The Legacy of Ram: Prologue- Part3 (দ্যা লেগ্যাসি অফ্ রাম: আদি পর্ব- অধ্যায়৩)- A mystery, post-apocalyptic fiction Bengali Novel series by Aritra Das
দ্যা লেগ্যাসি অফ্ রাম- আদি পর্ব (The Legacy of Ram- Prologue): অধ্যায়৩ (PART3)
- A Bengali science fiction, mystery, suspense thriller and post-apocalyptic fiction novel series by Aritra Das, the Bengali writer
The Legacy of Ram- Part3 |
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশ্বে আগত নতুন এক ভয়ংকর ভাইরাসের বিরুদ্ধে সংগ্রামে কি জয়ী হবেন দত্তাত্রেয়? পড়ুন সম্পূর্ণ উপন্যাস 'অমৃতের মৃত্যু'
অধ্যায়২ থেকে শেষের কিছুটা অংশ-
দূরের আকাশে ব্যোমযানটি তখন মিলিয়ে যাচ্ছে দিগন্তে; সেদিকে তাকিয়ে নিজের মনে বলে উঠলেন মহারাজ শান্তনু-
-“’শকুনি’, না? এখন দেখি আমার এই পাশার দানকে তুমি ঠেকাও কিভাবে! তোমার সমস্ত অভিপ্রায়ে আজ জল ঢেলে দিলাম এই একটিমাত্র চালে!!”
অদূরে কোথাও, তিমিরবরণ অন্ধকারে সকলের অলক্ষ্যে নিঃশব্দে, নিষ্ঠুর এক হাসি হাসলেন অন্তর্যামী। সে হাসির কোন আওয়াজ নেই, তবে তার অভিঘাত কিন্তু সুদূরপ্রসারী...
[পূর্ব প্রকাশিতের পর...]
দ্যা লেগ্যাসি অফ্ রাম: আদি পর্ব- অধ্যায়৩
[খণ্ডচিত্র২:একটি দণ্ড, এবং…]
(মানবসভ্যতার সমসাময়িক, কিন্তু স্থান-কাল অজ্ঞাত)
-“বন্দী, ক্রমিক নং অষ্টম– ব্যূহ!”
ঘোষণা শুনে একটি
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন মহর্ষি মার্কণ্ডেয়। ঘোষণায় অষ্টম বন্দীকে ব্যূহে,
অর্থাৎ বেষ্টনীতে প্রবেশ করতে বলা হচ্ছে; তিনিই অষ্টম বন্দী! ‘কালাতীত’সংঘের একটি বিধি
ভাঙবার অভিযোগে আজ অভিযুক্ত তিনি; মহর্ষি বাল্মীকির আশ্রম থেকে বন্দী করে তাঁকে সোজা
এনে উপস্থিত করানো হয়েছে এই বন্দীবাসে। কানাঘুষায় খবর, ‘কালচক্র’ সাজায় দণ্ডিত করা
হতে পারে তাঁকে। শিউড়ে উঠলেন মহর্ষি মার্কণ্ডেয় একবার; ‘কালচক্র’ দণ্ডের প্রাবল্যের
কথা স্মরণ করেই কি এই শিহরণ?
‘কালচক্র’এক
অতীব নিষ্ঠুর দণ্ড! এর অর্থ, অনন্তকাল ধরে বিভিন্ন জন্মের মধ্য দিয়ে সাংসারিক দুঃখ-কষ্টের
মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকা! এই দণ্ডের উদ্দেশ্য, অপরাধীর আত্মাকে দণ্ড দেওয়া বিভিন্ন দেহের
মধ্য দিয়ে, বিভিন্ন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে। মজার বিষয়, এই দণ্ডের অবসান একটি দেহের বিনাশসাধনের
মধ্য দিয়ে নয়; পৌনঃপুনিক হারে, চক্রাকারে বিভিন্ন দেহের, বিভিন্ন জন্মের মধ্য দিয়ে;
অনন্ত সংখক দেহের বারংবার বিনাশসাধন ঘটিয়ে। প্রতিবিধান? জানা নেই মহর্ষি মার্কণ্ডেয়র।
বর্তমানে কোথায়
আছেন তিনি, তা নিজেরই জানা নেই তার! মহর্ষি বাল্মীকির ‘মণিবাটী’ আশ্রম থেকে কৃত্রিম
আলোকসম্পাতে তাঁকে তুলে আনা হয় প্রথমে একটি ‘খেয়াযান’-এ; সেখান থেকে মহাকাশে একটি মূল
অন্তরীক্ষ যানে তাঁকে তুলে নেওয়া হয়- এই অবধি মহর্ষি বাল্মীকির স্মরণে আছে। কিন্তু
সেখানে তাঁকে বন্দী করে রাখা হয় প্রায়ান্ধকার একটি ছোট কক্ষে; স্বল্প পরিসর গরাদের
ওপারে। তবে বিভিন্ন সময়ে প্রহরীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলে তিনি জানতে পারেন- যেখানে তাঁকে
নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বিচারাধীন বন্দী হিসেবে, সেখানে সর্বসময়ে সকলের প্রবেশাধিকার থাকে
না; এমনকি সকল দেবতাদেরও নয়। সর্বোচ্চ পদাধিকারী কিছু দেবতা, তাঁদের মনোনীত কিছু প্রশাসনিক
কর্তা, সর্বসন্মত কয়েকজন গবেষক ও কর্মী, উচ্চ পর্যায়ের বিচারাধীন বন্দী এবং হাতেগোণা
কয়েকজন প্রহরী ভিন্ন কেউ থাকেন না এই স্থলটিতে। রহস্যময় এই জায়গাটির নাকি স্থান-কালের
বাইরে বিচরণ। কি, এই অদ্ভুত জায়গাটি? এবং, কোথায়?
একটি বিষয় অবশ্য
প্রহরীরা উল্লেখ করতে ভুলে গিয়েছিলেন, এবং এখানে এসে মহর্ষি মার্কণ্ডেয় তা সম্যক উপলব্ধি
করতে পেরেছেন। এখানে অবতরণের পরপরই যখন তাঁকে অবতরণ কেন্দ্র থেকে নিয়ে আসা হচ্ছিল বিশ্রামাবাসে,
তখনই তিনি দেখতে পান পুরো ক্ষেত্রটি খাঁচার ঘেরাটোপে আবদ্ধ। কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করে
তিনি জানতে পারেন, পৃথিবী সহ ‘ত্রিপুরা’সাম্রাজ্যের অন্যান্য উপনিবেশগুলিতে বিভিন্ন
সময়ে যত প্রাণ সঞ্চার করা হয়েছিল, তাদের নমুনা এনে জমা করা হয়েছে এই জায়গাটিতে। বহু
যুগ ধরে তিল তিল করে তৈরি করা হয়েছে এই সংগ্রহশালা। এই কারণেই জৈব গবেষণাগারও স্থাপনা
করা হয়েছে এখানে, যাতে বৃহত্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নতুন, উন্নত প্রাণ সৃষ্টি
করা যায়। এদের মধ্যে কয়েকটি প্রজাতি সবিশেষ হিংস্র; মূলত এইসব শ্বাপদের হাত থেকে আত্মরক্ষার্থেই
দেবতারা নিজেদের চলাচলের পথটিকে ঘিরে রেখেছেন তড়িৎ পরিবাহী এই খাঁচা দিয়ে, যাতে হিংস্র
শ্বাপদগুলি কোন দেবতার মৃত্যুর কারণ না ঘটে। আসবার সময় কয়েক ধরণের প্রাণীর দর্শন পেয়েছেন
মহর্ষি। এই জায়গাটি আর যাই হোক, ‘বরাবতী’গ্রহ নয়, কারণ সেখানকার নৈসর্গিক জীবনযাত্রা
ও দৃশ্যপট- দুইয়ের সঙ্গেই তিনি সম্যক পরিচিত।
লম্বা, টানা,
প্রায়ান্ধকার প্রশস্ত কক্ষটিকে অতিক্রম করে আসবার পথে দুপার্শ্বে অনেকগুলি খাঁচা রাখা
ছিল; তাতে আধুনিক মানবদের বিভিন্ন অন্তর্বর্তীকালীন বিকাশের ভিত্তিতে প্রজাতিগত নিদর্শন
ধরে রাখা হয়েছিল; গবেষণাগারের নমুনা হিসেবে। প্রতিনিয়ত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়
এইসব নিদর্শনগুলির ওপরে; বিবর্তনের সঠিক মার্গ নির্ধারণের উদ্দেশ্যে। তাদের দিকে তাকিয়ে
একটি ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হাসলেন মহর্ষি মার্কণ্ডেয়। এরাই মানবদের প্রকৃত পূর্বপুরুষ,
এবং তিনিও একজন মানব; সভ্য, সুশিক্ষিত একজন মানব! এক অর্থে ধরতে গেলে, তাঁরও পূর্বপুরুষ
খাঁচার মধ্যে থাকা এই আদিম মানব গোষ্ঠী; যাদের ছবি তিনি অনেকবার দেখেছেন ভগবন্ শ্রীবিষ্ণুদেবের
গ্রন্থাগারে। লক্ষণীয় বিষয়টি হল, তাঁর এই অতি-দূরসম্পর্কের পূর্বপুরুষদের মতই, তিনিও
আজ খাঁচায় বন্দী! বিধির কি অদ্ভুত পরিহাস! এই সাদৃশ্যটি ভেবেই হেসে ফেলেছিলেন তিনি!
