কর, তুমি
চলে যাও পূর্বদিকের পাহাড়ে। দেখ, কেউ হতাহত হল কি না! আর সকলকে খবর পাঠিয়ে দাও পাহাড়ের
মাথা থেকে নেমে আসতে, এখানে আর কোন প্রহরার দরকার নেই। সকলকেই বল নীচে নেমে আসতে। যাও!”
সকলেই দৌড়ে গেল
যার যার অভীষ্ট কর্মে, মহারাজ শান্তনুর আদেশ মাথায় নিয়ে।
***********************************************************************************
-“আমরা এখন কি
দেখছি. ভাষ্কর?”- নিজের প্রধান অঙ্গরক্ষক ও সদা-সহচর ভাষ্করের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন
মহারাজ শান্তনু।
কাঁচের প্রকাণ্ড
জানালার ঠিক অপর পারটিতেই সাক্ষাৎকার-কক্ষে একটি মেজের ধারে বসবার আসনে একাকী বসে উদ্ধার
হওয়া রাজপুত্র স্বয়ং; একশত ভাইয়ের মধ্যে একমাত্র ভাগ্যবান, যাকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব
হয়েছে। বাকিদের উদ্ধার করা যায় নি। তাঁরা সকলেই মৃত। অনাহার ও রোগভোগে পর্যায়ক্রমে
মৃত্যু হয়েছে বাকি সকলের। প্রশ্নটা এখানেই, এতগুলি ভাইদের মধ্যে একমাত্র এই ভাইটি বেঁচে
আছেন কি করে? তাও আবার প্রায় অক্ষত অবস্থায়? চোখের সামনে ভাইদের মৃত্যু দেখে এমনিতে
একটু মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হওয়া ছাড়া, এবং এক পায়ের ভাঙা গোড়ালি ছাড়া অপরাপর কোন উল্লেখযোগ্য
শারীরিক বৈকল্য কিছু ধরা পড়ছে না। কি করে সম্ভব হল এই অসম্ভব?
উদ্ধার হওয়া
এই ব্যক্তিটি বয়সে নবীন; হয়তো সদ্য তরুণ। অবিন্যস্ত চুল, চোখ-মুখ তীক্ষ্ণ, একমুখ দাড়ি,
বসবার ভঙ্গীটি দীর্ঘ ও ঋজু। বসবার আসনে বসে মেজের ওপর দুটি হাত রেখে ঠায়, প্রায় নিষ্পলক
হয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে বসে রয়েছেন তিনি; সেই দৃষ্টিতে কোন রাগ নেই, অভিমান নেই, ক্ষোভ-হিংসা-ঘৃণা
– কোন মানবিক অনুভূতিই নেই। তাকে হঠাৎ দেখলে মনে হবে কোন একটি যন্ত্রপুতুল বসিয়ে দিয়ে
গিয়েছে কেউ, ঘরের মাঝখানে – যার মধ্যে কোন মানবিক অনুভূতিই কাজ করে না।
-“অনেককিছু,
মহারাজ! নিশ্চিত না হওয়া অবধি অহেতুক আপনাকে বিব্রত করতে চাই নি। প্রথমতঃ, এর ভাইদের
সকলেই মৃত; কেউ আর বেঁচে নেই। দ্বিতীয়তঃ, বন্দী অত্যন্ত কম কথার লোক। বেশি কথা বলে
নি, কিন্তু মোটামুটিভাবে যা জানা গিয়েছে- ইনি হচ্ছেন এর ভাইদের মধ্যে সর্কনিষ্ঠ ব্যক্তি;
পাঞ্চালদের সঙ্গে যুদ্ধের পর এদের সকলকেই এখানে বন্দী করে আনা হয়েছিল প্রায় বছরখানেক
আগে, শেষ কটা দিন এরা এখানেই বন্দীজীবন কাটিয়েছিলেন একসঙ্গে। হিমালয় পর্বতমালার অপরপারে
বালুকাময় এক দেশ; সেখানকার রাজপুত্র ছিলেন এরা…”
-“গান্ধারপ্রদেশ?”
প্রশ্নটা করেই
ফেললেন মহারাজ শান্তনু। তিনি অবাকও কম হননি। মহাসৈন্ধব নদের অপরপ্রান্তে যে বিশাল পাঞ্চাল
সাম্রাজ্য তৈরী হয়েছিল তা যুগের সাথে সাথে বহুধা ধারায় বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বের
বিভিন্ন অংশে; কুরুবংশের মত অতটা না হলেও তাদের সাম্রাজ্যের আয়তনও নেহাত কম ছিল না।
এই পাঞ্চালদেরই একটি শাখা ‘গান্ধার’নাম নিয়ে শিকড় বসায় হিমালয় পর্বতমালার অপরপ্রান্তে।
বালি-পাথরের দেশ; কম জনসংখ্যার এই ভূখণ্ডকে আক্রমণ করবার পিছনে কোন কারণই খুঁজে পেলেন
না মহারাজ শান্তনু। প্রশ্নটা করেও বসলেন তিনি ভাষ্করকে, যদি আক্রমণের উপলক্ষ হিসেবে
কোন সূত্র বেরিয়ে আসে।
-“এরকম একটি
রুক্ষ, অনুর্বর ভূমিকে আক্রমণ করবার পিছনে আপাতদৃষ্টিতে কোন কারণ তো নেই ভাষ্কর! কিন্তু,
তাও আক্রমণ হল এবং এতবড় একটি হত্যাযজ্ঞ সম্পন্ন হল। কেন?”
