A little Discussion on 'The Legacy Of Ram (লেগ্যাসি অফ্ রাম)'- Five Memorable Moments in the Bengali, Science fiction, suspense thriller story
দ্যা লেগ্যাসি অফ্ রাম- নিঃসঙ্গ যাত্রার সূচনা প্রসঙ্গে দু-চার কথা- পর্ব৪
-লেগ্যাসি সমগ্রের সেরা পাঁচটি স্মরণীয় মুহুর্ত্ত: আলোচনায় লেখক (অরিত্র দাস)
Aritra Das on The Legacy of Ram- Five mode-changing moments |
এ যেন বাস্তবিক অর্থে খড়ের গাদায় সূঁচ খুঁজতে যাওয়া!
এ
কথা প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া ভাল- ‘লেগ্যাসি’ সমগ্রটির মত এতটা জটিল, ঘটনাবহুল সমগ্র
এর আগে তো বটেই, এর পরেও আমার হাত দিয়ে বেরোয় নি, অন্তত এখনও অবধি। একটি উপন্যাসসমগ্র,
যার প্রেক্ষাপটে একটি অপসারিত প্রজাতির শেষ সংগ্রামমুখর দিনগুলির রোজনামচা, আবার একই
সাথে সেখানে উপস্থিত দর্শন ও গভীর মূল্যবোধ, সামাজিক বিধিপালন ও পারষ্পরিক সম্পর্কগুলির
টানাপোড়েন। ব্যাপারটা এখানে শেষ হলেও হত, কিন্তু একই সমগ্রে আবার সম্পৃক্ত বিশ্বের
অন্যান্য পৌরাণিক চরিত্রগুলি (‘অ্যাল্কমেনা-পুত্র’ বা ‘সাগরপাড়ের একচক্ষু দেবতা’ দ্রষ্টব্য),
সাম্প্রতিক কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক খোঁজ বা সন্ধান (‘বাগদাদ ব্যাটারি’ বলে পরিচিত বস্তুটিকে
একটু ইন্টারনেট সার্চ করলেই পাওয়া যেতে পারে), বিলুপ্ত একটুকরো ইতিহাসকে খোঁজ করে বেরানো,
প্রাচীন ভারত ও সমসাময়িক বিশ্বের অন্যান্য সভ্যতাগুলির আচার-আচরণের মধ্যে সামঞ্জস্য
খুঁজে বের করার চেষ্টা, এবং অবশ্যই ‘কনস্পিরেসি থিওরি’র কিছু বেয়াড়া প্রশ্ন, মহর্ষি
ব্যাসদেবকে নায়ক করে এগনো মূলধারার গল্পটি – সব মিলিয়ে এমন একটি উপন্যাস যা যেকোন অনুসন্ধিৎসু
মনে কিছু প্রশ্ন তুলে দিতে বাধ্য!
এরকম
আদ্যপান্ত একটি জটিল, ঠাসবুনোট উপন্যাস থেকে পাঁচটি স্মরণীয় মুহুর্ত্ত তুলে আনা চাট্টিখানি
কথা না! প্রথমে দুহাত তুলে দিয়েছিলাম, নিজেকে প্রবোধ দিয়েছিলাম এই বলে যে কর্মটি শুধু
জটিল নয়, অসম্ভবও বটে! গোটা সমগ্রটি জুড়ে বিভিন্ন দশায়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে এত বিভিন্ন
‘মুড’-এ বিভিন্ন মুহুর্ত্তগুলি উপস্থিত রয়েছে যে এতগুলি সাতরঙা মুহুর্ত্ত থেকে কোন
অবস্থাতেই সম্ভব নয় ‘রোমাঞ্চকর পাঁচটি মুহুর্ত্ত’ তুলে আনা! কিন্তু এই স্বর্গীয় চিন্তা
অচিরাৎ বাতিল করতে হল, কারণ – যদি গল্পের ‘কি-পয়েন্টস’ দর্শকদের কাছে তুলে ধরা না হয়,
তবে দর্শকরা আগ্রহ ও ধৈর্য্য, দুটিই হারিয়ে ফেলতে পারেন! এই কারণেই হাতে কলম তুলে নেওয়া;
যদিও এর পরের ব্যাটনটি কিন্তু আমি দর্শকদের হাতে তুলে দিতে চাই। আপনারাই পরবর্ত্তী
সিদ্ধান্ত নেবেন- এই ‘মুহুর্ত্তচয়ন’ বিষয়টি সঠিক হয়েছে, না কি কিছু বাদ পড়ে গেল যা
স্মরণীয় মুহুর্ত্তের তালিকায় আসা উচিৎ ছিল! সিদ্ধান্ত আপনাদের হাতে।
দ্যা লেগ্যাসি অফ্ রাম উপন্যাস-সমগ্রের প্লটটির বিষয়ে আমার দু-চার কথা শুনতে পড়ুন এখানে!
প্রথম মুহুর্ত্ত নির্বাচন: মহর্ষি মার্কণ্ডেয়র জন্য দেবতাদের দেওয়া শাস্তির বিধান:
এটি
কিন্তু সবার আগে রাখলাম, কোন দ্বিধা ছাড়াই। এটি দেখানো হয়েছে আদি পর্বে (দ্যা লেগ্যাসি
অফ্ রাম- প্রলগ (আদি পর্ব)) ।
মহর্ষি
মার্কণ্ডেয় একটি গর্হিত অপরাধ করেছিলেন; ‘কালাতীত’ সংঘের বিধান ভেঙে তিনি মহর্ষি বাল্মীকিকে
নিয়ে কালভ্রমণ করেছিলেন! দেবতাদের চোখে এটি ছিল নিয়মবিরুদ্ধ অপরাধ, এই কারণে মহর্ষি
মার্কণ্ডেয়কে দণ্ডের মুখে পড়তে হয়।
পুরো
অংশটি যদি পড়ে দেখা যায় তবে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হবে- এখানে অনেকগুলি ধর্মীয় ও পৌরাণিক
তত্ত্বের প্রয়োগ ঘটেছে। যেমন- বাইবেল অনুযায়ী মানবগোষ্ঠীর সৃষ্টিতত্ত্ব। সৃষ্টির প্রথম
মানব-মানবী অ্যাডাম ও ঈভ স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হন পৃথিবীর বুকে, এভাবেই সৃষ্টি হয় পৃথিবীর
বুকে প্রথম সার্থক মানবগোষ্ঠী। এই প্রথম সার্থক মানব-মানবীর অষ্টমপুরুষ হবেন নোয়া,
যিনি পূর্বতন জীর্ণ-দীর্ণ মানবগোষ্ঠীকে ধ্বংস করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে দেবতাদের প্রেরণ
করা মহাপ্লাবনের হাত থেকে রক্ষা করবেন মনুষ্যেতর প্রাণীদের, ফলে মহাপ্লাবনের পরেও নতুন
করে আবার ভরে উঠবে পৃথিবী, বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণীদের প্রাণবৈচিত্র্যে! এককথায়, এটিই
হল চুম্বকসারে বাইবেলবর্ণিত সৃষ্টিতত্ত্বের একটি সরলীকৃত রূপ, যদিও এর ব্যাখ্যা নিয়ে
অনেক তর্কও রয়েছে।
এই
চিরন্তন প্রশ্নটির একটি কাল্পনিক ব্যাখ্যা রয়েছে ঠিক এই অংশটিতেই। বিচারকক্ষের বাইরে
মহর্ষি মার্কণ্ডেয় যখন অপেক্ষা করছিলেন খাঁচায় বন্দী বিভিন্ন যুগের বানর-মানবদের নিয়ে
জড়ো করা একটি প্রশস্ত দালান-কক্ষে, তখন একটি বিশেষ খাঁচায় তাঁর দৃষ্টি আকর্ষিত হয়;
এই খাঁচায় যে বানর-মানব যুগল ছিলেন (দুটি মাত্র বানর-মানব ছিলেন এই বিশেষ খাঁচাটিতে,
একটি মদ্দা, অপরটি মাদী) তারা ঐ কক্ষে খাঁচায় বন্দী অপর যেকোন বানর-মানবদের থেকে সম্পূর্ণ
আলাদা ছিলেন…তাদের আচার-আচরণ এতটাই স্বতন্ত্র্য ছিল মহর্ষি মার্কণ্ডেয়র দৃষ্টি আকর্ষিত
হয় তাদের প্রতি-
-“…এদেরই খাঁচার সারির একদম
শেষপ্রান্তে সবার থেকে আলাদা যে খাঁচাটি আছে, তার সামনে এসে একটু অবাকই হয়ে গেলেন মহর্ষি
মার্কণ্ডেয়। দূর থেকে প্রথমে তিনি খাঁচাটিকে শূণ্য ভেবে ছিলেন; কিন্তু না! খাঁচার ভিতরে
আশ্চর্যজনকভাবে শান্ত হয়ে বসেছিল এক বানর-দম্পতি; ভালো করে মহর্ষি তাকিয়ে দেখতে লাগলেন
তাদেরকে।
“...এরা কিন্তু এই কক্ষে
উপস্থিত অন্যান্য বানর-মানবদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, একেবারে স্বতন্ত্র প্রজাতির। চেহারাগতভাবে
এদের মিল কিন্তু অন্যান্য বানরদের মত নয়, বরং তাদের থেকে অনেকটাই পৃথক। গায়ে রোম উল্লেখযোগ্যভাবে
অনেকটাই কম; মাথায় পরিষ্কার কেশরাশি, এমনকি যে সামান্য সময়ের জন্য এরা একটু নড়াচড়া
করেছিল তাতে মহর্ষি মার্কণ্ডেয় বুঝতে পারলেন পিছনে এদের লেজ প্রায় নেই বললেই চলে! এদের
পূর্বজ প্রজাতির সঙ্গে শারীরবৃত্তীয় সাদৃশ্যের পরিবর্তে এদের শারীরিক আদল বরং সেই মানবদের
সঙ্গেই বেশি, যাদের দেখা যেত নব-প্রস্তরযুগের গোড়ার দিকে! চোয়ালের কাছটায় কিছুটা সাদৃশ্য
থাকলেও গোটা শরীরে পূর্ববর্ত্তী বানরদের সঙ্গে এদের কোন মিল নেই।
তবে অবাক করবার বিষয় আরো
আছে। এই দম্পতির মানবীটির গাত্রবর্ণের সঙ্গে তিনি পরিচিত; বর্তমান বিশ্বে যে বর্ণের
মানবপ্রজাতি দেখা যায় তার থেকে ভিন্ন কিছু নয়। কিন্তু মানবটির গায়ের রং একেবারে আলাদা;
পুরোপুরি ধপধপে ফর্সা! এরকমটি কি করে সম্ভব? কর্মসূত্রে পৃথিবীর পরিমণ্ডলের মধ্যে বিভিন্ন
জায়গায় তাঁকে ঘুরতে হয়েছে, অঞ্চলভেদে গাত্রবর্ণের তারতম্যের সঙ্গে তিনি সম্যক পরিচিত;
অতি-গ্রীষ্মের দেশগুলিতে মিশকালো মানব বা অতি-শীতের দেশের হালকা লালচে শ্বেত বর্ণের
প্রভাব তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন, কিন্তু এরকম বেয়াড়া ও অদ্ভুত ‘শ্বেতশুভ্র’ গাত্রবর্ণ তিনি এই প্রথম দেখছেন! এ কি ব্যাপার?”