এইখানেই একটু
কৌতুহলী হয়ে উঠলেন মহর্ষি মার্কণ্ডেয়; বর্তমান বিশ্বে মানবরাই তো সর্বেসর্বা, তাদের
আদিমতম প্রতিরূপগুলির তো বিলীন হয়ে যাওয়ার কথা; তাহলে আধুনিক মানবদের এই প্রজাতিভিত্তিক
বিভিন্ন সংস্করণগুলি এখানে এই খাঁচার মধ্যে এল কি করে, তাও, সংখ্যায় এত বেশি পরিমাণে?
উত্তর দেওয়ার
কেউ নেই, তাই এইসময় নিজেই একটা সন্তোষজনক ব্যাখ্যা তৈরি করতে চাইলেন মহর্ষি মার্কণ্ডেয়।
তিনি যেখানে এসেছেন, সেটি নিশ্চিতভাবে পার্থিব পরিমণ্ডলের থেকে অনেকদূরে; সময়ের পরিমাপ
এখানে ভিন্ন। তাছাড়া যে প্রজাতিগুলিকে এখানে আনা হয়েছে, তারা নিশ্চই আদিম মানবদের আদিরূপ
নয়। তাদের ওপর গবেষণা চালানো সর্বশেষ প্রজাতি, যাদের মধ্যে যোগ্যতমদের স্থানান্তরিত
করা হয়েছে পৃথিবীতে; পেছনে পড়ে রয়েছে তাদের অযোগ্য নিদর্শনগুলি। কিন্তু… নাঃ; সময়ের
হিসেব এক্ষেত্রে মিলছে না তো! এই মানবদের চেহারা মানবদের সঙ্গে সাদৃশ্যগত না হয়ে বানরদের
সঙ্গে বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ; তার মানে এরা এখনো মানবদের পর্যায়তেই আসতে পারে নি। আর,
এদের কালক্রম পৃথিবীতে আধুনিক মানবদের আসবার অনেক আগের ঘটনা; তাহলে এরা এখানে এল কি
করে?
যাই হোক, উদ্দেশ্য
বা বিধেয় – কোনটাই মহর্ষি মার্কণ্ডেয়র কাছে খুব একটা স্পষ্ট ঠেকল না। বিষয়টি নিয়ে তিনি
তাঁর চিন্তাভাবনা আপাতত স্থগিত রাখলেন; এই নিয়ে ভেবে আপাতত কোন লাভ নেই। কক্ষ দিয়ে
দিয়ে এগোতে এগোতে তিনি শুধু দেখলেন- বিভিন্ন প্রজাতির বানর-মানবরা খাঁচার ভিতরে তখন
একে অপরের সঙ্গে খুনসুটিতে ব্যস্ত; কেবল তিনি যে যে খাঁচার সামনে দিয়ে যাচ্ছেন, তার
ভিতরের বাসিন্দারা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে খানিক্ষণ তাঁর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে
তারপর আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ছে নিজেদের মধ্যে খুনসুটিতে! বোঝা গেল এদের চেতনাও এদের আদিম
শরীরের সঙ্গে মানানসই।
এদেরই খাঁচার
সারির একদম শেষপ্রান্তে সবার থেকে আলাদা যে খাঁচাটি আছে, তার সামনে এসে একটু অবাকই
হয়ে গেলেন মহর্ষি মার্কণ্ডেয়। দূর থেকে প্রথমে তিনি খাঁচাটিকে শূণ্য ভেবে ছিলেন; কিন্তু
না! খাঁচার ভিতরে আশ্চর্যজনকভাবে শান্ত হয়ে বসেছিল এক বানর-দম্পতি; ভালো করে মহর্ষি
তাকিয়ে দেখতে লাগলেন তাদেরকে।
এরা কিন্তু এই
কক্ষে উপস্থিত অন্যান্য বানর-মানবদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, একেবারে স্বতন্ত্র প্রজাতির।
চেহারাগতভাবে এদের মিল কিন্তু অন্যান্য বানরদের মত নয়, বরং তাদের থেকে অনেকটাই পৃথক।
গায়ে রোম উল্লেখযোগ্যভাবে অনেকটাই কম; মাথায় পরিষ্কার কেশরাশি, এমনকি যে সামান্য সময়ের
জন্য এরা একটু নড়াচড়া করেছিল তাতে মহর্ষি মার্কণ্ডেয় বুঝতে পারলেন পিছনে এদের লেজ প্রায়
নেই বললেই চলে! এদের পূর্বজ প্রজাতির সঙ্গে শারীরবৃত্তীয় সাদৃশ্যের পরিবর্তে এদের শারীরিক
আদল বরং সেই মানবদের সঙ্গেই বেশি, যাদের দেখা যেত নব-প্রস্তরযুগের গোড়ার দিকে! চোয়ালের
কাছটায় কিছুটা সাদৃশ্য থাকলেও গোটা শরীরে পূর্ববর্ত্তী বানরদের সঙ্গে এদের কোন মিল
নেই।
তবে অবাক করবার
বিষয় আরো আছে। এই দম্পতির মানবীটির গাত্রবর্ণের সঙ্গে তিনি পরিচিত; বর্তমান বিশ্বে
যে বর্ণের মানবপ্রজাতি দেখা যায় তার থেকে ভিন্ন কিছু নয়। কিন্তু মানবটির গায়ের রং একেবারে
আলাদা; পুরোপুরি ধপধপে ফর্সা! এরকমটি কি করে সম্ভব? কর্মসূত্রে পৃথিবীর পরিমণ্ডলের
মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় তাঁকে ঘুরতে হয়েছে, অঞ্চলভেদে গাত্রবর্ণের তারতম্যের সঙ্গে তিনি
সম্যক পরিচিত; অতিগ্রীষ্মের দেশগুলিতে মিশকালো মানব বা অতিশীতের দেশের হালকা লালচে
শ্বেত বর্ণের প্রভাব তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন, কিন্তু এরকম বেয়াড়া ও অদ্ভুত ‘শ্বেতশুভ্র’
গাত্রবর্ণ তিনি এই প্রথম দেখছেন! এ কি ব্যাপার?
মানবটিকে নিরীক্ষণ
করতে করতে হঠাৎ এক জায়গায় এসে তাঁর দৃষ্টি থেমে গেল। তাই তো! এটা তো লক্ষ্য করেন নি
তিনি আগে! পরিষ্কার দেখতে পেলেন- মানবটির চোখের চামড়ার ঠিক ওপরেই খুব ছোট্ট, গোল একটি
সাদা দাগ! দৃষ্টি ঘুরে গেল তাঁর, মানবীটির দিকে। সেখানেও আবিষ্কার হল একই জিনিষ- বাঁ
চোখের চামড়ার ঠিক ওপরে একই সাদা বর্ণের একটি ফুটকি। কিরকম একটা সন্দেহ হল তাঁর; আশেপাশের
খাঁচায় গিয়ে ভালো করে খেয়াল করলেন সেখানকার বাসিন্দাদের চোখমুখ; সেখানেও তিনি খেয়াল
করলেন একই রকম চিহ্ন প্রত্যেকের শরীরে। তার মানে-
এইবারে সময়ের
হেরফের ব্যাপারটা স্পষ্ট হতে লাগল তাঁর কাছে। তিনি বুঝতে পারলেন, কেন মানবপ্রজাতির
বিবর্তনের প্রত্যেকটি প্রজাতিকে দেখা যাচ্ছে এখানে; প্রত্যেকটি বিবর্তনে, প্রত্যেকটি
প্রজাতির মাঝখানে সময়ের দুস্তর ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও কোন জাদুমন্ত্রে তারা একত্রে
উপস্থিত, এইখানে! প্রত্যেকেই কালভ্রমণ করেছে, সময়ের নিরিখে তাদের সঠিক অবস্থান থেকে
তাদেরকে তুলে আনা হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন সময়ে, আলাদা পরিবেশে, এই সমাবেশ কেন্দ্রে, কোন
বৃহত্তর গবেষণার স্বার্থে! তারই চিহ্ন তারা বহন করছে শরীরে। আলগোছে নিজের বাঁ চোখের
চামড়ার ওপরে হাত চলে গেল মহর্ষি মার্কণ্ডেয়র।
সবই তো পরিষ্কার
হল, কিন্তু বোঝা গেল না যে বিষয়টি তা হল এই অদ্ভুত শ্বেতকায় মানুষটি কে? প্রকৃতপক্ষে
এই দম্পতির দুজনই তাদের পূর্বপুরুষদের থেকে এতটাই আলাদা যে তা প্রশ্ন জাগিয়ে তোলে দর্শনার্থীদের
মনে। এদের চোখে-মুখে মনন ও চেতনার ছাপ স্পষ্ট; তার মানে বুদ্ধির বিকাশ এদের ক্ষেত্রে
পূর্ণমাত্রায়। কারা এরা? আর, এরা মানবসভ্যতার কোন পর্যায়? কৌতুহলভরে, তাদের দিকে জিজ্ঞাসু
দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন মহর্ষি মার্কণ্ডেয়।
-“এরা বাকিদের
মত মানবসভ্যতার বিবর্তনের কোন স্বাভাবিক পর্যায় নয়, মহর্ষি; কৃত্রিমভাবে গবেষণাজাত
মানবসন্তান, যাদের জন্ম না হলে সম্ভবতঃ আপনাদের বিবর্তন আসতে আরো দেরি হতে পারত!”
ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনদিকে
তাকালেন মহর্ষি মার্কণ্ডেয়। ভগবান বিষ্ণুদেব কখন যেন এসে উপস্থিত হয়েছেন ঠিক তাঁর পিছনেই!
তাঁকে দেখে হাতজোড় করে নমস্কার জানালেন তিনি।
-“কিন্তু ভগবান,
আমি দৃঢ়ভাবে নিশ্চিত এই কক্ষে উপস্থিত সকল প্রাণীই সময়-যাত্রী। কিন্তু সমস্যাটা হল
এরকম কোন ‘সময়-যাত্রা’র তো উল্লেখ পাওয়া যায় নি ‘কালাতীত’-এর সদর-দপ্তরে, ‘মহাতথ্যপঞ্জিকা’-তে!
আমি খুব ভালো করে খুঁটিয়ে পড়েছি সেসব বিবরণ; প্রত্যেকটি ‘সময়-যাত্রা’-র উল্লেখ আমার
কন্ঠস্থ! তাহলে হঠাৎ এরকম বিচ্যূতি ঘটল কিভাবে?”
-“শুধু এরাই
নয় মহর্ষি, এই গ্রহটিতে উপস্থিত দেব-ব্যতিরেকে সকলেই সময়-যাত্রী, তাদের সকলকেই তুলে
আনা হয়েছে ভিন্ন সময় থেকে, বৃহত্তর গবেষণার স্বার্থে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এইসকল সময়-যাত্রা
নথিভূক্ত আছে অন্য এক পৃথক তথ্যপঞ্জিকায়, যা সর্বসমক্ষে প্রকাশ্য নয়। আর কিছু হাতে-গোণা
ক্ষেত্রে তা লিপিবদ্ধ করাই হয় নি, যাতে সুদূর বা অদূর ভবিষ্যতে তার কোন লিখিত বিবরণ
না পাওয়া যায়-”
-“সে কি! এরকমটা
কি বাস্তবে ঘটা সম্ভব?”
এ প্রশ্নে ভগবান
বিষ্ণুদেব তাঁর কথা থামিয়ে কিয়ৎকাল স্থির চক্ষে তাঁকালেন মহর্ষি মার্কণ্ডেয়র দিকে,
তারপর তিনি বলে উঠলেন-
-“নিজেকেই নিজে
প্রশ্ন করুন, মহর্ষি মার্কণ্ডেয়; কোন নথিভূক্ত বিবরণ ছাড়া সময়-ভ্রমণ কি নিতান্তই অসম্ভব?
আপনাদের সময়-ভ্রমণের কোন তথ্যই অবশ্য আমাদের কাছে লিপিবদ্ধ নেই।”
চুপ করে গেলেন
মহর্ষি মার্কণ্ডেয়। সত্যিই তো! তিনি নিজেই তো এরকম এক নাম-গোত্রহীন সময়-ভ্রমণের অভিযোগে
অভিযুক্ত! তিনিই তো ছিলেন এই অলিখিত ভ্রমণের মূল কাণ্ডারী, সেই অপরাধেই তো উনি বন্দী!
যদিও এই সময়-ভ্রমণ ঘটেছিল সশরীরে নয়, অশরীরে; কিন্তু এই অভিযান তো লিপিবদ্ধ করা উচিৎ
ছিল মূল নথিতে, যা তিনি করেন নি। তবে একটা বিষয় আবার তাঁর কাছে ধোঁয়াসা হয়ে রইল – তাঁদের
ক্ষেত্রে এই সময়-ভ্রমণ ছিল প্রয়োজন; মহর্ষি বাল্মীকিকে নিখুঁত রচনা উপস্থাপনে সহায়তা
করা। কিন্তু এই সকল মনুষ্যেতর প্রাণীদের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে এই নবমানব দম্পতির বেলাতেও
সেই নিয়মের বাত্যয় হবে কেন? প্রশ্নমাখা চোখে তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন মানব-দম্পতিটির
দিকে; তারা তখনও পিছনেই, গরাদের অপরপারে, শান্ত হয়ে বসে তাদের জায়গাতেই।
-“হনুমন্তের
জন্ম সাফল্যের প্রথম ধাপ ছিল বটে, কিন্তু এরপরের সাফল্য আসতে দেরি হচ্ছিল। যেকোন অজ্ঞাত
কারণেই হোক, হনুমন্তের ঔরসে কোন অপত্য জন্মগ্রহণ করে নি। আমাদের এই বিস্ময়কর সাফল্যের
ঠিক নীচেই লুকিয়ে ছিল ব্যর্থতার ছোবল! আমরা নিজেরাও বুঝে উঠতে পারি নি এমনটা ঘটবে,
হনুমন্তের বিরাট শরীরের ঠিক কোন অংশে লুকিয়ে ছিল ব্যর্থতার বীজ? আমরা তা পরবর্ত্তী
ক্ষেত্রে ঠিক বুঝে উঠতে পারি নি, কারণ হনুমন্ত লুকিয়ে ফেলেছিল নিজেকে, আমাদের কাছ থেকে।
হয়তো কোন বিষয়ে অভিমান করেই, যা আমরা তখন বুঝে উঠতে পারি নি এং এখনো, না! এইভাবে মানবদের
নতুন প্রজন্ম জন্মলাভের যে উজ্জ্বল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, তা শেষ হয়ে গেল হনুমন্তের
জীবনকালের সাথে সাথেই! মানবগোষ্ঠী একটা লম্বা সময়ের জন্য ফেরৎ চলে গেল তাদের আদিম শাখায়-
বাঁদর অবতারে।
হনুমন্তের ক্ষেত্রে
করা সমস্ত ভুল-ত্রুটিগুলি পর্যালোচনা করে আমরা সংশোধন করে নিয়ে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়লাম
আমাদের পরিকল্পনার দ্বিতীয় পর্যায়ে। নতুন করে খোঁজ শুরু হল উন্নত পর্যায়ের মানবগোষ্ঠীর
বিবর্তনের চাবিকাঠির – পুরনো বিশেষত্বগুলির সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে। হনুমন্তর ক্ষেত্রে
করা ভুলগুলি থেকে আমরা শিক্ষা নিয়েছিলাম; দ্বিতীয়বার এই ভুলগুলির আর পুনরাবৃত্তি হয়
নি। এদিক দিয়ে দেখতে গেলে কিন্তু হনুমন্ত যথার্থই একদম একা, স্বতন্ত্র্য এক মানব!