-“এর উত্তর প্রয়াত
মহারাজের সঙ্গে চিতায় লীন হয়ে গিয়েছে, মহারাজ। ‘কারন’ হয়তো সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন;
অথবা- প্রয়াত মহারাজ হয়তো কোন মিথ্যা জনশ্রুতির পিছনে দৌড়েছিলেন। এরকমটি ঘটাও অসম্ভব
নয়।”
নিশ্চুপ হয়ে
গেলেন মহারাজ শান্তনু। বাস্তবিকই, এরকম ঘটা অসম্ভব কিছু নয়। যদিও তাঁর পিতা খুবই বাস্তববাদী
লোক ছিলেন, তার পক্ষে কি সম্ভব একটি কষ্টকল্পিত লোককাহিনীর পিছনে দৌড়ে এরকম পর্যায়ের
হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন করা? কথা ঘুরিয়ে ফেললেন তিনি-
-“বন্দী সম্পর্কে
আর কি জানা গিয়েছে?”
-“আরও দুটি চিত্তাকর্ষক
তথ্য পাওয়া গিয়েছে বন্দী প্রসঙ্গে, মহারাজ! তার মধ্যে প্রথমটিই বলি আগে? তিলমাত্র খাদ্যগ্রহণের
পরেও বন্দীর শারীরিক অবস্থার কোন পরিবর্তন হয় নি কেন তার একটি যুক্তিগ্রাহ্য কারণ খুঁজে
পাওয়া গিয়েছে-”
-“তাড়াতাড়ি ব্যক্ত
কর।”- অধৈর্য্য হয়ে বলে উঠলেন মহারাজ শান্তনু।
-“সীমিত খাদ্য
সরবরাহের নির্দেশ যেদিন থেকে দেওয়া হয় সেদিন থেকে সকল ভ্রাতারা একত্রে মিলিত হয়ে একটি
মর্মন্তুদ সিদ্ধান্ত নেন। তাঁরা বিলক্ষণ বুঝেছিলেন, এই তিলমাত্র খাদ্য গ্রহণে শেষ অবধি
প্রাণে কেউ বাঁচবেন না; দুদিন আগে বা পরে সকলকেই মৃত্যুবরণ করতে হবে, অচিরেই। তাই সন্মিলিতভাবে
তাঁরা এক অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নেন। যে খাদ্য একশজনকে দেওয়া হচ্ছিল, তা একশজনের হিসেবে
তিলমাত্র হলেও একজনের পক্ষে প্রয়োজনের থেকেও বেশি। তাই, নিরানব্বইজন ভ্রাতা খাদ্য পরিহার
করে প্রাণত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু একজন- অনুপাতটি মাথায় রাখুন মহারাজ- মাত্র
একজন ব্যক্তি সেই খাদ্যগ্রহণ করেন, ও জীবিত থাকেন…”
-“এই অদ্ভুত
সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য?”- চোয়াল শক্ত হয়ে এল মহারাজ শান্তনুর; কিছু একটি ব্যাপার কি
অনুমান করেছেন তিনি?
-“বন্দী উদ্দেশ্য
সম্পর্কে কিছুই বলেন নি পরিষ্কার করে। এ বিষয়ে তিনি কোন মন্তব্য করেন নি। তবে তিনি
বয়সে যেহেতু সর্বাপেক্ষা নবীন, এবং সর্বসন্মতিক্রমে তিনিই যখন নির্বাচিত হয়েছিলেন,
তাই এক্ষেত্রে ধরেই নেওয়া যেতে পারে অনুজের বয়সের প্রতি অগ্রজরা সকলেই সহানুভূতিশীল
ছিলেন-”
এই পর্যন্ত বলে
চুপ করে গেলেন ভাষ্কর; তিনি আজন্ম মহারাজ শান্তনুর পার্শ্বচর, তিনি জানেন কখন চুপ করে
যেতে হয়।
-“চোখের সামনে
যা দেখা যাচ্ছে তা নাও হতে পারে। আর কি তথ্য জানা গেল বন্দী প্রসঙ্গে?”
এই প্রসঙ্গে
বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়লেন ভাষ্কর; মহারাজের কথার সূত্র ধরে তিনি বললেন-
-“এই তথ্যটা
জানাবার জন্য আমি খুবই উদগ্র ছিলাম, কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না আপনাকে এই তথ্য জানাব
কি করে! আপনি যখন জানতেই চাইলেন মহারাজ-”
-“তাড়াতাড়ি!”