সৌভাগ্যক্রমে
শ্রীবিষ্ণুদেবের সাথে তাঁর ভেট হয়, তাঁর কাছ থেকেই মহর্ষি মার্কণ্ডেয় মূল বিষয়টি জানতে
পারেন-
-“এরা বাকিদের মত মানবসভ্যতার
বিবর্তনের কোন স্বাভাবিক পর্যায় নয়, মহর্ষি; কৃত্রিমভাবে গবেষণাজাত মানবসন্তান, যাদের
জন্ম না হলে সম্ভবতঃ আপনাদের বিবর্তন আসতে আরো দেরি হতে পারত!”
শ্রীবিষ্ণুদেবের
কাছ থেকেই মহর্ষি মার্কণ্ডেয় জানতে পারেন আধুনিক মানুষদের বিবর্তনের একটি ইতিহাস, অবশ্যই
যা কল্পনাশ্রয়ী, কিন্তু তার উৎস কিন্তু অনেকটাই বাইবেল-বর্ণিত সৃষ্টিতত্ত্বের ব্যাখ্যা।
এই অংশটি জুড়ে এরকম কাল্পনিক, প্রতীকী ব্যাখ্যা আরও অনেক রয়েছে, তবে মূলগত বিষয়টি কিন্তু
লুকিয়ে ‘শাস্তি’র মধ্যেই, যেমন, মহর্ষি মার্কণ্ডেয়কে দেওয়া দণ্ডের বর্ণনা-
“…বিধি অনুযায়ী, অনথিভূক্ত
কালভ্রমণের শাস্তি অনির্দিষ্টকালের জন্য ‘কালচক্র’, যার অর্থ এককথায় অনন্তকাল পার্থিব দুঃখভোগ। আপনার আত্মাকে বারংবার জন্ম নিতে
হোত পৃথিবীতে, অনন্তকাল ধরে সংবাহিত হত এই পার্থিব জন্ম। যেহেতু আপনি ভাল উদ্দেশ্যে
এই বিধি লঙ্ঘণ করেছেন, তাই আমরা এই পুনর্জন্মের মেয়াদ ঠিক করেছি… আশিবার। হ্যাঁ, আপনাকে আশিবার পৃথিবীতে পুনর্জন্ম নিতে হবে বিভিন্ন প্রাণীর রূপ
ধরে; যতক্ষণ না আপনি জন্ম নিচ্ছেন স্বরূপে ও স্বমহিমায়, আপনার নিজের সময়ে, মনুষ্য অবতারে।
অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হতে চলেছে আপনার এই মনুষ্যজন্ম।”
শ্রীবিষ্ণুও
এই কালভ্রমণে নেপথ্যে থেকে সহায়তা করেছিলেন মহর্ষি মার্কণ্ডেয়কে, তাই দেবতারা কিছু
দণ্ড দেন তাঁকেও! শ্রীবিষ্ণুদেবের জন্য বরাদ্দ দণ্ডের বর্ণনা অনুযায়ী-
-“…আপনি ‘কালাতীত’ সংঘের প্রাতিষ্ঠানিক সদস্য পদে আসীন থাকা অবস্থায় সংঘের বিধিলঙ্ঘণ করেছেন। অপরদিকে,
সম্পূর্ণ একক প্রচেষ্টায় এই কালজয়ী সংঘের প্রতিষ্ঠাতা আপনি; এর ভালো-মন্দের প্রতি বিভিন্ন
সময়ে আপনি যে অবদান রেখেছেন তার জন্য দেবকূল আপনার কাছে ঋণী। সমস্ত কিছু মাথায় রেখে-
আমরা আপনার জন্য একটি শাস্তিই বিধান করলাম। তা হল- আপনাকে এখন থেকে দশবার পৃথিবীতে
জন্মগ্রহণ করতে হবে। ‘অমর্ত্য’-র শিরোভূষণ পরিত্যাগ করে নেমে আসতে হবে মরণশীলদের সঙ্গে একই সমতলে। বিচারশেষে
আপনি আমার গোপন কক্ষে আমার সঙ্গে একান্তে সাক্ষাৎ করবেন; আপনার ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব
সম্পর্কে আপনার সঙ্গে আমার কিছু ব্যক্তিগত আলোচনা এই বেলাতেই সেরে রাখা প্রয়োজন। আপনি
এখন বিদায় নিতে পারেন, শ্রীবিষ্ণূ! আশা করি পৃথিবীতে জন্মগ্রহণের প্রক্রিয়া সম্পর্কে
আপনাকে নতুন করে অবহিত করবার কোন প্রয়োজন নেই?”
‘আশিবার
পৃথিবীতে জন্ম নিতে হবে বিভিন্ন প্রাণীর রূপ ধরে…নিজের সময়ে মনুষ্য অবতারে জন্মগ্রহণের
আগে…’ বা ‘দশবার পৃথিবীতে জন্ম নিতে হবে মরণশীলদের মাঝখানে’…এই বিষয়দুটি কোন তত্ত্বগুলির
সঙ্গে খাপ খায়? এই বিষয়গুলি বিবেচনার ভার পাঠকদের হাতে ছেড়ে দিলাম। আপনারাই বিচার করুন,
কোন মতবাদগুলিকে তুলে আনা হয়েছে গল্পচ্ছলে?
আপনাদের
মতামত জানবার অপেক্ষায় রইলাম।
দ্যা লেগ্যাসি অফ্ রাম উপন্যাস-সমগ্রের বিবিধ চরিত্রগুলির নামকরণ কিভাবে স্থির হয়?