কিন্ত যত দিন
এগোতে লাগল, তত আমরা হতোদ্যম হয়ে উঠতে লাগলাম। আমরা কিছুতেই সক্ষম হচ্ছিলাম না সেই
নবগোষ্ঠী নির্মাণে। পুরনোর জীর্ণ শরীর থেকে নবীনবরণের যে কর্মযজ্ঞ, তাতে বারংবার ব্যর্থ
হচ্ছিলাম আমরা। তারপর একদিন- ঘটে গেল সেই দূর্ঘটনা।“
এই পর্যন্ত বলে
চুপ করে গেলেন ভগবান বিষ্ণুদেব। অনেক্ষণ ধরে কি যেন ভাবলেন তিনি, বোধহয় বলবেন কি বলবেন
না এই দোটানায় ভুগলেন কিছুক্ষণ। তারপর মতিস্থির করে আবার কথা বলা শুরু করলেন-
-“মানবদের তৎকালীন
শেষতম উন্নততর প্রজাতিটির সঙ্গে আমাদের দেহ ও জননকোষের কিছু একটা বৈসাদৃশ্য হচ্ছিল
যা আমরা কিছুতেই মেলাতে পারছিলাম না- জানি, আপনার প্রশ্নটা কি। আদিমতম সংস্করণে যা
সম্ভব হচ্ছিল, তা পরবর্ত্তী ক্ষেত্রে কেন সম্ভব হয় নি, তাই তো? এই ধরণের জটিলতা এরকম
একটা বড় আকারের কর্মযজ্ঞে যেকোন পরিস্থিতিতেই সৃষ্টি হতে পারে, মহর্ষি! এর কোন স্থিরতা
নেই; জটিলতা সৃষ্ট হলে কোন ধারণাই স্বয়ংসিদ্ধ নয় এই ক্ষেত্রে। অনুমানই তখন একমাত্র
ভরসা! দুটি পৃথক প্রজাতির শরীরের জননকোষ যেখানে একত্রে একটি কোষে সংমিশ্রণ করানোর প্রচেষ্টা
হচ্ছে, সেই ক্ষেত্রে সেই সংকর কোষের জটিলতার মাত্রা ক্ষেত্রবিশেষে তার পিতৃ-মাতৃকোষের
জটিলতার মাত্রাকেও বহুগুণে ছাপিয়ে বেরিয়ে যেতে পারে! এক্ষেত্রেও সেরকমই কিছু হয়ে থাকবে;
মোট কথা, আমরা বারংবার ব্যর্থ প্রমাণিত হচ্ছিলাম।
এইসময় দেবতাদের
একাংশের কাছ থেকে কিছু উদ্ভট পরামর্শ আসতে থাকে। অতীতে আমাদের প্রধান ও চিরন্তন শত্রু
অসুরদের দেহাংশের কিছু নিদর্শন আমাদের কাছে ছিল; দাবী উঠল, দেবতাদের দেহকোষ দিয়ে যখন
কিছু সুবিধা হচ্ছে না, তাহলে এবার অসুরদের দেহকোষ দিয়ে পরীক্ষাটা চালিয়ে দেখা যাক!
সীমাহীন শয়তানির
গোড়ার দিক ছিল তা মহর্ষি, সীমাহীন উচ্চাকাঙ্খা ও ক্ষমাহীন ষড়যন্ত্র, যার ভিত্তিভূমি
এই উৎকট দাবী! যে দেবতারা একত্রে গলা মেলাচ্ছিল এই যুক্তিহীন দাবীর সমর্থনে, তাঁদের
নিয়ন্ত্রণ করছিল স্বল্পসংখ্যক কিছু দেবতারূপী রাক্ষস! দেবতাই তাঁরা, কিন্তু এই পরিকল্পনা
তাঁরা করেছিলেন সাম্রাজ্যের প্রধান হওয়ার বাসনায়, আমাদের জন্মগত শত্রু অসুরদের সাথে
হাতে হাত মিলিয়ে-!”
-“সে কি, ভগবান!
কিন্তু, কেন?”
-“হয়তো প্রথমবারের
দৈবরক্তের সমুদ্র তাঁদের তৃষ্ণা নিবারণে ব্যর্থ হয়েছিল; অথবা তাঁরা হয়তো ভেবেছিলেন,
অসুরদের সঙ্গে হাতে হাত মেলালে তাঁরা এখানে সুখের স্বর্গ নির্মাণ করতে পারবেন। এই দেবতারা
অধিকাংশই নবীন ছিলেন; হাতে গোণা দু-একজন প্রবীণ বাদ দিলে।
প্রবল বাগবিতণ্ডা
ও তর্কাতর্কির মধ্য দিয়ে অবশেষে একদিন এই নতুন মতবাদ গৃহীত হল; নমুনা কোষের সঙ্গে সংমিশ্রণ
ঘটানো হল অসুরদের দেহকোষ; সজ্ঞানে। এই পরীক্ষা সফলও হল মহর্ষি- সৃষ্টি হল বহু-প্রতীক্ষিত
এক নব মানবগোষ্ঠী। আপনার পিছনে যে শ্বেত মানবটিকে দেখছেন, তারই আদিম পূর্বপুরুষ! সম্পূর্ণ
পৃথক এই শ্বেতকায় মানব তার পূর্ববর্ত্তী মানবদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, প্রতিটি ক্ষেত্রেই।
দেখা গেল, এই
নতুন প্রজাতির মানবের বুদ্ধির মান অনেক বেশি। শারীরিক ভাবে এরা অধিক শক্তপোক্ত, গড়
উচ্চতা বেশি, উপস্থিত বা তাৎক্ষণিক বুদ্ধি প্রয়োগে বেশি সাবলীল, মস্তিষ্কের আয়তন সামান্য
অধিক। তবে সমস্ত গুণকে ছাপিয়ে গেল একটিই অপগুণ- ক্রুরতা, নিষ্ঠুরতা, হিংস্রতা- যা বহুগুণে
ছাপিয়ে গেল তার পূর্বসূরীদের! আপনি জানেন মহর্ষি, ‘শিকারের দরকারে শিকার’ এবং ‘মনোরঞ্জনের
উদ্দেশ্যে শিকার’, দুইয়ের মধ্যে সঠিক প্রভেদটা ঠিক কোথায়, তাই নয় কি? আর এই অপগুণের
জন্য দায়ী আমরা, আমাদের অবিমৃষ্যকারীতা, মহর্ষি!
গোড়াতেই যদি
সমস্যা থাকে, তবে তো নির্মাণ ভঙ্গুর হবেই। যে বানরগোষ্ঠীকে নির্বাচিত করা হয়েছিল মানবগোষ্ঠী
নির্মাণের উদ্দেশ্যে, তা ছিল আমিষাশী বানরদের এক স্বাভাবিক হিংস্র প্রজাতি! আবার, কোন
এক পথের মোড়ে এসে যখন আমরা থমকে দাঁড়ালাম, তখন পথের দিশা পাওয়ার জন্য আমরা বেছে নিলাম
কাদের? অসুরদের! পরিণাম? মানবদেহের রক্তে যে হিংস্রতার বীজ সুপ্ত ছিল তা অনুকূল পরিবেশ
পেল ডালপালা মেলে বিকশিত হওয়ার। তারই ফল ঐ শ্বেতমানব, আগ্রাসন যার স্বভাবজাত। অন্যান্য
বানর-মানবদের জীবন সে অতিষ্ঠ করে তো তুলেছিলই, মেরেও ফেলেছিল সে কয়েকটিকে। প্রহরীদের
ওপরেও আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে; ওর হাতে মারাও গিয়েছিল দুজন প্রহরী! অবস্থা বেগতিক দেখে
তাকে আমরা আলাদা খাঁচায় রাখি। একমাত্র মিলনের সময়টুকু বাদ দিলে অন্য কোন সময় ও কোন
সঙ্গ পছন্দ করত না; অদ্ভুত প্রকৃতি ছিল এই শ্বেতবর্ণ মানবের।“
-“তাই যদি হবে
ভগবান, তাহলে সেই দূর্দান্ত পূর্বপুরুষের অধস্তন পুরুষ এই শ্বেতকায় মানবটি এত শান্ত
হয়ে বসে আছে কি করে?”
-“এই খাঁচায়
যে সাদা মানবটিকে দেখছেন, তাঁর নাম ‘মদন’। এ কিন্তু সেই আদিপুরুষটি নয়; তার বংশধরদের
প্রথম থেকেই আলাদা করে রাখা হয় এবং তাদের ওপর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়।
তার মধ্যে যে প্রজাতিটিকে আমরা শেষ অবধি মনোনয়ন করি, তারই অধস্তন পুরুষ হল এই ‘মদন’।
আর এর সঙ্গিনী যে মানবীটিকে দেখছেন, তার নাম ‘নীভা’। প্রসঙ্গতঃ, এ কিন্তু আমাদের স্বাভাবিক
পরীক্ষাজাত কন্যা, যার মধ্যে অসুরদের দেহকোষের লেশমাত্র নেই। হ্যাঁ, মহর্ষি! আমরা পরবর্ত্তীক্ষেত্রে
আমাদের ব্যর্থতা কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলাম; পথ খুঁজে পেয়েছিলাম দৈব-মানবকোষ সংক্রান্ত
অসমাপ্ত গবেষণার। সাফল্যমণ্ডিত হয় আমাদের পরীক্ষা; সেই সাফল্যেরই অধস্তন কন্যা এই
‘নীভা’। যেহেতু এই দুটি প্রজাতিই নবীন, সম্ভাবনাপূর্ণ ও আলাদা বিশেষত্বযুক্ত, তাই এদের,
এবং এদের স্বাভাবিক মিলনে সৃষ্ট সকল অপত্যদের আলাদা করে রাখা হয় অন্যস্থানে। এরা একা
ছিল না অবশ্য, তবে সব কথা ক্রমপ্রকাশ্য।
একটা কথা এখানে
আমি আগেই বলে নিতে চাই, মহর্ষি। আমাদের পরীক্ষা সাফল্যমণ্ডিত হওয়ার পর অসুরদের দেহকোষ
মিশ্রণের আর কোন কারণ ছিল না বলে সেই পরীক্ষা প্রক্রিয়াটাকেই বাতিল বলে ঘোষণা করে দেওয়া
হয়। তবে আরেকটি বড় কারণ ছিল এই বাতিলিকরণের পিছনে- আমরা জেনে গিয়েছিলাম যে একশ্রেণীর
দেবতাদের চক্রান্ত ছিল এটি। এই ষড়যন্ত্রের পিছনে থাকা মুখগুলিকে আমরা ধরে ধরে শনাক্ত
করি এবং তাঁদেরকেও বন্দী করে রাখি অন্যত্র; ‘মদন’ ও ‘নীভা’, তাদের পূর্ববর্ত্তী সকল
গবেষণালব্ধ বানর ও মানবগোষ্ঠী, এবং এই সকল অপরাধী দেবতাগণ- তাদেরকে রাখা হয়েছিল একত্রে,
পৃথিবীর পরিমণ্ডলে কিন্তু তার আকাশসীমার বাইরে, মহাকাশে, একটি আলাদা মহাকাশ-কেন্দ্রে!