-“আমরা বন্দীর
ওপর অনেকগুলি শারীরিক পরীক্ষা চালাই, তার দ্রুত আরোগ্যের সন্ধানেই। বাকি পরীক্ষার ফল
সন্তোষজনক, কিন্তু একটিই পরীক্ষার ফল বিস্ময়কারক! মহারাজ, এই ব্যক্তিটি প্রাকৃতিক উপায়ে
ভূমিষ্ঠ হওয়া এক সন্তান, যার শরীরে পিতা-মাতার সকল প্রত্যক্ষ ও প্রচ্ছন্ন গুণগুলি বর্তমান।”
-“অ্যাঁ! বল
কি হে?”- শীৎকার করে উঠলেন মহারাজ শান্তনু। তাঁর এরকম অদ্ভুত আচরণের পিছনে অবশ্য কারণও
ছিল।
প্রযুক্তির ওপর
অতি-নির্ভরশীলতা গন্ধর্বদের ঠেলে দিয়েছিল প্রকৃতি থেকে অনেক দূরে। এতটাই যে আগেকার
যুগের স্বাভাবিক সন্তানধারণের ও ভূমিষ্ঠকরণের দিকেও তাদের আর বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল
না। স্বাভাবিক উপায়ে সন্তানকে পৃথিবীতে আনবার প্রক্রিয়া আইনতঃ বাতিল হয় দুইশ বছর আগে;
গবেষণাগারে কৃত্রিম উপায়ে সন্তানজন্মের প্রক্রিয়াকে স্বাগত জানায় সকলে। এতে জীবন সংশয়ের
কোন প্রশ্নই নেই, অহেতুক রক্তপাত নেই, কমসময়ে অধিক সন্তানলাভ সম্ভব – এগুলিই মূল কারণ
ছিল কলসজাত সন্তানধারণ তত্ত্বের দ্রুত সমর্থনলাভের পিছনে। এক হিসেবে দেখতে গেলে, গন্ধর্ব
সভ্যতার গত দুইশ বছরে একমাত্র স্বাভাবিক উপায়ে জন্মলাভ করা শিশু,যার জন্ম স্বাভাবিক
উপায়ে মাতৃগর্ভে, সে এখন বসে আছে কাঁচের জানালার
ওপারে; খুব বেশি হলে পনের হাতের ব্যবধানে। বিস্মিত মহারাজ শান্তনু খানিক্ষণ অবাক হয়ে
তাকিয়ে থাকলেন সেদিকে।
-“স্বাভাবিক
উপায়ে জন্মলাভ করা শিশু অধিক বুদ্ধিমান, তেজোদ্দীপ্ত ও বলশালী হয়, তাই নয় কি, ভাষ্কর?”
-“বিজ্ঞজনেরা
তাই বলেন বটে, মহারাজ!”
-“এই ব্যক্তিই
একমাত্র বেঁচে থাকবেন, এই সিদ্ধান্ত মেনে বাকি নিরানব্বই জন ভ্রাতা আত্মবলিদান করেছেন,
তাই তো?”
সন্মতিসূচক ঘাড়
নেড়ে কথা বলতে গিয়ে আত্মসংবরণ করলেন ভাষ্কর। মহারাজ শান্তনুর দৃষ্টি তখন সটাং বন্দীর
দিকে নিবদ্ধ। চুপ করে তাকিয়ে আছেন তিনি, যেন কিছু একটা ভাবছেন, অন্যমনস্কের মত। কথা
বলে তাঁর চিন্তাসূত্রকে নষ্ট করতে চাইলেন না তিনি।
বেশ কিছুক্ষণ
একাগ্রতার সাথে মনে মনে কি যেন চিন্তা করে নিলেন মহারাজ শান্তনু; তারপরই যেন আচমকাই
ফেরৎ চলে এলেন তিনি বাস্তব জগৎে। ভাষ্করের দিকে তাকিয়ে বললেন-
-“বন্দীর সঙ্গে কথা বলতে হবে; চল, ওর সাক্ষাৎকার পর্ব শেষ করে ওকে যেতে দিই। ‘সংঘর্ষবিরতি চুক্তিপত্রটি’ সঙ্গে নিয়ে নাও ভাষ্কর- আর হ্যাঁ, ওর বোধ হয় একটি বোন আছে, না?”
বেশ কিছুক্ষণ পর মহারাজ শান্তনু ও সদাসহচর ভাষ্করকে একজন প্রহরীসমেত দেখা গেল সাক্ষাৎকার-কক্ষে, বন্দীর সঙ্গে আলাপরত অবস্থায়।
=========================================================================
RELATED PARTS OF THE SERIES: THE LEGACY OF RAM- PROLOGUE
আমার এই ছোট প্রয়াসটি কেমন লাগছে আপনাদের? জানাতে দ্বিধা করবেন না। আপনারা আমার সম্পর্কে আরও জানতে পারেন নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে:
আপনারা আমার পাঠ করা গল্প শুনতে পারেন আমার ইউটিউব চ্যানেলে
আপনারা সরাসরি ট্যুইট করতে পারেন আমায়
নতুন খবরগুলি সম্পর্কে আপডেট পেতে পারেন আমার পেজে
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আমাদের ব্লগগুলি আপনাদের কেমন লাগছে? অবশ্যই জানান আমাদের-