দ্বিতীয় মুহুর্ত্ত নির্বাচন: মহর্ষি ব্যাসদেবের ‘মিশ্র’ দেশ দর্শন
প্রথম
পর্বটি যেখানে শেষ হয়েছিল, দ্বিতীয় পর্বটির সূচনা সেখান থেকেই; আহত মহর্ষি ব্যাসদেবকে
গণপতিদেব ও মহর্ষি মার্কণ্ডেয় নিয়ে আসেন ‘মিশ্র’ প্রদেশে, দেবতাদের গুপ্ত একটি কার্যালয়ে।
এখানেই আরোগ্যলাভ করেন মহর্ষি ব্যাসদেব, আর এখান থেকেই শুরু হয় পরবর্ত্তী পর্যায়- নতুন
দেশের নতুন আচার-আচরণ, সংস্কৃতি, জনশ্রুতি, সর্বোপরি স্থাপত্য ও ধর্মবিশ্বাস দেখে প্রশ্ন
উঠতে শুরু করে তাঁর মনে। তবে কি তিনি কোন দর্পণের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন? এই বিচিত্র প্রদেশের
বিকাশের ব্যাপারে মুখ খোলেন মহর্ষি মার্কণ্ডেয়, অনেক কথাই শোনান তিনি মহর্ষি ব্যাসদেবকে-
-“বহুযুগ আগে মানুষ যখন
বুদ্ধিবৃত্তির আদিম স্তরে ছিল, তখন ‘মিশ্র’ প্রদেশের দায়িত্বভার ন্যস্ত ছিল দেবতাদের
কাঁধেই। তাঁরাই তখন রাজত্ব করতেন এখানে। অনেক পরে যখন মানুষরা স্থিতবুদ্ধি হয়ে ওঠে
তখন তাঁরা ক্ষমতার হস্তান্তর করে ফেরৎ চলে যান নিজেদের গৃহে- সে অবশ্য অনেক পরের কথা-“
জম্বুদ্বীপ
ও মিশ্র প্রদেশের বিভিন্ন আচার-আচরণগত নৈকট্য বিষ্মিত করে মহর্ষি ব্যাসদেবকে, এই নিয়েও
প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি। তাঁর মনের বিষ্ময়গুলিই ফুটে উঠেছে তাঁর করা প্রশ্নগুলির মধ্য
দিয়ে-
“এইখানে যে সময়টুকু রয়েছি
তাতে আমার বারংবার মনে হচ্ছে কেন যে এখানকার বেশ কিছু রীতি-নীতির সঙ্গে অবিকল সাদৃশ্য
রয়েছে আমাদের স্বদেশের বেশ কিছু রীতির?”
-“যেমন?”- তাঁর দিকে তাকিয়ে
প্রশ্ন করলেন মহর্ষি মার্কণ্ডেয়।
-“যেমন- প্রকৃতি উপাসনা।
এই প্রদেশ- কি যেন নাম বলেছিলেন…’মিশ্র’ প্রদেশ- এখানকার অধিবাসীরা যেমন সূর্যদেবের উপাসনা করেন, তেমনি সূর্যদেবের পূজোর
চল আমাদের দেশেও রয়েছে। এরা মূর্তিপুজোয় খুব একটা বিশ্বাসী নন; মূর্তি এদের কাছে একটি
আভিধানিক উপাচার মাত্র, যেমন দেবতাদের তিন-ভবনের মাঝখানের সবচেয়ে দীর্ঘ ভবনটির চূড়োয়
বসানো ঐ মূর্তিটি- ওর তো কোন পূজো হতে দেখি নি কোনদিন; এর থেকেই আমার এইরূপ স্বতঃসিদ্ধান্ত।
যাইহোক, যা বলতে চাইছি তা হল, স্বদেশেও তো মূর্তিপূজোর তেমন প্রচলন নেই। তাছাড়া…”
-“তাছাড়া?”
একটু ইতস্তত করে পুনরায়
বলে উঠলেন মহর্ষি ব্যাসদেব-
-“তাছাড়া মৃত্যু ও শরীরের
পুনর্জন্ম তত্ত্বে একটু আঞ্চলিক প্রভাব থাকলেও মূল তত্ত্বটি কিন্তু মোটের ওপর একই-
আত্মার শরীরকে ছেড়ে যাওয়া এবং পুনরায় অন্য কোন রূপে তার ফেরৎ আসা। এই বিশ্বাস তো যুগের
পর যুগ ধরে আমাদের দেশে চলে এসেছে; স্বয়ং মহর্ষি বাল্মীকির অমর কাব্যে ধ্বণিত হয়েছে
এই বিশ্বাস! এখানেই আমার মনে একটা প্রশ্ন জাগছে, এরা আমাদের কোন সুদূর আত্মীয় নয় তো?”
দ্যা লেগ্যাসি অফ্ রাম উপন্যাস-সমগ্রের কিছু না-বলা কথা
মিশ্র
প্রদেশের যে স্থাপত্যগুলি মহর্ষি ব্যাসদেবের মনে বিষ্ময় জাগিয়ে তুলেছে, চলুন একবার
ফিরে দেখা যাক সেগুলিকে-
‘ত্রিকাল’ ভবন:
‘মানুষ
ভয় পায় সময়কে, সময় ভয় পায়- পিরামিডকে!’- মিশরের বিশ্ববিখ্যাত গিজার তিনটি পিরামিড যেগুলি
নিয়ে কৌতুহল, জিজ্ঞাসা- কোন কিছুরই যেন শেষ নেই! বহুল প্রচলিত মত অনুযায়ী ফারাও তৃতীয়
খফ্রুর আমলে তৈরি এই পিরামিড, যদিও এর উৎপত্তিকাল কবে তা নিয়ে বিতর্কও প্রচুর। গ্রীক
ঐতিহাসিক হেরেডোটাস মিশরে গিয়ে ঐ পিরামিডগুলিকে দেখেন; স্থানীয়দের মতামত অনুযায়ী তখনই
ওগুলির বয়স হাজার ছুঁই-ছুঁই! আর স্ফিংক্স? মনে রাখা প্রয়োজন- এই সুবিশাল স্থাপত্যের
পুরোটাই একদিন চাপা পড়ে ছিল বালির নীচে, ফ্যারাও থুথমিস স্বপ্নাদেশ পেয়ে প্রথমবার এটিকে
খুঁড়ে তোলেন, কিন্তু আবার সেটি বালির নীচে চলে যায়, সেটিও খৃীষ্টের জন্মের বহুবছর আগেকার
কথা! ১৯৩০ সালের আধুনিক বিশ্বে শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয় স্ফিংক্সকে বালুকামুক্ত করতে।
পরবর্ত্তীতে অনেকগুলি গাণিতীক তত্ত্ব উঠে আসে পিরামিড ও স্ফিংক্স থেকে।
কোন
সন্দেহ নেই এই অনন্য স্থাপত্য মহর্ষি ব্যাসদেবকে বিষ্মিত করবে, তিনি প্রশ্ন করবেন বারংবার।
গোলোকধাঁধা বা ল্যাবাইরিন্থ:
-“একটি
সুপ্রশস্ত, সুগভীর খালের ধারে সারিবদ্ধ অজস্র ঘর, চতুষ্কোণী বিন্যাসে সজ্জিত এই ঘরগুলির
প্রতিটি দেখতে একই রকম; একইরকম গলি-ঘুঁজি, রাস্তাঘাট, পথের মোড়! এই ঘরবাড়ির সারির শেষপ্রান্তে
সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র্যভাবে অবস্থান করছে বিশাল একটি পিরামিড, আর ঘরবাড়িগুলির কেন্দ্রস্থলে
রয়েছে একটি নাতিবৃহৎ অট্টালিকা। ঐ অট্টালিকার ভিতরে রয়েছে একসার সিঁড়ি, তা সোজা নেমে
গিয়েছে ভূগর্ভস্থ একটি পাতালপুরীতে। জনশ্রুতি অনুযায়ী- ঐ পাতালপুরীতে রয়েছে বারোজন
রাজার দেহ, যারা মিশকে শাসন করেছিলেন লক্ষাধিক বছর ধরে!”
ইতিহাসের
হারিয়ে যাওয়া পাতা থেকে বিস্মৃত একটি অধ্যায়- গোলোকধাঁধা! গ্রীক ঐতিহাসিক হেরেডোটাসের
বিবরণ এমনটিই লেখা ছিল গোলোকধাঁধা সম্পর্কে; যদিও সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে পারেন নি তিনি,
অনুমতি ছিল না। একমাত্র ফ্যারাও ও ইমহোটেপ এবং তাঁর কিছু উচ্চপদস্থ অনুচরদের প্রবেশাধিকার
ছিল ঐ ভূগর্ভস্থ ঘরগুলিতে প্রবেশের! এই আস্ত গোলোকধাঁধাটি তার সুবিশাল পিরামিডসমেত
যে খালের ধারে অবস্থান করছিল সেটি ছিল ‘মোয়েরিস’ বা মিরিস খাল, যা জল ঢালত মিরিস হ্রদ
ও তৎসংলগ্ন উপত্যকা অঞ্চলে। এই খালটিতে আবার আংশিক নিমজ্জিত ছিল তিনটি পিরামিড, যার
মাঝেরটি আকারে বড়, তবে কোনটিই অবশ্য ধারে ও ভারে গোলোকধাঁধাঁর সাথে একই তলে অবস্থান
করা পিরামিডটিকে টপকাতে পারে নি!