অবাঞ্ছিত জটিলতা
এড়ানোর জন্যই এদের জন্য এই পৃথক ব্যবস্থা করা হয়েছিল। প্রথমতঃ, আমরা চাই নি মদন ও নীভা
সমেত এই পাঁচমিশালি মানবগোষ্ঠী আমাদের পরিকল্পনার বাইরে গিয়ে সংখ্যাবৃদ্ধি করুক। নাসা-বন্দী
করলে এদের প্রজননক্ষমতা চিরকালের জন্য বিনষ্ট হতে পারত; যা আরেক জটিলতার সৃষ্টি করত।
তাই এদের সকলকে ‘সন্মোহনী’যন্ত্রের সাহায্যে সন্মোহিত করে রাখা হত। এটি একধরণের গোলাকার
আলোক উৎস, যা মস্তিষ্কের সকল কার্যক্ষমতাকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য অসাড় করে রাখে! এর
দিকে তাকিয়ে থাকলে হাত-পা নাড়বার স্বাভাবিক ক্ষমতা পর্যন্ত লীন হয়ে যায়। ‘মহাকাশ-কেন্দ্র’-এ
থাকা সম্পূর্ণ মানবপ্রজাতিকে এইভাবেই বশীকরণ করা হয়েছিল।
দ্বিতীয়তঃ, আমরা
চাই নি কোনমতেই এই পৃথক বিশেষত্বযুক্ত জনজাতি নীচের ‘বিশুদ্ধ রক্তের’ মানবদের সঙ্গে
কোন প্রকার সংস্পর্শে আসুক। মনে রাখবেন মহর্ষি, মহাকাশ-যানে থাকা এই মানবপ্রজাতির শরীরে
কিন্তু অসুরদের রক্তও ছিল! তাই আমরা কোনভাবেই চাই নি এরা নীচে, জমিতে এসে অন্যান্য
প্রজাতির সংস্পর্শে এসে অসুরদের রক্তকে ছড়িয়ে দিক সবকটি মানবশরীরে; বিষয়টা আমাদের হাতের
বাইরে চলে যেত। এই মিলনে জন্ম নিত এক নতুন মানবসম্প্রদায়। এটি কখনোই আমাদের অভিপ্রেত
ছিল না।
যদিও ঠিক এমনটিই
ঘটেছিল কিছুকাল পরে; ওপরে, মহাকাশ কেন্দ্রের ‘অবিশুদ্ধ’মানবরক্ত মিশেছিল নীচের ‘বিশুদ্ধ’
রক্তের মানবগোষ্ঠীর শরীরে, যার পরিণাম আজকের এই দো-আঁশলা, বৈচিত্র্যময় মানবপ্রজাতি!
এটি একটি ক্ষমাবিহীন দূর্ঘটনা!!
সম্পূর্ণ ঘটনাটি
নিশ্চই আপনার জানা দরকার, কারণ এর পরে আপনার ঘাড়ে যে দায়িত্ব ন্যস্ত হতে চলেছে তাতে
এই সংক্রান্ত খুঁটিনাটি জানা থাকলে তবে আপনার সুবিধা হবে কার্য-কারণ নির্ধারণে। বিস্তারিত
বিবরণ আপনি নিশ্চই জানবেন, তবে এর কিছুটা সার-সংক্ষেপ আপনি আগেই শুনে রাখুন।
গন্ধর্বদের রাজত্বকালের
শেষদিকে দুটি বৃহদাকার প্রতিবন্ধকতা এসে উপস্থিত হয় তাদের সামনে; প্রথমতঃ- তাঁদের নিজস্ব
যন্ত্রনির্ভর সভ্যতা, যা তাঁদেরকে ঠেলে দেয় অবক্ষয়ের আবহে। লাগামছাড়া উন্নতির পণ তাঁরা
দেন- বিপজ্জনক হারে বিশ্ব উষ্ণায়ণ, এবং তজ্জনিত কারণে সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধি। এই দুই
প্রাকৃতিক কারণের প্রত্যক্ষ, অনির্বার্য মেলবন্ধন- প্রজাতিগতভাবে গন্ধর্বদের বিনাশ
যার জন্য তাঁরা আদপেই প্রস্তুত ছিলেন না! আর, দ্বিতীয়তঃ- গন্ধর্বপ্রজাতির বিনাশ আরও
ত্বরাণ্বিত হয় এদের এক আভ্যন্তরীন গৃহযুদ্ধের কারণে, যাতে নেপথ্যে ভূমিকা ছিল আমাদের
চিরশত্রু অসুরদের। স্বভাবতই, আমরাও জড়িয়ে পড়ি এই বিবাদে।
তবে এই দুইটি
দূর্ঘটনার সঙ্গে যোগ হয় তৃতীয় আরেকটি ঘটনা- সন্মোহণের মোহ পরিত্যাগ করে মহাকাশ-কেন্দ্র
থেকে ‘মদন’ ও ‘নীভা’-র, এবং অন্যান্য উন্নত শ্রেণীর মানবদের পলায়ন! ‘কালাতীত’সংঘের
ইতিহাসে এই ঘটনাটিকে লাল-চিহ্ন দেওয়া আছে-”
-“এরা পালিয়ে
ছিল? কিন্তু কিভাবে, প্রভু? আপনি এইমাত্র বললেন যে এদের রাখা হয়েছিল একটি পৃথক মহাকাশযানে,
পৃথিবীর পরিমণ্ডলেই; যদিও সেই মহাকাশযান কখনোই পৃথিবীর ভূমি স্পর্শ করে নি! তবে, কিভাবে?”-
জিজ্ঞাসা করে উঠলেন মহর্ষি মার্কণ্ডেয়।
-“মহাকাশ-কেন্দ্র
বলেছি, ‘মহর্ষি মার্কণ্ডেয়’, ‘মহাকাশ-যান’বলি নি। যাই হোক, একটি কথা আপনি ভুলে যাচ্ছেন-
ঐ একই মহাকাশকেন্দ্রে বন্দী ছিলেন সেই দেবতারা, যারা অসুরদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আবার
একটা স্বজন বিদ্রোহের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এই দেবতারাই মানবদের সহযোগিতা করেছিলেন এই
পলায়ন-পর্বে; আর তাঁরা অযাচিত সাহায্য পেয়েছিলেন একটি অন্য সূত্র থেকে- একটি মহাজাগতিক
দূর্ঘটনা থেকে।”
-“কি সেই মহাজাগতিক
দূর্ঘটনা?”- জিজ্ঞেস করলেন মহর্ষি মার্কণ্ডেয়। তিনি ভিতর ভিতরে কিছু আন্দাজ করেছিলেন
কি? ভগবান বিষ্ণুদেবের পরের কথায় তা পরিষ্কার হল।
-“আপনি ঠিকই
ধরেছেন, মহর্ষি! ‘অলকা’-র বিনাশ ঐ সময়তেই সম্পন্ন হয়। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই মহাকাশকেন্দ্রের
বিশৃঙ্খলতার সুযোগ নিয়ে এই পলায়নপর্ব সম্পন্ন হয়।
যে মহাকাশকেন্দ্রটিতে
এই নবমানবগোষ্ঠীকে এবং বিদ্রোহী দেবতাদের বন্দী করে রাখা হয়েছিল, তার নাম ছিল ‘উদ্যান’।
পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরে এই মহাকাশকেন্দ্রটিতে কৃত্রিম অভিকর্ষ বলের ব্যবস্থা করা
হয়েছিল, ফলে পৃথিবীর অনুকূল পরিবেশ এখানে তৈরি করে নিতে কোন সমস্যা হয় নি। পৃথিবীকে
ঘিরে পৃথিবীর সমান ঘূর্ণনবেগ বজায় রেখে মহাকাশকেন্দ্রে এই কৃত্রিম অভিকর্ষজ বলের সৃষ্টি
করা হয়। জীবনযাত্রা এখানে ছিল নিস্তরঙ্গ, শান্ত।
কিন্তু গণ্ডগোল
বাঁধল যেদিন ‘অলকা’ ধ্বংস হল।
‘অলকা’ ধ্বংসের
প্রভাবে সৃষ্ট বিস্ফোরণের অভিঘাত এবং টানা কয়েকদিন ধরে ঘটে যাওয়া চৌম্বক ঝড়ের প্রভাবে
আমাদের মহাকাশযান ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আসছিল; পৃথিবীতে তা আছড়ে পড়বার ভয়ে আমরা একটি মূল
মহাকাশযানে সকল প্রয়োজনীয় বস্তু, বন্দী ও অন্যান্য কর্মী সমেত আশ্রয়গ্রহণ করি। অল্প
কয়েকজন কর্মী মহাকাশকেন্দ্রে তখন অবস্থান করছিলেন তাকে সারিয়ে তোলবার প্রচেষ্টায়। পতনজনিত
বেগ ও অগ্নিসংযোগের ভয়ে আমরা মূল মহাকাশযানটিকে নামিয়ে আনি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ভিতরে।
এমনিতে কোন সমস্যা ছিল না, অভিঘাত সংক্রান্ত প্রাথমিক বিপর্যয় আমরা কাটিয়ে উঠেছিলাম
ততদিনে; কিন্তু চৌম্বক ঝড়ের একটি প্রভাব তখনো ছিল যা মাঝেমধ্যেই বিপর্যস্ত করে তুলত
আমাদের মহাকাশযানটিকে। ভিতরের পরিস্থিতি তখন হয়ে উঠত বিপর্যস্ত, বিশৃঙ্খল! এরকমই কোন
একটি বিশৃঙ্খলতার সুযোগে একদিন সুযোগ বুঝে বন্দী দেবতারা প্রথমে নিজেদের মুক্ত করেন
বন্দীশালা থেকে; তারপর সন্মোহনমুক্ত করেন নব-মানবগোষ্ঠীকে। এরপর ‘রামধনু পথ’ বেয়ে তাঁরা
নেমে পড়েন নীচে, কৃষ্ণ মহাদেশের বুকে, পাহাড়ে ঘেরা অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিতে। পলায়নের
সময় দেবতাদের বেশ কয়েকটি খেয়া-যান তাঁরা নিয়ে পালাতে সমর্থ হন; বাকিগুলিকে তাঁরা অকেজো
করে রেখে যান পিছনে।
কৃষ্ণ মহাদেশের
এই অংশে নেমে আসা ছাড়া তখন অন্য কোন পথ খোলা ছিল না, মহর্ষি মার্কণ্ডেয়! পৃথিবীর মানচিত্র
তখন প্রতিদিন পরিবর্তনশীল! এই ভবিষ্যদ্বাণী আমরা আগেই করেছিলাম যে ‘অলকা’বিনষ্ট হলে
পৃথিবীতে তার কি প্রভাব পড়তে পারে, এবং বাস্তবে তাই হল! স্থলবেষ্টিত কয়েকটি উঁচু অঞ্চল
বাদে অপরাপর কোথাও ডাঙার চিহ্নমাত্র নেই! চতুর্দিকে শুধু জল আর জল! আর সেই জলের নীচে
আমাদের এত বছরের সাধনা, আমাদের অমূল্য সব সৃষ্টি! সবই প্রায় শেষ, ইতস্তত বিক্ষিপ্ত
কিছু অঞ্চল বাদে; প্রাকৃতিকভাবে সুবিধাজনক অবস্থানের জন্য। জৈবভর এসব অঞ্চলগুলিতে যা
আছে, তাই আছে পড়ে, বাকি সবকিছুরই সলিল সমাধি।
এখন জল সরে যাওয়ার
পরের স্থিতাবস্থার সঙ্গে আপনি পরিচিত, মহর্ষি। পৃথিবীতে বর্তমানে তিনভাগ জল, একভাগ
স্থল। এই মহাবিপর্যয়ের পূর্বে স্থল ও জলের পরিমান পৃথিবীতে ছিল প্রায় আধা-আধি; বর্তমানে
যা কমে এসে দাঁড়িয়েছে এক-তৃতীয়াংশে! তবে, এর জন্য দায়ী এর পশ্চাতেই আরও একটি প্রলয়।
যাই হোক, মানবদের
কথায় ফেরৎ আসা যাক। এবং অবশ্যই সেই সকল বন্দী দেবতাদের কথায়, যারা তাদের সাহায্য করেছিল
এই পলায়নে। কৃষ্ণভূমিতে অবতরণের পর এই দেবতারাই সহযোগিতা করেন এই নবমানবগোষ্ঠীকে, নতুন
পরিবেশে তাদের মানিয়ে নিতে।
এই পলাতক দেবতাদের
ভুলেও সাধারণ দেবতা ভাবতে যাবেন না মহর্ষি! আপন দোষে এই দেবতারা দেবভূমি থেকে বিচ্যূত
হয়েছেন বটে, কিন্তু নিজ নিজ ক্ষেত্রে এঁনারা প্রত্যেকেই বিস্ময় প্রতিভা; নিজেদের কীর্তি
এঁরা স্থাপন করেছেন অন্যভাবে, অন্যক্ষেত্রে। গবেষক, চিকিৎসক, ভূতত্ত্ববিদ, স্থপতি,
আবিষ্কারক – সর্বোপরি প্রথম সারির যোদ্ধা এই সকল দেবতারা। কিন্তু, প্রত্যেকের একটিই
সমস্যা- সীমাহীন উচ্চাকাঙ্খা, যা এদের বিপথগামী করে তোলে! ‘উদ্যান’ থেকে পালিয়ে আসবার
পর কিছুদিন সময় লাগে এঁদের নিজেদের ধাতস্থ হতে; আরও কিছুদিন সময় অতিবাহিত হয় নবমানবগোষ্ঠীর
মূল ধারাটিকে আশেপাশের অঞ্চল থেকে খুঁজে বার করতে; তারপর এঁরা শুরু করেন এদের পরিকল্পনার
দ্বিতীয় ধাপ- নব-মানবগোষ্ঠী, যাদের শরীরে অসুরদের রক্তও বিদ্যমান, তাদের সংখ্যাবৃদ্ধি
করে একটি নতুন মানবপ্রজাতি নির্মাণ। যদিও তাঁদের হাতে উপকরণ ও আয়োজন- দুইই ছিল যৎসামান্য,
কিন্তু তাতে থেমে যাওয়ার মত ব্যক্তি ছিলেন না এই দেবতারা।
সংক্ষিপ্ত করি
বিষয়টা, সপ্তম বন্দীর বিচার চলছে, হাতে বেশি সময় নেই- অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে এই
দেবতারা সক্ষম হন কাজ-চালানো গোছের কিছু গবেষণাগার তৈরি করতে, যেগুলির কর্মপ্রণালী
অনেকটাই আদিম। ফলে জটিলতর পরীক্ষার দিকে তাঁরা অগ্রসর হতে পারেন নি। তাঁরা অবশ্য সেই
চেষ্টাও করেন নি। তবে ‘মদন’ ও ‘নীভা’কে দিয়ে কিছু অপত্য সৃষ্টি এঁরা করিয়েছিলেন এই
ক্ষেত্রে; কালক্রমে এদের মূল প্রজাতিটি সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে, অন্যান্য মানবগোষ্ঠীগুলির
সঙ্গে। বর্তমান পৃথিবীতে শীতল বা নাতিশীতোষ্ণ প্রদেশগুলিতে যে ভিন্ন বর্ণের মানব আপনারা
দেখেন, মনে করা হয় যে এদের সৃষ্টি এই আদিম দম্পতির মিলনের থেকে। আমরা অবশ্য এখনও নিশ্চিত
নই; বিষয়টি এখনও গবেষণাধীন-“
-“এখানে একটি
প্রশ্ন ছিল ভগবান!”- বাধা দিয়ে বলে উঠলেন মহর্ষি মার্কণ্ডেয় – “গাত্রবর্ণের রকমফেরের
প্রশ্ন যদি ওঠে, সেক্ষেত্রে প্রথমযুগের যে কৃষ্ণবর্ণের মানুষদের দেখা যেত ‘সিন্ধু নদ’অঞ্চলে-
তাদের থেকে আমাদের, আর্যদের গাত্রবর্ণ ও শারীরিক গড়ণ একেবারে আলাদা। আবার, সমগ্র বিশ্বের
কথা যদি তোলা হয়, শীতকালীন দেশগুলির মানবদের গায়ের বর্ণ আমাদের থেকে আবার সম্পূর্ণ
আলাদা। একই কথা খাটে গ্রীষ্মকালীন দেশগুলিতে অবস্থিত কৃষ্ণবর্ণের মানবদের ক্ষেত্রেও।
অঞ্চলভিত্তিক এই তারতম্য তাহলে সম্ভব হল কি করে, যদি আমরা সকলেই ‘মদন’ ও ‘নীভা’-র অধস্তন
সন্তান হই?”