হেরেডোটাস
বর্ণিত এই গোলোকধাঁধাঁকে খুঁজে পাওয়া যায় পরবর্ত্তী যুগের ডিওডালাস সাইটোকিউলাসের বিবরণীতেও,
এবং তার পর স্ট্র্যাবোর বিবরণীতেও, কিন্তু তার পর…ধীরে ধীরে ইতিহাসের পাতা থেকে সম্পূর্ণ
উধাও হয়ে যায় এই বিপুল স্থাপত্যটি! এইখানেই উঠে আসে কল্পনার প্রশ্ন- কি ছিল হারিয়ে
যাওয়া সেই গোলোকধাঁধাঁর কেন্দ্রস্থলে মাটির নীচের সেই পাতালপুরীতে? ‘কল্পনা বিনে গতি
নাই’- সেই খালও শুকিয়ে গিয়েছে, সেই গোলোকধাঁধাঁও! কল্পনার আলোকে একে ধরা ছাড়া আর উপায়ও
নেই-
-“…গাণিতীক স্থাপত্যবিদ্যার
সবথেকে নিখুঁততম নিদর্শন কোন পর্যায়ে যেতে পারে তার একটি অন্যতম দৃষ্টান্ত হওয়া উচিৎ
গোলোকধাঁধাঁ। যদিও, মহর্ষি মার্কণ্ডেয়র মতে গণিতের সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট নিদর্শন দাঁড়িয়ে
আছে সামনে- দেবতাদের নির্মিত তিনটি ভবন। সেখানে যাওয়ার কোন উপায়ই নেই, খালের একেবারে
মাঝামাঝি গহন জলে এদের অবস্থান। এই ভবন তিনটি সম্পর্কে একটি অদ্ভুত চালু প্রবাদ শোনালেন
মহর্ষি মার্কণ্ডেয়-
-“মানুষ ভয় পায় সময়কে, আর
সময় ভয় পায় এদের!”
ষাঁড়ের মন্দির:
মিশরের
পবিত্র ‘ষাঁড়ের মন্দির’ বা ‘অ্যাপিস দেবতার মন্দির’ সেই অর্থে কোনদিন খুঁজেই পাওয়া
যায় নি। অ্যাপিস ষাঁড় সম্পর্কে মিশরীয়রা মনে করতেন – এই পবিত্র ষাঁড়েদের এবং অন্যান্য
বিশেষ প্রাণীদের জন্ম পৃথিবীর বুকে নয়, দেবতাদের বাসগৃহে; সেখানে জন্ম নিয়ে এই ষাঁড়
ও অন্যান্য প্রাণীরা রামধনু পথ বেয়ে নেমে আসে পৃথিবীর বুকে! এরকম অদ্ভুত ধারণা কিন্তু
কম-বেশি রকমফেরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই প্রচলিত ছিল; ক্রীট দ্বীপের বলিবর্দ ষাঁড়গুলির
কথা স্মরণ করুন! যাই হোক, ভিন্ন ও বিচিত্র লক্ষণসম্পন্ন এই ষাঁড়রা দেবতার গৃহে জম্মাত
বলেই এরা অবধ্য ছিল; এদের হত্যা করা যেত না। কিন্তু এদের দানবাকৃতি শরীর ও উগ্র মেজাজের
কারণে মানবসমাজে আতংকের সৃষ্টি হলে পুরোহিতরা দেবতাদের সহায়তায় ‘অ্যাপিস’ দেবতার মন্দির
নির্মাণ করে খাপছাড়া, অদ্ভুত ঐ প্রাণীগোষ্ঠীকে বন্দী করে এনে ঐ মন্দিরে রাখবার ব্যবস্থা
করেন, আমৃত্যু তাদের রাখা হত মন্দিরের ভিতর
প্রথমেই তিনি আশ্চর্য হয়েছিলেন
‘ষাঁড়ের মন্দির’ নির্মাণের নেপথ্য কাহিনীটি শুনে। আর কি
কি অদ্ভুত কর্মকাণ্ড করেছেন দেবতারা, এবং তার থেকেও বড় প্রশ্ন- কতদিন ধরে চলছে তাঁদের
এই বিচিত্র কর্মকাণ্ড? নাহলে এখানকার অধিবাসীদের মধ্যে কেন ছড়াবে এরকম এক বিচিত্র উপাখ্যান,
যার কোন মাথা-মুণ্ডু নেই?
মহর্ষি ব্যাসদেবের এই ‘মিশ্র’ প্রদেশ ভ্রমণ ও নবীন চোখে ঐ প্রাচীন বিশ্বকে দর্শন অনেকগুলি প্রশ্নের মুখে এনে দাঁড় করায় পাঠককে, এই কারণেই এটি একটি বিশেষ মুহুর্ত্ত, যা সেরা পাঁচটি মুহুর্ত্তের মধ্যে পড়বে। ‘লেগ্যাসি’ সমগ্রের এই দ্বিতীয় পর্বটি অবশ্যই পড়ে দেখবেন।
আমার পরবর্ত্তী উপন্যাস 'দুরন্ত ঘূর্ণি- মহাসংবর্ত্তের মাঝখানে'র বিষয়বস্তু সম্পর্কে জানতে পড়ুন এখানেে
তৃতীয় মুহুর্ত্ত নির্বাচন: ‘শার্দূলের দরজা’ ও ভগবন্ বীরাকোচার আবির্ভাব
‘লেগ্যাসি’
সমগ্রটির এই তৃতীয় পর্বে এসে এই প্রথম, স্বজ্ঞানে প্রচলিত প্রত্নতত্ত্বের বিরুদ্ধে
গিয়ে কোন একটি ঐতিহাসিক স্থানের প্রতিষ্ঠাকালকে এক ধাক্কায় পেছিয়ে নিয়ে এলাম মহর্ষি
ব্যাসদেবের সময়েরও আগে! না, গল্পের প্রয়োজনে নয়, বরং কিছু জনশ্রুতিকে মান্যতা দিয়ে।
পশ্চিম
বলিভিয়ার ‘পুমা পুন্কু’ নামক মন্দিরটির স্থাপনাকাল মূলস্রোতের প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে-
ইনকা সভ্যতার সময়ে, মোটামুটিভাবে ষষ্ঠ খৃীষ্টাব্দের গোড়ার দিকে- এমনই মত বিশেষজ্ঞদের।
কিন্তু এই স্থাপনাকাল নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বিভিন্ন কারণে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস-
এই মন্দিরের স্থাপনাকাল তারও ঢের আগে!
‘পুমা
পুন্কু’ শব্দটির অর্থ- ‘শার্দূলের দরজা’। এই অঞ্চলটি সম্পর্কে বলা হয়- এটি এমন একটি
জায়গা যেখানে কোন যুক্তি কাজ করে না! প্রথম দর্শনে একে একটি ভাঙাচোরা ‘এক্সক্যাভেশন
সাইট’-এর এত দেখতে লাগলেও যদি ভালো করে এই ধ্বংসস্তুপে পড়ে থাকা প্রতিটি পাথরখণ্ডকে
খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করা যায়, তবে এই মতের পিছনে রহস্যটা খোলতাই হবে।
পুমা
পুন্কুর বিরাটাকৃতি ইংরেজি ‘এইচ্’ আকারের যে পাথরগুলি রয়েছে, তার কথা ছেড়েই দিলাম;
সাধারণ ছোট বা মধ্য আকৃতির যে পাথরগুলি হেলায় পড়ে হেথা-হোথায়, সেগুলি পর্যন্ত আধুনিকতম
‘প্রিসিসন্ কাটিং’ ও ‘ড্রিল হোলিং’-এর চূড়ান্ত পরাকাষ্ঠা! ধারগুলি একেবারে মাপে মাপে
সমকোণ, ওতে মধ্যিখানে যে গর্ত খোঁড়া হয়েছে তা একেবারে নিখুঁত বৃত্তাকার ও ধারগুলি একেবারে
মসৃণ! প্রাচীন ছেনি-হাতুড়ি-শাবল-গাঁইতি দিয়ে কিভাবে সম্ভব এরকম কাজ?
আসল
বোমাটি অবশ্য ফাটিয়েছে একটি রাশিয়ান পাথর-কাটাই কোম্পানি। এই কোম্পানিটির হাতে এই মুহুর্ত্তে
বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিকতম পাথর কাটবার প্রযুক্তি; পুমা পুন্কুর বিভিন্ন পাথরের নমুনা
পরখ করে, বিভিন্ন মডেল বানিয়ে তারা শেষে নিদান দিলেন- ‘আধুনিক লেজার-কাটিং প্রযুক্তির
সহায়তায় কাটা হয়েছে ঐ পাথরগুলি’! এই কীর্তির পিছনে প্রাচীন মানবগোষ্ঠী, নাকি আধুনিক
কোন ‘ধাপ্পাবাজ’দের সুকৃতি- এই বিষয়টি অবশ্য খোলসা করেন নি ঐ কোম্পানির কর্ণধাররা-
পরীক্ষার
কথাই যখন উঠল, তখন আরও একটি বিষয়ে কথা বলা যাক? পুমা পুন্কায় যে ইংরেজি এইচ আকৃতিবিশিষ্ট
পাথরের কথা বললাম তা মনে আছে নিশ্চই? বহুল পরিমাণে বিভিন্ন মাপে পাওয়া গিয়েছে এই পাথর;
সেগুলিকে কম্পিউটারে পুনর্নির্মাণ করে যে চিত্রটি উঠে আসে তা বেশ অর্থবহ!
দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানরা ‘ভি-২’ রকেট উৎক্ষেপণের জন্য একটি বিশেষ আকৃতির লঞ্চিং
প্যাড নির্মাণ করেন; এই লঞ্চিং প্যাডের নীচে শক্ত সিমেন্ট দিয়ে তৈরি অনেকগুলি ছোটবড়
ব্লক পরপর উচ্চতা অনুযায়ী সাজিয়ে পথটিকে একটি ঢালু রূপ দেওয়া হয়; তার ওপর রেললাইন মাপ
অনুযায়ী পেতে সম্পূর্ণ প্যাডটি বানানো হয়। রকেটটিকে এই পথের ওপর রেখে পিছন থেকে একটি
আড়াআড়ি ‘পুশার’ ফেলে নিশ্চিত করা হয় কোন অবস্থাতেই উৎক্ষেপণের সময় রকেটটি যাতে ঢালু
পথ বেয়ে নীচে গড়িয়ে না নেমে আসে! এবারে ইগনিশন হলে ভরবেগে রকেট এগিয়ে যায় সামনে, পিছনের
‘পুশার’ তাকে ‘হেঁইও’ বলে ঠেলে তোলে ওপরে। ঢালু পথের উঁচু আনতি কোণের শেষপ্রান্তে এসে
প্রয়োজনীয় গতি সংগ্রহ করে রকেট উড়ে যায় লক্ষ্যবস্তুর দিকে, পরিত্যক্ত পুশার রেলরোডের
শেষপ্রান্তে এসে পড়ে যায় নীচে রাখা জলভর্ত্তি একটি পুলে!
পুমা
পুন্কুতে পাওয়া এইচ আকৃতির পাথরগুলিকে পরপর সাজিয়ে এরকমই একটি রেলরোডের কাঠামো কিন্তু
ভেসে উঠেছে কম্পিউটার স্ক্রীনে! তাজ্জব ব্যাপার নয় কি?
-“পরবর্ত্তীকালে আরও কিছু অদ্ভুত ব্যাপার চোখে পড়ে মহর্ষি ব্যাসদেবের। তাঁর একান্ত
অনুরোধে মহর্ষি মার্কণ্ডেয় মহর্ষি ব্যাসদেবকে নিয়ে গিয়েছিলেন একদিকের ‘ঢালু পথ’ স্থাপত্যটির কাছে, একেবারে কাছাকাছি পৌঁছে তবেই সন্দেহ নিরসন করেন তিনি। ঠিকই
অনুমান করেছিলেন মহর্ষি ব্যাসদেব, ওপর থেকে দেখে। ‘ঢালু পথ’ ব্যাপারটি কিন্তু নির্দোষভাবে ‘মসৃণ’ নয়; অর্থাৎ এটি কোনমতেই একটি নির্দোষ,
সমতল, চ্যাটালো পাথর নয়! এর মধ্যে বেশ কিছু খাঁজ মতন আছে; তার মধ্যে সর্বপ্রথম যেটি
উল্লেখযোগ্য, তা হল- পাথরটির ধার বরাবর দুপাশে দুটি সমান্তরাল, প্রশস্ত, সুগভীর খাঁজ;
এমন সুপরিকল্পিত ভাবে তৈরি করা হয়েছে এই খাঁজদুটি যেন চাকাজাতীয় কিছু চলবার সুবিধার্থে
এইগুলির সৃষ্টি। কিন্তু সত্যিই কি তাই? মহর্ষি মার্কণ্ডেয়র ব্যাখ্যাটা যদিও খুবই প্রাঞ্জল;
এই খাঁজগুলি প্রকৃতপক্ষে নালা! পবিত্র অনুষ্ঠানের দিন এই নালাগুলি দিয়ে পবিত্র মদ ঢালা
হয় ওপর থেকে, যা সংগ্রহ করে নীচে থাকা মানবরা! তিনি কথাটি যদিও বলেছেন অত্যন্ত হালকা
চালে, রসিকতার ঢঙে; কিন্তু প্রকৃত সত্যটি মহর্ষি মার্কণ্ডেয় খুলে বলেন নি সেদিন।”
ভগবন্
বীরাকোচার বিষয়টি কিন্তু অত্যন্ত রহস্যাবৃত!
খাতায়-কলমে
ইনি একজন ইনকা দেবতা। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে- তুলনামূলকভাবে একজন নবীন দেবতাকে
মহর্ষি ব্যাসদেবের সময় টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কেন?
বীরাকোচা
শব্দটির অর্থ ‘যিনি এই মহাবিশ্বের কারিগর’; এমন একজন দেবতা জনশ্রুতি অনুযায়ী যিনি লেক
টিটিকাকা থেকে চন্দ্র ও সূর্য সৃষ্টি করেছিলেন; এক অর্থে তিনিই মহাবিশ্ব ও তার নীচে
সৃষ্টি হওয়া সকল প্রাণের কারিগর। ইনকা যুগের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলিতে তার উপস্থিতি
থাকলেও প্রাগ্-ইনকা যুগে পেরুর বিভিন্ন নিদর্শনেও এই দেবতাটি উঁকি মেরে গেছেন। তবে
বিষয়টি কিন্তু এখানেই থেমে থাকছে না!
সুমেরীয় সভ্যতা গোটা বিশ্বে মান্যতা পাওয়া প্রথম
সভ্যতা (এ বিষয়ে সন্দেহ থাকছে, কারণ ভারতের মেহেরগড় সভ্যতা বয়সের দিক থেকে আরও প্রাচীন,
কিন্তু মানুষ এই সময় ‘খাদ্য উৎপাদনশীল’ জাতি হয়ে ওঠে নি, এই কারণেই কি মেহেরগড় সভ্য
নয়?)। এই সভ্যতার যে দেব-দেবীরা, তাঁদের একত্রে বলা হত ‘আনুনাকি’। এই দেবতারা ছিলেন
গৌড়াঙ্গ, টানা-টানা চোখ, বেশিরভাগের মুখে চৌকো দাড়ি-
এক
মিনিট, কি বললেন? শ্বেতাঙ্গ, মুখে দাড়ি? কিন্তু বীরাকোচাও তো শ্বেতাঙ্গ, তাঁর মুখেও
তো চৌকো দাড়ি…
কিন্তু
এখানকার মানুষরা তো শ্বেতাঙ্গ নন! ইওরোপীয় অনুপ্রবেশের আগে এখানে যে মানুষজন ছিলেন
তারা তো মূলতঃ কৃষ্ণাঙ্গ! এদিকে ইনকাদের বিভিন্ন স্থাপত্যে-ভাষ্কর্য বা পটের গায়ে ফুটিয়ে
তোলা চিত্রে বীরাকোচার যে শারীরিক নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে তা তো স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথেও
মেলে না, বরং তাঁর সাথে অনেক বেশি মিল হাজার-হাজার মাইল দূরের সুমেরীয় ভগবানদের সাথে!
কে এই ভগবান?
এখানেই
কল্পনার প্রয়োজন, আর সেটিই করা হয়েছে নিরাকার গল্পটিকে একটি রূপ দেওয়ার আশায়। গল্পের
প্রয়োজনে প্রয়োজন ছিল আপাতদৃষ্টিতে একজন শক্তিশালী খলনায়কের, এমন একজন ভিলেন, যিনি
নিজে দেবতা হবেন। রহস্যময় এই দেবতাটিকে সেজন্যই আপ্যায়ন করে নিয়ে আসা গল্পে, আর গল্পের
প্রয়োজনেই দেবতাদের সঙ্গে তাঁর বিরোধ। কিন্তু কি কারণে? মনে রাখা প্রয়োজন- এত রক্তপাত
গোটা ‘জয়সংহিতা’ জুড়ে, কিন্তু এটি এমন একটি মহাকাব্য যাতে কোন ভিলেন নেই! এই অনুপম,
শাশ্বত সত্যটিকে অস্বীকার করা যায় কি করে? করবার চেষ্টাই করা হয় নি গোটা ‘লেগ্যাসি’
সমগ্র জুড়ে। এই উপন্যাসে ভুঁড়ি দুলিয়ে হা হা করে অকারণে হেসে ওঠা কোন ভিলেন নেই!
ভগবন্
বীরাকোচার দেবতাদের প্রতি বিরাগের কারণ জানবার জন্য অবশ্য ‘লেগ্যাসি’ সমগ্রের শেষ পর্বটিও
খুঁটিয়ে পড়তে হবে। এক সারাংশে কি সবই বলা সম্ভব? তবে তাঁর আবির্ভাব ‘নবীন ভূমি’র দেবতাদের
কাছে কতখানি আকষ্মিক তা জানা যেতে পারে এই অংশটিতে-
“সহসা একটি গুরুগম্ভীর আওয়াজ
ভেসে এল অশুদ্ধ দেবনাগরী উচ্চারণে কক্ষে প্রতিস্থাপিত বেতার যন্ত্রের মধ্য দিয়ে-
-“আমি এসে গিয়েছি, দেবতাগণ!”
মহর্ষি ব্যাসদেব লক্ষ্য
করলেন, একথায় যেন পলকের জন্য শিউড়ে উঠলেন গণপতিদেব; যেন এ এমন এক অবাঞ্জিত আওয়াজ, যা
তিনি শুনতে প্রস্তুত ছিলেন না কোন সময়তেই! বেতারের বার্তাবাহী চোঙটা হাতে নিয়ে যেন
খানিকক্ষণ ইতস্তত করলেন তিনি, তারপর পাল্টা প্রশ্ন করলেন-
-“কে আপনি? আমাদের বেতার
তরঙ্গে আপনি প্রবেশ করলেন কিভাবে?”