-“নিশ্চিতভাবে
কোনকিছুই আর কখনোই বলা সম্ভব নয়, মহর্ষি! তার মূল কারণ, সময়ের স্রোতে ও পরপর ঘটে যাওয়া
প্রাকৃতিক দূর্যোগে কোন নিশ্চিত প্রমাণ খুঁজে বের করা অসম্ভব। তবে মনে করা হচ্ছে, যেহেতু
এই দুটি পরপর প্লাবনে পৃথিবীতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রগুলিতেই প্রাণ বিনষ্ট হয়ে যায়, তাই
‘মদন’ ও ‘নীভা’-র সন্তানরাই পৃথিবীতে আধিপত্য বিস্তার করে। তবে উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ বা
কৃষ্ণবর্ণের মানুষদের উপস্থিতিও প্রমাণ করে যে একটি সমান্তরাল মানবগোষ্ঠীর অস্তিত্বও
ছিল; পরবর্তীকালে তারা দোঁহায় মিলে এক হয়ে যায়। আর আপনি যে বর্ণভেদের বিষয়গুলি নিয়ে
প্রশ্ন তুললেন, তা অঞ্চলভেদে জলবায়ুর তারতম্যে ঘটতে পারে।
বর্তমান মানবগোষ্ঠীর
যে সাধারণ শারীরিক বিশেষত্ব, তার উদ্ভব কিন্তু ‘মদন’ ও ‘নীভা’-র মিলনে জাত সন্তানদের
থেকেই। এই সন্তানরা কিন্তু প্রত্যেকেই বুদ্ধিমান ও শারীরিকভাবে উন্নত শ্রেণীর। এই কারণেই
এই দম্পতিকে ‘মানবসভ্যতার পিতা-মাতা’ আখ্যা দেওয়া হয়।
যাই হোক, মূল
আখ্যানে ফেরৎ আসা যাক। দেবভূমি বিচ্যূত দেবতারা কিন্তু শুধুমাত্র এই একটি অঞ্চলেই নিজেদের
সীমাবদ্ধ রাখেন নি, আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে তাঁরা তাঁদের কার্যালয়ের দ্বিতীয় একটি
শাখা প্রতিষ্ঠা করেন অপর একটি প্রদেশে। এই প্রদেশটি ভূমিপুঞ্জ দ্বারা পরিবেষ্টিত; আরও
সুবিধা যে এটি শীতকালীন দেশ ও পাহাড়-পর্বত অধ্যুষিত হওয়ায় প্রাকৃতিক হিমঘরের কাজ করত;
ফলে সংরক্ষণের কোন অসুবিধাই ছিল না এই স্থলটিতে। ভূমধ্যভাগের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গের
কোল ঘেঁষে স্থাপনা করা হয়েছিল এই সংরক্ষণাগার; প্রলয়ের পর পর দেবতারা যেখান থেকে যা
প্রাণীর নমুনা খুঁজে পেয়েছেন, সব এনে জড়ো করেছিলেন নৌকো আকৃতির এই সংরক্ষণাগারটিতে।
এই শাখাটি স্থাপনের পিছনেও আরও একটি গূঢ় কারণ ছিল।
দ্বিতীয় একটি
মহাপ্রলয়ের কথা এর আগে উল্লেখ করেছিলাম না, মহর্ষি? এবারে তা শুনুন! আমরা, এবং নীচে,
পৃথিবীতে পলাতক বন্দী দেবতারাও জানতেন এই গ্রহে আরেকটি মহাপ্রলয় আসন্ন। পৃথিবীর সৃষ্টির
সময় থেকেই অসংখ্যবার এই গ্রহ দুটি দশার মধ্য দিয়ে গিয়েছে- উষ্ণযুগ, আর তাকে অনুসরণ
করে শীতল যুগ। দুটি যুগেরই স্থায়িত্বকাল পর্যায়ক্রমে বিরাট। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে,
পৃথিবীতে তখনও বিরাজমান ছিল ‘শীতলযুগ’, জায়গাবিশেষে তার হিমাঙ্কের নীচে থাকা তাপমাত্রা
নিয়ে। কিন্তু ‘অলকা’-র বিনাশ এই পৌনঃপুনিকতার হিসেব উল্টে দেয়; উষ্ণযুগ দ্রুত ফেরৎ
আসতে থাকে তার উত্তাপ নিয়ে। এই আগুণের আঁচ প্রথমে স্তিমিত ছিল, আস্তে আস্তে তার প্রভাব
দেখা দেয় বিশ্বের সর্বত্র!
পৃথিবীর ভূভাগের
একটি বড় অংশ, বিশেষতঃ উত্তর ও দক্ষিণ মেরুর সন্নিহিত অঞ্চলগুলি তখন শীতলযুগের প্রভাবে
তুষারাবৃত ছিল। এই তুষার বিশ্ব উষ্ণায়ণের প্রভাবে গলতে থাকে। ফলস্বরূপ, সমুদ্রের জলস্তরের
অস্বাভাবিক বৃদ্ধি; পৃথিবী তখন দাঁড়িয়ে আর একটি মহাপ্লাবনের ভ্রু-কূটির দোরগোড়ায়!
অঙ্ক কষে পতিত
দেবতারা জানতে পেরেছিলেন কবে এই মহাপ্লাবন ঘটতে চলেছে। তাঁরা সঠিক ক্ষেত্রগুলিকেও নির্ভুলভাবে
শনাক্ত করতে সক্ষম হন যে ক্ষেত্রগুলিতে প্লাবনের জল প্রবেশ করতে পারবে না, অথবা করলেও,
তার ধ্বংসাত্মক প্রভাব হবে সীমিত। এই কারণেই তাঁরা বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন
উচু পর্বতের কোল ঘেঁষা সমতল অঞ্চলটিতে সংরক্ষণাগার নির্মাণ করে; এমনকি পুরো ভবনটিকে
একটি নৌকার মত আকৃতি দিয়ে, যাতে জলে পড়লেও সেটি যেন কিছুক্ষণ ভেসে থাকে।
করিৎকর্মা ও
অপরিসীম সাহসি এই দেবতারা এরপর তাঁদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে
বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণীদের দেহাংশ সংগ্রহ করে জমা করেন এই সংরক্ষণাগারে। এরা সত্যিই
অসীম সাহসি দেবতা, মহর্ষি! ভুলে যাবেন না, ‘অলকা’ধ্বংসের প্রভাব পৃথিবীতে তখনও আসীন
এবং আমরা, নিরাপদ দূরত্বে থাকা দেবতারাও তখনও সাহস করে উঠতে পারি নি নীচের মাটিতে পা
রাখবার; এঁরা কিন্তু জীবন-মৃত্যুর তোয়াক্কা পর্যন্ত করেন নি, অভীষ্ট লক্ষ্যের পিছনে
দৌড়ে বেরিয়েছেন অহরহ! এই গ্রহের বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণীর নিদর্শন তাঁরা জমা করছিলেন
একটাই কারণে, যাতে ধ্বংসের পর পুনর্নির্মাণের প্রক্রিয়া সহজ হয়। এই সময়কালে একবারই
মাত্র আমরা সফল হই এদের অভিসন্ধিতে বিঘ্ন ঘটাতে; আমরা ‘মদন’ ও ‘নীভা’-কে পুনরুদ্ধার
করতে সক্ষম হই।
পতিত দেবতারা
এতে আরও সতর্ক হয়ে যান। তাঁরা এই দুইজনের গর্ভজাত সন্তানদের সর্বদা আলাদা করে রাখতেন;
সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে এবারে তাঁরা আরও একধাপ এগিয়ে গেলেন।
‘মদন’ ও ‘নীভা’-র
অষ্টম গর্ভজাত সন্তানটি যেন প্রকৃতিতে মদনেরই অনুরূপ প্রতিচ্ছবি! একইরকম গাত্রবর্ণ,
একইরকম আকৃতি-প্রকৃতি, শুধু বুদ্ধির মাত্রা যেন আরও বেশি তীক্ষ্ণ, আরও বেশি প্রখর।
এই অষ্টম বংশধরটি একটু স্বাবলম্বী হতেই তার বংশ সমেত পতিত দেবতারা তুলে নিয়ে রেখে দিয়ে
এলেন তাঁদের গোপন সংরক্ষাণাগারে। হয়তো একে জীবন্ত অবস্থাতেই সংরক্ষণ করতে চেয়েছিলেন
তাঁরা। ঘড়ির কাঁটা অনুযায়ী, মহাপ্লাবন তখন আসন্ন!
এরপরের ঘটনা
খুবই সংক্ষিপ্ত, মহর্ষি! নির্দিষ্ট সময়ে শুরু হল মহাপ্রলয়, বিন্দু-বিন্দুতে যে অতিরিক্ত
জল জমা হচ্ছিল সিন্ধুতে, তাতে একদিন সে বিদ্রোহ ঘোষণা করল! অবিশ্রাম, টানা একনাগাড়ে
বৃষ্টি, ভূমিকম্প এবং প্রলয়ংকর বন্যা- সমুদ্রের জল উঠে এল অনেকটা ওপরে। যারা ভূমিপরিবেষ্টিত
ছিল এবং উঁচু জায়গায় যাদের বসবাস, তারাই একমাত্র প্রাণে বাঁচল, বাকি সমস্ত প্রাণী ও
উদ্ভিদ পলকে ধ্বংস! সৃষ্টি ধ্বংস হল, আর তারই সঙ্গে শেষ হল এক বিপুল সম্ভাবনা!”
-“এই ধ্বংসের
কিছুটা আমি নিজের চোখে দেখেছি, ভগবান বিষ্ণুদেব! দূরদর্শনে। আপনার নিজস্ব অন্তরীক্ষ
যানে বসে। তখন অবশ্য- পুরো বিষয়টি আমার কাছে ‘মায়া’ মনে হয়েছিল। আর একটি কথা, ভগবান;
উন্নত প্রজাতির গন্ধর্বদের কি হল? তাঁরা কি এই প্রলয়েই-?”
-“সব কথা ক্রমপ্রকাশ্য,
মহর্ষি! আগের কথা আগে ব্যক্ত করি। কেমন?
মহাপ্রলয় ধীরে
ধীরে কেটে যাওয়ার পর পরিস্থিতি আবার আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হওয়া শুরু হয়। লুপ্ত ভূমিভাগ
আবার একটু একটু করে জেগে উঠতে শুরু করে; যদিও একটি বড় অংশের ভূমি জলের নীচেই থেকে যায়।
আগেই বলেছি মহাপ্লাবনের আগে পৃথিবীতে জল ও স্থল ছিল আধাআধি; কিন্তু মহাপ্লাবনের পর
পৃথিবীর তিনভাগ জলের অধিকারে চলে যায়, একভাগে থাকে স্থল।
পর্যবেক্ষণের
ফল দেখে দেবতাদের মাথায় হাত পড়ে যায়! যা কিছু ছিল, তার অধিকাংশই বিনষ্ট! আমাদের হাতে
তৈরি মানবরা অধিকাংশই শেষ; যা পড়ে রয়েছে তা যৎসামান্য। পতিত দেবতাদের তৈরি নিদর্শনগুলি
অবশ্য সবই প্রায় অক্ষত তাদের গোপন ও নিরাপদ আশ্রয়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সৃষ্টি প্রায়
লয় পেয়ে গিয়েছে।
আমাদের পক্ষ
থেকে সেইসময় একটিই কার্য করণীয় ছিল; আর সেটিই করেছি আমরা- ‘মদন’ ও ‘নীভা’-কে পৃথিবী
থেকে সরিয়ে নিয়ে আসা। সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি সময়ে নিয়ে এসে ওদের তালাবন্দী করে রেখে দিয়েছি
আমাদের এই গোপন ও নিরাপদ আশ্রয়ে। নিয়ন্ত্রিত জননের সাহায্যে সম্ভূত অপত্যদের ওপর গবেষণা
হয়; তারপর চূড়ান্ত নির্বাচিত সদস্যদের সময়চক্রের বিভিন্ন শাখায় নিয়ে গিয়ে ছেড়ে আসা
হয় এদের নিজ প্রজাতির মধ্যে। বেশিরভাগই মিশে গিয়েছে নতুন দলে, নতুন পরিবেশের মধ্যে।
অল্প কয়েকজন অবশ্য মারা গিয়েছে এই প্রক্রিয়ায়; সাফল্যের নিরিখে এই ব্যর্থতার উদাহরণ
অবশ্য হাতে গোণা-“
-“’ছেড়ে আসবার’
অর্থ, প্রভু? প্রক্রিয়াটি সঠিক…বুঝতে পারলাম না।”
-“সদ্য সন্তান
হারানো কোন মায়ের কাছে নবজাতক অপত্যকে রেখে আসা হয়; সদ্য সন্তান হারানোর বেদনায় জর্জরিত
মা সন্তানস্নেহে সেই অপত্যকে টেনে নেন মাতৃক্রোড়ে। এটিই সব থেকে কার্যকর প্রক্রিয়া,
নিরুপদ্রপে গবেষণাকৃত অপত্যকে মানবসমাজে মিশিয়ে দেওয়া। এছাড়াও বিকল্প পথও আছে, কৃত্রিম
উপায়ে গর্ভাধান। এই প্রক্রিয়াটি অবশ্য ব্যয় ও সময়সাপেক্ষ, ফল অনিশ্চিত। পূর্ণবয়স্ক
অবস্থায় অবশ্য কোন নব-মানবকে কোন দলে ঠেলা যায় না।
মোটের ওপর, এই
হল এই নবীন আধুনিক মানবদের একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, মহর্ষি মার্কণ্ডেয়।”
ভগবান বিষ্ণুদেবের
এই সুদীর্ঘ বক্তব্যের পর খানিক্ষণের জন্য নিশ্চুপ ও আনমনা হয়ে গেলেন মহর্ষি মার্কণ্ডেয়।
তিনি সত্যিই ভাগ্যবান, নিজের চোখে তিনি দর্শন করলেন আধুনিক মানবদের আদিপিতা ও মাতাকে!
বিষয়টা নিয়ে যদিও একটি মতবিভেদ রয়েছে, তাও, মানবদের প্রস্তাবিত মূল ধারাটির মনুষ্যরূপ
চোখের সামনে দর্শন করতে পারাও ক্ষুদ্র বিষয় নয়। কি বিচিত্র এই ভাঙা-গড়ার খেলা! খাঁচার
ভিতর বন্দী এক আদিম নর-নারী, যাদের সঙ্গে প্রকৃতিগতভাবে বর্তমান মানবগোষ্ঠীর কোন মিলই
নেই, এরা নিশ্চিতভাবেই বাঁদর নয়, আবার বর্তমান মানবদের সঙ্গেও যাদের বিস্তর প্রভেদ;
একই রক্ত তাদের শরীরে, মধ্যিখানে শুধু দুস্তর সময়ের ব্যবধান। এই কি বিধির বাঁধন?
-“অষ্টম অভিযুক্ত – ব্যূহ! শীঘ্র করুন!!”
ঘোষিকার ঘোষণায়
চমকে উঠে আবার বাস্তবে ফেরৎ এলেন মহর্ষি মার্কণ্ডেয়। ভাবের জগৎে চলে গিয়েছিলেন তিনি,
এখন ঘোষিকার এই যান্ত্রিক কন্ঠস্বর তাঁকে ঘোর কাটিয়ে উঠতে সহযোগিতা করল। তিনি বিচারাধীন
বন্দী, তাঁকে ভগবানের দেওয়া দণ্ড মাথা পেতে নিতে হবে। সামলে নিয়ে সামনে দাঁড়ানো ভগবান
বিষ্ণুদেবকে কিছু বলতে যাবেন, এমন সময় স্পষ্ট শুনতে পেলেন পিছন থেকে নীচুস্বরে জড়ানো
গলায় ‘মদন’এর একটানা কন্ঠস্বর-
-“অভিযুক্ত…
দ্যূহ… অভিযুক্ত… দ্যূহ… দ্যূহ…”
একটি কথাই পর্যায়ক্রমে
উচ্চারণ করে চলেছে ‘মদন’! অস্পষ্টভাবে ‘ব্যূহ’ কথাটি মহর্ষির কানে শোনাল ‘দ্যূহ’। কিন্তু
সেদিকে তখন মন নেই তাঁর, তিনি শুধু বিস্মিত এই ভেবে যে এই আদিম মানব দম্পতি তা হলে
কথা বলতেও সক্ষম! তিনি আবিষ্ট হয়ে তাকিয়েই থাকলেন তাদের দিকে।
-“বিচারকরা সকলেই
আপনার জন্য অপেক্ষমান, মহর্ষি! চলুন, আর বেশি দেরি করা উচিৎ হবে না। আমি উপযাচক হয়ে
এগিয়ে এসেছিলাম আপনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আসুন।”
-“আমাকে পথ দেখান,
ভগবান!”
মাথা নীচু করে
ভগবান শ্রীবিষ্ণুদেবের পিছু পিছু এগিয়ে চললেন মহর্ষি মার্কণ্ডেয়।
[চলবে...]
RELEVANT LINKS (দ্যা লেগ্যাসি অফ্ রাম: আদি পর্বের অপর অধ্যায়গুলি):
আমার এই ছোট প্রয়াসটি কেমন লাগছে আপনাদের? জানাতে দ্বিধা করবেন না। আপনারা আমার সম্পর্কে আরও জানতে পারেন নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে:
আপনারা আমার পাঠ করা গল্প শুনতে পারেন আমার ইউটিউব চ্যানেলে
আপনারা সরাসরি ট্যুইট করতে পারেন আমায়
নতুন খবরগুলি সম্পর্কে আপডেট পেতে পারেন আমার পেজে
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আমাদের ব্লগগুলি আপনাদের কেমন লাগছে? অবশ্যই জানান আমাদের-