-“এমন কেউ, যাকে আপনারা
আর কখনোই দেখতে চান নি!”
যানটির দিকে একবার তাকিয়েই
অবশ হাত থেকে বেতারের চোঙটি নীচে পড়ে গেল ভগবন্ গণপতিদেবের। তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে
বাকিরা সকলেই চোখ রাখলেন পর্দার দিকে; তারপরই চমকে উঠলেন সকলে, এমনকি মহর্ষি ব্যাসদেবও!
খেয়া-যানটির খোলা পার্শ্ব-দরজার
সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন যে ব্যক্তি, তাঁর চেহারার সঙ্গে বিলক্ষণ পরিচিত মহর্ষি ব্যাসদেব!
এঁনার গাত্রবর্ণ সম্পূর্ণ সাদা, চৌকোনো দাড়ি, বড় বড়, টানা টানা চোখ, হাতের কবজিতে গোল
আকৃতির একটি অদ্ভুত বাজুবন্ধ, কোমরে বন্ধনী, বর্তমানে অবশ্য হাতে কিছু নেই, কিন্তু
দীর্ঘ, ঋজু তাঁর শরীর! এই চেহারা তিনি দেখেছেন আগে, সূর্যমন্দিরের উন্মুক্ত প্রাঙ্গণের
মাঝখানে, মূর্তির আকারে! ইনিই স্থানীয়দের উপাস্য সেই দেবতা, যিনি চলে গিয়েছিলেন অনেকদিন
আগে – ‘কোন একদিন ফিরে আসব’- স্থানীয়দের এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে! আজ ফেরৎ এসেছেন তিনি।
কিন্তু প্রশ্নটা হল, কেন?”
ভগবন্
বীরাকোচা এমন একজন ট্র্যাজিক নায়কের নাম যাকে দেখবেন বলে দেবতারাও আশা করেন নি! ভগবন্
গণপতিদেবও নিজের বিষ্ময় লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করেন নি। ‘মৃত’ দেবতাটিকে চোখের সামনে
চলে বেরাতে দেখে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন-
-“কিন্তু আপনি তো-”
-“মারা গিয়েছি, তাই তো?
আপনি ঠিকই বলেছেন, দেবতাদের পঞ্জিকা তাই বলে বটে! ধরে নিন, আপনারা চোখের সামনে ‘চলমান
অশরীরী’ দেখছেন! নীচের মানবরাও তাই দেখছে বটে।”
‘লেগ্যাসি’
সমগ্রে পরবর্ত্তী ঘটনাবলী প্রমাণ করে- ভগবন্ বীরাকোচার আবির্ভাব এই সমগ্রটিকে আগিয়ে
নিয়ে যাওয়ার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ!
আমাদের চ্যানেলে বর্তমানে চলতে থাকা ধারাবাহিক 'মহাকালের মাঝে' উপন্যাসটির প্রথম পর্ব পড়ুন ও শুনুন এখানে
চতুর্থ মুহুর্ত্ত নির্বাচন: অভয়ঙ্করের সহায়তায় পার্থের ‘বিশ্বরূপ’ দর্শন
এই
বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে ‘শ্রীমদ্ভগবৎগীতা’ যে দর্শন ও মানসিক উন্নয়নের পথ দেখিয়েছে
তা সর্বোৎকৃষ্ট; একজন মানুষের বৌদ্ধিক ও আত্মিক উন্নতির অনুপম সহায়ক ‘গীতা’।
কিন্তু
নিছক কৌতুহলবশতও যদি এই মহান গ্রন্থকে সাময়িককালের জন্য বৈজ্ঞানিক দর্শনে দেখতে চাওয়া
হয়? কাজটি কঠিন, ভয়াবহ কঠিন!
একটি
পাত্রের মধ্যে রাখা সবটুকু জল যদি একটি গামলার মধ্যে ঢালা হয়, আর নির্দেশ দেওয়া হয়
ঐ জলটুকুনিকে ধ্বংস করতে, তবে তা সম্ভব নয়। কিন্তু ঐ জলকে বিভিন্ন ছোট ছোট পাত্রের
মধ্যে সঞ্চয় করে রাখা যায়। যে পাত্রে যতটুকুনি জল ভরবে, জল কিন্তু তার আধার ঐ পাত্রটিরই
আকৃতি ধারণ করবে। এবারে ঐ পাত্রগুলিকে আমি আলাদা আলাদা জায়গায় রাখতেই পারি!
‘আত্মা
বা শক্তিকে সৃষ্টি বা বিনষ্ট করা যায় না, তারা রূপান্তরিত হতে পারে মাত্র’- এই বিষয়টিকে
নিয়ে চিন্তা করতে করতে ‘জলের মত সহজ’ বিষয়টি মাথায় চলে এল- শক্তিপুঞ্জকে বিশ্লিষ্ট
করে ভিন্ন ভিন্ন ধারক (এক্ষেত্রে মানবশরীর) কোষে ভরে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় বা ডাইমেনশনে
কি এদের ধরে রাখা যেতে পারে? প্রশ্নটি কিন্তু প্রাসঙ্গিক; আমি তো আর মহাকাব্য লিখতে
বসি নি, লিখতে চাইছি মৌলিক একটি লেখা; স্বাভাবিকভাবেই এই অংশটিকেও লিখতে হবে আমারই
মত করে। না হলে লেখকের জায়গায় নিজের নাম ব্যবহার করবার যুক্তিসংগত কারণটা কি?
‘লেগ্যাসি’
সমগ্রটিতে এটিই সবচেয়ে বড় ও প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল, কারণ- বিশ্লেষণ যাই হোক না কেন,
প্রশ্নটি কিন্তু বারংবার থেকেই যায়। শুধু দর্শন বিষয়টিকে নিয়ে এসে লাভ নেই, ঐ বিষয়ে
দিকপাল কবিবর হাজার হাজার বছর আগে যা লিখে গিয়েছেন তার ওপরে আর অন্য কোন কিছুই যায়
না। আমার দেখার বিষয় ছিল বিজ্ঞানের চোখে বিষয়টিকে ধরা সম্ভব কি না, আর তা করতে গিয়ে
যে বিনিদ্র রাতগুলি আমাকে কাটাতে হয়েছে তা সার্থক কি না তা আপনারাই বলবেন।
এবারে কিছু অদ্ভুত ব্যাপার
ঘটল সেখানে যা একটু বিষ্মিত করে তুলল পার্থকে- উচ্চ স্তরের দেবতাদের কার্যাবলীর গতিপ্রকৃতি,
কার্যকারণ কিছু বুঝে উঠতে পারলেন না তিনি; তিনি শুধু দেখলেন বাকি সকল দেবতারাই তাঁদের
ডান হাত সামনের দিকে প্রসারিত করলেন, আর তা করতেই কিছুক্ষণের মধ্যেই যেন আলোর একটি
অর্ধবৃত্তের রচনা হল তাঁদের সকলের চোখের সামনে! আর তা হতেই আর একমুহুর্তও দেরি করলেন
না দেবতারা; পার্থ আর অভয়ঙ্করকে নিয়ে দেবতাদের সম্মিলিত আলোকপুঞ্জটি সবেগে প্রবেশ করল
সেই আলোকময়, প্রদীপ্ত অর্ধবৃত্তের মধ্যে! অপরপ্রান্তে পৌঁছানোর পর মাত্র একপলকের জন্য
ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনদিকে তাকাবার সুযোগ পেয়েছিলেন পার্থ; তার মধ্যেই তিনি দেখতে পেলেন-
তাঁদের প্রবেশের সাথে সাথে আকাশে মিলিয়ে গেল সেই উজ্জ্বল প্রভা! এখন ভীমবেগে পৃথিবীর
দিকে নিরন্তর ধেয়ে চলেছেন সকলে; একটু পরেই কালো, জমাটবাঁধা অন্ধকারের রাজত্ব পেরিয়ে
এলেন সকলে, প্রবেশ করলেন দিনের আলোকস্নাত রাজ্যের সীমানায়, এক সূর্যের নীচে থাকা পৃথিবীর
বুকে!
উচ্চ
কটির দেবতারা সর্বোচ্চ স্তরের দেবতা, যাদের সহায়তায় প্রবেশ করা যায় ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায়;
পার্থ ও অভয়ঙ্করের স্থান পরিবর্তন হয় নি, কিন্তু পরিবর্তন হয়েছে ‘সময়’ ও ‘মাত্রা’,
আর তাতেই ভোজবাজি, চেনা পৃথিবী মুহুর্ত্তে অচেনা পার্থের কাছে! এই বিষয়ে প্রশ্ন করেন
তিনি, আর তাতে যে উত্তর পান অভয়ঙ্করের কাছ থেকে, তা যেন বিশ্বাসই হতে চায় নি পার্থের-
-“বল তো পার্থ, এটি কোন
জায়গা?”- অবশেষে আবার প্রশ্ন করলেন অভয়ঙ্কর। জঙ্গলের মাঝামাঝি অংশে কোন একটি জায়গায়
এসে উপস্থিত হয়েছেন তাঁরা; আপাতত গাছের সারির কিছুটা ওপরে হাওয়ায় ভাসছেন দুজনেই। উত্তরে
সাগ্রহে তাঁর মুখের দিকে তাকালেন পার্থ। তিনি সোৎসাহে তা জানতে ইচ্ছুক।
-“যে রুক্ষ প্রান্তরে আমরা
কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম করছিলাম, আমাদের শকট ‘কপিধ্বজ’ যেখানটায় এসে থেমেছিল, এটা
এখন ঠিক সেই জায়গাটিই-”
অদূরেই মাথা তুলে দাঁড়িয়ে
থাকা বিশাল বড় বড় গাছপালাগুলির ফাঁক দিয়ে পার্থ তখন চিনে নিতে চেষ্টা করছিলেন তাঁদের
ফেলে আসা সেই ন্যাড়া, পাথুরে, শুকনো বালুকাময় অঞ্চলটিকে- চরম অবিশ্বাসের মুখভঙ্গী করে।
অভয়ঙ্করের কথা শেষ হওয়ার আগেই একটিই কথা বেরিয়ে এল তাঁর মুখ দিয়ে-
-“যাঃ!”
-“‘যাঃ’? তার অর্থ তুমি
আবার আমার কথা অবিশ্বাস করলে, ঠিক কি না? আচ্ছা, বেশ! আমার সঙ্গে একটু এস তো।”
অভয়ঙ্করের
সাথে পার্থের বিভিন্ন মাত্রায় ভ্রমণের সাথে সাথে অবশেষে তার কাছে স্থান-কাল-মাত্রা
বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, মাত্রায় অবস্থানকালে প্রতিটি প্রাণীর দায়িত্ব সম্পর্কে তিনি
সচেতন হন, ‘আত্মার অবিনশ্বরতা’ বিষয়টিও স্পষ্ট হয় তার কাছে। এই কারণেই গন্ধর্ব প্রজাতির
সঙ্গে আপাতদৃষ্টিতে যেকোন প্রকার সংস্রববিহীন, মানবদের সমসাময়িক কোন একটি যুদ্ধে পরাস্ত
এক বৃদ্ধকে দেখে যখন পার্থ তাঁকে শনাক্ত করেন পিতামহ দ্যুহ বলে, চমকে ওঠেন তিনি! এ
কি করে সম্ভব? এই সময় অভয়ঙ্কর পার্থকে বলেন-
-“আত্মা চিরকাল অবিনশ্বর
থাকে, পার্থ; তার মৃত্যু নেই। পতন হয় নশ্বর দেহের, আত্মার নয়। প্রত্যেক দেহ থেকে মুক্তিলাভের
পর সেই আত্মা নতুন দেহ খুঁজে নেয়- নিজ ‘মাত্রা’য়, অথবা ভিন্ন ক্ষেত্রে। ঘাতক মানবের
মুখ দেখবে না পার্থ?”
অনেকেই এসে জড়ো হয়েছিল ভূপতিত
দ্যুহের আশেপাশে। সকলেরই মুখ পার্থের বিপরীত দিকে ঘোরান; তাঁদের কথাবার্তার মধ্যেই
একজন ধনুর্ধারী মানব পার্থদের অতিক্রম করে এগিয়ে দাঁড়ালেন ভিড় থেকে দূরে, দুহাত জড়ো
করে প্রণামের ভঙ্গীতে, অঝোর ধারায় কাঁদতে কাঁদতে। চোখে-মুখে একরাশ অনিশ্চয়তা নিয়ে অদূরে
তাঁদের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়ানো নবীন যোদ্ধাটির দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন পার্থ;
এই যোদ্ধাটিই খানিকক্ষণ আগে অনর্গল শরপ্রহার করে যাচ্ছিলেন বড়জ্যাঠামশাই, থুরি, মানবরূপী
দ্যুহের দিকে। একভাবে ভুঁরু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকে দেখে নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন পার্থ।
তিনি ধরতে পেরেছেন, যোদ্ধাটি কার প্রতিচ্ছবি হতে চলেছে। কিন্তু সময়ের দুস্তর বাধা অতিক্রম
করে এসে আয়নার সামনে দাঁড়ানোর আর কোন সদিচ্ছা নেই তাঁর। না, ওঁনার মুখ পার্থ দেখবেন
না! মাথা নেড়ে অভয়ঙ্করকে এ কথাই বললেন তিনি, তারপর দুজনেই সরে এলেন অকুস্থল থেকে।
গোটা
‘লেগ্যাসি’ সমগ্রে এটিই বোধহয় সবচেয়ে অবিস্মরণীয় মুহুর্ত্ত; যেখানে অতীত এসে দাঁড়ায়
বর্তমানের মুখোমুখি, জীবন-নাটকের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংকের পুনরাভিনয় হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন
অপর একটি স্থানে! পরিসমাপ্তি একই- নবীনের হাতে প্রবীণের পরাজয়, কিন্তু সময়সারণীর মানদণ্ডে
ও মাত্রার রকমফেরে দুটি পৃথক ঘটনার আপতন? ব্যাপারটি বুঝতে পেরেই হয়তো আততায়ীর মুখ দেখতে
চান নি পার্থ- সময়ের বাধা অতিক্রম করে আয়নার সামনে দাঁড়ানোর সদিচ্ছা তার নেই-
প্রসঙ্গত,
পিতামহ দ্যুহের পতনও কিন্তু ঘটে পার্থের হাতেই; ‘বহ্নিশিখা’কে চালনাকারী হাতদুটি কিন্তু
পার্থেরই ছিল-
-“পার্থ! ‘বহ্নিশিখা’ হাতে
পাওয়ার পর এখন আমি চাইলে এই গোটা যুদ্ধ একমুহুর্তে থামিয়ে দিতে পারি; সবংশে বিপক্ষের
প্রতিটি সৈনিককে বধ করে! কিন্তু না! যুদ্ধ শুরুর আগে আমি নিজের কাছে নিজে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ
ছিলাম- ভ্রাতৃঘাতী এই যুদ্ধে আমি একটিবারের জন্যও হাতে অস্ত্রধারণ করব না। আমার অস্তিত্বের
উদ্দেশ্য প্রাণহরণ নয়, তোমাদের পথ দেখানো; সেই পথ ধরে চলবার সিদ্ধান্ত তোমাদের নিজেদের
হোক। আমাকে একটা কথা বল- গন্ধর্বরা যখন অর্থ ও রাজনীতির স্রোতে নিজেদের গা ভাসিয়ে দিয়েছিল,
জটিল ও দূর্বিষহ হয়ে উঠেছিল সিংহভাগ অন্যান্য গন্ধর্বের জীবন, তখন কি তারা প্রার্থনা
করেছিল দেবতাদের কাছে- এই অচলাবস্থা থেকে দ্রুত মুক্তির জন্য? না, তারাও সিদ্ধান্ত
নিয়েছিল আধুনিকতার স্রোতে গা ভাসানোর। তবে আজ নয় কেন? আজকে তো এর প্রয়োজন! চেয়ে দেখ
সামনের দিকে; তোমার কি মনে হয় বিশ্বে কোন অস্ত্র আছে এই সেনার পালকে ঠেকানোর জন্য?”
আরেকবার সামনের দিকে তাকিয়ে
দেখে দীর্ঘশ্বাস পড়ল পার্থের। সত্যিই কোন বিকল্প উপায় নেই।
-“তোমার সামনেই তোমাদের
জীবন; শিয়রে ওঁৎ পেতে দাঁড়িয়ে মৃত্যু। সিদ্ধান্ত তোমার!”
বাঁহাত সামনে সম্প্রসারিত
করে কথাটি কেটে কেটে বললেন অভয়ঙ্কর।
ততক্ষণে কুচ শুরু করে দিয়েছে
সেই না-গন্ধর্ব সেনাদল। সামনে দাঁড় করানো ‘বহ্নিশিখা’কে একবার ভালো করে দেখে নিলেন
পার্থ; তারপর সব দ্বিধা কাটিয়ে উঠে শক্ত হাতে বর্ধিত হাতলদুটিকে চেপে ধরে সামনে একবার
দেখে নিলেন তিনি। তারপর বাম হাতের নীলকান্ত মণিখানি টিপে ধরতেই-
‘দ্যা লেগ্যাসি অফ্ রাম- দ্যা লোন ভয়েজ বিগিন্স (নিঃসঙ্গ যাত্রার সূচনা)’ (অন্তিম পর্ব) থেকে
পড়ুন আমার লেখা উপন্যাস 'দহনা' সম্পূর্ণ আকারে এখানে
পঞ্চম তথা শেষ মুহুর্ত্ত নির্বাচন: মহর্ষি ব্যাসদেবের ‘নরক দর্শন’!
গোটা
‘লেগ্যাসি’ সমগ্রের সবথেকে করুণ ও ট্র্যাজিক একটি মুহুর্ত্ত যা সমগ্রটির অন্তিমভাগে
এসে পাঠকরা জানতে পারবেন। মূল মহাকাব্য অনুযায়ী নরকদর্শন হয়েছিল যুধিষ্ঠিরের; নেপথ্য
কারণ ছিল সেই সজ্ঞানে অনৃতভাষণ- ‘অশ্বথ্থামা হত…ইতি গজঃ’। কিন্তু আগেই বলেছি, ‘লেগ্যাসি’
মহাকাব্য নয়, বরং একটি মৌলিক উপন্যাস, যার প্রেক্ষাপট তৈরি করবে একটি মহাকাব্য, ভবিষ্যতে
কোন একটি সময়ে। এই উপন্যাস অনুযায়ী ‘নরক দর্শন’ বিষয়টি তোলা থাকল স্বয়ং কবিবরের জন্যই;
মহর্ষি ব্যাসদেবের জন্য। কেন?
মহর্ষি মার্কণ্ডেয় পরিপূর্ণ
চোখ মেলে তাকালেন মহর্ষি ব্যাসদেবের দিকে। তারপর ধীরে ধীরে বললেন-
-“প্রত্যেক মানুষের জীবনে
একটি সময় আসে মহর্ষি ব্যাস, যখন তাকে নিজের কর্মফল সম্পূর্ণ নিজেকে শোধ করতে হয়। এখন
সেই সময়, যখন আপনাকে নিজের পূর্বকৃত অন্যায়ের ঋণশোধ করতে হবে।”
-“অন্যায়?” – স্তম্ভিত হয়ে
জিজ্ঞেস করলেন মহর্ষি ব্যাস – “কিন্তু জ্ঞানতঃ আমি তো কোন অন্যায় করি নি-”
-“আপনার বদান্যতায় ‘সূর্যবংশ’
প্রাণ ফিরে পায়, নয়তো তা পুত্রশূণ্য হয়ে যেত! নির্বংশ হওয়ার হাত থেকে সমগ্র বংশটিকে
রক্ষা করেছেন আপনি, সেই অর্থে আপনি ছিলেন গোটা ‘সূর্যবংশ’-এর পিতা। আপনি চাইলে এই প্রাণঘাতী
যুদ্ধটিকে ঠেকাতে পারতেন, কিন্তু আপনি তা করেন নি, কারণ প্রচ্ছন্নভাবে আপনি আপনার প্রিয়
পুত্রের বিরোধিতা করতে চান নি! পুত্রস্নেহে মহারাজ কুরু অন্ধ হয়ে যান নি মহর্ষি ব্যাস,
হয়ে গিয়েছিলেন আপনি! আপনার প্রচ্ছন্ন নিষ্ক্রিয়তায় এই সুবিশাল বংশ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।
আর আপনার নিষ্ক্রিয়তার জন্য একটি শাস্তি প্রাপ্য!”
মাথা নীচু করে মহর্ষি মার্কণ্ডেয়র
যুক্তি শুনছিলেন মহর্ষি ব্যাস; তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা এই অভিযোগ রন্ধ্রে রন্ধ্রে সত্যি!
মহর্ষি মার্কণ্ডেয়র কথা এবার শেষ হতে তিনি প্রশ্নমাখা চোখে চাইলেন তাঁর দিকে।
-“আপনার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ
নামমাত্র; তাই এর শাস্তিও সমতূলই হবে। আপনার দণ্ড ‘নরকদর্শন’! একবারের জন্য। আসুন আমার
সাথে-”
কিন্তু
কি সেই ‘নরক’, যা দর্শন করতে হয়েছিল মহর্ষি ব্যাসদেবকে?
মহর্ষি
ব্যাসদেবের জীবনে একটি অন্ধকার অতীত আছে যা দুঃস্বপ্ন হয়ে মাঝে মধ্যেই ফেরৎ আসে তাঁর
কাছে! এই দুঃস্বপ্নের কারণ কিছুটা তাঁর অতীত, কিছু তাঁর সুদূর অতীতের কোন এক অজানা
অধ্যায় যা প্রকাশিত হয়েছে পরে। এই দুঃস্বপ্নের কারণকেই আত্মারূপে দর্শন করতে হয়েছে
তাঁকে; এতটাই দূর্বিষহ সেই স্মৃতি যে অধৈর্য্য ও বিরক্ত হয়ে স্বভাববিরোধী ভঙ্গিমায়
মহর্ষি মার্কণ্ডেয়কে বলে ওঠেন তিনি-
-“ক্ষণিকের নরকদর্শনের নাম
করে আপনি আমায় যা দেখালেন তা নিঃসন্দেহে আমার সারাজীবনের মনোবেদনার কারণ হয়ে রইল; আমি
জানতাম আমার স্ত্রীরই একমাত্র অতি-প্রাকৃতিক দৃষ্টি রয়েছে, তার চোখে সেই সবকিছু ধরা
পড়ে যা সাধারণ মানুষের চোখে অদৃশ্য! আর আজ, এই বৃদ্ধ বয়সে এসে আমি জানতে পারলাম যে
আমার সন্তানও সেই অতীন্দ্রীয় ক্ষমতার- কেন এরকম করলেন মহর্ষি? এই বৃদ্ধ বয়সে এই সত্য
কেন তুলে ধরলেন আমার সামনে যে আমার সন্তানের মৃত্যুর কারণ আমি নিজে? আমাকে দেখেই তো
সে-”
এখানেই
ফুটে ওঠে এক পিতার অক্ষমতা! নিজের সন্তানের মৃত্যু ‘দ্বিতীয়বার’ চোখের সামনে দেখে অন্তরের
রাগ বাইরে বেরিয়ে আসে অসহায় এক পিতার। মহর্ষি মার্কণ্ডেয় প্রতি-যুক্তি দেন, এবং তারপরই
মন শান্ত হয়ে আসে তাঁর। অবশেষে ভিতর থেকে মহর্ষি ব্যাসদেব উপলব্ধি করেন- অবাঞ্ছিত এই
‘নরকদর্শন’ খুলে দিয়েছে তাঁর দুচোখের দিব্যদৃষ্টিকে! তিনি প্রস্তুত- নিরাকারকে শাশ্বত
রূপদানের জন্য-
দেবতারা এই উপাখ্যানে থাকবেন
আড়ালে; তাঁরা দর্শন দিয়েই আচমকা মিলিয়ে যাবেন অন্তরালে, যেন তাঁরা ছিলেনই না! মানবপ্রজাতির
একা পথ চলাকেই প্রাধান্য দেওয়া হবে, তারাই হবেন নিজেদের ভাগ্যের নিয়ন্তা। ঠিক যেমনটি
আপনি ব্যক্ত করেছেন দেবতাদের অভিপ্রায়!
শুধু একটিই অনুরোধ- উপাখ্যানটি
আবর্তিত হবে যে পাঁচটি মূল চরিত্রের ওপর ভিত্তি করে…মানে যেমনটা আমি ভেবে রেখেছি- এই
পাঁচজনের নামকরণ ও চারিত্রীক বিশেষত্বগুলি আমি গড়তে চাই আমার পাঁচ নাতভাইয়ের সঙ্গে
সাদৃশ্য রেখে। বঞ্চণা ও উপেক্ষাই আজীবন জুটেছে ওদের কপালে, তারই প্রায়শ্চিত্ত আমি করতে
চাই আমার লেখনীর মধ্য দিয়ে!”
-“শিল্পীর স্বাধীনতাতেই
তাঁর রচনার পূর্ণতা, মহর্ষি ব্যাস! কি নাম রাখতে চান এই উপাখ্যানের?”
‘দ্যা লেগ্যাসি অফ্ রাম-
দ্যা লোন ভয়েজ বিগিন্স (নিঃসঙ্গ যাত্রার সূচনা)’ (অন্তিম পর্ব) থেকে
যা লেখা হল, পরতে পরতে ঘটনার ঘনঘটা তার থেকে অনেক বেশি! পাঠকদের কাছে শুধু একটিই অনুরোধ- দয়া করে এই পাঁচটি নির্বাচনের ওপর ভিত্তি করে কোন অভিমত গড়ে তুলবেন না, এত বিভিন্ন নাটকীয় মোড় এই সমগ্রটিতে যা এককথায় ব্যক্ত করা অসম্ভব! তার থেকে এক কাজ করুন; নীচে ‘লেগ্যাসি’ সমগ্রের সবকটি পর্বের লিঙ্ক দেওয়া রইল; সময় করে একবার অবশ্যই পড়ে দেখবেন। কেমন লাগল তা জানাতে ভুলবেন না, এবং অবশ্যই আমাকে সাবস্ক্রাইব করবেন!
Find us on our YouTube Channel
Look for my works on Pratilipi here, in case if you wish to see my other fiction stories
You may follow my page to stay updated with latest news and Releases
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
আমাদের ব্লগগুলি আপনাদের কেমন লাগছে? অবশ্যই জানান আমাদের-